গ্রন্থ পর্যালোচনাঃ “মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর”
–মহিবুর রহিম
“মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর” একটি আধুনিক ধারার সঙ্গীত সংকলন। এগুলোকে গীতধর্মী কবিতা ও বলা যায়। তবে স্বার্থক সঙ্গীতের জন্যে কাব্যগুণের শর্ত তো খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। গ্রন্থটির লেখক শফিকুল ইসলাম মূলত একজন কবি। কবিতা নিয়েই সাহিত্য জগতে তার পদযাত্রা।”এই ঘর এই লোকালয়”, “একটি আকাশ ও অনেক বৃষ্টি”, “শ্রাবণ দিনের কাব্য”, “তবু ও বৃষ্টি আসুক”, প্রভৃতি কাব্য গ্রন্থে তার স্বতন্ত্র কাব্য প্রবণতা বিশেষভাবে বিবেচনার দাবী রাখে।
আর একজন কবির রচিত সঙ্গীত গ্রন্থে ভাব ও সুরের মিশেলে আমরা পেয়ে যাচ্ছি সংবেদনশীল হৃদয়ানুভূতিকে। শফিকুল ইসলামের কাব্য চর্চ্চার মূল বিষয় ও হৃদয় চর্চ্চা। তিনি বিষয়কে হৃদয় রসে জারিত করে প্রকাশে প্রাণান্ত হয়েছেন। এজন্যই তার এ সঙ্গীত গ্রন্থে ও বিষয়ের মুক্তি ঘটেছে বিশেষভাবেই।
“তোমার হাসি দোলা দিয়ে যাক বন্ধু অধরের কোণে
আমার আখীজল ঢাকা থাক বন্ধু গোপনে।
তোমায় সুখী দেখলে
আমি সব দুঃখ যাই ভুলে
স্বপ্ন শুধু ছড়িয়ে থাক ও দুটি নয়নে”।
মানব হৃদয়ের চিরন্তন প্রেম-বিরহ,অনুরাগ-বিরাগ, আশা-হতাশাসব কিছুকে লেখক গভীর দরদে স্থান দিয়েছেন তার লেখায়। প্রেম সৃষ্টিরএকটি অন্যতম নিয়ামক। প্রেম হৃদয়কে বিচিত্র অনুভূতির মুখোমুখি করে।কখনো বিপুল দুঃখ যাতনায় হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে এবং সমৃদ্ধ করে। তাইপ্রেমিক হৃদয়ের আর্তিগুলো হয় নিখাদ মনের স্বচছ সুন্দর প্রকাশ। শফিকুলইসলামের লেখায় চমৎকার সব অনুভূতির শিল্পিত প্রকাশ ঘটেছে।
“এক পশলা বৃষ্টিতে হয়ে যায় শরতের আকাশ নির্মল
শত বর্ষায় ও কি ফুরাবেনা আমার আখিজল ?
হঠাৎ আসা দমকা হাওয়ায়
প্রদীপশিখা নিমেষে নিভে যায়
শত দীর্ঘশ্বাসে ও নিভে না আমার বুকের অনল।”
বাংলা গানের এক আধুনিক রূপকার আবু হেনা মোস্তফা কামালের সাথে কবিতা ও গান নিয়ে কথা বলার কিছু সুযোগ আমার হয়েছিল। আবু হেনা মোস্তফা কামাল তার রচিত গানে যে কাব্যধর্মীতার প্রবর্তন করেছিলেন, এই প্রবণতাকে তিনি বাংলা গানের নতুন মুক্তির সন্ধান বলে মনে করতেন।আমার কাছে তার এই ধারণা খুবই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছে। শফিকুল ইসলামের লেখায় এই কাব্যধর্মীতার সমণ্বয় আমাকে আশাণ্বিত করেছে।
“আমি অন্ধকার আকাশের তারা, আধারের মাঝে জ্বলি একা একা
আমার গোপন কান্না রাতের গহন আধারে থাকে ঢাকা।
নয়নে আমার কত যে ছিল আশার স্বপন
আজ স্বপ্ন আমার ভেঙ্গেছে,ভেঙ্গেছে মন
অশ্রুভেজা আজ এ দুটি আখি কাজল আকা”।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে জনপ্রিয় বাংলা আধুনিক গানের যে সব বৈশিষ্ট্য আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় শফিকুল ইসলাম সেই আধুনিক গানের ধারাতেই নিজেকে যুক্ত করতে চেয়েছেন। এ ধারার গানগুলো বিশেষত মননধর্মী। নিসর্গ আশ্রয়ী ক্যানভাসে সুখদুঃখ,বিরহ-বেদনা মূর্ত করে তোলা হয় এসব গানে । উপমা আর চিত্রকল্পে একটি হৃদয়স্পর্শী অনুভূতির ও সন্নিবেশ ঘটে।
“প্রহরের পর প্রহর কেটে যায় আমি একা জেগে থাকি
তারা-ভরা আকাশের পানে মেলে স্তব্ধ নির্বাক দুটি আখি।
কখনো হঠাৎ আসা পবনে
দোলা লাগে ঝাউবনে
কি যে ঝড় বয়ে যায় আমার প্রাণে-
গন্ধশেষ দগ্ধ ধূপের মত আমি একা পড়ে থাকি।
কিংবা
“এই মন হয় রঙিন তোমার কাছে এসে
কথাগুলো গান হয় তোমাকে ভালবেসে।
এই নয়নে যখন রাখো দুনয়ন
এই কাধে হাত রাখো যখন
মন হারায় কোন স্বপনের অজানা দেশে।”
কিংবা
“যতবার ভাবি আর পিছু ডাকব না
দুচোখের জল আর কিছুতে মানেনা মানা।
জানি পিছু ফিরে তাকাবার
নেইতো আজ অবসর তোমার
নয়ন ফেরানো যায় যদি মন তো আর ফেরে না”।
গানের চূড়ান্ত মুক্তি হতে পারে যথার্থ সুরারোপে।”মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর” গ্রন্থের শতাধিক গানের যথার্থ সুরারোপ গানগুলো মননশীল ধারার শ্রোতাদের মুগ্ধ করবে বলে আমার বিশ্বাস। শফিকুল ইসলাম নীরবে নিভৃতে যে শিল্পবোধ গড়ে তুলেছেন গ্রন্থটি পাঠ করে তার অনায়াসে উপলব্ধি করা যায়।”মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর” গ্রন্থের লেখাগুলোকে লিরিক কবিতা হিসাবে ও বিবেচনা করা যায়। তবে যে ভাবেই বিবেচনা করিনা কেন শফিকুল ইসলামের বেদনাহত হৃদয়ের সংরক্ত শিল্প নির্যাসই এখানে “মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর” হয়ে ধরা দেয়।
৪৮ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে আগামী প্রকাশনী। চমৎকার প্রচ্ছদ করেছে মাশুক হেলাল।
[প্রকাশক- আগামী প্রকাশনী ৩৬ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০। ফোন-৭১১১৩৩২,৭১১০০২১। মোবাইল- ০১৮১৯২১৯০২৪।