প্রায় এক দশক ধরে রান্নার কাজে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন বাংলাদেশের পাইপলাইনের গ্যাস বঞ্চিত মানুষ। বিশেষ করে বরিশাল, খুলনা, যশোর, ময়মনসিংহ, সিলেট ও রংপুর অঞ্চলে সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। এমনকি রাজধানী ঢাকাতে অসংখ্য পরিবার রান্নার জন্য এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন।
গত ১০ অক্টোবর আবারও সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এই নিয়ে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে গত চারমাসে চারবার এলপিজির দাম বাড়ানো হলো। যা সরকারের উচ্চমহলের স্বার্থ রক্ষা ছাড়া আর কিছু নয় বলে দাবি করেছেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন,
গ্যাসের অযৌক্তিক দাম বৃদ্ধিতে দেশের বাজারে শুরু হয়েছে অস্থিরতা। এরফলে বিদ্যুৎসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। যা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ সরকার। আসলে এই সরকার সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষার কোনো চেষ্টাই করছেন না।
এদিকে গাড়িতে ব্যবহৃত এলপিজির দাম ৫০ টাকা ৫৬ পয়সা থেকে হচ্ছে ৫৮ টাকা ৬৮ পয়সা হয়েছে ফলে সিএনজি অটোরিকশা সহ গণপরিষদের ভাড়াও বেড়ে গেল। ১৩ অক্টোবর সকালে বরিশাল শহরের রুপাতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে লঞ্চঘাট সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া গুনতে হলো ১৫ টাকা যা গতদিনও ছিলো ১০ টাকা।
সিএনজি চালক মতিন মের্ধা জানালেন, আমরা কি করবো, গ্যাসের দাম বেড়ে গেছে তাই ভাড়াও বাড়াতে হলো।
স্বাভাবিক ভাবেই দর বৃদ্ধির এ প্রভাব এখন কাঁচা বাজারসহ অন্যান্য নিত্য পণ্যের উপরও পড়তে শুরু করেছে বরিশালসহ সারাদেশের বাজারে। ইতিমধ্যেই হু হু করে বাড়তে শুরু করেছে তেল, চিনি ও ডালের দাম। ১০৫ টাকার মুশরীর ডাল এখন ১১০ বা ১১৫ টাকা। চিনি পৌছেছে ১০০ এর ঘরে।
বাংলাদেশে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজির মূল্য গত ১০ অক্টোবর রবিবার প্রতি কেজি প্রায় ১৯ টাকা বাড়ানো হয়েছে, যা আগের দরের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি। প্রতি কেজি এলপিজির মূল্য আগের ৮৬ টাকা ০৭ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ১০৪ টাকা ৯২ পয়সা।
এর ফলে ১২ কেজির একেকটি সিলিন্ডারের মূল্য আগের ১০৩৩ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১২৫৯ টাকা। আর গাড়িতে ব্যবহৃত এলপিজির দাম ৫০ টাকা ৫৬ পয়সা থেকে হচ্ছে ৫৮ টাকা ৬৮ পয়সা। যা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ১৩০০ ও ৬০ টাকা করে আদায় হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করতেই গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে দাবি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের।
এর মধ্যে বেসরকারি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর আবেদনের কারণে এই বছরেই দুইবার শুনানি করে দাম বৃদ্ধি করা হয়।
গত এপ্রিলে প্রথমবারের মতো এলপিজির দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসি। এরপর জুলাইতে ও সেপ্টেম্বরে তা আবার বৃদ্ধি পায়।
মোঃ মকবুল ই ইলাহী চৌধুরী যা বলেন
কমিশনের সদস্য মোঃ মকবুল ই ইলাহী চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এলপিজির নতুন দাম ঠিক করা হয়েছে।
তিনি বলেন, গত এপ্রিলে যখন গ্যাসের দাম ঘোষণা করা হয়েছিল, সেটা নিয়ে এলপিজি অপারেটরদের কিছু আপত্তি ছিল। আগের দাম যেহেতু গণ শুনানি করে নির্ধারণ করা হয়েছিল, তাই তাদের আপত্তির পরে গত মাসের ১৪ তারিখে একটা গণ শুনানি করা হয়েছিল। দ্বিতীয় আরেকটা কারণ হলো, আন্তর্জাতিকভাবে সৌদি কন্ট্রাক্ট প্রাইস (সিপি) প্রতি মাসে ঘোষণা করা হয়, সেটা প্রায় প্রতিমাসেই ওঠানামা করে। তাই আমাদেরও সেটার সঙ্গে মিল রেখে মূল্য ঠিক করতে হয়। এসব কারণে নতুন করে দর নির্ধারণ করতে হয়েছে।
কিন্তু সিলিন্ডার গ্যাসের এরকম মূল্যবৃদ্ধিতে ক্ষুব্ধ বাংলাদেশের বেশিরভাগ জেলা শহরের মানুষ। রাজনৈতিক নেতা ও সাংস্কৃতিকজন। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সারা যাকের, রাজনৈতিক নেতা মজিবর রহমান সরোয়ার, ঢাকার সাভারের কাউন্দিয়া এলাকার হামিদা আক্তার, বরিশালের সুলতানা, যশোরের আইনজীবী পপি ইসলামসহ অসংখ্য মানুষের জীবনযাপনে প্রভাব ফেলেছে এই মূল্যবৃদ্ধি।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সারা যাকের
বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সমাজ সেবক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি সারা যাকের বলেন, চলতি বছরে চারমাসে চারবার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। এটা চোখে লাগার মতোই বিষয় বটে। করোনাকালীন সংকটে মানুষের জীবনযাপনের মান অনেক কমে গেছে। অনেকেরই আয়ের পথ নষ্ট হয়েছে বা বন্ধ হয়েছে। আমার নিজের প্রতিষ্ঠান এর অবস্থা আগের তুলনায় অনেক নাজুক। সে উপলব্ধি থেকে বুঝতে পারছি সাধারণ মানুষের অবস্থা কতটা খারাপ। সরকারের কাছে অনুরোধ জানাবো গ্যাসের মুল্যে বৃদ্ধির বিষয়টি পুনঃবিচারের এবং সম্ভব হলে এ খাতে ভর্তুকি বহাল রাখার।
হামিদা আক্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, ”যারা বাসায় পাইপের গ্যাস পায়, তারা যেভাবে ইচ্ছামতো খরচ করে। আর আমরা সিলিন্ডারের গ্যাস কিনে এতো হিসাব করে খরচ করি, তারপরেও তাদের চেয়ে আমাদের গ্যাসের পেছনে বেশি টাকা দিতে হয়। এটা তো ঠিক না।”
পপি ইসলাম বলছেন, এখন শহরে বা গ্রামে তাদের মতো অনেক পরিবার রান্নার কাজে পুরোপুরি এলপিজির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে এই অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের দর বৃদ্ধি মানেই সংসারের বাজেটের ওপর চাপ তৈরি করা।
বরিশালের একজন কর্মজীবী সুলতানা। তিনি বলেন, যেভাবে পাল্লা দিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়েতো আয় বাড়ছেনা। করোনাকালীন সংকটে চাকুরী হারিয়ে আমরা স্বামী স্ত্রী উভয়ই উপার্জনহীন এখন। ঢাকা থেকে বরিশালে এসে আশ্রয় নিয়ে প্রথমে একেকটা সিলিন্ডার কিনতাম সাড়ে আটশো টাকা করে। সেটা এখন হাজার টাকার ওপরে হলে আমাদের চলবে কি করে? ‘দাম বাড়লে যে ব্যবহার কমাবো বা বাদ দিবো, সেই উপায় তো নেই। বাসায় যেটুকু দরকার, তা তো লাগবেই। সরকারের উচিত আমাদের দিকে তাকিয়ে হলেও এখাতে ভর্তুকি দেয়া।
এখন গ্রামীণ এলাকাতেও এই সিলিন্ডারের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। শিল্প ও আবাসিক মিলিয়ে বছরে এই দেশে ১২ লাখ মেট্রিকটনের বেশি এলপিজি ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বা বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪১ লাখ পরিবার এলপিজি ব্যবহার করেন।
বাংলাদেশ ভোক্তা অধিকার সংস্থা বা কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ক্যাব বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দর সমন্বয়ের কথা বলা হলেও বাংলাদেশে এলপিজির দাম নির্ধারণে ব্যবসায়ীদের স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
ক্যাবের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বলেন, ব্যবসায়ীরা যেভাবে পরিবর্তনটা চেয়েছে, এই মূল্যহারের পরিবর্তনে সেটাই নিশ্চিত করা হয়েছে। এমনিতেই আন্তর্জাতিক বাজারে যেহেতু ঊর্ধ্বগতি আছে, তার সাথে দর সমন্বয় করতে হবেই। কিন্তু যেসব কারণ দেখিয়ে গ্যাসের দর বৃদ্ধি করা হয়েছে, সেগুলো গ্রহণযোগ্য নয় বলে আমরা মনে করি।”
এ বিষয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, সরকার শুধু সিপির (সৌদি কন্ট্রাক্ট প্রাইস) বাইরে যেভাবে বাড়িয়ে ব্যবসায়ীদের বেশি বেশি মুনাফা লাভের প্রত্যাশা পূরণ করছেন। এই ব্যবসায়ীরা সবাই আওয়ামী লীগের নিজস্ব নেতাকর্মী। এ দেশে এখন আওয়ামী রাজত্ব চলছে না বলে বলতে পারেন প্রকৃত বাকশাল কায়েম করেছে তারা।
এ নিয়ে আপনাদের জোড়ালো কোনো প্রতিবাদ দেখা যায়নি, আপনারা সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষায় কি কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন?
এ প্রশ্নের উত্তরে সরোয়ার বলেন, ঢাকায় আমাদের মহাসচিব সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু শুধু প্রতিবাদে কি এ সরকারের কানে পৌঁছে? আপনাদের মিডিয়ার অবস্থাই দেখুন, আপনারা আমাদের সময়ে যতটুকু সত্য তুলে ধরতেন তার ছিটেফোঁটা কি এখন লিখতে পারছেন?
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসি অবশ্য বলছে, গ্যাসের নতুন দর নির্ধারণের সময় তারা ভোক্তাদের দিক যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনায় রেখেছেন। বিরোধী দলের লোকেরা আগুপিছু না ভেবে শুধু বিরোধিতার জন্যই সরকারের সমালোচনা করছে।