শমিত মণ্ডল এর কবিতা
নদীর দিক থেকে আসছে আশ্চর্য বাতাস
পাখির কলতানে হয়েছিলো সকাল— এখন দুপুর।
মায়ের গাঁ ঘেঁষে চলছে সাদা শান্ত বাছুর,
ঝুমকো জবার গাছভর্তি ফুল
সবুজ ধানের খেতে আলো।
বুঝতে পারি, ঠিকঠাক চলছে আমাদের পৃথিবী।
দুই
মাতৃভাষা
বালুচর পার হয়ে ভাষারূপা নদীটিকে দেখি
চাঁদ ঝুঁকে আছে তাই নদীটির জলে আঁকিবুঁকি।
কুয়াশার শীতরাতে তারাভরা আকাশের নীচে
বাঁধা আছে ছোটো ডিঙি ঝুঁকে পরা বাবলার ডালে।
চাঁদের ইশারা ফলে তার ঠোঁটে খেলা করে গান
যথাযথ মাতৃভাষা — ভাটিয়ালি মাঝিটির মুখে।
তিন
রাত্রি
অন্ধকার
নক্ষত্রের আলোয় মেঠোপথ কোনোক্রমে চিনে নেওয়া যায়।
তালগাছের মাথা যা একটু স্পষ্ট। রাতের একটি দুটি পাখি
উড়ছে। তাদের দেখা যাচ্ছে না, ডানার শব্দ বাতাসে।
অনেক দূরে বাজছে মাদল।
নিজস্ব ধরনে নিজেকে বিকশিত করছে রাত্রি।
মৈথিলী এর কবিতা
এক
পেরনো চৌকাঠ
একটা ছোট দেওয়াল জুড়ে
নকশিকাঁথার মাঠ
পেরিয়ে যাচ্ছে একটা মেয়ে
পেরচ্ছে চৌকাঠ ।
চৌকাঠ নয়, ওটাই মেয়ের
হারিয়ে ফেলা দিন
খেলাচ্ছলে কখন যেন
তিন এক্কে তিন।
তিন তিন তিন নয় পেরলেই
গর্জে ওঠে ঝোপ
বিষাক্ত এক ছোবল
মেয়ের নিঃশ্বাসে ছোপ-ছোপ ।
নিঃশ্বাস তার উপচে উঠেই
তলিয়ে গেল ঘাট
পেরিয়ে যাচ্ছে অনেক মেয়ে
পেরচ্ছে চৌকাঠ ।
শিরা কাটলেই রক্তের ধারা লাল
গরমে ঝলসে পথটুকু পার হব,
ঋণের বোঝাটা নামাতেই মাথা উঁচু
রাজা রাজা খেলা নিশ্চুপে শোধরাব।
কাদা মাটি প্রজা, আমাদের ছাতি ছোট
ছয় ছয় গুণ ইঞ্চিতে কত সুখ,
লাল রক্তটা তোমায় শেখালো ভাষা
নীল রক্তের পকেটে পুড়ছে মুখ।
পোড়া মুখ ঢেকে পালানো কি আজ সহজ ?
প্রজার চিলতে বুকের রক্ত আগুন
রাজার দুচোখে কালঘুম খেলা করে,
প্রজাটা জিতছে। জিতছে, উড়ছে ফাগুন।
তিন
তিনকড়ি
ক্যাম্প ফায়ার, গল্প আর আড্ডা
সাথে সেই তিনকড়ি কথা।
মন শপথ নিলে, শপথ আগুন হয়,
কে বলেছিল কিছুতেই মনে পড়ে না,
ভাসা ভাসা, আস্তরণহীন
ছেঁড়া পাতার কালচে ডায়েরি
আলমারির এক কোণে ছিপি খোলা রাম
শ্যাম আর যদুবংশ কখনও উধাত্ত হয়ে ছিল
মন শপথ নিলে, শপথ আগুন হয়
কে বলেছিল কিছুতেই আর মনে পড়ে না,
ভিন্ন ধারার অলস যাপন
ছিন্ন ভিন্ন ছবি রবি,
নদীটির নাম হয় অঞ্জনা। অঞ্জনা নদীতীরে
খঞ্জনা গ্রাম নেই আর,
মন শপথ নিলে শপথ আগুন হয়,
কে বলেছিল কিছুতেই আর মনে পড়ে না।
অভিজিৎ দাশগুপ্ত এর কবিতা
অপেক্ষা
ডায়েরির প্রতিটা পাতায় পাতায় রক্তক্ষরণ,
ভাঙা সেতু, ঝরা পাতা, উল্কাপাতের গল্প।
গল্পের মধ্যে অন্য গল্প, তার ভিতর অন্য
আরো অনেক গল্প; এ গল্পের জন্যই তো
খানিকটা বাঁচতে শেখা; নইলে বাস্তবের
জটিল অঙ্কের সমাধান কে কবে করতে পেরেছে?
ডায়েরির শেষের লেখাটা আবারও বাঁচার
অমোঘ সত্যকে বুঝিয়ে দিয়ে গেল—-
‘ তুমি যেখানেই থাকো না কেন
আমি তোমার অপেক্ষায় চিরকাল জেগে থাকবো’।
ডায়েরি বন্ধ করে, চোখ বুঝে, অপেক্ষার
নতুন জগতে প্রবেশ করলাম, যেখানে
মর্মভেদী যন্ত্রণাগুলোও ফিকে হয়ে যায়।।
এখনো অপেক্ষা
ধরো, তোমার সাথে আমার দেখা
অনেকদিন পর
কোনো বাসে, ট্রামে , অটোয়ে, বা
অন্য কোনো খানে।
তখন কি আমায় জিজ্ঞেস করবে–
আমি কেমন আছি,
অতীতকে কি এখনো আগলে রেখেছি,
সেই পুরানো স্মৃতিগুলো
কি এখনো সময় অসময়ে উঁকি মারে,
কষ্ট দিয়ে যায়।
আমি তো রোজ রাতে
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে
মনে মনে এই প্রশ্নগুলোই করি।
আয়নার ওপারে যে তোমার মুখটাই
বার বার ভেসে ওঠে; তফাৎ শুধু ওপার
থেকে কোনো উত্তর আজও আসে না।
অপেক্ষা করতে করতে
অপেক্ষাকে ভালোবেসে ফেলেছি।
ভালোবাসার গভীরতায় অপেক্ষা চিরকালীন।।
তিন
দমকা হাওয়া
একটা একটা করে শুকনো পাতা
অনেক কষ্টে জড়ো করেছি
ডাস্টবিনে ফেলবো বলে।
হঠাৎ দমকা হাওয়া এসে
পাতাগুলোকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিল।
চুপ করে দেখলাম, কিচ্ছু করতে পারলাম না।
দমকা হাওয়া তার কাজ সে করেছে,
তুমি তোমার কাজ করতে পারোনি।
তোমার কাজ ছিল দমকা হাওয়া সত্ত্বেও
পাতাগুলোকে ডাস্টবিনে ফেলা।।
সাথী মন্ডল এর কবিতা
এক
টুসু ভাদুর কথা
টুসু ভাদু ভালোই জানে
সাঁইজতে পরিপাটি,
চুলের মাঝে ফুল গুঁজে আর
তার পাশে কাঠি।
ঘরের ভিতর নক্সী নিকায়
দেওয়াল জুইড়ে আঁকে,
সবাই চিনে মেয়েদুটা
পরবে লাইচতে তাদের ডাকে।
হাসির ছলে কথা কয়
যেন মুক্তা ঝরে খাঁটি
রাতবিরেতে গান আর-
বুনে শীতলপাটি।
মা তোমার সেই ছোট্ট মেয়েটা
এখন আর ঠান্ডায় কাঁপে না,
হালকা চাঁদরই শীতের পোষাক;
গায়ে আর কিচ্ছু লাগে না।
ঘড়ির এলামেই ঘুম ভেঙে যায়
কেউ তোমার মতো ডাকে না,
উনুনের পাশে বসে ঝিম ধরে মা
জল দেখে ভয় আর পাইনা।
কনকনে পুকুরের জলে স্নান সেড়ে
কাঁপতে কাঁপতে হাত ঘষি
আমার দেহ,মন আর চলে না।
সব কাজ সেরে শুদ্ধ বসনে
যখন ঠাকুর দালানে বসি
তোমাকে খুব মনে পরে মা
খুব মনে পরে ;
কান্না যেন বাঁধ ভেঙে যায়
আমার হারিয়ে গেছে সব খুশি,
আর মনে হয়-
আমার থেকে অনেক দূরে
মা’গো,হারিয়ে গেছো তুমি।
তিন
দুর্নীতির কবলে
টাকায় টাকা বাড়ছে সুদ
গরিবরা বারবার পড়ছে জাঁতাকলে,
আর-সাহেবদের কালো টাকা সাদা হচ্ছে-
ট্রাস্টি,মন্দির,বাড়ে কিংবা;
বড় বড় হাসপাতালে।
নীলকড়েরা নেই তো কি?
কমেছে কি কড়ের মার?
গলা যেন খামচে ধরে,যখন-
মাসে মাসে বাড়ে সুদের হার।
পেশায় ওজন ছেলেমেয়ের শিক্ষা;
সবাই জানে শিক্ষাটা আগে দরকার,
ভাবে-পড়াশোনা করালে মানুষ হবে
নয়তো পুরো ভবিষ্যত অন্ধকার।
নিয়মহীন কিছু নিয়মগুলিই
সবখানেতেই বাঁধা,
শিক্ষা হোক বা চাকরিক্ষেত্রে
দমে যায় সব গরিবের স্পর্ধা।
শিক্ষার জন্যেও অর্থ চাই;
ডিগ্রি পড়তেও করতে হয় দেনা,
তবু-সংখ্যালঘু ,মধ্যবিত্তের জন্যে-
মাত্র কয়েকটি কোটা হাতেগোনা।
হাজার হাজার ছেলেমেয়ে
দশে যদি হয় সুযোগ!
বাকিরা সবই যায় বাতিল খাতায়
সরকারি অঙ্কেতে সব বিয়োগ!
স্বর্ণালী তালুকদার এর কবিতা
এক
কবিতা
ঘষামাজা করা হয়নি বহুদিন,
স্বপ্নেরা পিছোল হয়েছে শ্যাওলায়।
কবিতা লিখে কাটবে আর কতদিন?
সমাজ জেগে থাকে প্রমাণের অপেক্ষায়।।
অনেক তো হল – এবার রোজগার করো,
বই নয়, বেঁচে থাকার লড়াই এখানে বাস্তবে ঘটে।
স্বপ্ন ছেড়ে সংসারের হাল ধরো,
কবিতার লাইন কড়াইয়ের গরম তেলে ফোটে।।
হাল ছেড়ো না, স্বপ্ন দ্যাখো,
কলম যেন প্রতিজ্ঞা না করে থামার।
সবাই বলবেই – তাদেরকে বরং আগলে রেখো,
একদিন এরাই পাশে দাঁড়াবে তোমার।।
এসো হাতে হাত রেখে আবার নতুন স্বপ্নে মাতি,
সুযোগ বুঝে আত্মীয় সাজবে অনাত্মীয় জনজাতি।।
অনেকেই আঙুল তোলে ঠিকই,
তবে ভরসার হাত রাখে না কেউ।
আমার পথ খুঁজে নেব আমি নিজেই,
আঘাত পেতে পেতে শক্ত হয়ে গেছে আমার পা-ও।।
চরিত্রে দোষ খুঁজতে ব্যস্ত থাকে যারা,
তারা আজীবন খুঁজেই যাবে।
আমি তাদেরকে দিই না বিশেষ সাড়া,
আসলে প্রমাণহীন নিন্দা করেই এরা মজা পাবে।।
ধরে নাও আমি বেশ্যাগলিতে যাই,
ভদ্রলোকেরা নিজেদের উঁচু নাক সিঁটকায়।
ওখান থেকেই আমি বেঁচে থাকার রসদ পাই,
এনারাই তো আমাদেরকে বাঁচতে শেখায়।।
আমরা খুব ভালো আছি, আছি রাজার মতো,
বাকিরা দোষ খুঁজতে থাকো, সেটাই সহজাত।।
তিন.
প্রতিমূহুর্তে খুঁজে বেড়াই তোমায়,
খুঁজি নতুন বইয়ের গন্ধতেও।
আসলে তুমি আর চাও না আমায়,
সেটা তো বলে দিলেও পারো।।
সারা ঘর জুড়ে রয়েছে তোমার ছাপ,
ড্রেসিং টেবিলে খুলে রাখা কানের দুল।
দু’হাত ভরে নিতে চাই তোমার সবটুকু তাপ,
হয়তো ক্ষমারও অযোগ্য ছিল আমার করা ভুল।।
তুমি শিখে গেছ একা পথ চলতে,
সবসময় ভালো হোক তোমার।
চেয়েছিলাম আজীবন তোমার পাশে থাকতে,
আসলে এখন আর কোনো প্রয়োজন নেই আমার।।
হেঁটে যাও অনন্ত, অবশ্যই জিতবে তুমি,
দূরের নক্ষত্র হয়ে তোমার সাফল্যে খুশি হব আমি।।
অভিজিৎ পালচৌধুরী এর কবিতা
ভাঙন
কিছু ভাঙার
শব্দ পান
আপনি ?
ভাঙছে
ভেঙে টুকরো টুকরো
হচ্ছে
টুকরোগুলো
আর জোড়া
লাগছে না
কীসের অভিঘাতে
ভাঙছে সব
জানে সবাই
তাই খুঁজছে না
বরং ভাঙছে
নিজেকে
চুরমার করে
কিংবা আদৌ
ভাঙছে না
টের পাচ্ছেন
বুকের ভেতর !
দুই
তুমি ডাকলে..
তুমি ডাকলে আকাশ
বৃৃষ্টি হব
ভেজাব তোমার
চাতক চোখ
তুমি ডাকলে নদী
জোয়ার হব
ভরাব তোমার
শূন্য বুক
তুমি ডাকলে বাতাস
ঝড় হব
উড়িয়ে আঁচল
নেব দুখ
তুমি ডাকলে জীবন
নিশান হব
উড়ব যতই
বিরোধ হোক
তুমি ডাকলে ..
তিন
না-বলা কথা
একটা জীবনেই কী শেষ হয়ে যায়
যত না-বলা কথারা
কত কথা তো মানুষ বলে না
চিরকুটে লিখে বুকপকেটে রাখে
একদিন বলবে বলে
কিছু হিসেবী কথা সে বলে
আর বেহিসেবী কথাগুলো
চিরকুটের লেখা হয়েই
বুকপকেটে উঁকি মারে আজীবন
তারপর একদিন
এক ঘনঘোর আষাঢ় বর্ষণে
না-বলা কথার প্রতিটি অক্ষর
বুকপকেট ছাড়িয়ে
ভিজতে ভিজতে
জুঁইফুলের মত
ঝরে পড়ে
মৃত মানুষের চোখের পাতায়
এক অনির্বচনীয় স্বপ্ন হয়ে
না-বলা কথারা
আজও বেঁচে আছে।