কেদারনাথ মজুমদার
আশিক চৌধুরী
বাংলা সাহিত্যের অনন্য অধ্যয় ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’। ড: দীনেশ চন্দ্র সেনের সম্পাদনায় এই গ্রন্থের পালগানসমূহ সংগ্রহ করেন চন্দ্র কুমার দে। চন্দ্র কুমার দেকে এেেত্র উৎসাহিত করেন কেদারনাথ মজুমদার। পূর্ববাংলা থেকে সংগৃহীত লোক সাহিত্যের সমৃদ্ধ অনুষঙ্গ পালাগানগুলো প্রথমে প্রকাশিত হয় ময়মনসিংহের মাসিক সৌরভ পত্রিকায়। যার সম্পাদক ছিলেন কেদার নাথ মজুমদার। বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ ময়মনসিংহ গীতিকার সাথে জড়িয়ে রয়েছে এই গুনীজনের নাম। কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার গচিহাটায় ১২৭৭ বঙ্গাব্দের ২৬ জ্যৈষ্ঠ জন্মগ্রহণ করেন কেদারনাথ মজুমদার মৃত্যু ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ৬ জৈষ্ঠা। তার পিতা লোকনাথ মজুমদার। ময়মনসিংহ জেলা সদরের আমলাপাড়ায় বসবাস করতেন। আমপট্টি এলাকায় ছিল তার সৌরভ অফিস। যেখানে কাজ করতেন চন্দ্র কুমার দে। আজকে অনেক গবেষক ইতিহাসবেত্তা ময়মনসিংহের অতীত ইতিকথা লেখেন, মূল্যায়ন করেন, তাদের জন্য কেদারনাথ মজুমদার সেই পূর্বসরী, যিনি শতবর্ষ আগে সেই কাজ করেগেছেন।
ময়মনসিংহের ইতিহাস ও ময়মনসিংহের বিবরণ কেদার নাথ মজুমদারের রচিত দৃটি মূল্যবান গ্রন্থ। ময়মনসিংহ জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট অফিসের ফৌজদারী নকলখানার নকলনবীশ ছিলেন কেদারনাথ। কর্ম জীবনের সুবাদে তিনি ময়মনসিংহে থেকে সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চা ও সংবাদপত্র সম্পাদনা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তার সৃজনশীলতা, উৎসাহ উদ্দীপনায়, সম্পাদনায় সেই মৌলিক কাজ সম্পন্ন হয়েছে যা ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের দৃষ্টি আর্কষণ করে এবং ময়মনসিংহ গীতিকা হিসাবে পরিপূর্ণতা পায়। একজন গবেষক হিসাবে তিনি এ অঞ্চলের জীবনধারা ও সংস্কৃতিকে বিশাল ক্যাবভ্যাসে ধরেছিলেন। গবেষণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে নিজ বাসা আমলাপাড়ায় প্রতিষ্ঠানিক করেছিলেন রিসার্চ হাউজ। যেখানে তিনি স্থাপন করেছিলেন ছাপাখানা ১৩০৪ সনে ২৭ বছর বয়সে তিনি ‘কুমার’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। যা বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশনা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের পত্রিকা প্রকাশনার ইতিহাসে প্রথম দিকের মাইল ফলক। কেদার নাথ মজুমদার একাধিক পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন। তিনি একজন সম্পাদক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, যা তাকে এ অঞ্চলের পত্রিকা জগতে অন্যতম পথিকৃৎ করেছে। শুধু সম্পাদকতা নয় সেই সাথে তিনি সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। সাংবাদিক হিসেবে তিনি অগ্রণীভূমিকা পালন করে গেছেন। ১৩০৬ সনে তার সম্পাদনায় ‘বাসনা’ ও ১৩০৭ সনে ‘আরতি’ নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি সাহিত্য সংস্কৃতি ছাড়াও সমাজ ও জীবন ধারার চিত্র তুলে ধরেছিলেন স্বকীয় দৃষ্টি ও দায়বদ্ধতার আলোকে। ১৩১৯ সনে তিনি মাসিক সৌরভ প্রকাশ করেন। যা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সম্পাদনা ও প্রকাশনা করে গেছেন তিনি।
কেদার নাথ মজুমদার লেখক, গবেষক,ম সংগঠক, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অনুসন্ধানী ও বিশ্লেষক ছিলেন। তিনি নাসিরাবাদ স্কুল সিটিস্কুল ও জিলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন। এন্ট্রাস পাশ করেছিলেন। অসাধারণ পান্ডিত্যের অধিকারী কেদার নাথ মজুমদার তার সময়ে ময়মনসিংহে জ্ঞানী ও বৃদ্ধিজীবী মহলের অন্যতম পুরোধা ছিলেন।
সাংবাদিকতা, প্রকাশনা, সম্পাদনা, ইতিহাস চর্চা, গবেষণা ও সাহিত্য চর্চায় তিনি উচ্চমান বজায় রেখেছেন। তিনি নিজস্ব ধারা বিনিমার্ণ করে গেছেন। তিনি জীবন ভর ইতিহাস অন্বেষণ করে ফিরেছেন, সমকালীন লেখক, সাহিত্যিকদের গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপি সংরণ করেছেনম প্রাচীন পুঁথি, পালাগান সংগ্রহ করেছেন, বিলুপ্ত ও বিস্মৃতির অতল থেকে তুলে এনেছেন লোকজ সং®কৃতি ও ঐতিহ্যের ইতিকথা। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃাতর প্রতি যেমন ছিলেন যত্নবান তেমনি লেখক সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে গড়ে তুলে ছিলেন সম্প্রীতির সেতু বন্ধন। একজন সংগঠক হিসাবে কেদার নাথ মজুমদার ময়মনসিংহের সংস্কৃতি অঙ্গনে ছিলেন জনপ্রিয় ও আলোচিত নাম। তিনি ১৩১০ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ময়মনসিংহ সাহিত্য পরিষদ। ১৩১৮ সনে তার উদ্যোগে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন। তিনি ময়মনসিংহে সাহিত্য সম্মেলন সারস্বত সম্মেলন আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা বা সঞ্চালক ছিলেন।
কেদার নাথ মজুমদার ময়মনসিংহ শহরের নাগরিক সমাজের বিকশমান শ্রেনী সচেতনতাও মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম প্রানপুরুষ ছিলেন।
কেদার নাথ মজুমদার বাঙলা ভাষার ও গদ্য সাহিত্যের সংপ্তি ইতিহাস নামক গ্রন্থ রচনা করেন। ১৩১৫ বঙ্গাব্দে। যা ড: সুকুমার সেনের এ সংক্রান্ত কাজের ও অগ্রবর্তী মৌলিক কাজ। তার প্রকাশিত সারস্বত কুঞ্জ গ্রন্থটি সে সময়ে আলোচিত হয়েছিল। এর বছর পর তিনি রচনা করেন বাংলার সাময়িক সাহিত্য গ্রন্থ।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনার পথিকৃৎ হিসাবে কেদার নাথ মজুমদারকে বিবেচনা করা হয়। তিনি ময়মনসিংহের ইতিহাস ও ময়মনসিংহের বিবরণ গ্রন্থ লিখে গেছেন যা ময়মনসিংহের ইতিহাস চর্চায় প্রাচীন তথ্যসূত্র। এছাড়াও তিনি ঢাকার বিবরণ ফরিদ পুরের বিবরণ, রামায়নের সমাজ, সারস্বতকুঞ্জ, শুভ দৃষ্টি, সমস্যাচিত্র, বাংলার সাময়িক সাহিত্য ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করেন। শৈশবে জিলা স্কুলে পড়ায় সময়ই তিনি রচনা করেন উপন্যাস স্রোতের ফুল। তার খ্যাতি ছিল পাঠ্য পুস্তক রচয়িতা হিসাবেও।
ময়মনসিংহের সর্বকালের স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব, গুণীজন হিসাবে কেদারনাথ মজুমদার এর জীবন ও কর্মের মূল্যায়ন রয়েছে পরবর্তী সময়ের গবেষক ও লেখকদের গ্রন্থে। সৌরভ যুগ সৃষ্টি করে তিনি ময়মনসিংহের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতাকে আলোকিত করেছেন। যে আলো আজও অম্লান।
বিশ্ব সাহিত্যের গীতিকভান্ডেরে বাংলার অমূল্য সংযোজন মৈমনসিংহ গীতিকার নেপথ্য কুশলী হিসাবে কেদান নাথ মজুমদারের ভূমিকা ও চির স্মরনীয় হয়ে থাকবে।
আশিক ভাই সত্যিই অসাধারন