দূরের কোথাও থেকে ভোরের আযান ভেসে আসছে। অন্ধকার এখনো কাটেনি। কুয়াশায় ঢাকা চারিদিক। কুয়াশার দেয়াল ঠেলেই একটু একটু করে এগোচ্ছে যাত্রী বোঝাই লঞ্চটি। সার্চ লাইটের তীব্র আলোতেও কুয়াশার দেয়াল সরাতে ব্যর্থ লঞ্চের চালক।তাই মাঝে মধ্যেই লঞ্চ থামিয়ে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। ভোররাত থেকে এভাবেই চলছে লঞ্চটি। পদ্ম-মেঘনা পাড়ি দেয়ার পর প্রায় তিনঘণ্টা পার হয়েছে। শীতকাল না হলে এ সময়টায় লঞ্চ ঘাটে ভিড়ে যেত। কিন্তু এখন অনিশ্চিত ঘাটে পৌঁছানো।
কেবিনের জানালায় মাথা ঠেকিয়ে একটু পর পরই বাইরে উঁকি দিচ্ছিল তানভীর।না কানো ব্যকুলতা নেই, নেই কোনো তাড়াও। ইচ্ছে করেই ঢাকা থেকে বরিশাল যেতে লঞ্চ ভ্রমণটাকে বেছে নেয় ও, এই ভ্রমণটাকে খুব উপভোগ করে তানভীর। বিশেষ করে কেবিনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মুক্ত শীতল বাতাসের ছোঁয়াটাকে ভীষণ ভালবাসে তানভীর। শুধু এই ছোঁয়াটা উপভোগ করতেই বন্ধুদের প্লেনে তুলে দিয়ে নিজে একটা কেবিন নিয়ে লঞ্চে চড়ে বসেছে। প্রতিবারই বরিশাল বা ভোলা যেতে ও এটাই করে।
অফিসের কাজে বছরে অন্তত তিন থেকে পাঁচবার বরিশাল, ভোলা ও পটুয়াখালীতে যেতে হয় ওদের চারজনকে। অনীতা, মাহবুব আর পরাগ প্লেনে উঠেছে বিকেল ৫টায়। মাত্র একঘণ্টায় বরিশাল পৌঁছে ওরা যখন ফোন করে জানাল, তখন তানভীর মাত্র সদরঘাটে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে। কীর্তোণখোলা-৩ নামের এ লঞ্চটি রাত নয়টা ত্রিশে ঢাকা ত্যাগ করেছে। তানভীর সবসময় নদীর দিকের কেবিন ভাড়া করে।ইচ্ছে করলে কেবিনে বসেই বাইরের নদী ও প্রকৃতি দেখা যায় এতে। বন্ধুরা ভাবে তানভীর খুব আরাম প্রিয়, তাই লঞ্চে কেবিন নিয়ে লম্বা ঘুম দিতে দিতে পৌঁছতে চায়। আসলে এটা মোটেই সত্য নয়, বরং কেবিন নিলেও তানভীর কখনো বিছানায় শুয়ে দেখেনা। লঞ্চের বিছানা বালিশ ও কম্বল ব্যবহারে এলার্জী ওর। নিরাপদে নিজের লাগেজ রাখা, কাপড় পাল্টে, হাতমুখ ধূয়ে ফ্রি হয়ে এই যে মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এটাই তানভীরের সখ। ঘুমানোর সময়ই যেন নেই ওর, একটু চোখ বুঝলেই হয়তো প্রকৃতির এই রূপ অদৃশ্য হয়ে যাবে। যদিও রাতে লঞ্চ থেকে বিশ ত্রিশ গজের বেশি দেখা যায় না, তবে পাশ দিয়ে ছুটে চলা অন্য লঞ্চ বা জাহাজের আলো, জেলে নৌকার প্রদীপ আর ঢেউ তানভীরের দু’চোখের তৃপ্তি।চোখেমুখে দমকা বাতসের আছড়ে পরাটা খুব উপভোগ করে ও। কেবিন বয়কে ডেকে এ পর্যন্ত ১০ কাপ চা খেয়েছে। এখন আবার খেতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু কাউকেই আশেপাশে দেখতে পেলনা। ইচ্ছে হলো ফোন করে বন্ধুদের জানায় ওর এখনের অবস্থান, পরক্ষণে ইচ্ছেটার গলা চেপে ধরে, হয়তো এখন গভীর ঘুমে মগ্ন ওরা।
কেবিনের দরজা খুলে বের হয়ে দ্রুত লঞ্চের সারেং বা চালকের কক্ষের দরজায় নক্ করে তানভীর। ব্যস্ত হাতে কেউ একজন দরজা খুলে দেয়। নিয়মিত যাতায়াতের ফলে এই লঞ্চের অনেকেই এখন তানভীরের ভালো বন্ধুতে পরিণত হয়েছে। চালক সেলিমও তাদের একজন।
তানভীরকে দেখেই সেলিম প্রশ্ন করল, আরে, স্যার এই ঠাণ্ডায় আবার বাইর হইলেন যে। চা খাইবেন?
কেবিন থেকে বের হতেই ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাঁপটে ধরায় শীতে কাঁপুনী উঠে গেছে তানভীরের, কাঁপতে কাঁপতেই বলল, তাড়াতাড়ি চা দিন আগে।
দরজা খুলে দিয়েছে যে কিশোর ছেলেটি, সে তখন ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে তানভীরের হাতে দিল। গরম রং চায়ের গ্লাশে চুমুক দিয়ে স্বস্তি ফিরে পেল তানভীর। জানতে চাইলো, আমরা এখন কোথায় আছি, বরিশাল পৌঁছতে আর কত সময় লাগবে?
সারেংরুমে অন্য কেবিনগুলোর তুলনায় শীতের তীব্রতা কিছু কম, কারণ এখানে একটা হিটার রয়েছে। তারপরও শাল পেচানো সেলিমের কাঁপুনী থামছেনা।কম্পনরত কন্ঠেই জানালো – ওই যে আযান শুনছেন… ওটা চরমোনাই থেকে ভেসে আসছে, কুয়াশার কারণে কিছু …. বলেই হর্ণ চেপে ধরল সেলিম… বিকট শব্দে বেজে উঠল লঞ্চের হুইসেল। বেশ ঘন ঘন তিনবার বাজিয়ে আবার হর্ণ ছেড়ে দিল। কুয়াশার দেয়াল চিড়ে একটা ক্ষীণ প্রদীপ অতি ধীরে ধীরে একপাশ থেকে অন্যপাশে চলে গেল। সেলিমের চোখের তীক্ষ্নতার প্রশংসা না করলেই নয়, হুইসেল না দিলে হয়তো লঞ্চের নীচে চাপা পরে যেত জেলে নাওটি।
সেলিম তখনও বলছে, অজগরের মতো যেভাবে চলছি, তাতে সকাল নয়টায়ও পৌঁছতে পারি কিনা সন্দেহ। শুনে মনে মনে খুশি হয়ে উঠলো তানভীর। সেলিমের হাতে একটা সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে সারেংরুম থেকে বের হয়ে এলো। নিজের কেবিনের সামনের চেয়ারটায় হাত দিয়ে দেখলো শিশিরে ভিজে পানি জমেছে। কেবিনের দরজা খুলে একটা নিউজপেপার এনে পানি মুছে বসে পড়লো। আঢ়চোখে দেখলো পাশের কেবিনের দরজায়। ওখানে দু’জন রমনী ও চার বছর বয়সের একটি মেয়েশিশু নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমাচ্ছে। লঞ্চছাড়ার মাত্র পাঁচ মিনিট আগে এসে উঠেছে ওরা। শিশুটির নাম অন্তরা। ভালো নাম জেসমীন জাহান। তানভীরের সাথে শুধু শিশুটিরই আলাপ হয়েছে।
আলাপের শুরুটা অবশ্যই খুব কঠিন, বেলকুনীতে ঝুকে বেশ আরাম করে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল তানভীর। শিশুটি ওপাশের চেয়ারে বসে দূরে দেখছিল আর ওর মা ও সাথের মেয়েটি কেবিনে লাগেজ গুছাচ্ছেন। হঠাৎ শিশুটি উঠে এসে তানভীরকে খুব ধমকের সুরে বলল, এই বেয়াদপ লোকটা, তুমি সিগারেট খাচ্ছ কেন? ফালাও, এখুনী ফালাও বলছি, জাননা, এটা ক্ষতি করে।
তানভীর প্রথমে খুব হকচকিয়ে যায়, মুগ্ধ হয়ে মিষ্টি শিশুটিকে দেখে। তারপর সিগারেটটি নদীতে ফেলে দিয়ে জানতে চায়, এটা ক্ষতি করে বুঝি? আপনাকে কে বলল?
ও মা.. তুমি জাননা, তুমি টেলিভিশণ দেখনা? এটাতো টেলিভিশনে প্রতিদিন বলে। কথাটা বলেই শিশুটি ছুটে যায় তার মায়ের কাছে, মা মা লোকটা জানে না সিগারেট ক্ষতি করে, এটা লোকটা জানেনা।
পিছন ফিরে থাকায় তানভীর দেখতে পায় না, কিন্থু শুনতে পায় ওর মায়ের ধমক – ছিঃ মা, তুমি ওনাকে বিরক্ত করনা। যাও চুপচাপ বসে থাকো।
শিশুটি তার আগের চেয়ারটায় যেয়ে চুপচাপ বসে পরে। তানভীর আর ওর মাঝে শুধু একটা পিলারের দুরত্ব। তাই তানভীর জানতে চায়, আমি কি আপনার নামটা জানতে পারি মা’মনি।
নিজের হাতে নিজের হাতকে চেপে, মুখে গালে দু’হাতের চাপ দিয়ে, অনেক ভেবে চিন্তে সে বলে- ও মা, আমি তো কত ছোট্ট, আমাকে আপনি বলছে এত্ত বড় লোকটা। আমাকে অন্তরা ডাকে সবাই বুঝেছো? আরো একটা নাম আছে আমার, জেসমীন জাহান। তোমার নাম কি?
তানভীর ওর কথায় মুগ্ধ হয়, বলে, আমার নাম তানভীর হুসেন। তোমার আব্বু আসেনি?
এ কথায় আবারো চুপ অন্তরা, তারপর বলে, আম্মু আর ফুপি এসেছেতো। তবে…কথা শেষ হতে পারে না, ওর মা এসে ওকে টেনে নিয়ে যায় কেবিনের ভিতরে। লাগিয়ে দেয় দরজা জানালা সবই। মাঝে একবার শুধু হাত ধূতে বের হয়েছিল ওরা, আর একবারও কেউই বের হয়নি।খুবই রহস্যময় মনে হয়েছে এদের আচরণ। তানভীর ওর অভিজ্ঞতায় জানে মেয়েরা তিন ঘণ্টায় অন্তত একবার টয়লেটে যাবে হিশু দিতে। কিন্তু এখানে ওর সেই অভিজ্ঞতা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। শিশুটি হয়তো প্যাম্পাস পরে আছে কিন্তু মহিলা দুজন? তারাও কি তবে প্যাম্পাস…?
দুরশালা, আমার কি? আমি কেন এদের নিয়ে ভাবছি? নিজেকেই গালি দিল তানভীর। মানছি অন্তরার মিষ্টি আচরণ মনের ভিতর খুব প্রভাব বিস্তার করেছে। কিন্তু তাই বলে আমি ওই শিশুটির জন্য অপেক্ষা করছি কেন? সারারাত জেগে বারান্দায় টহল দেয়ার পিছনে এটাও কি কোনো কারণ, হয়তো অন্তরা বের হয়ে আসবে। ওকে ডেকে গল্প করবে। এই ঠাণ্ডায় একটা শিশুর কাছে এটা আশা করা কি বোকামী না?
কুয়াশার চাদর ক্রমশ পুড়ো লঞ্চটিকে গ্রাস করে নিল। থেমে দাঁড়িয়ে আছে লঞ্চটি। একহাত দূরের কিছুই দেখা যাচ্ছেনা আর। মোটা জ্যাকেটের আবরণ ভেদ করে শরীরে কাটা ফুটাচ্ছে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। শীতের দাপটে দাঁতে দাঁত ঘর্ষণ হচ্ছে নিজের অজান্তেই। তবুও যেন গো ধরে বসে আছে তানভীর।ু খুট করে দরজা খোলার শব্দ হলো, কারো হাঁটার শব্দ এসে থামলো তানভীরের পাশে। আমরা কোথায় আছি বলতে পারেন? লঞ্চটা চলছে তো?
মেয়েলী কণ্ঠ কানে যেতেই চমকে তাকালো তানভীর। একহাতে চাদর জড়িয়ে ধরে অন্যহাতে নিজের চুল সামলাতে সামলাতে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে গতরাতে একপলক দেখা আপাতত ‘অন্তরার মা’ নামের মহিলাটি। রাতে তাকে দেখতে খুব একটা ভালো মনে হয়নি।বেশ মোটা আর খিটখিটে মেজাজের মনে হয়েছে। কিন্তু কুয়াশা ঢাকা এই ভোরে তাকে খুব স্নিগ্ধ আর সৌম্য মনে হচ্ছে।
একনজর তাকে দেখে নিজের পাশের চেয়ারটা দ্রুত মুছে দিয়ে বসার ঈঙ্গিত করতে করতে তানভীর জানালো, চরমোনাই পীরের এলাকায় কোথাও আছি আমরা। লঞ্চ এখন থেমে আছে।
তানভীরের পাশে বসতে বসতে অন্তরার মা বললেন, আপনি সারারাত ঘুমাননি? এই শীতে এভাবে বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে না?
লঞ্চে আমার ঘুম আসে না। তাছাড়া এটাতেই আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। শীত লাগছে, কিন্তু প্রটেকশানতো আছে দেখুন – বলে নিজের গায়ের মোটা জ্যাকেটটি দেখালো তানভীর।
তানভীরের দেখানোর কৌশলে হেসে উঠলেন অন্তরার মা। একসময় আমিও খুব উপভোগ করতাম এই ঠাণ্ডা হাওয়া, নদীর উপর এই ছুটে চলাটাকে। এখন আর এগুলো আমাকে টানে না। অন্তরার জন্মের পরই সব বদলে গেছে। এখন আমার প্রাণচাঞ্চল্য সব ওকে ঘিরে।
ওকি ঘুমাচ্ছে?
হ্যাঁ । ঘুম থেকে জাগলেই বিপদ। এই ঠাণ্ডায় ওকে আমি বাইরে আসতে দেব না, আর ও বাইরে আসার জন্য পাগল হবে। বাবার আচরণটা পুরোমাত্রায় পেয়েছে যে।
এ কথায় উদাসী তানভীর। অন্তরাকে দেখতে না পাওয়ার বিষয়টা স্পষ্ট যন্ত্রণা দেয় ওর মনে। বলে, বাচ্চাদের এতে কিছু হয় না, বরং ওদের মন মতো চলতে না দিলেই ওরা অসুস্থ হয়ে পরে।
কি বলছেন? এতো ঠাণ্ডায় যদি একটা বাচ্চা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে কি অবস্থা হবে ভেবে দেখেছেন? রাতে ওকে কত কষ্টে যে আটকে রেখেছি, কতটা আবদার রক্ষা করে যে ঘুম পাড়িয়েছি তা শুধু আমার বোনটা-ই জানে।
না না আমার কথায় ভয় পাবেন না, আমি এতো ঠাণ্ডায় ওকে বাইরে পাঠাতে বলছি না, শুধু বলতে চাচ্ছি যে শিশুদের মন যখন যে কাজটা করতে চায়, সেটা করতে বাধা পেলেই ওরা অসুস্থ হয়ে পরে। তাই যতটা পারা যায় ওদের সাথে মানিয়ে নিতে হবে।
তাই বলে ও আগুনে হাত দিতে চাইলো আমি দিতে দেব, এটা কেমন কথা?
না না আপনি উল্টো বুঝছেন কেন? তবে কখনো কখনো আগুনের কাছে ওর হাতটা নিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে এটা আগুন, এর থেকে দূরে থেকো। একবার হাত না পুড়লেতো ও আগুনটাকে চিনবে না।
কি ভয়ানক চিন্তা আপনার, একটা বাচ্চা মেয়ের হাত আগুনে পুড়তে দিয়ে তাকে আগুন চিনাতে হবে?
হ্যাঁ, শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই করতে হবে। তানা হলে আপনার অবর্তমানে ও হয়তো আগুনে ঝাপ দিয়ে গোসল করতে চাইতে পারে, তখন কি করবেন? বাদ দিন এসব, তা সাথের ভদ্রমহিলা বুঝি আপনার বোন?
নিজেকে আরো একটু চাদরে জড়িয়ে অন্তরার মা বলেন, হ্যাঁ দূর সম্পর্কের খালাতো বোন। আমাদের গ্রামের তিন গ্রাম পরের গ্রামে ওদের বাড়ি। তিন বছর হলো আমার কাছেই থাকে। আমি অফিসে গেলে অন্তরার ভার ওর উপরেই থাকে।আচ্ছা আমি উঠি। আপনাকে বিরক্ত করলাম। বলেই তানভীরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই খুব দ্রুত চলে যায় অন্তরার মা।খুট করে দরজা লাগানোর শব্দ। আনমনে সিগারেট জ্বালায় তানভীর। নিজের ভিতর গভীর কোনো অরণ্যে হারিয়ে যায়…।
কোমল ছোট্ট হাতের পরশের সাথে মিষ্টি কণ্ঠের ডাক- এই তানভী… আবার সিগারেট খাচ্ছ? চমকে বাস্তবে ফিরে আসে তানভীর। দেখে ওর একেবারে গাঁ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে অন্তরা। এবার ওর গাঁয়ে ভারী শীতবস্ত্র। অনেকটা তানভীরের গাঁয়ের জ্যাকেটটির সাথে ম্যাচ করা। এ জ্যাকেট ঠেলে ঠাণ্ডার প্রবেশ বেশ কষ্ট সাধ্য হবে। মেয়েটির স্মরণ শক্তি আরো প্রখর। সেই রাতে তানভীর ওর নাম বলেছে, বাচ্চা মেয়েটি সেটাও মনে রেখেছে।
অন্তরার ডাকটা এবার এমন হলো যে, নিজের মায়ের ধমককে মনে করিয়ে দিল। দ্রুত শেষ হয়ে আসা সিগারেটটি কুয়াশার দেয়ালে ছুড়ে ফেলে অন্তরাকে কোলে তুলে নিল ও। মুখে বলল, মাপ করে দেও মা। আর কখনো হবে না। তুমি আসনিতো তাই খাচ্ছিলাম।
আমি তোমার কাছে থাকলে আর খাবেনাতো?
একদম খাব না।
আচ্ছা! লঞ্চ ঘাট না আসলে আমি তোমার কাছে থাকবো। কিচ্ছু দেখা যায়না কেন?
এই যে কুয়াশা, অনেক কুয়াশা তাই দেখা যায় না।
কুয়াশা কাকে বলে?
কুয়াশা কাকে বলে, ভাবনায় পরে যায় তানভীর।কীভাবে বোঝাবে ওকে। এই যে দেখ, এই সামনে যে ধূয়ার মতো দেখা যায়, এটা আসলে ধূয়া না, এটা হচ্ছে শীতের পানি। বাতাস চেন।
হ্যাঃ চিনিতো। বাড়িতে ফ্যানের বাতাস আছেতো।
না ফ্যানের বাতাস না মা। ওই যে ঝড় হলে বাতাস হয়, ওই বাতাস।দেখেছো কখনো?
হ্যাঃতো দেখেছিলাম, মা খুব ভয় পায় বাতাসে বলেই হিঃ হিঃ করে হাসিতে ফেটে পড়ে অন্তরা।
তানভীর দ্রুত পিছনে অন্তরাদের কেবিনে ঊঁকি দিয়ে দেখে। ওর মা আবার দেখছে নাতো। তারপর কানে কানে বলে, মা আগুনকেও খুব ভয় পায়, তাই না?
মাথা উপর নীচ করে অন্তরা স্বায় জানায়, এবার দুজনেই একসাথে হেসে ওঠে। ওদের হাসিতে এসে যোগ হয় অন্তরার মায়ের রাগি আর উদ্বিগ্ন কণ্ঠ, খবরদার তানভীর আমার মেয়েকে উল্টোপাল্টা কিছু শিখাবে না তুমি।এমনিতেই তোমার সব বদ গুনগুলো ও পেয়েছে।
আচমকা অন্য কণ্ঠস্বর শুনে আঁতকে উঠে অন্তরা, দ্রুত তানভীরের বুকে মুখ লুকায়। অনাবিল শান্তির পরশ তানভীরের সমস্ত শরীর ছুঁয়ে ওর সব কষ্ট, গ্লানী দূর করে দেয়।
খুবই মোলায়েম কণ্ঠে ভিন্ন এক তানভীর কথা বলে এবার, না শীলা- জেসমীন উল্টাপাল্টা কিছু শেখার মেয়ে নয়, তুমি-আমি ওকে যা শেখাবো ও তা-ই শিখবে।অযথা আর রাগ করনা।রাগ করে তিনটা বছরতো একা একা কাটালে, এই তিনবছর তুমি যতটা কষ্ট পেলে, তার তিনগুন কষ্ট আমাকে দিয়েছো। আমার মেয়ের থেকে আমাকে দূর করে রেখেছো? আর কতদিন, এভাবে অপরিচিতের মতো করে নিজের মেয়েকে দেখবো বলতে পারো? আমি যে আর পারছিনা। এবার ক্ষমা করো।
কে শোনে কার কথা, রাগি শীলা, অন্তরাকে নিয়ে হন হন করে কেবিনে চলে যায়।
লঞ্চঘাটে ভেড়ার শব্দ। হুইসেল, কুলিদের ডাক। নিস্তব্দ বসে থাকে তানভীর। মনের ভিতর কুয়াশার ঝড় চোখ বেয়ে নেমে যায়… আজ তিনবছর পর নিজের মেয়েকে দেখেছে তানভীর। ওর নিজের মেয়ে। সেই শিশুবেলা মাত্র দু’বার কোলে নিয়েছিল, তারপর আর দেখা হয়নি কারো।
ধীরে ধীরে সব যাত্রী নেমে যায়। অন্তরাদের দরজা খুলে বের হয়ে আছে অন্তরা। বাবা, আমাকে কোলে নাও, বলেই তানভীরের কোলে চেপে বসে অন্তরা।
তানভীরের চোখেমুখে খুশীর দীপ্তি খেলে যায়। একহাতে মেয়েকে অন্য হাতে বউ শীলাকে জড়িয়ে ধরে।
(সংক্ষিপ্ত)