সাহিত্য বাজার শ্রেষ্ঠকবির সম্মাননা পাচ্ছেন ময়মনসিংহের কবি শামসুল ফয়েজ ও চট্টগ্রামের কবি ওমর কায়সার। গত ২২ শে ফেব্রুয়ারি সাহিত্য বাজার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন উপদেষ্টা কবি আসাদ চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক আতা সরকার, নাট্যাভিনেত্রী ও নির্দেশক সারা যাকের এবং ছড়াকার আমীরুল ইসলাম। পরে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাহিত্য বাজার সম্পাদক আরিফ আহমেদ ও যুগ্মসম্পাদক স্বাধীন চৌধুরীর উপস্থিতিতে সাহিত্য বাজার সাহিত্য পদক ও সম্মাননা প্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করেন নির্বাহী সম্পাদক সালাম খোকন। সাহিত্য বাজার সাহিত্য পদকটির নামকরণ করা হয়েছে এ এম জহুর স্মৃতি সাহিত্য পদক। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক পাচ্ছেন এই সাহিত্য পদকটি।
এছাড়া, গল্পে আতা সরকার, নাসরীন জাহান, শিশুতোষ সাহিত্যে দীপঙ্কর চক্রবর্তী ও ফরিদুর রেজা সাগর, আবৃত্তিকথনে মীর বরকত এবং সাহিত্য সমালোচনায় আশিক চৌধুরীকে সাহিত্য বাজার সাহিত্য সম্মাননা প্রদান করা হচ্ছে।
আগামী ২৪ এপ্রিল ময়মনসিংহে সাহিত্য বাজারের সপ্তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও সাহিত্য সম্মেলন উদযাপনের সিদ্দান্ত গ্রহণ করা হয়েছে উক্ত বৈঠকে। উৎসব ও সম্মেলনে আগত বিশিষ্টজনরা এই পদক ও সম্মাননা তুলে দেবেন বলে জানা গেছে।
কবি শামসুল ফয়েজ সম্পর্কে
সত্তর দশকের কবিদের মধ্যে অন্যতম শামসুল ফয়েজ এখনো খুবই সক্রিয়। তিনি বিদেশী কবিতার অনুবাদে খুবই সিদ্ধহস্ত। তিনি একইসাথে অনেকগুলো দেশের ভাষায় কথা বলতে পারেন, লিখতে পারেন। আড্ডারু, বোহেমিয়ান এবং মানুষের সাথে মেশার অসম্ভব মতা সম্পন্ন এ কবির প্রচুর কবিতা ইতোমধ্যে জাতীয় ও স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। ইতিমধ্যে তার একটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশ পেয়েছে। তীব্র বাস্তবতাবোধ, নাগরিক বৈদগ্ধ এবং জীবনাকাঙ্খা তারঁ কবিতার প্রধান উপাদান। নগর মানুষের যান্ত্রিক আচরণ তার মধ্যে দ্রোহের জন্ম দেয়। যখন তিনি বলেন –
এই সব লোহা লক্করের মুখ
আমি আর দেখতে চাই না …। তখন ক্রোধ তাকে উত্তপ্ত করে, উচ্চারিত হয় প্রচণ্ড আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্রুদ্ধধ্বনি –
এইসব মুখ দেখলে আমার গলায়
গন্ডারের আওয়াজ উঠে
কেরেল্লা বালুতে দা ঘষার
শব্দ উঠে’…।
বস্তুত শামসুল ফয়েজের একটি নিজস্ব শব্দভুবন আছে, ব্যঁঙ্গ মিশ্রিত তীক্ষ্ণ ধারালো বাক্যরীতি আছে, আছে সৌন্দর্য নির্মাণের আলাদা ভাষা। সে সব দিয়েই তিনি তৈরি করেন কবিতার সোনালি অবয়ব।
কবি শামসুল ফয়েজ নিভৃতচারী, প্রচারবিমুখ এই কবি ময়মনসিংহে বিশুদ্ধ কবিতা রচনায় আত্মনিমগ্ন থেকে রাজধানীর কোলাহলমুখর কবিতাঙ্গনে তার সরব ও সফল উপস্থিতির স্বার রেখেছেন।
১৯৮২ সনে ছড়াকার সরকার জসীম ও কবি গাওসুর রহমানের উদ্যোগে কবি শামসুল ফয়েজকে ময়মনসিংহ প্রেসকাব মিলনায়তনে ময়মনসিংহের কবি ও কাব্যানুরাগীগণ তাকে সম্বর্ধনা দেন। ১৯৮০ সনে কবি তসলিমা নাসরিন সেঁজুতি’র দ্বিতীয় সংখ্যার শ্রেষ্ঠ কবিতার জন্য তাকে ‘সেঁজুতি’ পুরস্কার প্রদান করেন। কবি আবু সাঈদ কামাল ও কবি মোস্তফা তারেকের উদ্যোগে স্থরীয় মুসলিম ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ২০০১ সনে কবির ৪৮তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়। সেই অনুষ্ঠানে কথাসাহিত্যিক ইফফাত আরা ও কবি মাকিদ হায়দারসহ আরও অনেকেই তার মূল্যায়ন করেন। ২০০৩ সনে কবি মোস্তফা তারেক ও কবি শাবিহ মাহমুদের উদ্যোগে স্থানীয় মুসলিম ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে বর্ণাঢ্য আয়োজনে কবির ৫০তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়। ওই অনুষ্ঠানে গল্পকার ইউসুফ শরীফ, কবি মুশাররাফ করিম, কবি ড. মাহবুব হাসান, মরহুম কবি আবিদ আজাদ, কবি আশরাফ মীর, কবি ফরিদ আহমদ দুলাল, গল্পকার সালিম হাসানসহ আরও অনেকেই তার মূল্যায়ন করেন।
কবির জীবনী
জন্ম : ১৮ জানুয়ারি, ১৯৫৩, মোজাহিদী লজ (মাতুল বাড়ি), জুবিলী কোয়ার্টার, আকুয়া, ময়মনসিংহ। বর্তমান ঠিকানা : এস.র্আস লজ, জুবিলী কোয়ার্টার, আকুয়া, ময়মনসিংহ। আদিবাড়ি – গ্রাম : কালেঙ্গা, ইউনিয়ন : মোয়াজ্জেমপুর, থানা : নান্দাইল, ময়মনসিংহ। পিতা : মরহুম আবুল খায়ের মুহাম্মদ (মৃত্যু : ১৫ জুন, ১৯৯১), ১৯৪৭ সালের আগেই বৃটিশ আর্মিতে কর্মরত ছিলেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মা ফ্রন্টে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে পাকিস্তান আর্মিতে কর্মরত অবস্থায় ১৯৬৪ সনে অবসর নেন। মাতা : মরহুমা সালেহা খাতুন (মৃত্যু : ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৯০)। তাঁর পিতা জালাল উদ্দীন খাঁর পোস্ট মাস্টার ছিলেন। সেই সুবাদে কবি কায়কোবাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল তাঁর।
ঢাকা তেজগাও পলিটেকনিক বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে বড় বোনের হাত ধরে কবি শামসুল ফয়েজের প্রথম স্কুল গমন। ১৯৬৯ সনে নাসিরাবাদ কলেজিয়েট স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসিতে উত্তীর্ণ হোন। ১৯৭২ সনে নাসিরাবাদ কলেজ থেকে এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে উত্তীর্ণ। ১৯৭৯ সনে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্নাতক সম্মান ডিগ্রী লাভ। ১৯৮১ সালে বাংলায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে এম.এ. ডিগ্রী লাভ। ১৯৮১ সনে ঈশ্বরগঞ্জ ডিগ্রী কলেজে বাংলা বিভাগে যোগদান। পরবর্তীতে ঢাকায় অধুনালুপ্ত দৈনিক দেশ ও মাসিক বসুন্ধরাতে কিছুকাল চাকরি। এই সময় মিরপুরে শাহ আলী (বালক) উচ্চ বিদ্যালয়ে কিছুদিন শিকতা করেন। আবার ময়মনসিংহে এসে ভালুকা কলেজে যোগ দেন। সেই সময়ে প্রতিষ্ঠাতা অধ্যরে দায়িত্ব নিয়ে আহমদবাড়ি কলেজ প্রতিষ্ঠায় যুক্ত হোন। সেই সাথে নজরুল সেনা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ইংরেজি শিক হিসেবে কিছুদিন শিকতা করেন।
১৯৮৪ সালে ময়মনসিংহ জালাল উদ্দীন পাঠাগারে সফলভাবে ফার্সি ভাষার কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৮৭ সালে ঢাকাস্থ Alliance France সফলভাবে ফারসি ভাষার কোর্স সমাপন। বর্তমানে রাঘকপুর সিনিয়র মাদরাসার বাংলা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরধী আন্দোলনে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির জেলাপ্রধান হিসেবে সবিশেষ ভূমিকা রাখেন। ১৯৯০ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিও ময়মনসিংহ সদর ও নান্দাইলে তাকে সংসদপ্রার্থী হিসেবে মোনোনয়ন দান করেন।
কবি শামসুল ফয়েজ ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে এখনও দায়িত্ব পালন করছেন। সেই সাথে বর্তমানে নজরুল চর্চাকেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে নজরুল গবেষণায় রত আছেন। জেলা প্রশাসনের নজরুল জয়ন্তীতে প্রকাশিত নজরুল স্বরণিকা কমিটির সদস্য হিসেবেও কয়েক বছর যাবৎ দায়িত্ব পালন করছেন। বেশ কয়েক বছর ত্রিশালের জাতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত নজরুল জন্মবার্ষিকীর কবি সম্মেলনে সমন্বয়কারী হিসেবে ভূমিকা পালন করছেন। বর্তমানে অনান্দ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শতবর্ষী পূর্তি উৎসবে প্রকাশিতব্য স্বরণিকা কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তার কবিতা ময়মনসিংহ, চট্রগ্রাম, ঢাকা থেকে প্রকাশিত অসংখ্য সাহিত্য পত্রিকায় মুদ্রিত হয়েছে। সেই সাথে ময়মনসিংহ ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত সকল জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় সাহিত্য পাতায় নিয়মিত লিখছেন। বর্তমানে তিনি সুবিখ্যাত সাহিত্য সাময়িকী ‘কালি ও কলমে’ নিয়মিত লিখছেন।
তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : শামসুল ফয়েজের কবিতা (কাব্য সংকলন, ১৯৯৭), শোণিতে বিবিধ কোরাস (জুন ২০০৮), সময়ের দ্রুপদ (২০০৮), মনে চায় শুক্কুর পাগলা হয়ে যাই (ডিসেম্বর ২০১১)।
কবি শামসুল ফয়েজের কবিতা ‘মুক্তিযুদ্ধের কবিতা’ (আবুল হাসনাত সম্পাদিত), ‘উৎসবের কবিতা’ (কবি সৈয়দ শামসুল হক সম্পাদিত), ‘সত্তর দশকের কবিতা’ (কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা, বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত), ‘দুই বাংলার সত্তর দশকের কবিতা’ (কবি মাহমুদ কামাল ও কবি কামাা নাথ সেন সম্পাদিত), ‘বাংলাদেশের জনপ্রিয় কবিতা’ (ইফফাত আরা সম্পাদিত), জলদ ছড়া সংকলন (স্বপন ধর সম্পাদিত) ইত্যাদি কাব্য সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কবিতা লেখা ছাড়াও কবি শামসুল ফয়েজ ছড়া ও আন্তর্জাতিক সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ লিখেন।
কবি শামসুল ফয়েজ ইংরেজি, ফরাসি, উর্দু হিন্দি ও নেপালী ভাষা থেকে ইতোমধ্যে বেশ কিছু অনুবাদ করেছেন এবং সেগুলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি বিশেষভাবে বাংলাদেশে সমসাময়িক কবিতা ও গল্পের অনুবাদ করছেন।
* ২০০৯ সালে সাকী পাবলিশিং কাবের প্রকাশনায় কবি শামসুল ফয়েজ গল্পকার দীপু মাহমুদ -এর ‘মেঘজড়ানো দিন’ এর ইংরেজি অনুবাদ প্রতাশ করা হয়। (Cloud covered day).
*২০১০ সালে কবি শামসুল ফয়েজ কবি মোজাম্মেল হক নিয়োগীর ‘প্রেমের কবিতা’- এর ইংরেজি প্রকাশ করেন। (Poems of Love).
* ২০১১ সালে সাকী পাবলিশিং কাব থেকে তার কবিতার বই ‘মনে চায় শুক্কুর পাগলা হয়ে যাই’ প্রকাশিত হয়।
* ২০১১ সালে কবি শামসুল ফয়েজ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি মহাদেব সাহার নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ প্রকাশ করেন। (সাকিী)
* ২০১১ সালে ময়মনসিংহ প্রেসকাব তাকে সাহিত্যের জন্য ময়মনসিংহ প্রেসকাব সাহিত্য পদক প্রদান করে (২০০৮ সনের জন্যে)।
(কবি ওমর কায়সার সম্পর্কে পড়ুন আগামি সপ্তাহে)