অতিমাত্রিক ও বহুমাত্রিক অতুলনীয় মানবীয় গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। পরাধীন উপমহাদেশে চরম পশ্চাদপদ সমাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। বাংলা সাহিত্যে ধূমকেতুর মত আবির্ভূত কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহের, প্রেমের, সাম্যের, শিল্প-সৌন্দর্য ও নান্দনিকতার কবি। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ভাস্বর বাঙালির হূদয়ে। তার রচনা যে কোন ক্রান্তিকালে দেয় পথের দিশা।
১১ জ্যৈষ্ঠ। সাম্যের কবি, বিরহ-বেদনার কবি, বিদ্রোহের কবি বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৫তম জন্মবার্ষিকী। বাংলা সাহিত্য-সঙ্গীত তথা সার্বিক সংস্কৃতির দুই প্রধান পুরুষের একজন তিনি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তার লেখনী ধূমকেতুর মত আঘাত হেনে জাগিয়ে দিয়েছিল ভারতবাসীকে। ‘বল বীর, চির উন্নত মম শির’। কবিতায় এ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের সামনে আবির্ভূত হন ‘বিদ্রোহী’ কবি হিসাবে। আজও কবির নানা ধরনের লেখার মাঝ থেকে বিদ্রোহের পংক্তিমালা বাঙ্গালির হূদয়ে অনাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দুন্দুভি বাজিয়ে চলে। তার ‘চ্ল চল্ চল্’ বাংলাদেশের রণসঙ্গীত।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকীতে আমাদের একান্ত আবেদন – প্রেমের কবি, বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুলের প্রেমিকা কোথায় আছেন? যাকে ছাড়া কবির বিদ্রোহ কাব্য মক্তি পেত না, সেই তাঁকে ছাড়াই আজ কতটা বছর কবি একা। বিশ্ব বিদ্যালয় মসজিদের পাশে শুয়ে কবি কাঁদছেন, সে কান্না কি কেউ শুনতে পান না? দয়া করুন, কবির স্ত্রী প্রমীলা দেবীর কবরটি ভারতের চুরুলিয়া থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় বাংলাদেশে নিয়ে আসুন ও কবির পাশে তাকে সমাহিত করে কবির শেষ ইচ্ছাটিকে সম্মান দেখান।
এ বিষয়ে গত ২২ মে পাবরিক লাইব্রেরীর সেমিনার কক্ষে তৃনা হক কবিতার আসরে ভাষা সৈনিক ড. এনামুল হক বলেছেন, প্রমীলা দেবীর শেষ ইচ্ছে ছিল স্বামীর কবরের পাশে যেন তাকে সমাহিত করা হয়। তাই তিনি কবি নজরুল এর সমাধী তৈরিতে বাধা দিয়েছিলেন। তিনি এ সময় সব্যসাচীর কিছু বক্তব্য কোড করেন।
আমরা চাই বাংলাদেশের জাতীয় কবির পত্নীকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হোক। আমাদের এ অনুরোধ রক্ষা করুন।
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর বাণী
রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে পৃথক বাণীতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সমাজ পরিবর্তনের যে অনির্বাণ শিখা জ্বালিয়েছেন তার আলোকচ্ছটা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে সোনার বাংলা গড়তে। আমার বিশ্বাস, নতুন প্রজন্ম নজরুল চর্চার মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হবে এবং দেশপ্রেমের মহান ব্রতে উজ্জীবিত হয়ে জাতি গঠনে অর্থবহ অবদান রাখবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, নজরুলের অগ্নিঝরা কবিতা ও গান আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছিল অনন্ত প্রেরণার উত্স। আজও যখন গণতন্ত্র ও মানবতা বিপন্ন হয়ে পড়ে, আমরা সাহস সঞ্চয় করি বিদ্রোহী কবির ছন্দ থেকে। তিনি বলেন, তরুণ সমাজকে শৃঙ্খল ভেঙে সামনে এগিয়ে যেতে এবং অজানাকে জয় করতে তিনি পথ দেখিয়েছেন। জাতীয় কবি অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন দেখতেন, তা বাস্তবায়নের জন্য আমরা কাজ করছি। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের কর্ম, চিন্তা ও মননে কবির অবিনশ্বর উপস্থিতি আমাদের নতুন প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত করবে।
জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে কর্মসূচি
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয়ভাবে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন নানা কর্মসূচির মাধ্যমে কবির ১১৫তম জন্মবার্ষিকী পালন করবে।
বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন ও বিভিন্ন স্যাটেলাইট টেলিভিশন কবির জন্মদিন উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হবে বিশেষ সংখ্যা। এ বছর জাতীয় পর্যায়ের মূল অনুষ্ঠান হবে আজ রবিবার সকাল ১১টায় ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার দরিরামপুর হাইস্কুল মাঠে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি থাকবেন ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান। স্বাগত ভাষণ দেবেন সংস্কৃতি সচিব ড. রণজিত্ কুমার বিশ্বাস এনডিসি। নজরুল স্মারক বক্তা থাকবেন মুহম্মদ নুরুল হুদা। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবেন ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী।
এর আগে আজ সকাল ৬টা ৪৫ মিনিটে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কবির সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এছাড়া কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও নজরুল ইনস্টিটিউট।
অন্যদিকে গতকাল শনিবার বিকাল সাড়ে ৪টায় বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। নজরুল ইনস্টিটিউটের আয়োজনে আজ থেকে শুরু হচ্ছে তিনদিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
মূল অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জাতীয় কবির স্মৃতিবিজড়িত কুমিল্লার দৌলতপুর এবং চট্টগ্রামে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় যথাযোগ্য মর্যাদায় তাঁর ১১৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হবে।
এবার কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের থিম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘নজরুল ও অসামপ্রদায়িকতা’। নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমি জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণিকা ও পোস্টার মুদ্রণ করেছে। নজরুল ইনস্টিটিউট কাজী নজরুল ইসলামকে বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে পরিচিত করার লক্ষ্যে কবির ছবি, পোস্টার ও বই প্রদর্শনীর এবং গণগ্রন্থাগার অধিদফতর বই প্রদর্শনী, পাঠ ও রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে।
ঢাকাসহ দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দিবসটি যথাযোগ্যভাবে উদযাপন করা হবে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসসমূহে এ উপলক্ষে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান ও অন্যান্য অনুষ্ঠানমালা বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বেসরকারি চ্যানেলসমূহ সমপ্রচার করবে।
শিল্পকলা একাডেমি
আজ রবিবার সন্ধ্যায় একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন প্রফেসর ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আলোচক হিসাবে উপস্থিত থাকবেন কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দার। স্বাগত বক্তব্য প্রদান করবেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সংগীত, নৃত্য ও আবৃত্তি বিভাগের পরিচালক সোহরাব উদ্দীন। আলোচনা শেষে রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে জাতীয় পর্যায়ের শিল্পীরা অংশ নেবেন।
ছায়ানটে নজরুল উত্সব
ছায়ানটের আয়োজনে শুরু হয়েছে দুইদিনের নজরুল উত্সব। গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম দিনে ধানমণ্ডির ছায়ানট-সংস্কৃতি ভবন মিলনায়তনে ছিল নজরুল স্মারক বক্তৃতা। এতে বক্তৃতা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সিরাজ সালেকীন। আজ সন্ধ্যা ৭টায় এ আয়োজনে একক গান ছাড়াও থাকবে নৃত্য, পাঠ ও আবৃত্তি। অংশগ্রহণ করবেন ছায়ানটের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছাড়াও ঢাকাসহ দেশের নানা অঞ্চলের নবীন-প্রবীণ ও প্রতিশ্রুতিমান শিল্পীরা। উত্সবে সহযোগী হয়েছে গ্রামীণফোন।
নজরুল একাডেমী
নজরুল জন্মজয়ন্তীতে নজরুল একাডেমী শিল্পকলা একাডেমীর সঙ্গীত ও নৃত্যকলা কেন্দ মিলনায়তনে তিনদিনব্যাপী বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। আজ আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। বিকালে অনুষ্ঠামালার উদ্বোধন করবেন প্রধান অতিথি কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা। শিক্ষাবিদ আশরাফ সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে এতে আলোচনায় অংশ নেবেন বিশিষ্টজনেরা। আলোচনা শেষে রয়েছে বিশিষ্ট শিল্পীদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
চ্যানেল আই নজরুল মেলা
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে চ্যানেল আই আয়োজিত এবি ব্যাংক-চ্যানেল আই নজরুল মেলার আয়োজন করেছে। এতে আজীবন সম্মানিত হবেন বিশিষ্ট নজরুল সংগীতশিল্পী নিলীমা দাশ। রবিবার বেলা ১১টায় মেলার উদ্বোধন করবেন দেশবরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী, সাহিত্যিক, বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদকবৃন্দ, নজরুল বিশেষজ্ঞ ও নজরুল সংগীতশিল্পী ও চ্যানেল আইয়ের পরিচালকবৃন্দ।
মেলার খোলা প্রাঙ্গণে তৈরি অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে দিনব্যাপী পরিবেশিত হবে নবীন-প্রবীণ শিল্পীদের পরিবেশনায় নজরুল সংগীত, নৃত্যনাট্য, শিশুনৃত্য, আবৃত্তি ইত্যাদি। মেলায় কুটির শিল্পের স্টল ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২০টি স্টল থাকবে।
ত্রিশালে ৩ দিনব্যাপী কর্মসূচি
ত্রিশাল (ময়মনসিংহ) সংবাদদাতা জানান, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৫তম জন্মজয়ন্তী উদ্বোধন করতে আজ রবিবার ময়মনসিংহের ত্রিশালে আসছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। কবি নজরুলের ‘শৈশবস্মৃতি জাগানিয়া’ ত্রিশালে জেলা প্রশাসন ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আজ থেকে ৩ দিনব্যাপী জন্মজয়ন্তীর বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান শুরু হবে। প্রথম দিনটি জাতীয় পর্যায়ে উদযাপিত হবে। উত্সব চলবে ২৭ মে পর্যন্ত। আজ সকাল ১১ টায় উপজেলার দরিরামপুর নজরুল একাডেমী মাঠের ‘নজরুল মঞ্চে’ অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এমপি।
(সংবাদ: দৈনিক ইত্তেফাক থেকে গৃহিত)