কাঁধে ঝোলা, পান খেয়ে লাল ঠোটে পথচলা তার প্রিয় শখ। রংঙিন শার্ট বা পাঞ্জাবী ছাড়া খুব একটা দেখা যায়নি বয়বৃদ্ধ এই মানুষটিকে। কথা বলেন পরিস্কার শুদ্ধ বাংলায়। তবে কখনোই মাতৃভাষার বরিশালের আঞ্চলিকতাকে উপেক্ষা দেখান নাই। বরিশালের মানুষ মাত্রই তার মনোযোগ কেড়ে নেয়। আর সেই সূত্রেই তাঁর সাথে পরিচয় বাংলা একাডেমীর বারান্দায়। তখন তিনি বাংলা একাডেমীর পরিচালক পদে আসিন।
হাঃ জনপ্রিয় কবি ও উপস্থাপক আসাদ চৌধুরীর গল্প এটি। গণসংগীত শিল্পী মরহুম আব্দুল লতিফকে নিয়ে তার কিছু লেখা সংগ্রহ করতে এসে পরিচয় হয়েছিল কবি ও ছড়াকার আসাদ চৌধুরীর সাথে। সেই ১৯৯০-এর কথা। তাঁরপর আজ প্রায় ২৫টি বছর তারই ছত্রছায়ায় আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা আমরা তরুণ প্রজন্মের কব্যিককর্মিরা। কবি আসাদ চৌধুরী এখন কল্যানপুরের একটি বাড়িতে থাকেন। সেখান থেকেই যখন তখন ছুটে আসেন পাবলিক লাইব্রেরী কিম্বা ছায়ানট ভবনের যেকোনো সাহিত্য আসরে। এ বয়সেও ছুটে চলেন দূর দূরান্তে। ময়মনসিংহ বরিশাল কিম্বা কক্সবাজার আর দিনাজপুর, সাহিত্য সভা মানেই কবি আসাদ চৌধুরী আছেন। প্রতিবাদী কণ্ঠে আবৃত্তি করেন নিজের লেখা পঙিতিমালা –
নদীর জলে আগুন ছিলো
আগুন ছিলো বৃষ্টিতে
আগুন ছিলো বীরাঙ্গনার
উদাস-করা দৃষ্টিতে।
আগুন ছিলো গানের সুরে
আগুন ছিলো কাব্যে,
মরার চোখে আগুন ছিলো
এ-কথা কে ভাববে?
কবি আসাদ চৌধুরীর লেখা তখন সত্যি মানুষ ছিলাম শীর্ষক কবিতার অংশবিশেষ এটি। মুক্তিযুদ্ধের আগুনঝরা দিনের স্মৃতি এ কাব্যের পরতে পরতে সাঁজানো রয়েছে। রয়েছে স্বপ্ন ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এক্ই সাথে –
কুকুর-বেড়াল থাবা হাঁকায়
ফোসে সাপের ফণা
শিং কৈ মাছ রুখে দাঁড়ায়
জ্বলে বালির কণা।
আগুন ছিলো মুক্তি সেনার
স্বপ্ন-ঢলের বন্যায়-
প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে
কাঁপছিলো সব-অন্যায়।
এখন এ-সব স্বপ্নকথা
দূরের শোনা গল্প,
তখন সত্যি মানুষ ছিলাম
এখন আছি অল্প।
তখন সত্যি মানুষ ছিলাম/এখন আছি অল্প এ বাক্যে কবি বর্তমান সময়কে, বর্তমানের রাজনীতিকে আঘাত করেছেন সমান ভাবে।
১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন কবি আসাদ চৌধুরী। জন্মসূত্রেই তাই প্রতিবাদী তিনি। সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবি লেখেন-
প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল
বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম
আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো।
এ-সব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে
বৃক্ষের আড়ালে স’রে যায়-
বেড়ার ফোঁকড় দিয়ে নিজের রন্ধনে
তৃপ্ত অতিথির প্রসন্ন ভোজন দেখে
শুধু মুখ টিপে হাসে।
প্রথম পোয়াতী লজ্জায় অনন্ত হ’য়ে
কোঁচরে ভরেন অনুজের সংগৃহীত কাঁচা আম, পেয়ারা, চালিতা-
সূর্য্যকেও পর্দা করে এ-সব রমণী।
অথচ যোহরা ছিলো নির্মম শিকার
সকৃতজ্ঞ লম্পটেরা
সঙ্গীনের সুতীব্র চুম্বন গেঁথে গেছে-
আমি তার সুরকার- তার রক্তে স্বরলিপি লিখি।
মরিয়ম, যীশুর জননী নয় অবুঝ কিশোরী
গরীবের চৌমুহনী বেথেলহেম নয়
মগরেবের নামাজের শেষে মায়ে-ঝিয়ে
খোদার কালামে শান্তি খুঁজেছিলো,
অস্ফুট গোলাপ-কলি লহুতে রঞ্জিত হ’লে
কার কী বা আসে যায়।
বিপন্ন বিস্ময়ে কোরানের বাঁকা-বাঁকা পবিত্র হরফ
বোবা হ’য়ে চেয়ে দ্যাখে লম্পটেরক্ষুধা,
মায়ের স্নেহার্ত দেহ ঢেকে রাখে পশুদের পাপ।
পোষা বেড়ালের বাচ্চা চেয়ে-চেয়ে নিবিড় আদর
সারারাত কেঁদেছিলো তাহাদের লাশের ওপর।
এদেশে যে ঈশ্বর আছেন তিনি নাকি
অন্ধ আর বোবা
এই ব’লে তিন কোটি মহিলারা বেচারাকে গালাগালি করে।
জনাব ফ্রয়েড,
এমন কি খোয়াবেও প্রেমিকারা আসে না সহজ পায়ে চপল চরণে।
জনাব ফ্রয়েড, মহিলারা
কামুকের, প্রেমিকের, শৃঙ্গারের সংজ্ঞা ভুলে গ্যাছে।
রকেটের প্রেমে পড়ে ঝ’রে গ্যাছে
ভিক্টোরিয়া পার্কের গীর্জার ঘড়ি,
মুসল্লীর সেজদায় আনত মাথা
নিরপেক্ষ বুলেটের অন্তিম আজানে স্থবির হয়েছে।
বুদ্ধের ক্ষমার মূর্তি ভাঁড়ের মতন
ভ্যাবাচেকা খেয়ে প’ড়ে আছে, তাঁর
মাথার ওপরে
এক ডজন শকুন মৈত্রী মৈত্রী ক’রে
হয়তো বা উঠেছিলো কেঁদে।
বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক আসাদ চৌধুরী এভাবেই কবিতায় প্রতিবাদের ঝড় তোলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান সবসময়। তিনি টেলিভিশন উপস্থাপনা ও চমৎকার আবৃত্তির জন্যও সমান জনপ্রিয়। উলানিয়া হাই স্কুল থেকে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং চলে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অধ্যয়ন নিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ আরিফ চৌধুরী এবং মাতার নাম সৈয়দা মাহমুদা বেগম। আসাদ চৌধুরীর স্ত্রীর নাম সাহানা বেগম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকে যাওয়ার পর কলেজে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে আসাদ চৌধুরীর চাকুরিজীবন শুরু হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে তিনি ১৯৬৪ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীকালে ঢাকায় স্থিত হবার পর তিনি বিভিন্ন খবরের কাগজে সাংবদিকতা করেছেন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ভয়েজ অব জার্মানীর বাংলাদেশ সংবাদদাতার দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকায় বাংলা একাডেমীতে দীর্ঘকাল চাকুরীর পর তিনি এর পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর পদচারণা। কবিতা ছাড়াও তিনি বেশ কিছু শিশুতোষ গ্রন্থ, ছড়া, জীবনী ইত্যাদি রচনা করেছেন। কিছু অনুবাদকর্মও তিনি সম্পাদন করেছেন। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর রচিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শীর্ষক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
তাঁর বিখ্যাত কিছু কাব্যগ্রন্থ হল –
তবক দেওয়া পান (১৯৭৫); বিত্ত নাই বেসাত নাই (১৯৭৬); প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড় (১৯৭৬); জলের মধ্যে লেখাজোখা (১৯৮২); যে পারে পারুক (১৯৮৩); মধ্য মাঠ থেকে (১৯৮৪); মেঘের জুলুম পাখির জুলুম (১৯৮৫); আমার কবিতা (১৯৮৫); ভালোবাসার কবিতা (১৯৮৫); প্রেমের কবিতা (১৯৮৫); দুঃখীরা গল্প করে (১৯৮৭); নদীও বিবস্ত্র হয় (১৯৯২); টান ভালোবাসার কবিতা (১৯৯৭); বাতাস যেমন পরিচিত (১৯৯৮); বৃন্তির সংবাদে আমি কেউ নই (১৯৯৮); কবিতা-সমগ্র (২০০২); কিছু ফল আমি নিভিয়ে দিয়েছি (২০০৩); ঘরে ফেরা সোজা নয় (২০০৬)।
পুরস্কার ও সম্মাননা :
আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৫);
বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮৭);
শম্ভুগঞ্জ এনায়েতপুরী স্বর্ণপদক (১৯৯৯);
বরিশাল বিভাগীয় স্বর্ণপদক,
অশ্বনী কুমার পদক (২০০১);
জীবনানন্দ দাশ পদক;
অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক;
জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার (২০০৬)
বঙ্গবন্ধু সম্মাননা ১৪১৮
একুশে পদক, (২০১৩)
প্রবন্ধ-গবেষণা – কোন অলকার ফুল (১৯৮২)
শিশুসাহিত্য –
রাজার নতুন জামা (রূপান্তর, ১৯৭৯); রাজা বাদশার গল্প (১৯৮০); গ্রাম বাংলার গল্প (১৯৮০); ছোট্ট রাজপুত্র (অনুবাদ : ১৯৮২); গর্ব আমার অনেক কিছুর (১৯৯৬); ভিন দেশের মজার লোককাহিনী (১৯৯৯); তিন রসরাজের আড্ডা (১৯৯৯); কেশবতী রাজকন্যা (২০০০); গ্রাম বাংলা আরো গল্প (২০০০); তোমাদের প্রিয় চার শিল্পী (জীবনী, ২০০০); জন হেনরি (আমেরিকার লোককাহিনী, ২০০১); মিকালেঞ্জেনো (জীবনী, ২০০১); ছোটদের মজার গল্প (২০০১); সোনার খড়ম (২০০৬); মুচি-ভ’তের গল্প (২০০৬)। : সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু (১৯৮৩); রজনীকান্ত সেন (১৯৮৯); স্মৃতিসত্তায় যুগলবন্দী (২০০১)।
ইতিহাস – বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৮৩)।
সম্পাদনা – যাদের রক্তে মুক্ত এদেশ (১৯৯১ যুগ্মভাবে); ছয়টি রূপকথা (১৯৭৯)