কবির মনে উদিত ভাবের প্রকাশ ঘটে তার কবিতায়। ভাব অনুসারে প্রকাশের জন্য তিনি আশ্রয় নেন ছন্দের। বাংলা কবিতার বৈচিত্রপূর্ণ ছন্দ-সম্পদের মধ্যে বিচরণের ক্ষেত্রটুকু নির্ধারণ করে নির্মাণ করেন কবিতা। ছন্দোবদ্ধ কবিতা হলে তা কোন ছন্দের হবে, গদ্য কবিতা হলে তার গঠনশৈলী কেমন হবে তা প্রকাশিতব্য বিষয়স্তু ও ব্যক্ত করার ধরনের উপর নির্ভর করে। কবির প্রকাশ-যন্ত্রণা তার চেতনা, রুচি ও দক্ষতার উপর ভিত্তি করে বিকশিত হয়। তখন পাঠক মনের আনন্দে পাঠ করেন, উপলদ্ধি করেন হৃদয় দিয়ে, জ্ঞান দিয়ে করেন বিশ্লেষণ। এ ধরনের পাঠকের মধ্যে থাকেন আবৃত্তিকার, যিনি কেবল একজন পাঠক নন। তিনি কবিতাটি আত্মস্থ করেন ও নিজ শিল্পক্ষেত্রের নির্মানশৈলী দ্বারা নবরূপ দান করেন তার শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে।
আবৃত্তিশিল্পী যেহেতু একজন পাঠকও বটেন, সেহেতু তিনি প্রথমত: তার ভালো লাগার জন্য কবিতা পড়েন। পড়তে পড়তে তার মনোজগতে ছবির পর ছবি ভাসতে শুরু করে। এই ছবিগুলোকে পর্যায়ক্রমে সাজিয়ে একটি নিখুঁত বুনন প্রস্তুত করে নেন। এই গ্রন্থিত ছবিগুলো প্রকাশ করার জন্য চলে নিরন্তর অনুশীলন। পর্যায়ক্রমে নির্মিত হয় বোধসিঞ্জিত ছবির সিরিয়াল। একাজে তিনি সহায়তা নেন বাক্ প্রত্যঙ্গ ও স্বরস্থানের। ছবিগুলো অনুশীলনকৃত স্বর-প্রমোপনে জীবন্ত হয়ে উঠে। ফলে একটি জীবন্ত চলৎছবি শ্রোতার মানসপটে ভেসে উঠে।
উপর্যুক্ত ব্যাপারে আবৃত্তিশিল্পীর কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন রয়েছে। তাকে বাকশিল্পের যথাযথ প্রয়োগের জন্য ধাপে ধাপে পদ্ধতিগতভাবে অনুশীলন করতে হয়। শুদ্ধ উচ্চারণের বিষয়ে তার সম্যক ধারণা থাকা বাঞ্জনীয়। প্রতিটি শব্দের সঠিক উচ্চারণ জেনে যথাযথ উচ্চারণস্থান ব্যবহার করে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে হয়। শুদ্ধ ও স্পষ্ট করার প্রবল প্রবণতায় যেন কোন প্রকার কৃত্রিমতা না এসে যায় সে ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হয়। এজন্য একেবারে সহজ ও সাবলীলভাবে উচ্চারণ করার দক্ষতা অর্জন করতে হয়। সাঠিকভাবে মুখনিঃসৃত কথাগুলো সুন্দর উচ্চারণে উপাস্থাপন করা প্রয়োজন।
কবিতাটি ছন্দবদ্ধ হলে তার ছন্দ বুঝে প্রস্বর-যতি অনুসরণ করার পাশাপাশি অর্থগত চলন-প্রক্রিয়ার অনুসন্ধান করতে হয়। ছন্দও অর্থ উভয় প্রকৃতির গতিবৈচিত্রের সমন্বয় একান্ত জরুরি হয়ে পড়ে। গদ্য কবিতার ক্ষেত্রে অর্থগত তালটি অনুধাবন করতে পারা দরকার। উভয় ক্ষেত্রেই চলনভঙ্গি কেমন হবে তা নির্ধারণ করে নিতে হয়।
ভাব ও রস সম্পর্কে জ্ঞানের গভীরতা আবৃত্তিশিল্পীর জন্য আবশ্যকীয়। মানব মনের বিচিত্র ভাবের মধ্যে কোন ভাবটি তার পঠিত কবিতায় মূল আশ্রয় গ্রহণ করেছে তা জানা থাকা ভাল। মূল ভাব ছাড়াও সঞ্চারী ও সাত্ত্বিক ভাবগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা অনুযায়ী অনুশীলনে সহায়ক হয়ে উঠে। ভাবের একান্ত কথ্য সূরটিকে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চর্চার মাধ্যমে আবৃত্তিতে যথার্থ প্রয়োগ ঘটাতে পারলে শ্রোতার কাছে প্রকৃত রসগ্রাহী হতে বাধ্য।
কবিতাটি বারংবার পাঠের ফলে মূল বক্তব্য অর্থাৎ বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারনায় উপনীত হওয়া যায়। বক্তব্যের বিষয়টি স্বচ্চভাবে জানা থাকলে আবৃত্তিশিল্পীর প্রকাশরূপে গভীর আস্থার প্রতিফলন ঘটে। এক্ষেত্রে কার উদ্দেশ্যে এবং কেন এ প্রস্তাবন তাও বিবেচনায় নিতে হয়। কারণ মূল বক্তব্যের সাথে পরিস্থিতে, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যবস্তুর সম্বন্ধ রয়েছে। এই সম্বন্ধটি সম্পর্কে সচেতন থাকলে কবিতার একটি সুনির্দ্দিষ্ট বাচনভঙ্গি নির্ধারণ করা সহজ হয়ে যায়। মানুষ সাধারণত দুইভাবে আবেগ প্রকাশ করে। ক্রোধ, হুমকী, বীরত্ব, বিপ্লব, বিদ্রোহ, সংগ্রামের প্রকাশ ঘটে অনেকটা উচ্চকিতভাবে। আবেগ প্রকাশের ধরনটিকে বলা যায় বহির্মুখী। অপরদিকে নিকটজনদের সাথে কথা, নিজের সাথে নিজের কথা, সলাপরামর্শ করা অথবা অন্তরঙ্গ মূহুর্তের কথা অন্তর্মুখী হয়ে থাকে। এই ধরনগুলো সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা কবিতার আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রে আবৃত্তিশিল্পীকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করে তোলে।
আমাদের দেহের উর্দ্ধাংশের গহ্বরগুলিতে স্বরতন্ত্রী হতে নিঃসৃত স্বরকে অনুরণিত করিয়ে বাক্-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে প্রক্ষেপণ করে থাকি। আমাদের উচ্চারিত ধ্বনিসমূহের ভিন্ন ভিন্ন রূপ রয়েছে। বারংবার সযতœ উচ্চারণের মাধ্যমে ধ্বনির সর্বোচ্চ রূপকে প্রকাশ করতে হয়। কণ্ঠস্বরের মেজাজগত পরিবর্তনের জন্য স্বরের প্রকৃতি সম্বন্ধে পরিস্কার ধারণা থাকা দরকার। উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিত, কম্পিত ও ফিসফিসÑ এই পাঁচ ধরনের স্বরের প্রযোজনমাফিক নিখুঁত ব্যবহারে ধ্বনি রূপের সর্বোচ্চ পরিস্ফুটন ঘটানো সম্ভব হয়। একই পর্দায় রেখে আওয়াজের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটিয়ে স্বরের রঙ পরিবর্তন করা যায়। আবার পর্দা, আওয়াজের কোনরূপ পরিবর্তন না করেও গতির তারতম্য ঘটিয়ে ধ্বনির গুনগত পরিবর্তন সাধন করা যায়। ক্রমানুশীলনের মাধ্যমে পর্দা, আওয়াজ ও গতির চমৎকার সমন্বয়ে ধ্বনিরূপের দ্যুতি ছড়িয়ে দেওয়া যায় শ্রোতাহৃদয়ে।
ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কণ্ঠস্বর ও বাক্যন্ত্রÑ উচ্চারণযন্ত্রের গঠনের উপর নির্ভর করে তার নিজস্ব ধ্বনিরূপ। এর সঙ্গে যুক্ত হয় তার শিা, রুচি ও ব্যক্তিগত মানসিক গঠনের বিষয়টি। একজন মানুষের বাচন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে তার কণ্ঠস্বর, স্বর প্রক্ষেপণের ধরন, কথাভ্যন্তরের সুর ও ঝোঁক এবং বাচনিক মুদ্রাদোষ। পরিবেশ ও কালÑ এসব ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। কোন্ পরিবেশ ও সময়ে সে লালিত হয়েছে তার প্রভাব পড়ে কথা বলার ধরনে এবং আবৃত্তিতে। তাই সুকণ্ঠের অধিকারী হওয়া সত্বেও একই ব্যক্তিব আবৃত্তি একটানা বা বহুবার শুনলে অনেকসময় একঘেঁয়েমিপূর্ণ মনে হতে পারে। এজন্য আবৃত্তিশিল্পীকে তার ব্যক্তিযাত আচরণ ও স্বভাবের বাইরে এসে দাঁড়াতে হয়। মেতে উঠতে হয় নিত্য নতুন আবিস্কারের নেশায়। কেবল স্বভাব প্রতিভা বা কৌশলের জোরে বেশিদুর অগ্রসর হওয়া যায় না। আবৃত্তিশিল্পী কবির প্রচারক হয়ে মঞ্চে উঠেন না বা এই শিল্পটি অন্য কোন শিল্পের অতিরিক্ত অংশও নয়। আবৃত্তি ভিন্ন একটি শিল্পমাধ্যম বিধায় এর প্রকাশরূপটি মানবমনে স্বতন্ত্র রসের সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।
একজন কবি তার রচিত কবিতাংশ যেমন বারংবার পরিবর্তনের সুযোগ পান তেমনি চিত্রকরেরও আঙ্কিত ছবির সংশোধনের সুযোগ থাকে। কিন্তু আবৃত্তিশিল্পী আবৃত্তি করার সময় বারবার তা সংশোধনের সুযোগ পান না। জনসমক্ষে একটানা তাকে আবৃত্তি করে যেতে হয়, সেখানে বিরতি দিয়ে ত্রুটি সংশোধনের কোন সুযোগ পাওয়া যায় না। সেজন্য কানের সমৃদ্ধি ও প্রয়োগের কৌশল উভয়ের জন্যই তাকে আন্তরিকভাবে পরিচর্যা করতে হয়।
শ্রোতার সাথে আবৃত্তিশিল্পীর সংযোগকে অতিমাত্রায় প্রাধান্য দিতে হয়। সেজন্য যে ভাষায় আবৃত্তি করা হয়, সেই ভাষার গঠনশৈলী ও বিন্যাস, চলনরীতি, বাক্যের অন্তর্নিহিত সুর, কথ্যভঙ্গি ও ঝোঁক ইত্যাদি বিষয়ে গভীর অভিনিবেশ প্রয়োজন। নির্বাচনও এমন হতে হবে যা শ্রোতার বোধগম্য ও হৃদয়গ্রাহী হয়। তবে শ্রোতাচিত্ত মনোরঞ্জনের আশায় বিষয়, প্রতিভাবান বা প্রতিশ্রুতিশীল আবৃত্তিশিল্পী এসব ক্ষেত্রে যথেষ্ট সচেতন থাকেন। সমাজ, ভাষা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, মানবিক সম্পর্কের ব্যাপারে গভীর বোধসম্পন্ন হওয়ায় বিষয় নির্বাচনে এর প্রতিফলন ঘটে থাকে। গভীর ও সৎ সাহিত্যের নির্বাচন আবৃত্তিশিল্পীকে যেমন গ্রহণযোগ্য করে তোলে তেমনি এই শিল্পের বিস্তারে আবৃত্তিকারের ভূমিকাও গুরুত্ব পেতে থাকে।