সরেজমিনে গত একমাস বরিশাল সিটি কর্পোরেশন ও জেলার কয়েকটি উপজেলা ও ইউনিয়নের সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে যে চিত্র পাওয়া গেছে তা যদি কবির ভাষায় বলি তাহলে বলতে হয়—
উন্নয়নের রাজনীতিঃ হায় বরিশাল
প্যাক আর কাদায় জোঁকের বিস্তার
অগভীর জলে হাঙরের সাঁতার।।।
এখন প্রশ্ন হতে পারে প্যাক আর কাদাতো বুঝলাম, অগভীর জলও না হয় বুঝে নেব কিন্তু জোঁক আর হাঙর বুঝি কি করে? পুরো লেখাটি পড়লে আপনার বুঝে চলে আসবে এটা নিশ্চিত। শুধু জানুন জোঁকের কাজ কি আর হাঙর কি করে?
প্রথমেই সিটি কর্পোরেশন এর উন্নয়ন চিত্র দেখুন। কয়েকটি সড়কের চাকচিক্য ছাড়া আর কি আছে এই বিভাগীয় শহরে? কিন্তু অভিযোগ আছে, বিস্তার অভিযোগ। আর সব অভিযোগ চলমান মেয়রের বিরুদ্ধে, মহানগর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। যদিও সব অভিযোগ কিন্তু আড়ালে আবডালে। প্রকাশ্যে কিছু বলার সাহস মেয়র সাদিক সেরনিয়াবাত এর মামারও নেই। তার দালান ভাঙার মামলা ঝুলন্ত আছে এই শহরে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতিকেও বাড়ি নির্মাণ করতে হয়েছে নাকি আপোস করে। এসব কানাঘুষো পুরো শহর জুড়ে। প্রকাশ্যে কিছু বলার বা লেখার সাহস কারো নেই। এমন কি বরিশালের সাংবাদিকরাও এখানে কোনঠাসা বলে গালি শোনেন সাধারণ মানুষের কাছে। সত্যি বলতে কি, কান কথায় কান দিতে নেই, তা আমরা সাংবাদিকরা জানি। সাহস থাকেতো দশজন মিলে লেখিতো অভিযোগ দিন সাংবাদিক সংগঠনে এসে।িএটাই অনুরোধ সাধারণ মানুষ ও পাঠকের প্রতি।
বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকার আয়তন: ২৪.৯১ বর্গ কিমি। জনসংখ্যা ২২৪৩৮৯; পুরুষ ১২৩৪০২, মহিলা ১০০৯৮৭।বলা যায় প্রায় ৩ লাখ।(মেয়র হীরন এর সময়ের পরিসংখ্যান)
সীমানা: উত্তরে কাউনিয়া ও এয়ারপোর্ট থানা, দক্ষিণে বন্দর থানা এবং নলছিটি ও বাকেরগঞ্জ উপজেলা, পূর্বে কাউনিয়া ও বন্দর থানা, পশ্চিমে এয়ারপোর্ট ও কোতোয়ালী থানা এবং নলছিটি উপজেলা।।
বহু ইতিহাসের সাক্ষী ঐতিহ্যবাহী কীর্তনখোলা নদী বেষ্টিত চমৎকার সম্ভাবনাময় একটি শহর এই বরিশাল। রয়েছে প্রাচীণ গর্বিত ইতিহাস।চন্দ্রদ্বীপ, বরি শল্ট থেকে বরিশাল হওয়া, আগা বাকের খানের বাকেরগঞ্জ হওয়া। অতঃপর বরিশাল পৌরসভা। পৌরসভা গঠিত হয় ১৮৭০ সালে এবং বরিশাল সিটি করপোরেশন ঘোষণা করা হয় ২৫ জুলাই ২০০২ সালে বিএনপির শাসনামলে।
বর্তমানে ৩ টি থানা, ৩০ টি ওয়ার্ড এবং ১২৫টি মহল্লা নিয়ে গঠিত বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকার মোট বাড়িঘরের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজারের বেশি। রাজধানী ঢাকার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে এখানের হাউজিং ট্যাক্স ও বাড়ি ভাড়া। কিন্তু পাল্লা দিয়ে বাড়েনা মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন। গত বিশ বছরের উন্নয়ন চিত্রে দেখা যায়, সম্প্রতি পায়রা বন্দর ও লেবুখালী ব্রীজ, কয়েকটি সড়ক উল্লেখযোগ্য দর্শন। যা কর্মসংস্থান হিসেবে মোটেই ভূমিকা রাখেনা। তবে পায়রা বন্দরের কাজ সম্পন্ন হলে এটা অবশ্যই উপকারী হবে। কিন্তু কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তা অনিশ্চিত।
রাজনীতির মাঠে বরিশাল সবসময় সরগরম। দেশভাগের সময় থেকেই বিশ্ব তথা ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বরিশাল উল্লেখযোগ্য নাম। যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বাংলাদেশ গঠিত হবার পর ৭৫ পরবর্তী একটা সময় গেছে যখন বরিশাল অঞ্চলে আওয়ামী লীগের কোনো উল্লেখ হতোনা। যদিও হতো তা ছিলো ঝালকাঠি আমির হোসেন আমু এবং গৌরনদী হাসনাত আব্দুল্লাহ এর আপ্রাণ চেষ্টায়।
কেউ স্বিকার করুক বা না করুক এটা অপ্রিয় সত্যি যে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে পুনরায় আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠিত হবার পথ তৈরি করে দেন বহুদলীয় রাজনীতির চর্চার অনুমোদন দিয়ে। এরফলে ১৯৮১ সালের ১৭ মে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিজ দেশে ফিরে আসার পথ সুগম হয়েছিল।তিনি আসার পর কি আচারণ বা বিধিনিষেধ দেয়া হয়েছিল সে বিষয়ে তর্ক নাই বা করি। কিন্তু এটা সত্যি তো?
সে যাক, বর্তমান বরিশালের রাজনীতির মাঠ আপাতদৃষ্টিতে সম্পুর্ণ ই আওয়ামী লীগের দখলে। অন্য কোনো দল আছে বলেই মনে হয়নি গত একমাসে। মাঝেমধ্যে বিএনপির সাবেক সাংসদ ও বরিশালের সাবেক মেয়র মজিবুর রহমান সারোয়ার এর উঁকি ঝুঁকি দেয়া ছাড়া।
তবে হাঃ বামজোট বাসদ এর ডাঃ মনীষা চক্রবর্তী ও তার দর একাই সাহসের সাথে বিরোধীদলীয় ভূমিকা বাঁচিয়ে রেখেছেন এই বরিশালে। সহ্য করছেন অসংখ্য বাধাবিপত্তি।
মনীষা বলেন, গত সাড়ে তিনবছরে অসংখ্যবার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলা বাঁধার শিকার হতে হয়েছে আমাদের। আর এ সবই হচ্ছে মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক এর নির্দেশনায়। তিনি সিটি করপোরেশনকে নিজের পৈতৃক সম্পত্তি বানিয়ে নিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে দেখুন, তার পছন্দের লোক ছাড়া কোনো কর্মকর্তা কর্মচারীদের তিনি সিটি করপোরেশনে ঢুকতেও দেন না। এমনকি কাউন্সিলরদের অনেকের ই সিটি করপোরেশন ভবনে প্রবেশ নিষেধ।
অনেক খুঁজেও এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকে পাওয়া গেল না। এখানে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীর হোসেন, সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ, মেয়র বরিশাল সিটি করপোরেশন।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসানাত আব্দুল্লাহ এবং সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মোহাম্মদ ইউনুস। আর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভপতি মনিরুল ইসলাম ছবি সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন খান।
জেলায় বিএনপির অবস্থা খুবই করুন। নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধ প্রকট বলেই স্বীকার করেন মহানগর বিএনপির সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার। খুব শীঘ্রই এ দ্বন্ধ নিরসন হবে বলে আশাবাদী তিনি। এখানে মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন সিকদার। জেলা বিএনপিতে আছেন য়েবায়দুল হক চাঁন ও আবুল কালাম শাহিন।
অন্যান্য রাজনীতির দলের তেমন ভুমিকা এখানে নেই তবে চরমোনাই পীরজাদা সৈয়দ রেজাউল করিম কখনো সখনো হাতপাখার বাতাস বিলির চেষ্টা করেন গরমের সময়।
আওয়ামী লীগের এই মানুষগুলোর ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা বর্তমান আওয়ামী লীগের কর্মী সংখ্যা জেলার জনসংখ্যার সমান। যা অনেকটা জোঁকের বিস্তার বলা যায়। কেননা সবখানেই কর্মীদের খুশি রাখতে কিছু না কিছু ত্যাগ স্বীকার করতেই হয় নেতাদের। আর এই ত্যাগ যদি হয় সড়ক বা ব্রীজের কন্ট্রাক্ট তাহলেই ফুলেফেঁপে ওঠা কর্মী নিজেই বড় নেতা হয়ে ওঠেন। কাজের মান দেখে তখন সয়ং মেয়র সাদিক বলে উঠেন – এটা কি রাস্তা বানাইছো, এখানেতো আমিও ডুবাইতে পারমু। গত ২৭ মে সিটি করপোরেশন এলাকার ঠাকুরবাড়ি সড়ক পরিদর্শন করে মেয়র এ কথাই বলেছেন।
উপজেলা সভাপতি ও চরকাউয়ার চেয়ারম্যান ছবির এলাকার চিত্রতো আগেই জেনেছি। কর্ণকাঠী ও চরকরন্দি সড়ক তার প্রমান।
বরিশাল সিটি করপোরেশন বিসিসি এর জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই উন্নয়ন বাজেটে। সব সিটি করপোরেশন এলাকায় বাজেট আছে, বরিশালে কেন নেই?
এর উত্তরে প্যানেল মেয়র ১৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি গাজী নঈমুল হোসেন লিটু বলেন, বরাদ্দ নেই কথাটি ঠিক নয়। একনেক সভায়
আর উন্নয়ন মানেই সড়ক কিম্বা মসজদ নির্মাণ। যে নির্মাণের কাজ করছেন তাদেরই নিজের লোক বা লীগের লোক। তাহলে পুরো উপজেলাগুলোর চিত্র কি?
বরিশাল জেলার মোট আয়তন ২,৭৮৪.৫২ বর্গ কি.মি.। দশটি উপজেলা । বরিশাল সদর, বাকেরগঞ্জ, বাবুগঞ্জ, আগাইলঝাড়া, উজিরপুর, হিজলা, মেহেন্দিগঞ্জ, মুলাদী, বানারীপাড়া, গৌরনদী। এই দশটি উপজেলার রয়েছে ৮৭টি ইউনিয়ন এবং ১,১১৬টি গ্রামের প্রায় ২৩,২৪,৩১০ (২০১১ পরিসংখ্যান অনুযায়ী) লোক নিয়ে বরিশাল জেলা। এই ১১১৬টি গ্রামের চিত্র কি ৬ টি সাংসদীয় আসনের প্রতিনিধি কিম্বা জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ঘুরে দেখেছেন কখনো?
আগে তবু নির্বাচন সময়ে হলেও প্যাক-কাদা মেখে সাংসদপ্রার্থী ও দলের লোকেরা ঘুরতেন গ্রামে গ্রামে। এখনতো নির্বাচনে কারো আস্থাই নেই। লোকবল ও টাকাই এখন সব। কিন্তু এই গ্রাম যদি না বাঁচে বাঁচবে কি শহর?
করোনা মহামারী চাপে কর্মহীন মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামমুখী। গ্রামীণ জনপদে আয়ের উৎস তৈরি হলে এই সুযোগে শহরমুখী চাপ কমবে। বরিশাল বিভাগের রয়েছে প্রচুর সম্ভাবনা। নতুন নতুন উৎপাদনশীল শিল্পকারখানা তৈরির রয়েছে বিস্তর সুযোগ। ডক ইয়ার্ড, অপসোনিন আর খানসন্স দখল করছে নদীর পাড় এলাকা। সরকারি উদ্যোগ এখানে কি পথ দেখাতে পারেনা? প্রয়োজন সিটি মেয়র ও সাংসদদের ঐক্যবদ্ধ আন্তরিকতা ও উদ্যোগ।
অগভীর জলে হাঙরের সাঁতার কথাটা এখানেই প্রয়োজনীয় শব্দ। রাজনীতির বাইরের মানুষগুলো শুধু টাকা আর ক্ষমতার জোরে সংসদে যাবেন। আর রাজনৈতিক মানুষগুলো নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব করে শেষ হবেন। হবেন হাঙরের খাবার নয়তো সমাজে উপহাসের পাত্র। যেমনটা হয়েছেন বরিশালের বেশিরভাগ সাংবাদিক বন্ধুরা। চেয়ারম্যান ছবি হাওলাদার বা বরিশাল চেম্বার কমার্সের সভাপতি উপজেলা চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রিন্টু কেন সাংবাদিক দেখতে পারেন না। তালুকদার মোঃ ইউনুস ফোনে দায়সারা গোছের উত্তর দেন। প্রশ্ন পছন্দ না হলে কেটে দেন।
বিএনপির লোকেরা কথা বলেন, খুব কৌশলে। তাদের কথায় বরিশালের উন্নয়ন ভাবনা নোই। আছে ক্ষমতায় যাবার জন্য পরষ্পরের নিন্দা, সরকারের নিন্দা।
বিএনপির জেলা সভাপতি এবায়দুল্লাহ চান অবশ্য বললেন, কর্ণকাঠী ও চরাদির সড়কের উন্নয়ন নিয়ে। তাদের সময় ব্রীজ ছিল বলে জানালেন।
যেই তাকে প্রশ্ন করা হলো – আপনারা জেলা ও মহানগর কেন আলাদাভাবে অনুষ্ঠান করেন?
সংগে সংগে একটাই উত্তর – একজন মানুষের জন্য এখানে এই বিভক্তি তৈরি হয়েছে।
পরিশেষে বলছি দলীয় বা পেশী শক্তির আস্ফালন নয়, উন্নয়ন ও ভালোবাসা দিয়ে করুন বরিশাল কে জয়। বরিশালের মানুষ ভালোবাসার কাঙাল, ক্ষমতা বা টাকার নয়।