আলু,পিঁয়াজ ডিম, গ্যাস আর বিদ্যুতে বাড়ছে শুধু ঋণ: জনমনে অশান্তি চরমে

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাহিত্য বাজার

Sharing is caring!

আলু,পিঁয়াজ ডিম, গ্যাস আর বিদ্যুতে বাড়ছে শুধু ঋণ: জনমনে অশান্তি চরমে

বিশেষ প্রতিবেদক

“আলু,পিঁয়াজ ডিম
গ্যাস আর বিদ্যুতে
বাড়ছে শুধু ঋণ। ”
এভাবেই কাব্য করে নিজের অবস্থা তুলে ধরলেন বৃদ্ধ আব্দুল হাই। বরিশালের পোর্ট রোড বাজারের হাতে ব্যাগ নিয়ে ঘুরছেন আর বলছেন – একী অবস্থা? ৮/১০ টাকা দরের আলু গত পনের বছর ধরে বাড়তে বাড়তে ৬০ টাকা, ৮০ টাকার নীচে নেই বেগুন আর পটল। পিঁয়াজতো হাসিনা যাওয়ার আগেও ১১০ টাকা এখনো ১১০ টাকা। উল্টো ডিমের দাম বাড়িয়ে দিলো এই বিপ্লবী সরকার এসে। আমাগো জীবন তাইলে কি করে চলবে বলেন? বৃদ্ধ আব্দুল হাই একা নয়, শ্রমজীবী প্রায় প্রতিজন মানুষের মুখে একই প্রশ্ন বারবার। প্রশাসন কেন বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে। কেন ভাঙতে পারেনা সিন্ডিকেট? নিত্য পন্যের দামের বাজারে ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্যাস ও বিদ্যুৎ এর দাম কমিয়ে দেন, সবকিছু কমে যাবে। আর সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা সরকারি উদ্দ্যোগে সরাসরি কৃষকদের নিয়ে পৃথক বাজার সৃষ্টি করার পরামর্শ দিচ্ছেন বারবার।
বৃহস্পতিবার সকালে বরিশালের বাজারে ডিম যেমন ৫৫/৬০ টাকা তেমনি সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রি হয়েছে ১২ লিটার ১৫ শত টাকায়। তবে গ্যাসের দোকানের তুলনায় কাঠ বা লাকড়ি বাজারে ক্রেতার ভিড় ছিলো লক্ষ্যনীয়। নগরীর চাদমারি, রূপাতলী ও চৌমাথার নবগ্রাম রোডের সমিলে বিক্রি হচ্ছিল লাকড়ি ও কাঠের গুড়ো। জ্বালানি হিসেবে পুনরায় কাঠের উপর নির্ভরশীলতা বাড়তে শুরু করেছে বলে জানালেন স্বমিল শ্রমিকরা। এতে করে চাপ পরছে বনাঞ্চলে এবং উজার হচ্ছে গাছ। উত্তম জ্বালানি হওয়ার কারণে ইতিমধ্যেই গ্রামাঞ্চল থেকে উধাও হয়েছে খেজুর গাছ যা স্বীকার করেছে সয়ং কৃষি দপ্তরের কর্মকর্তারাও। বরিশাল অঞ্চলে এখন আর খুব একটা খেজুর গাছ চোখে পড়ে না। যে কারণে খেজুরের গুড় আর তৈরি হয়না এ অঞ্চলে বলে জানিয়েছেন তারা।
এদিকে ৫ আগষ্টের পর বর্তমান বিপ্লবী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করলে ইতিমধ্যেই দুইবার বেড়েছে সিলিন্ডার গ্যাসের দাম। প্রথমবার ৫০ টাকা এবং দ্বিতীয় বার ৮০ টাকা। অর্থাৎ ১৩০ টাকা বৃদ্ধি হয়েছে দুইমাসে। আর খুচরা বাজারে ১৫০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ১৫০০ টাকা ১২ লিটার জ্বালানি। ইতিপূর্বে বিগত সরকারের ১৭ বছরে ১৭ বার বৃদ্ধি পেয়ে ৪৫০ টাকা থেকে ১৪০০ টাকায় এসে থেমেছিলো সিলিন্ডার গ্যাস। গত ১ অক্টোবর দেশে ভোক্তা পর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম ১২ কেজিতে ৩৫ টাকা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। গত মাসে সেপ্টেম্বরে ১২ কেজিতে বেড়েছিল ৪৪ টাকা। এর আগে আগস্টেও দাম বৃদ্ধি পায় ৫০ টাকা। এবার অক্টোবরের জন্য প্রতি ১২ কেজির সিলিন্ডারের দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৪৫৬ টাকা। সেপ্টেম্বরে দাম ছিল ১ হাজার ৪২১ টাকা। এলপিজির ১২ কেজি সিলিন্ডার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় গৃহস্থালির কাজে। খুচরা বাজারে বর্তমানে তা ১৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে স্বীকার করলেন বরিশালের ব্যবসায়ী নাসির ট্রেডার্স ও খান ব্রাদার্স । সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রভাব সবচেয়ে বেশি পরে দরিদ্র মানুষের উপর জানিয়ে খান ব্রাদার্সের মাহবুব খান বলেন, যে কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলো পুনরায় লাকড়ির চুলা নির্ভর হচ্ছে। আমার এখান থেকে নিয়মিত গ্যাসের সিলিন্ডার নিতেন এমন বেশ কয়েকজন পরিবার গত তিন চার মাস গ্যাস সিলিন্ডার বদল করেন নাই। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি তারা এখন লাকড়ি ব্যবহার করছেন। গ্যাস শুধু জরুরী প্রয়োজনে ব্যবহার করেন বলে জানান তিনি।
লাকড়ি ব্যবহারে গ্যাসের তুলনায় খরচ অনেক কম বলে জানালেন বেশ কয়েকজন গৃহিণী। বরিশালের ভাটার খাল এলাকার বাসিন্দা গৃহিণী মনি দাস বলেন, বাজারে কাঠের মন বিক্রি হচ্ছে ১৫০-২০০ টাকায়। একটি পরিবারে মাসে সর্বোচ্চ ৫ মন কাঠ প্রয়োজন হয়। সেখানে একমাসের মধ্যে ১২ লিটারের সিলিন্ডার গ্যাস প্রয়োজন হয় কম হলেও দুটি। যার মূল্য পড়ে ৩০০০ টাকা। সেখানে কাঠের মূল্য ৫০০/৭০০ টাকায় হয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। কেউ কেউ আবার ধানের সময়ে খড়কুটো সংগ্রহ করেন। সেই খড়কুটো দিয়েও রান্না করেন অনেক পরিবার। তবে এখনতো গরুর জন্যও খড়কুটো পাওয়া দুষ্কর বলে জানান বিসমিল্লাহ রেষ্টুরেন্টের মালিক সবুজ খান। তার হোটেলে প্রতিমাসে প্রায় ১৫ মন লাকড়ি ব্যবহার হয় বলে জানান তিনি।
স্বাভাবিক ভাবেই গ্রামাঞ্চলে সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবহার কমে কাঠের ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে বলে জানালেন চাঁদমারি স্বমিলের কাঠ ব্যবসায়ী এমদাদুল হক মিলন। তিনি বলেন, আম, কাঠাল, রেন ট্রি কাঠের জ্বালানির চাহিদা বেশি। অনেক পরিবার পাশাপাশি ভুষিও ব্যবহার করেন। ভুষি বা কাঠের গুড়ো বাজারে ২০/৩০ টাকা বস্তা। নগরীর বস্তি এলাকার বাসিন্দারা বেশিরভাগই কাঠের গুড়ো ব্যবহার করে এনজিওর দেয়া সাশ্রয়ী চুলোয় রান্না করে বলে জানান তিনি।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও বরিশালের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি কাজী মিজানুর রহমান বলেন, সিলিন্ডার গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং বাজার দর নিয়ে যে সিন্ডিকেট চলছে তা নিয়ন্ত্রণ করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে প্রশাসন। এ অবস্থা চলতে থাকলে বনাঞ্চলের উপর চাপ পরবে এটাই স্বাভাবিক। সরকারের উচিত দ্রুত সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করা অথবা কৃষকদের জন্য সরাসরি কৃষি বাজার তৈরি করে তা নিয়মিত মনিটরিং করা । প্রতিটি উপজেলায় একটি কৃষক বাজার হতে পারে। যে বাজারে কৃষক তার পণ্য নিয়ে আসবেন ও সরাসরি ক্রেতার কাছে বিক্রি করবেন। কিছুতেই তিন কেজির উপরে কোনো পণ্য বিক্রি হবে না এই বাজারে। এমন নীতিমালা থাকতে হবে বলে জানান কাজী মিজানুর রহমান ।
একই কথা বললেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাহবুব খান। তিনি বলেন, সরকারের উচিত গ্যাস ও বিদ্যুৎ এ ভর্তুকি দিয়ে হলেও বাজার নিয়ন্ত্রণ জরুরী। গত বছর সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে এই কথা বলেছিলেন সুজন সম্পাদক ও বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ড বদিউল আলম মজুমদারও।

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!