২২শে আগস্ট, ২০১৫ শনিবার। শিল্পকলা একাডেমির মূলমঞ্চে প্রবেশমাত্রই উপচে পড়া ভিড়ে দিশেহারা বোধ করলাম। নিজের আসনটি খুঁজে পেতে অনেক বেগ পেতে হলো। মঞ্চের সামনের সারিতে তখন বসা নাট্যাঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা। রয়েছেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণায়ের মাননীয় সচিব আকতারী মমতাজ, বিশিষ্ট নাট্যনির্দেশক, নাট্যকার মঞ্চসারথি আতাউর রহমান, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, শব্দসৈনিক আশরাফুল আলম, বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ঝুনা চৌধুরী, আবৃত্তি জগতের বিশিষ্ট জনসহ জাতীয় দৈনিক ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংস্কৃতি বিষয়ক সংবাদকর্মীদের অনেকে।
আমি পেছনের মানুষ। নাটকটিকে পেছন থেকে দেখতেই অভ্যস্থ। কারণ মঞ্চকর্মীদের কণ্ঠটা পেছন পর্যন্ত আসে কি না, তারা যা বোঝাতে চায় তাই আমি পেছনে বসে বুঝি কি না সেটা দেখাই আমার মূল লক্ষ্য। প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা পর্বে বিশিষ্টজনদের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন কিছুটা বিরক্তিকর ছিলো। এ পর্বটা নাটকের শেষে হলে সবচেয়ে ভালো হতো। তাহলে বিশিষ্টজনদের অনেকে নাটক দেখতে বাধ্য হতেন এবং নাটকের মঞ্চায়ন নিয়েও কিছু বলতে পারতেন। কিন্তু তা না করে বক্তব্য রেখে বা শুনে কেউ কেউ চলে গেলেন। আমরা সংবাদকর্মীরা নাটকের মঞ্চায়ন বিষয়ে তাদের মন্তব্য বা অভিব্যক্তি জানতে পারলাম না। যেটা জানা একটি নতুন মঞ্চায়নের জন্য খুবই জরুরী।
যাই হোক আলো নিভে গেলো ৭টা ২০ মিনিটে। শুরু হলো চাঁদ বণিকের পালার শ্রুতি নাট্যয়ন। মিউজিকের তালে মঞ্চের পর্দা উঠতে থাকলো, একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছিলো ভাসমান একটি নৌকা। নৌকার ভেতর বসে আছেন এগারোজন আরোহী। চমৎকার মঞ্চসজ্জা। মঞ্চব্যবস্থাপক সালাম খোকনকে ধন্যবাদ না জানিয়ে উপায় নেই। কারণ প্রথম দর্শনেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন কি ঘটতে যাচ্ছে। নৌকাকে সামনে রেখে ঠিক পেছনেই আরো সাতজন বসে আছেন ডাঙ্গায়। একদম পিছন সারিতে বসে আমি পরিস্কার বুঝতে পারছি নৌকার দল ও ডাঙ্গায় বসা দলটির মধ্যে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। একদল বর্ণনা করছেন ডাঙ্গা ও ঘরের পটভূমি অন্যদল নদীপথে যাত্রার বর্ণনা করছেন। সত্যি চমৎকার। মাঝি মাল্লার পোষাক আর ডাঙ্গার বসাদের পোষাকও ছিলো লক্ষণীয়। পোষাক পরিকল্পক নায়লা তারান্নুম চৌধুরি কাকলি প্রশংসার দাবী রাখেন। নদীর ঢেউ এ নৌকার দুলে ওঠা, দিন-রাতের আলোর তারতম্য, ঝড়ের তাণ্ডব এসবই ছিলো আলো ও হাওয়া নির্ভর। আলোক পরিকল্পনায় হেনরি পলাশ চমৎকার দক্ষতা দেখিয়েছেন এই মঞ্চায়নে। এ মঞ্চায়নের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আবহসঙ্গীতের সমন্বয় ঘটিয়েছেন বিশিষ্ট সঙ্গীত পরিচালক কে.বি. আল আজাদ। তার পাণ্ডিত্য ও সময়োপযোগী সঙ্গীতের ব্যবহার নিয়ে কিছু বলার যোগ্যতাই আমার নেই।
এবার আসি শ্রুতিনাট্যের ধারাবাহিকতায়। “আমাদের পথ সত্য, চিন্তা সত্য, কর্ম সত্য। আমাদের জয় কেউ ঠেকাতি পারে না। ” এই বক্তব্যটিকেই মূলত প্রতিষ্ঠিত করলেন নির্দেশক গোলাম সারোয়ার তাঁর চাঁদ বণিকের পালার এই শ্রুতি নাট্যয়নে। তিনি বলেন, প্রাচীন ও মধ্যযুগের কাব্য পুরাণে ভক্তি প্লাবিত দেবাশ্রিত চরিত্রের অভাব নেই আদৌ। এ ক্ষেত্রে চম্পক নগরীর চাঁদ সদাগর বা চাঁদ বণিক এক বিস্ময়কর ব্যতিক্রম, মানুষের জীবন সংগ্রামে বিশ্বাসী, দেবদ্রোহী, যুক্তিবাদী এই চরিত্রটিকে অবলম্বন করে এ যুগের নট এবং নাট্যকার শম্ভু মিত্র তাঁর এই পালাতে সরবরাহ করেছেন নতুন যুগের সংকট, সংগ্রাম এবং মানবিক দ্বন্দ্বের মানসিক ঘূর্ণাবর্ত। যাতে কাল এবং কালান্তরের বাঙালি যুক্তিবাদী জীবন সংগ্রামে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত হয়। দুর্গতির কালের পচন প্রক্রিয়া ও তার বিরুদ্ধে বীরোচিত প্রতিরোধের নায়কÑ এই শম্ভু মিত্রর পালার বিষয়। প্রতিরোধের ব্যর্থতা নির্ধারিত, তবু নায়কের জীবন সেই প্রতিরোধেই। বাংলার যেখান থেকে ভাঙনের শুরু, সেই তামসের সূচনাকালের বীর নায়ক। কণ্ঠশীলনের উপলব্ধি যে, চাঁদের মতো সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম যুগে যুগে ভালো মানুষদের করে যেতে হবে। কারণ বেণীনন্দদের দল অর্থাৎ নষ্ট মানুষও যুগে যুগে থাকবে।
আবৃত্তি ও বাংলা নাটকের কিংবদন্তি শম্ভু মিত্রের শততম জন্মদিন উপলক্ষে কণ্ঠশীলন আলোচনা সভা ও ‘চাঁদ বণিকের পালা’র মঞ্চায়নের আয়োজন করে । বাংলাদেশে খুব সম্ভব কণ্ঠশীলনই বাংলা নাটক ও আবৃত্তি এই প্রবাদপুরুষের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলো। শুরুর ঐ আলোচনাপর্বে শম্ভু মিত্রকে নিয়ে আলোচকবৃন্দ বলেন- শম্ভু মিত্র বাংলা থিয়েটারের প্রবাদ পুরুষ, কেবলমাত্র অভিনেতা ও নাট্য নির্দেশক হিসেবে নয়, নাট্যাঙ্গনে নব-নাট্য নাট্যচর্চার পথিকৃত হিসেবে তিনি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। শম্ভু মিত্র অনন্য হয়ে আছেন বাংলার মঞ্চে নবযুগের শ্রষ্ঠা হিসেবে।
চাঁদ বণিকের পালা’র চরিত্রায়ণে ছিলেন মীর বরকত, গোলাম সারোয়ার, রইস উল ইসলাম, মোস্তফা কামাল, অনিন্দ্য ইমরান, ইলা রহমান, শফিক সিদ্দিকী, লিটন বারুরী, নুরুজ্জামান নান্নু, মু. কামরুল হাসান, বাদল সাহা শোভন, গোলাম রাব্বানী প্লাবন, অমিতাভ রায়, অনুপমা আলম, আফরিন খান, ফারহানা আক্তার ঈশা, মো. আব্দুল কাইয়ুম ও মো. হাসান মিয়া।
দু’দিন অপেক্ষা করলাম জাতীয় দৈনিকগুলোতে এই মঞ্চায়ন ও শম্ভু মিত্রের শততম জন্মবার্ষিক উদযাপন নিয়ে কি প্রতিক্রিয়া হয় দেখার জন্য। কারণ একেতো বাংলা নাটকের কিংবদন্তিপুরুষ শম্ভু মিত্রের শততম জন্মবার্ষিক ও তাঁরই লেখা নাটক ‘চাঁদ বণিকের পালা’র প্রথম প্রদর্শনীতে ছয়শত’র বেশি দর্শক যেখানে উপস্থিত, তাও শ্রুতিনাট্য উপভোগের জন্য সেখানে এই নাটকের মঞ্চায়ন নিয়ে দৈনিক পত্রিকার বিনোদনপাতায় ঝড় উঠবে বলেই আশা করেছিলাম। অথচ কি আশ্চর্যের বিষয়- অনেকগুলো দৈনিকে – নাটকটি মঞ্চস্থ হবে এই আগাম সংবাদ প্রচার হলো বটে, কিন্তু হওয়ার পরে- কি ঘটলো? অজ্ঞাত কারণে তা কেউই প্রকাশ করলো না। তবে কি এখানেও নোংরা রাজনীতির অবাধ যাতায়াত শুরু হয়ে গেছে? যদিও অসংখ্যা ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদকর্মী বন্ধুদের অনুষ্ঠানটি স্যাটেলাইট চ্যানেলে প্রচারের জন্য। তাঁদের উৎসাহেই আমার এ লেখনি।