‘অসম্ভবকে সম্ভব করার দৃঢ় প্রত্যয় যার
সেইতো রচিবে ইতিহাস;স্মরণে চিরকাল।’
আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ইতিহাস যদি আবার নতুন করে লেখা হয় তাহলে, বর্তমান সময়ের কিছু মানুষের নাম আপনা থেকেই উঠে আসবে ইতিহাসের পাতায়। সঙ্গীত, আবৃত্তি, নৃত্য, মঞ্চনাটক, টেলিভিশনের ছোটপর্দা কিম্বা বড়পর্দার বাংলা সৃজনশীল চলচিত্রে সবখানে, সব মাধ্যমেই মিশে রয়েছেন তাঁরা। শুধু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগতভাবে (গ্রুপ থিয়েটার) নয়, তাঁরা মিশে আসেন স্বপরিবারে। স্ত্রী, সন্তান সবাইকে জড়িয়ে নিজের বসতভিটাকেও পরিণত করেছন সংস্কৃতিক অঙ্গনে।
এইসব ইতিহাস্য মানুষদের নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্বটি সাজানো হয়েছে – আমাদের তারকা পরিবার শিরোনামে। আর এ পর্বে আমরা খুঁজে এনেছি এ সময়ের জনপ্রিয় চারটি মুখের একটি পরিবারকে। সাস্কৃতিক অঙ্গনের সকলের কাছে যারা সুখি পরিবার হিসেবেই বেশি পরিচিত। বলা যায়- একভুবনের চার বাসিন্দা, সঙ্গী চিরকাল।
এই পরিবারের প্রধান ব্যক্তিটি দীর্ঘকায় মানুষ, যিনি নিজেকে গ্যালিলিও চরিত্রেই দেখতে বেশি পছন্দ করেন। পরিবারের মা মনে করেন, তিনি এখনো মঞ্চেই বেশি সাচ্ছন্দ। ছেলেটি ইতিমধ্যেই ছোটপর্দার জনপ্রিয় তারকা আর মেয়েটিকে পর্দায় খুব কম দেখা গেলেও রেডিওর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন চিত্রে তার নেপথ্য কণ্ঠ শুনতে অভ্যস্ত অনেকেই।
চারজনের পরিবার। পরিবারের চারজনই মিডিয়া তারকা। আমাদের প্রিয় মুখ। আলী যাকের এবং সারা যাকের। বিয়ে করলেন। সংসার। পাশাপাশি অব্যাহত সংস্কৃতিচর্চা। দিন গড়িয়ে যায়। এভাবেই সংসার আলো করে একদিন ঘরে আসে ইরেশ যাকের এবং শ্রিয়া যাকের। হাঁটি হাঁটি পা পা করে তারাও একদিন বড়ো হয়। কিন্তু বাবা-মায়ের পৃথিবী ছেড়ে খুব বেশি একটা দূরে যাওয়া হয়না তাদের। অভিনয়, গান, প্রযোজনা, পরিচালনার মাধ্যমেই বেড়ে ওঠে তাদেরও জীবন। একারণেই তাদেরকে সবাই একনামে চেনেন ‘মিডিয়া পরিবার’ বলে!
রথমেই সারাকথন! অর্থাৎ সারা যাকের সম্পর্কে জানবো কিছু তথ্য
‘চোখ তার কবেকার বিদিশার দিশা/ মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য/ অন্ধকার বিদিশার পথে যে নাবিক হারিয়েছে দিশা ‘ — জীবনানন্দকে টেনে এনে গ্যালিলিও খ্যাত আলী যাকের এভাবেই বলেন সারা যাকের সম্পর্কে। একাধারে অভিনেত্রী, নির্দেশক এবং পরিচালক সারা যাকের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি ট্রাস্ট এবং জাদুঘর ট্রাস্টি বোর্ডের অন্যতম সদস্য, আই.টি.আই এর নির্বাহী কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য ও প্রাক্তন চেয়ারপারসন, নাট্যউন্নয়ন প্রকল্পের আহ্বায়ক ও আরও বেশকিছু কার্যক্রমের সাথে যুক্ত ছিলেন ও আছেন।
নাট্যজগতের মাধ্যমেই সারা যাকের তার পেশা আরম্ভ করেছেন। বর্তমানে এশিয়াটিক এমসিএল, রেডিও স্বধীন ও ধ্বনিচিত্র লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। তাদের প্রতিষ্ঠান নয়নতারা নির্মিত শিশু-কিশোরদের জন্য সিসিমপুর বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানটি বেশ কয়েকটি এ্যওয়ার্ড ও স্বীকৃতি লাভ করেছে। ২০০৫ সালে সিনে গোল্ডেন এ্যাওয়ার্ড, ২০০৬ সালে নিউইয়র্ক ফেস্টিভেল এ্যাওয়ার্ড, ২০০৭ সালে সিনে গোল্ডেন এ্যাওয়ার্ড এবং ২০১০ সালে হুগো টেলিভিশন এ্যাওয়ার্ড পেয়েছে সিসিমপুর। বাংলাদেশে শিশু-কিশোরদের জন্য তৈরি আর কোনও অনুষ্ঠান এতো এ্যাওয়ার্ড পায়নি। রেডিও, মঞ্চ, টেলিভিশন-সব জায়গাতেই সারার পদচারণা।
এছাড়াও সারা যাকের অভিনীত চলচ্চিত্র এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী এবং অন্তর্যাত্রা সুধীজনদের প্রচুর প্রশংসা পেয়েছে। নাট্যজন সারা যাকের এই রেডিও স্বাধীন’ স্টেশনটির অন্যতম পরিচালক। মঞ্চ, টিভি ও নিজের বিজ্ঞাপনী সংস্থা দেখভালের পাশাপাশি রেডিও স্বাধীনের এই নতুন দায়িত্ব প্রসঙ্গে সারা যাকের বলেন, ‘এটা অবশ্যই একটা ভাল লাগার জায়গা। কারণ তরুণদের ভেতরে এফএম বিপ্লব যেভাবে ঘটেছে তাতে নতুন কিছু দিতে পারবো বলে আমার বিশ্বাস।’
এছাড়া রেডিও স্টেশন স্বাধীন অন্য একাধিক এফএম স্টেশন থেকে কি ব্যতিক্রম হবে সে প্রসঙ্গে সারা যাকের বলেন, ‘আমরা নিউজ সম্প্রচার করবো না। আমরা ভিউজ প্রচার করবো। তরুণদের ভেতরে সমসাময়িক বিষয়গুলো সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করবো। এছাড়া গান ও অন্যান্য আয়োজন তো রয়েছেই। ৯২.৪ এফএম-এ লগ করলেই রেডিও স্বাধীন শুনতে পারবে ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরবাসী।
সারা যাকরে অভনিতি নাটক সমূহ
অভিনীত নাটক-এর নাম নাট্যদল নাটক মঞ্চায়ন নাট্যকারের নাম / নির্দেশকের নাম চরিত্রের নাম
বাকি ইতিহাস নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় ১৩ই ফেব্রুয়ারী ১৯৭৩ বাদল সরকার / আলী যাকের কণা
বিদগ্ধ রমনীকুল ’’ ১৯৭৩ মলিয়ের এর নাটক রূপান্তর-নি: আলী যাকের মা
এই নিষিদ্ধ পল্লীতে ” ১৯৭৩ এডওয়ার্ড এ্যালবি এর নাটক রূপান্তর-নি: আলী যাকের নীরা
ক্রস পারপাস ” ১৯৭৩ আলবেয়ার কামু রূপান্তর : সৌমিত্র চট্টপাধ্যায়/নি: জিয়া হায়দার বোনের চরিত্রে
বহি পীর নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় ১৯৭৪ সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ/ জিয়া হায়দার ছেলের বৌ- এর চরিত্রে
দেওয়ান গাজীর কিস্সা ” ১৯৭৭ বেরটল্ট ব্রেষ্ট রুপান্তর- নি. : আসাদুজ্জামান নূর চামেলী
সৎ মানুষের খোঁজে ” ১৯৭৬ বেরটল্ট ব্রেষ্ট, রুপান্তর-নি. : আলী যাকের ফুলি
শাহজাহান ” ১৯৭৮ দিজেন্দ্রলাল রায় নির্দেশনা আতাউর রহমান জাহানারা
কোপেনিকের ক্যাপটেন ” ১৯৮০ কার্ল সুখমায়ার নি: আলী যাকের
নুরলদীনের সারা জীবন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় ১৯৮১ রচনা সৈয়দ শামসুল হক নির্দেশনা আলী যাকের
ম্যাকবেথ নাগরিক ও থিয়েটার উইলিয়াম সেক্সপিয়ার ক্রীস্টোফার ও স্যান্ডফোর্ড
কবর দিয়ে দাও নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় এ্যারউইন্স রূপান্তর: জামালউদ্দিন হোসেন আতাউর রহমান
ঈর্ষা ” সৈয়দ শামসুল হক নির্দেশনা আতাউর রহমান একজন মহিলা চরিত্র
নায়ক-নায়িকা ও স্বপ্ন বিলাস ” সৈয়দ শামসুল হক/হুমায়ুন আহমেদ
এবার আমরা সারা যাকের সম্পর্কে জানবো তারই ঘনিষ্টজন রন্ধন বিশেষজ্ঞ ও পুষ্টিবিদ সিদ্দিকা কবীর-এর কাছে।
সিদ্দিকা কবীর জানান, ‘সারা ও আমার সম্পর্ক মামী ভাগ্নী। ১৯৭২ সালের নভেম্বরে সারার বড় মামা সৈয়দ আলী কবীরের সাথে পরিণয়সূত্রে ওদের পরিবারে আমার প্রবেশ। ১৬ নম্বর ইস্কাটন গার্ডেন রোডের নিজস্ব বাড়ি কবীর হাউস এ তখন আমার শ্বশুর সৈয়দ গোলাম কবীর থাকেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আমার দুই ননদ আলিয়া আমিন ও কানিজ ফাতেমা এবং বড়ভাই আলী কবীর বাবার বাড়িতে চলে আসে। সে সময় আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই পাকসেনার দৌরাত্ম্যে এক বাড়িতে একসাথে থেকেছে। ছোটভাই হুমায়ূন কবীর স্ত্রী সাজেদা কবীরসহ নিজ বাড়িতেই ছিলো। আলিয়া আমিনের দুই ছেলে, দুই মেয়ে। সারা তৃতীয় সন্তান। বড় ছেলে চিঙ্কু (এ. এম. জহুর) মুক্তিযুদ্ধে নিখোঁজ হয়। মেয়েদের মধ্যে সবার বড় চিক্সি (সারা যাকের)। ছোটবোন পিক্সি, কাজিন আয়সূ ও আমার মেয়ে বুলা সবার ছোট। ওরা ভিকারুন্নিসা স্কুলের ছাত্রী। চিক্সি হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। ফল প্রকাশের অপেক্ষায় ছিলো সে। তবে অলস সময় কাটায়নি। প্রতিদিন বিকেলে ব্রিটিশ কাউন্সিলে চলে যেতো। সেখানে ওদের নাটকের মহড়া চলতো। চিক্সির বড়মামা আলী কবীর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে শেক্সপীয়রের ওথেলো নাটকে ইয়াগোর অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছিলো। বড়ভাই চিঙ্কুরও নাটকের প্রতি অসম্ভব ঝোঁক ছিলো। সে ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। বিভাগীয় নাটকে অংশগ্রহণ করে সে-ও সবার নজর কেড়েছিলো। নাটকের জন্য সে অনেক সময় ব্যয় করতো। ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর মা আলিয়া আমিন নাটকের জন্য তৈরি চিঙ্কুর পোশাকগুলো প্রায়ই রোদে দিতো, আবার তা সযতনে তুলে রাখতো। এমনি চলেছে কয়েক বছর। সারাও নাটকে সম্পৃক্ত হলো। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নাট্যদল নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় এর সংগঠন ও অনুশীলন সম্পাদক পদে থেকে নাটকের প্রতি ওর আগ্রহ ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের মঞ্চে আমি সারার প্রথম নাটক বাকী ইতিহাস দেখি। ইতোমধ্যে সারার এইচএসসির ফল প্রকাশিত হলো। সে প্রথম শ্রেণীতে পাশ করলো। বাড়িতে সবাই খুশী! একদিন আলী যাকেরকে নিয়ে এলো বাড়িতে ও। ওরা এবং আরও অনেকে একসাথে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা। একসাথে নাটক করে। সারা ও আলী যাকেরের উভয় পরিবারের মুরুব্বিদের সম্মতিতে আনুষ্ঠনিক আয়োজনে ওরা যুগলবন্দি হলো। নিজেরা সংসার আরম্ভ করলো। তবে চিক্সি পড়াশোনা বাদ দেয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন বিভাগে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হলো। যথাসময়ে কোলে এলো ইরেশ। সংসার, সন্তান পালন, নাটক, পড়াশোনা-এতোকিছু একসাথে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলো না। তাই প্রাণ রসায়ন ছেড়ে ইংরেজিতে অনার্স ও মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করেছে সে। পড়া শেষ হয়েছে। প্রথম সন্তানের আট বছর পর দ্বিতীয় সন্তান শ্রিয়ার জন্ম।’
এবারে শোনা যাক আলী যাকের বা ছোটলু কথন
নাট্যজন মামুনুর রশীদ বলেন, যুদ্ধের মাঠে আমাদের পরিচয়। একটা ছোটো হোটেলে আমরা দুপুরে খাচ্ছিলাম। এ পরিচয় থেকেই আলাপের ঘনিষ্টতা। স্বাধীন দেশে নাটক নিয়ে কাজ কারার প্রত্যয় ব্যক্ত করি আমরা।
জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত অভিনেতা আলী যাকের (জন্ম: ৬ই নভেম্বর, ১৯৪৪) যিনি একাধারে টেলিভিশন নাটক ও মঞ্চনাটকে সমান জনপ্রিয়। তিনি একই সাথে দেশীয় বিজ্ঞাপন শিল্পের একজন পুরোধা ব্যাক্তিত্ত্ব। আলী যাকের বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিক এম সি এলের কর্ণধার। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখে আসছেন দীর্ঘসময় থেকে। তাঁর সহধর্মিনী সারা যাকেরও একজন বিখ্যাত অভিনেত্রী। টেলিভিশন নাটকে তাঁর পুত্র ইরেশ যাকের এবং এফএম রেডিও স্বধীন সহ বিভিন্ন এফএম চ্যানেলে শ্রীয়া সর্বোজয়া শ্রুতিনাট্য ও উপস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৭২ সালে আলী যাকের আরণ্যক নাট্যদলের হয়ে মামুনুর রশীদের নির্দেশনায় মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকটিতে প্রথম অভিনয় করেন যার প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে। ১৯৭২ সালের জুন মাসের দিকে আতাউর রহমান ও জিয়া হায়দারের আহ্বানে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে যোগ দেন তিনি। ঐ দলে তিনি আতাউর রহমানের নির্দেশনায় বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন যার প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল ওয়াপদা মিলনায়তনে। ১৯৭৩ সালে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে তিনি প্রথম নির্দেশনা দেন বাদল সরকারের বাকি ইতিহাস নাটকটিতে যা ছিল বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনীর যাত্রা।
এ পর্যন্ত ১৫টি নাটকে ১৫’শ বারের বেশী অভিনয় করেছেন তিনি। নাটকগুলো হচ্ছে-‘কবর’, নির্দেশক-মানুনুর রশিদ। ‘বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ, নির্দেশক-আতাউর রহমান। ‘বাকী ইহিতাস’, নির্দেশক-আলী যাকের। ‘বিদগ্ধ রহনী কুল’ নির্দেশক-আলী যাকের। ‘তৈল সংকট’, নির্দেশক-আলী যাকের। ‘এই নিষিদ্ধ পল্লীতে’, নির্দেশক-আলী যাকের। ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা’, নির্দেশক আসাদুজ্জামান নূর। ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, নির্দেশক-আলী যাকের। ‘অচলায়তন’, নির্দেশক-আলী যাকের। ‘কোপেনিকের ক্যাপ্টন’, নির্দেশক-আলী যাকের। ‘ম্যাকবেথ’, নির্দেশক- ক্রিস্টোফার স্যানফোর্ড। ‘টেমপেষ্ট’ নির্দেশক- ডেবোয়া ওয়ারনার। ‘নুরল দীনের সারাজীবন’, নির্দেশক- আলী যাকের। ‘কবর দিয়ে দাও’, নির্দেশক- আতাউর রহমান এবং ‘গ্যালিলীও’, -আতাউর রহমান।
প্রিয় চরিত্র প্রায় সবই তবে নিজেকে গ্যালিলিও ভাবতে ভালবাসেন তিনি। ব্যাক্তিগত জীবন নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের জন্য বিশ্বখ্যাত বিদেশী নাটকের বাংলা রূপান্তর আর নাটক নির্দেশনা এসব কাজে আলী যাকের ব্যস্ত ছিলেন। ১৯৭৩ সালে ঐ দলে যোগ দেন সারা যাকের যাকে শুরুতে চোখেই পড়েনি আলী যাকেরের। একটি নাটকের প্রদর্শনীর আগের দিন একজন অভিনেত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলে সারা যাকেরকে দেওয়া হয় চরিত্রটিতে অভিনয় করতে। আলী যাকেরের ওপর দায়িত্ব পড়ে তাকে তৈরি করার চরিত্রটার জন্য এবং খুব দ্রুত চরিত্রটির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেন সারা যাকের। এই প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে যান আলী যাকের। ১৯৭৭ সালের এই ঘটনার রেশ ধরেই আলী যাকের আর সারা যাকেরের বিয়ে হয়।
এক ভুবনের চার বাসিন্দা, সঙ্গী চিরকাল
আপনাদের নিজেদের শৈশব এবং আপনাদের সন্তানের শৈশবের মধ্যে কি ধরনের পার্থক্য খুঁজে পান?
সারা যাকের : আমাদের শৈশব নিয়ে একটা জিনিস আছে। ওরা যা পেয়েছে, যেমন, খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে বিদেশ ভ্রমণ, সবকিছুই ঘটেছে অন্যভাবে। তারা বিভিন্ন ফাস্টফুড আর চাইনিজ খেয়েছে। সবকিছুই ওরা একটু বেশি বেশি পেয়েছে। ১০-১৫ বছর আগে ওরা যা পেয়েছে এবং এখন যা পাচ্ছে, তার মধ্যে অনেক তফাৎ। এগুলো নিয়ে তারা মাঝে মাঝে আলাপও করে।
আলী যাকের : আমার শৈশবের সঙ্গে আমার সন্তানের শৈশবের বিস্তর ফারাক। আমার শৈশব কেটেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন মফঃস্বল এলাকায়। শৈশবের বেশির ভাগ এবং আমার কৈশোর জীবন ছিলো সাদামাটা। তাই বলে আনন্দ যে কম ছিলো সেটা নয়। এই আনন্দ কোনো পরিকল্পনামাফিক ঘটেনি। হাতের কাছে যা পাওয়া যেতো তাতেই ছিলো আনন্দ। আনমনে দৌড়ে যাওয়ার আনন্দ, নদীতে সাঁতার কাটার আনন্দ, কাশ বনের ফাঁক দিয়ে ট্রেন দেখার আনন্দ। এই সব ছোটখাটো বিষয়গুলো ছিলো আনন্দদায়ক। এভাবেই কেটেছে আমার দিন। এখন আমার বাচ্চাদের দিন কাটছে অন্যরকম। আমার ছেলের সময়ে ছিলো সাদা-কালো টেলিভিশন, আমার মেয়ের সময়ে এলো রঙীন টেলিভিশন। আমার ছেলেমেয়ে দুজনেই গাড়ি পেয়েছে। তারা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়েছে। আমি পড়েছি সম্পূর্ণ বাংলা মিডিয়ামে। বিশাল ফারাক। মধ্যবিত্ত বলতে যা বোঝায়, সেরকম খাঁটি বাঙালি মধ্যবিত্ত ছিলাম। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আমি বলবো, আমার উভয় সন্তান তাদের শৈশবে আমাদের তুলনায় অনেক বেশি প্রাচুর্য্যের মধ্যেই বড়ো হয়েছে।
আপনি মূলত কোথায় বড় হয়েছেন?
আলী যাকের : আমি বড় হয়েছি ঢাকাতে। আমার আব্বা ছিলেন আর্মিতে। তার চাকরির সুবাদে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে বিভিন্ন সময় থাকা হয়েছে আমাদের।
আপনারা দুজনই ব্যস্ত। দারুণ ব্যস্ততার মাঝেও সন্তানদের গড়ে তুলেছেন, কিভাবে?
সারা যাকের : লেখাপড়ার বিষয়টা আমি দেখি। ব্যাপারটা আলী যাকের আমার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। আমি নিজেই ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশুনা করেছি এবং আমার ছেলেমেয়েদেরকেও ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়েছি। তারা স্কলারশিপ পেয়েছে। বিষয়টি আলী যাকের আমার উপর ছেড়ে দিয়েছিলো। আমার মনে হয়, ব্যাপারটা ঠিকই আছে।
ইরেশ আপনার কি মনে হয় আপনার বাবা-মার শৈশব আপনার শৈশবের চাইতে অনেক বেশি বর্ণাঢ্য ছিলো?
ইরেশ যাকের : না, আমার তা মনে হয় না। তারা তাদের মতো করে তাদের শৈশবকে উপভোগ করেছে। আমি আমার মতো করেছি। তাছাড়া আমার শৈশব অনেক ভালো কেটেছে। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে থিয়েটারে রিহার্সেল দেখতে যেতাম, এটা আমার খুবই ভালো লাগতো। আমি বলবো তাদের শৈশবও ভালো, আমারটাও ভালো।
আপনার বাবা-মা খুবই ব্যস্ত মানুষ। তারা কি আপনাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পেরেছেন?
ইরেশ : হ্যাঁ, পেরেছেন। তারা বরাবরই প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যে সময় কাটিয়েছেন। নাটক করেছেন, আবার অফিসও করেছেন। বলা যায়, ব্যস্ততার সঙ্গে রীতিমতো স্ট্রাগল করেছেন তারা। ফুলটাইম ওয়ার্কার হয়ে ফুলটাইম প্যারেন্ট হওয়াটা খুবই কঠিন একটা ব্যাপার। তারপরও টাইম ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে তাদের উপস্থিতির অভাব কখনোই বুঝতে দেননি আমাদেরকে। যথেষ্ট সময় দিয়েছেন আমাদেরকে।
আপনার বাবা-মা দুজনই খ্যাতিমান। তাদের শক্তি ও দুর্বলতা সম্বন্ধে কিছু বলবেন?
ইরেশ : বাবা-মা দু’জনের ভেতরই সবচেয়ে শক্তিশালী যে বিষয়টা আমি দেখেছি সেটা হলো খ্যাতির প্রতি কখনোই কোনো ধরনের মোহ ছিলো না তাদের। আমার বাবার ভালো দিক বলতে গেলে তার মন-মানসিকতার বিশালতার কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্ব যাকে দেখে কমবেশি সবাই অনুপ্রাণিত হয় এবং অবশ্যই অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন মানুষ তিনি। তার যে দুর্বলতাটা আমি বলবো, তিনি একটু অলস প্রকৃতির। আর আমার মায়ের ভালো দিক হলো, তিনি প্রচন্ড আন্তরিক। যে কাজই করেন, একশো ভাগ আন্তরিকতার সঙ্গে করেন। প্রস্তুতি ছাড়া কোনো কাজ করেন না। আবার তার খারাপ দিক বলতে গেলেও বলবো, এই মাত্রাতিরিক্ত আন্তরিকতাই তার অন্যতম দুর্বলতা। কারণ এই আন্তরিকতার মাত্রাটা এতোই বেশি যে, মাঝে মাঝে সেটা চলে যায় অবসেশনের পর্যায়ে।
শ্রিয়া! আপনিও তো ব্যস্ত একজন মানুষ। এতো ব্যস্ততার মাঝে পরিবারের সবাইকে সময় দেন কিভাবে?
শ্রিয়া : এই যে, আপনাদের কারণে একটা সেশন হয়ে গেলো। আমাদের সবার একসঙ্গে থাকা হলো। এই, মাঝে মধ্যে হয়তো একসঙ্গে খেতে বসলাম। আমার হয়ত দুইদিন আসা হলো না, অবশেষে বকা শুনেই আসতে হলো। এটাকে আমি খুবই উপলব্ধি করি।
বাইরে ঘুরতে গিয়ে কখনো মজার কোনো কিছু ঘটেছে কখনো?
শ্রিয়া : একটা গল্প বলতে পারি। নেপালে গিয়েছি আমরা। তিনজন হোটেলের তিন রুমে। সবাইকে বাই-টাই বলে আসলাম ঘরে। একটু পরই বাবা নক করলেন, দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে – বাবা বলতে শুরু করলেন, তোমাকে আসতেই হবে, আসতেই হবে! আমি বলি, আমি ঘুমাবো তো বাবা। কিন্তু কোনো কথা শুনবেন না। আমাকে নিয়েই যাবেন। তো গেলাম। আমার হাত ধরে বল্লেন, আকাশের দিকে তাকাও। সেদিন আকাশে অনেক তারাও ছিলো! আমি কোনদিনও সে রকম কোনো আকাশ দেখিনি। এটা মনে পড়লে খুবই মজা লাগে। অনেক পাহাড় চূড়ায় উঠেছি সেবার। অনেক মজা করেছি।
আপনাদের পরিবারকে মিডিয়া পরিবার বলা হয়। বিষয়টাকে কতটা উপভোগ করেন?
আলী যাকের : এটা আসলে নিতান্তই কাকতালীয়। আমি আর সারা মঞ্চ দিয়ে জীবন শুরু করেছি। মঞ্চে যে নাটকগুলো হতো, পরবর্তীতে সেগুলো আবার টিভিতে করেছি। বেসিক্যালি আমরা মঞ্চের অ্যাক্টর। মঞ্চের ডিরেক্টর। ফ্রেন্ডলি স্পিকিং, আমি সেভাবে পেশাদারি নাটক করি না। আগে অভিনয়ের জন্য একটা অ্যামাউন্ট নিতাম। দেখা যায়, অনেক সময় অনেকে আসে স্ক্রিপ্ট নিয়ে। আমার হয়তো পছন্দ হয়নি, তখন ছোট ভাইয়ের মত এসে ধরে। আর মিডিয়ার কাজ জাস্ট একটা বিজনেস!
ইরেশ : আমি কিন্তু মনে করি না, আমরা মিডিয়া পরিবার। এটা ঠিক যে আমরা সবাই মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত। তবে আমরা কেউই কিন্তু ফুলটাইম পারফর্মার নই। আমরা সবাই মিডিয়ার কাজের পাশাপাশি রীতিমতো অফিস করছি, পারিবারিক ব্যবসা দেখছি। কাজেই আমি বলবো যে আমরা মিডিয়া পরিবার নই।
সারা যাকের : আলী যেটা বলেছে আসলে সেটাই ঠিক। সবকিছু কাকতালীয়ভাবে হয়ে গেছে। আমরা মঞ্চে কাজ শুরু করি। তখন বিজ্ঞাপনের সাথে মঞ্চের কোন সম্পর্ক ছিলো না। কিন্তু ক্রমে ক্রমে, এই পথ ধরেই একদিন টেলিভিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া। আরো পরে, প্রকাশনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া। এখন যখন একটা দোকানে যাই, শুনতে হয়, দ্যাখ দ্যাখ, এটা আলী যাকেরের বউ না! এরা কত বছর আগে থেকে মিডিয়াতে আছে। আমি মনে করি, আমরা এখনো অভিনয় করে যাচ্ছি বলেই ওরা মনে রাখছে। মঞ্চেই আমরা ব্রাইট, ওটা আমরা সবসময় ভালভাবে করার চেষ্টা করি। আমাদের একটা প্রোডাকশান হবে, আমি এটার ম্যানেজিং ডিরেক্টর হবো, এরকম কোনোদিনও ভাবিনি। এটা কাকতালীয়ভাবে হয়ে গেছে।