আবু হাসান শাহরিয়ার এর স্মৃতিগাঁথা

অতিথি লেখক

Sharing is caring!

shahariar 02(আবু হাসান শাহরিয়ার ভাইয়ের ফেসবুক পেজ থেকে গৃহিত)

পৃথিবীরও মাটির শরীর
নদীগুলো, মেঘগুলো শিরা ও ধমনী
সাগরের পেন্ডুলামে হৃদপিণ্ড দোলে
নদীতে-নদীতে বয় জলরক্তধারা
মেঘে-মেঘে রক্তকণা শুদ্ধ হয়ে ফেরে।

নদী-মেঘে পৃথিবীর প্রাণ
গাছেরা শিক্ষক, জীববিদ্যা পড়ান।

[আবু হাসান শাহরিয়ার/পৃথিবীকথন/এবছর পাখিবন্যা হবে]

অামার কোনও কবিতার অন্তঃশীল বাণী যদি আলোকচিত্রী আজহার উদ্দীনের মতো একজন পাঠকেরও মর্মমূলে পৌঁছয়, সার্থক আমার কবিতাজীবন। শেয়ারকৃত এই স্ট্যাটাসই ফেসবুক বন্ধুদের কাছে আমার সবুজ ঈদকার্ড।

উৎসবে-আনন্দে সঞ্চারিত হোক বৃক্ষপ্রেম।

দুই

সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই
-চণ্ডীদাস

shahariar 01একবার কবি শামসুর রাহমান এক রাজনৈতিক গদ্যে ‘পাখির মতো গুলি করে মানুষ মারা হচ্ছে’ কথাটি লিখলে জিজ্ঞেস করেছিলাম– “পাখির মতো গুলি করে লিখলেন যে? পাখির প্রাণের কি মূল্য নেই?” আমার কথায় তিনি ঈষৎ ক্ষেপে গিয়ে বলেছিলেন– “পাখি আর মানুষ কি সমান হল?” প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে আমি সাফ-সাফ জবাব দিয়েছিলাম– “আমি কি বলেছি ’সমান’? মানুষের চেয়ে পাখি অনেক ভালো।”

আমার পরের কথাটি হাসিমুখে মেনে নিয়েছিলেন শামসুর রাহমান। তারপর চণ্ডীদাসের ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ থেকে জীবনানন্দ দাশের দুটি পংক্তি ছুঁয়ে ফররুখ আহমদ ও আল মাহমুদ প্রাসঙ্গিক কিছু কথা হয়েছিল আমাদের মধ্যে। সৈয়দ আলী আহসানের সাম্প্রদায়িক বক্তব্য-লেথালেখি নিয়েও কথা বলেছিলাম আমরা।

জীবনানন্দ দাশের সেই পংক্তি দুটি তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘ঝরাপালকের ‘নিখিল আমার ভাই’ শিরোনামের কবিতাটিতে আছে– “নিখিল আমার ভাই/কীটের বুকেতে যেই ব্যথা জাগে আমি সে বেদনা পাই।”

লেখা বাহুল্য– শামসুর রাহমানের সঙ্গে অনেক বিষয়ে মতদ্বৈধতা থাকলেও আমাদের মধ্যে কখনও মতবিরোধ হয়নি। শামসুর রাহমান প্রাসঙ্গিক আমার গদ্য-সংলাপের বই ’আমরা একসঙ্গে হেঁটেছিলাম’ যাদের পড়া আছে, তারা বিষয়টি জানেন। তবে, সেদিন আমাদের আলোচনা মতৈক্যে পৌঁছেছিল। বাঙলা সাহিত্যের অনেক মুনি-ঋষির সাহিত্যকর্ম নিয়েও কথা হয়েছিল সেদিন। কথায়-কথায় উঠে এসেছিল রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ প্রসঙ্গ। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে লেখা অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের একটি স্মরণ-গদ্যও প্রসঙ্গ হয়েছিল আমাদের আলোচনার। সেখানে অচিন্ত্য বলেছিলেন– “ ’সবার উপরে মানুষ সত্য’– এ আপাতবাক্যে সে (তারাশঙ্কর) বিশ্বাস করেছে কিন্তু ‘তাহার উপরে নাই’ এই শূন্যবাদ– এই নেতিবাদে সে আচ্ছন্ন হয়নি।”

সেদিনের আলোচনায় শামসুর রাহমান ও আমি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম যে– প্রকৃত কবিকে রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে উঠে বৈশ্বিক, ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ এবং মানুষের ঊর্ধ্বে উঠে সর্বপ্রাণময় হতে হয়। কবিচৈতন্যের এ ঊর্ধগামিতা একটি অশেষ প্রক্রিয়া।

পরবর্তী সময় আমার দুটি গদ্যে (কবিতার বাঁক অথবা বাংলা কবিতার ৫০ বছর’ ও ‘বাংলা কবিতার বিপরীতবিহার : সাম্প্রতিক পাঠ’) সেদিনের সিদ্ধান্ত যুক্তি-তর্কসমেত বিশদে এসেছে। দ্বিতীয় প্রবন্ধটিতে ফররুখ আহমদ ও সৈয়দ আলী আহসানকে আবহমান বাংলা কবিতা থেকে খারিজ করে দিয়েছি আমি। বাংলার কাদামাটিমাখা জাতকবি হওয়ার পরও আল মাহমুদকে নিয়ে প্রকাশ করেছি সংশয়। কারণ একটাই– ঊর্ধ্বগামিতার পরিবর্তে তার কবি-চৈতন্যের অধঃগামিতা।

ধর্মকাব্যের মধ্যযুগেও সূফি ও বৈষ্ণব কবিরা সর্বধর্মীয় মানবতার চর্চা করেছেন। অাধুনিক যুগের কবি হয়েও ফরুরুখ, আলী আহসানের মতো যারা বিশেষ কোনও ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি, বাংলা কবিতার মূলধারা তাদের বর্জন করেছে। আমার ধারণা, অাল মাহমুদের জন্যও সেই একই পরিণতি অপেক্ষা করছে। অথচ কবিতাজীবনের প্রথমভাগে তিনি বিশ্বাস করতেন– “ধর্ম উঠে গিয়ে কবিতাই তার স্থান দখল করবে।”

হুমায়ুন আজাদ তার ‘আধুনিক বাঙলা কবিতা’ সংকলনে ফররুখ আহমদ, সৈয়দ অালী আহসান ও অাল মাহমুদকে বাদ দিয়ে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। ধারণা এই যে, ভবিষ্যতের কাব্যসমালোচকদের হয়তো লিখতে হবে– অাল মাহমুদ একজন জাতকবি হিসেবেই বাংলা কবিতায় আবির্ভূত হয়েছিলেন, কিন্তু বিশ্বমানবতা ও সর্বপ্রাণময়তাকে ছুঁতে না-পারায় পাঠক তাকে মনে রাখেনি।

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!