একজন রাজনৈতিক নেতার মেনিফেস্টো’ (১৯৮৩) নিয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের রাজপথে অংশ নিয়েছিলেন কবি মুহম্মদ সামাদ (১৯৫৮)। দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি সাহসী ও নিরাপস ভূমিকা পালন করেছেন শারীরিক অংশগ্রহণ কিংবা লেখনীর মাধ্যমে। সরকারি কলেজের শিক্ষক হয়েও তিনি এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠনে ও পরিচালনায় পালন করেছেন কার্যকর ভূমিকা। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কর্মসূচীতেও তাঁর উপস্থিতি ছিল যথারীতি। কিন্তু তাঁর মূল শক্তি কবিতাকে তিনি শাণিত রেখেছেন বরাবর। সরকারি কলেজ ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পরে তাঁর রাজনৈতিক ভূমিকা আরো বৃদ্ধি পায়। কবিতাচর্চা এবং কবিতা পরিষদের আন্দোলনে তিনি আরো গতিময় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন। এরশাদের পতনের আগেই তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘আমি নই ইন্দ্রজিৎ মেঘের আড়ালে’ (১৯৮৫) এবং ‘পোড়াবে চন্দন কাঠ’ (১৯৮৯) প্রকাশিত হয়। গোটা আশির দশকই ছিল সংগ্রামমুখর। নব্বই দশকে এসে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। মুহাম্মদ সামাদের কাব্যচর্চায় তার প্রভাব পড়ে। তিনি অবলীলায় রচনা করেন ‘চলো, তুমুল বৃষ্টিতে ভিজি’র (১৯৯৬) মতো রোম্যান্টিক কবিতা নিয়ে নতুন কাব্যগ্রন্থ।
‘একজন রাজনৈতিক নেতার মেনিফেস্টো’ গ্রন্থে মাত্র চারটি কবিতা স্থান পায়। নামকবিতায় রাজনৈতিক নেতার বক্তৃতার ঢঙে তিনি দেশের পঁচাত্তর-উত্তর পরিস্থিতির বিবরণ দিয়েছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরে যারা অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা ভোগ করেছেন, তাঁদের রাজনৈতিক মুখোশ উন্মোচনে সহায়ক এই কবিতা। ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ ও শ্লেষপূর্ণ কথকতায় তিনি এঁকেছেন কঠিন বাস্তবতার বিশ্বস্ত চিত্র। গণবিরোধী অবৈধ সরকারের নেতাদের বাসনাকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন শ্লেষাত্মক বাক্যবন্ধে-
ঘাতকের নির্মম বুলেটে বজ্রকণ্ঠ স্তব্ধ হোক
সবংশে নিশ্চিহ্ন হোক স্বাধীনতার মহান স্থপতি
শান্তিপূর্ণ মিছিলে অবৈধ অস্ত্রের ব্যারেল থেকে ঝরুক বুলেটের ঝাঁক
দুখিনীর বুকের মানিক ঢলে পড়–ক কালো রাজপথে
আইনের অন্যায় ষড়যন্ত্রে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুদণ্ড হোক
পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান জেলের অভ্যস্তরে
নৃশংস হত্যা হোক রাজবন্দিদের। [এ.রা.নৈ.নে.মে.]
এই কবিতা যে বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিরুদ্ধে, জেলহত্যার বিরুদ্ধে এবং সকল হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী উচ্চারণ তা সহজেই বোঝা যায়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উৎস হিসেবে ব্যবহারের প্রতিবাদ করেছেন কবি। জনসভায় বোমাহামলা কিংবা সৈনিকের সক্রিয় রাজনীতি করারও প্রতিবাদ করেছেন তিনি। টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া, ছাত্রের হাতে সম্মানিত অধ্যাপকের লাঞ্ছিত হওয়া, অভিভাবকের প্রহারে নিরীহ শিক্ষকের মৃত্যু, হল-হোস্টেলে অস্ত্রের ভাণ্ডার নির্মাণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হওয়ার মতো অনৈতিক-অপ্রীতিকর-অমানবিক-অস্বাভাবিক ঘটনারও তিনি প্রতিবাদ করেন কাব্যের ভাষায়। কবি সোচ্চার হয়েছেন চোরাচালানির বিরুদ্ধে, নতজানু পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে, শিল্পসাহিত্যে অশ্লীলতার বিরুদ্ধে, ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে, উন্নয়নের নামে অনিয়ম ও লুটপাটের বিরুদ্ধে। দেশের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রের ক্ষতি ও সর্বনাশ দেখে কবির হৃদয় বিদীর্ণ হয়। তারই শিল্পিত প্রকাশ সুদীর্ঘ এই কবিতা। বলা যায়, মোশতাক-জিয়া-সাত্তার আমলের যাবতীয় অপশাসনের বিরুদ্ধে কবি প্রবল ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন এই কবিতাকে। সাত্তার-পরবর্তী এরশাদের স্বৈরশাসনের প্রথম দিককার কিছু চিত্রও এতে পাওয়া যাবে। মুহাম্মদ সামাদ কেবল কবির কোমল হৃদয় ধারণ করলে এই কবিতা নির্মাণ করতে পারতেন না। রাজনৈতিক কর্মীর সাহসী হৃদয়কে তিনি ধারণ করেন বলেই তার হাতে এই কবিতা ফুটে উঠেছে।
এই কাব্যের দ্বিতীয় কবিতা ‘পিকনিকের ছবি’তে রয়েছে দুর্ভিক্ষের চিত্র। ‘মনে থাকবে’ কবিতায় কবি অতীতচারী ও স্মৃতিকাতর এক গ্রাম্য বালক। কবিতার ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পেয়েছে শৈশবের স্মৃতি। দেশপ্রেমের চেতনায় লালিত শৈশবের স্মৃতি প্রকাশিত হয়েছে ছন্দোবদ্ধ চরণে-
ফিরোজ রনু বাচ্চু চাচা
আমরা তখন ক্ষ্যাপা কিশোর
মিছিল মিটিং জনসভায়
লাঠির আগায় নিশান রেঁধে
আকাশ ফাটা স্লোগান দিতাম
‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো
জয়বাংলা স্বাধীন করো’।
[মনে থাকবে, এ.রা.নৈ.নে.মে.]
মুক্তিযুদ্ধের সময় কবি ছিলেন তের বছরের কিশোর। বাংলাদেশের একটি গ্রামের সম্প্রীতির ছবি আঁকা হয়েছে এই কবিতায়। কবির স্মৃতি আছে যাত্রাগান, জারিগান, শহিদ দিবস, পত্রিকা প্রকাশ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রভৃতি। ‘পুজোর সময় লুচি-সন্দেশ মুড়ি-মোয়া’, ‘কলেজ ফেরা সুন্দরীদের শাড়ির আঁচল ওড়না ওড়া’,‘লাস্যময়ী মিনা’র সাথে হাওয়াই প্রেমের মিষ্টি আমেজ’, ‘লক্ষ্মী মেয়ে অরুণা পাল’, ‘শিলা দাসের খোলামেলা রৌদ্র-মেঘের স্নিগ্ধ স্বভাব’ কবি চিরদিন মনে রাখতে চান। এইসকল সবুজ স্মৃতিকে দিনি ধরে রেখেছেন কবিতার ছন্দে। ‘সমুদ্রের দিকে যাচ্ছি’ কবিতায় আবার ফিরে গেছেন রাজনীতিতে। যে রাজনীতি তাকে কবিতা থেকে দূরে তাকতে বলে, সেই রাজনীতিকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। একজন বুর্জোয়া নেতা তাঁকে ভালোবেসে কাছে টানতে চেয়েছিলেন। তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। একজন বিলাসী আমলা তাঁকে আমলা হতে বলেছিলেন। কবি তাকে অমান্য করে কবিতার দিকেই ফিরে গেছেন। একজন বয়সী সমালোচক তাঁর কাঁচা হাত আগুনে দিতে মানা করেছিলেন। কিন্তু কবি সেই কাঁচা হাতকে পাকা করার সাধনা করেছেন। কবি রাজনীতিকে অবজ্ঞা করেননি, রাজনীতিকে অঙ্গীকার করেই কবিতা লিখেছেন। তবে সেই রাজনীতি অবশ্যই দেশের বঞ্চিত মানুষের ভাগ্য ফেরানোর রাজনীতি ছিল। বিসিএস দিয়ে আমলাতন্ত্রেও যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু আরো উত্তরণ ঘটিয়ে তিনি যোগ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর কাঁচা হাতকে সম্বল করেই তিনি এগিয়েছেন। তাঁর সময়ের অগ্রগণ্য কবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিপথগামিতার হাতছানি তাঁকে গন্তব্য থেকে ফেরাতে পারেনি। অনড় এবং আপসহীন মনোবৃত্তিই মুহম্মদ সামাদের মৌল অবলম্বন। সামাজিক বিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে কনসালটেন্সি করে টাকার পাহাড় বানানোর যোগ্যতা তাঁর রয়েছে। কিন্তু তিনি পড়ে রইলেন কবিতা নিয়ে। কবিতার প্রতি এই প্রেম তাঁকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে পারে না। তাঁর গলায় তাই শোভা পায় কবিতার বরমাল্য।
‘আমি নই ইন্দ্রজিৎ মেঘের আড়ালে’ কাব্যে কবি আগের চেয়ে বেশি রাজনীতিপ্রবণ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু শিল্পপ্রকরণকেই তিনি অঙ্গীকার করেছেন একই সঙ্গে। হিন্দু পুরাণের চরিত্র ‘ইন্দ্রজিৎ’ এসেছে তাঁর কবিতার নায়ক হয়ে। মহাকাব্য ‘রামায়ণে’র ইন্দ্রজিতের অপর নাম মেঘনাদ। রাবণের পুত্র এই মেঘনাদ। এই মেঘনাদকে অন্যরূপে পাওয়া যায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধকাব্য’-গ্রন্থে। মাইকেলের মেঘনাদকে নয়, কৃত্তিবাসের ইন্দ্রজিৎকে গ্রহণ করেছেন কবি মুহম্মদ সামাদ। ইন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধে জিতেছিলেন বলে তিনি ইন্দ্রজিৎ। তিনি রাম-লক্ষ্মণকে বধ না করে ঘরে ফিরবেন না বলে শপথ করেন। মেঘের আড়ালে বসে যুদ্ধ করেও তিনি নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি। সেই মিথকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে কবি মুহম্মদ সামাদ বলতে চান যে, তিনি মেঘের আড়ালে যুদ্ধ করে পরাজিত হওয়া ইন্দ্রজিৎ নন। তাই তিনি সম্মুখ-সমরে বিজয়ী হওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। এখানে কবির উন্মুক্ত ঘোষণা-
সাতসকালে পর্দা তুলে পালাও কোথাও?
সারারাত্র দুধ খেয়েছে
তোমার দাঁতের কাটা দাগে বিক্ষত বাঁট
লজ্জা কীসের, ভয় পাচ্ছ?
আমি জন্মযোদ্ধা ইন্দ্রজিৎ
ঘন মেঘের আড়াল থেকে
আমার এখন আলোয় স্থিতি।
[আ.ন.ই.মে.আ.]
এই কাব্যের ‘মুজিব’ নামের কবিতাটি যথেষ্ট জনপ্রিয়। মুহাম্মদ সামাদের কবিখ্যাতির পেছনে এই কবিতার ভূমিকা ব্যাপক বললে অত্যূক্তি হয় না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে মুহাম্মদ সামাদ অনেক কবিতা লিখেছেন। এ সম্পর্কিত প্রতিটি কবিতায় জনপ্রিয়। তবু ‘মুজিব’ কবিতার গুরুত্ব অপেক্ষাকৃত বেশি বলেই মনে হয়। কবিতার প্রথম অনুচ্ছেদ অনেকেরই মুখে মুখে ফেরে-
মুজিব আমার স্বপ্ন-সাহস
মুজিব আমার পিতা
মুজিব আমার শৌর্যে-বীর্যে
নন্দি সংহিতা।
[মুজিব, এ.রা.নৈ.নে.মে.]
এই কবিতার ‘মুজিব আমার শিরায় শিরায় রক্তে রক্তে প্রেম’, ‘মুজিব আমার স্বাধীনতার অমর কাব্যের কবি’, ‘মুজিব আমার বাংলা জুড়ে একটি লাল গোলাপ’ প্রভৃতি চরণও যথেষ্ট জনপ্রিয়। তাঁর এই কবিতার চরণ দেয়ালের লিখন হয়েছে। একজন কবির জন্য এটি কম বড় পুরস্কার নয়! তিনি স্লোগান লেখেননি, কিন্তু তাঁর কবিতা হয়ে গেছে মন্ত্রপূত স্লোগান। এটিও কম সৌভাগ্যের ব্যাপার নয়! মুহাম্মদ সামাদের কবিতা ঠাঁই পেয়েছে শহরের দেয়ালে, মানুষের হৃদয়ে।
‘পোড়াবে চন্দন কাঠ’ কাব্যে মুহাম্মদ সামাদ রাজনীতির ভাষ্যকে কিছুটা আড়ালে নিয়ে গিয়ে শিল্পের সন্ধান করেছেন। এখানে রাজনীতি আছে চেতনায়। রাজনৈতিক বক্তব্য আছে কবিতার অন্তরালে। কবি যেন খুঁজে পেয়েছেন তাঁর আসল কাব্যভাষা। বলা যেতে পারে ‘একজন রাজনৈতিক নেতার মেনিফেস্টো’ দিয়ে যে কবির যাত্রা শুরু,‘আমি নই ইন্দ্রজিৎ মেঘের আড়ালে’ (১৯৮৫) লিখে তাঁর পরিচিতি, ‘পোড়াবে চন্দন কাঠ’-এ এসে তাঁর স্বীকৃতি লাভ। বক্তব্য প্রকাশে কবি এখানে সংযত ও সংহত। রাজনীতির চেয়ে শিল্পের দায়পূরণে কবি এখানে বেশি সতর্ক ও সচেষ্ট। তাই ‘একটি রাজনৈতিক কবিতা’ শিরোনামের কবিতায়ও তাই রাজনীতিগন্ধী শব্দের সমাহার নেই-
মেয়েটির পুষ্পিত হৃদয় ছিল মোরগ ফুলের মতো টকটকে লাল
ভরপুর রক্ত আর আবেগের উষ্ণ প্রস্রবণ
কাপ্তাই হ্রদের মতো লহমায় উজ্জ্বল করতো অন্ধকার!
বাংলার দো-আঁশ মাটির মতো ওর বুক ছিল
কামার্ত, উর্বর।
[‘একটি রাজনৈতিক কবিতা’, পো.চ.কা]
এখানে ‘মেয়েটি’ নয় কেবল রক্তমাংসের কোনও মেয়ে, ‘মেয়েটি’ হতে পারে কোনও দেশ কিংবা কোনো ভূখণ্ড। ‘মেয়েটি’ হতে পারে নেপাল, আফগানিস্তান কিংবা বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের মতো কোনও অশান্ত ভূমি। মুহাম্মদ সামাদের কবিতাও এভাবে ক্রমশ হয়ে ওঠে ব্যঞ্জনাময়। ‘বৃক্ষ’ নামের এগারটি কবিতায় এ-কাব্যে মূল ভাবনা কেন্দ্রীভূত হয়েছে। কবি এখানে প্রকৃতিপূজারী অর্থে দেশপ্রেমিক। এই কবিতায় কবি পুরাণের ব্যবহার করেছেন বেশ দক্ষতার সঙ্গে। কাব্যের নামেও রয়েছে পুরাণের ব্যবহার। চন্দনকাঠ দিয়ে পোড়ানো হয় মানুষের শব। চন্দনকাঠে পোড়ানোর মধ্য দিয়ে একটি জীবনের সফল সমাপ্তি সূচিত হয়। চন্দনকাঠ এখানে জীবনের অন্তিম অর্থাৎ চূড়ান্ত অবস্থার প্রতীক। কবি এই সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ অনুষঙ্গ অনুসন্ধানের প্রমাণ পাওয়া যায় সর্বত্র। ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী কবি তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমেও সেই চেতনার প্রকাশ করেন।
‘চলো, তুমুল বৃষ্টিতে ভিজি’ কাব্যে কবির অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। ‘গাঁয়ের মন্দির’ নামের কবিতায় স্মৃতিকাতর কবির পর্যবেক্ষণ-
সন্ধ্যায় কাঁসর-ঘণ্টা উলুধ্বনি খোল-করতাল
কিছুই বাজে না আজ।
কাঁপে না কিশোরী-বুক, নাচে না তল্লাট, ছোটে না কিশোর।
….
তবুও কঁকিয়ে ওঠে
সিঁদুরের ফোঁটা
লাজুক ঘোমটা সাদা শাঁখা মাটির প্রতিমা
বোন
আমাদের গাঁয়ের মন্দির।
[গাঁয়ের মন্দির, পো.চ.কা]
গাঁয়ের মন্দির নিয়ে লেখার উৎসাহ আমাদের কবিদের মধ্যে খুব একটা থাকার কথা নয়। মৌলবাদীদের টার্গেট হওয়ার আশঙ্কাকে তো আর উড়িয়ে দেয়া যায় না! তাছাড়া কায়মনে বিশুদ্ধ অসাম্প্রদায়িক মানুষের সংখ্যাও তো কমে যাচ্ছে দিনদিন। এইরকম নিশ্চেতনার কালে কবি মুহাম্মদ সামাদ অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করে চলেছেন জীবনাচরণে এবং সৃষ্টিসম্ভারে। কবল পুরাণের উপকরণ খোঁজার জন্য মুহাম্মদ সামাদ অন্য ধর্মের সংস্কৃতির দ্বারস্থ হননি, প্রতিবেশী সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং বাঙালি সংস্কৃতির অনুষঙ্গ বিবেচনা করেন বলেই ইন্দ্রজিৎ কিংবা চন্দনকাঠ হয়ে ওঠে তাঁর কাব্যগ্রন্থের শিরোভূষণ।
প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী ব্যক্তিমাত্রই অনির্বাচিত সরকার কিংবা সামরিক সরকারে বিরোধী হয়ে থাকেন। মুহাম্মদ সামাদও তাঁর ব্যতিক্রম নন। এই নিবন্ধটি যখন লিখছি তখন নির্দলীয় সরকারের নির্দেশে দেশে কার্ফ্যু চলছে (২৩.০৮.২০০৭)। আর কার্ফ্যুর মধ্যে ঘরবন্দী আমি পড়ছি মুহাম্মদ সামাদের ‘সামরিক জান্তার কার্ফ্যুর প্রতিবাদে’ নামের কবিতা। কার্ফ্যু ঘোষণার আগের কয়েকটি মুহূর্তের তিনি চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন-
সন্ধ্যার আজানে
আমার মা মাথায় আঁচল তুলে নিয়ে যখন
জায়নামাজে বসবেন প্রার্থনায়
কাঁসার-ঘণ্টার ডাকে
ঘোমটা লাজুক সাদা-শাঁখা বধূটি যখন
মাটির মন্দিরে দেবে অর্ঘ্য- প্রণত প্রণাম
গির্জার ঘণ্টায় শান্তির ললিত সুর যখন ধ্বনিত হবে
ত্রাণকর্তা যিশুর পবিত্র কণ্ঠে
…..
ঠিক তখনই, এই পড়ন্ত বিকেলে
হ্যামেলিনের শিশুহন্তারক বংশীবাদকের মতন
বাংলাদেশের উদ্ভট হীরক রাজা তার
বাঁশিতে চড়িয়ে দিল গণ্ডরের ঠোঁট।
[‘সামরিক জান্তার কার্ফ্যুর প্রতিবাদে, চ.তু.বৃ.ভি]
এখন সামরিক স্বৈরাচার নেই। কিন্তু কার্ফ্যু আছে। তাই ওই কবিতাকে তেমন পুরোনো মনে হয় না। এবং আমরা লক্ষ্য করি যে কবি মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রার্থনার কথা একই মর্যাদায় উল্লেখ করে দেশে সকল ধর্মের সহাবস্থানের কথা প্রকাশ করেছেন। এটিই কবির কাক্সিক্ষত মানব-সমাজ।
‘দাদিমার শুয়োর পেটানো লাঠি’ নামে মুহাম্মদ সামাদের চমৎকার কবিতা আছে। শুয়োরের প্রতীকে তিনি আসলে সামরিক জান্তার মুখচ্ছবিই এঁকেছেন। প্রতীক ও রূপক অলঙ্কারের কারণেই এই কাব্য বেশি শিল্পসফল, সংহত ও সংযত আবেগের কারণে এই কাব্যে মুহাম্মদ সামাদ হয়ে উঠেছেন পুরোদস্তুর কবি।
এই চারটি কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতাসমগ্র’ (২০০০) নামে গ্রন্থিত হয়েছে। এর পরেও কবি বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন। পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেই সকল কবিতায় আমরা একজন পূর্ণাঙ্গ কবিকে প্রত্যক্ষ করি। অনুশীলন ও সাধনার পথ পেরিয়ে কবি ক্রমশ সিদ্ধির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছেন দেখে পরবর্তী প্রজন্মের পাঠকের ভালো লাগে। কবির কলমে এখন ধরা দিচ্ছে প্রেমের কবিতা। অরুণা হয়ে উঠেছে কবির মানস-প্রেমিকা। জীবনানন্দ দাশের যেমন ‘বনলতা সেন’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের যেমন ‘নীরা’, বিনয় মজুমদারের যেমন ‘গায়ত্রী’, উত্তম দাশের যেমন ‘রুণু’, মুহাম্মদ সামাদের তেমনি ‘অরুণা’। এই অরুণাকে নিয়ে কবি লিখেছেন বেশ কয়েকটি হৃদয়ছোঁয়া কবিতা। অরুণাকে নিয়েই তাঁর নতুন কবিজীবন শুরু হয়েছে। কবিতাতেই রয়েছে তাঁর স্পষ্ট স্বীকারোক্তি-
এই শীর্ণ দেহে এত প্রেম আর খেলা ছেলেবেলা
এই লক্ষ্মীমন্ত মাটির সঞ্চিত ধন
অরুণা, তোমার আলিঙ্গনে ঋদ্ধ হলো
কবি’র কলম পেলো নতুন জীবন।
[অরুণা, তোমার আলিঙ্গনে]
মুহাম্মদ সামাদ কবিতাচর্চাকে জীবনেরই অঙ্গ করে নিয়েছেন। প্রাচুর্যের হাতছানি তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। সাধারণ জীবনযাপনেই অভ্যস্ত তিনি। স্ত্রী-কন্যা নিয়ে সুখী সংসার তাঁর। কিন্তু ‘সাতে-পাঁচে নেই’ স্বভাবের নন তিনি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি বরাবরই সোচ্চার। বঞ্চিত মানুষের প্রতি তিনি আন্তরিক সহানুভূতিশীল। ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতির চেয়ে জাতীয় প্রয়োজনের প্রতি তাঁর প্রবল পক্ষপাত। আর এই সকল কারণেই কাব্যলক্ষ্মী তাঁকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেননি। প্রতিবার অঞ্জলি ভরেই তিনি ক্রমশ শুদ্ধতার দিকে ছুটে চলছেন। তাঁর কাব্যকুশলতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার মৌহূর্তিক নিবেদন-
একজন অরুণার ডাকে তুমি শেষতক ঘুরিয়েছ ঘাড়
মেঘের আড়ালে তুমি নও জানি ইন্দ্রজিৎ জন্মযোদ্ধা বীর-
প্রকাশ্যে লড়াই করে একা জিতে নিতে চাও প্রেমের পাহাড়
তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে অরুণাকে পেতে কত অপেক্ষা অধীর!
রাজনৈতিক নেতার মেনিফেস্টো হাতে নিয়ে এসেছিলে জানি
পিছু ডাকে ফিরবে না, সমুদ্রের দিকে যাবে – তোমার ঘোষণা
পোড়াবে চন্দন কাঠ কে তোমাকে শুনিয়েছে এই শেষ বাণী
চিরন্তন কাব্য লিখে কেন তবে লক্ষ বর্ষ বাঁচার বাসনা?
অরুণা কি রাধা ছিল পূর্বজন্মে? কেন এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলে?
তুমি কি আয়ান ঘোষ? নাকি কৃষ্ণ? নাকি মহাভারত-নায়ক
তুমি কি জানো না হায়-‘কানু ছাড়া গীত নাই’ ভুবনে নিখিলে
কেন খোঁজে রাধিকা-হৃদয় তুমি, কেন হও বন্দনা-গায়ক।
তুমি কবি, তোমার উদার হাতে দেখি নীল প্রজাপতি ওড়ে
তুমি তো বাঙালি কবি, চক্ষু বুঁজে থাক তাই কল্পনার ঘোরে।
মুহাম্মদ সামাদের কবিতায় সত্তর দশকীয় প্রবণতা ধারণ করলেও সৃষ্টি ও বিকাশের কাল আশির দশকের। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কাব্যধারায় তিনি সত্তর ও আশির দশকের সন্ধিক্ষণের কবি। দশকের বিচার যা-ই হোক তিনি বাংলাদেশের কবি, বাংলাভাষার কবি। বাংলার মাটির ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ তাঁর কবিতার প্রতিটি চরণ।
ডক্টর তপন বাগচী : ইমেইল : drbagchipoetry@gmail.com
কবি মুহাম্মদ সামাদের বিষয়ে আগ্রহী হয়েছি বেশ কয়েকদিন হলো। আর আজকে জানতে পারলাম, তিনি ঢাবির প্রোভিসি হয়েছেন। এখন কোনো কিছু করতে গেলেই লোকে ভাববে তেলবাজি! তবুও …