Sharing is caring!
জমি নিয়ে ভয়ভীতি পুরোটাই দালালদের কারসাজি: স্কুল কলেজের পাঠ্যবইয়ে ভূমি সংক্রান্ত পাঠদান জরুরী
(অনলাইনে আবেদন করে মেসেজের অপেক্ষা করুন)
বিশেষ প্রতিবেদক
প্রশাসনের কর্মকর্তারা যখন বলছেন, জমিজমা নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। আপনার কাগজপত্র সঠিক হলে আপনি অনলাইনে আবেদন করার পর মেসেজের জন্য অপেক্ষা করুন। আপনার ফোনে আসা মেসেজ বলে দেবে এরপর আপনার করনীয় কি। অন্যদিকে একশ্রেণীর ভুমি সহযোগী বা সহকারী ও কম্পিউটার দোকানের ব্যবসায়ী বলছেন, খবরদার নিজে না বুঝলে কিছু করবেন না, তহসিলদার বা সার্ভেয়ার কারো একজনের সাথে পরামর্শ করে তবেই কাজ করবেন। আর এই দুই ধরনের বক্তব্য নিয়ে সাধারণ মানুষ পরছেন মহাবিপাকে। ভূমি সংক্রান্ত যেকোনো বিষয় ২০২৩ সাল থেকে অনলাইনে আপডেট হচ্ছে। যে কারণে বেশিরভাগ মানুষ কম্পিউটার দোকানের এই অনলাইন আবেদনের জন্য ভিড় করেন। নামজারি, ভূমি কর, সংশোধন ইত্যাদি কাজের জন্য নির্দিষ্ট কিছু কম্পিউটার দোকানের এসব অনলাইন আবেদন করা হয়। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনলাইন কম্পিউটার দোকান বা আদালত পাড়ায় ওঁৎ পেতে থাকা একশ্রেণির ভূমি সংক্রান্ত দালাল, দলিল লেখক বা অফিস সহকারী এভাবেই বিভিন্ন ভয়ভিতি দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে ধোঁকার ওপর রাখছে। আর এভাবেই টিকিয়ে রেখেছে তাদের এবং অসাধু কিছু সরকারি কর্মকর্তার বাড়তি উপার্জনের পারিবারিক বাণিজ্য। এদের কারণেই ভূমি মানেই ভয়ংকর বিষয় এবং ঘাটলেই বিপদ বলে একরকম প্রচারণা চালানো হচ্ছে গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে। আর এই প্রচারণা চালানোর প্রধান দায়িত্ব পালন করেন দলিল লেখক ও সরকারি সার্ভেয়ার ও কোথাও কোথাও অনলাইন কম্পিউটার দোকানের মালিক।
অন্যদিকে সচেতন নাগরিক সমাজের বেশিরভাগ অংশ মনে করেন, পাঠ্যবইয়ে স্কুল জীবন থেকেই ভূমি বা জমিজমা সংক্রান্ত মৌলিক জ্ঞান থাকা উচিত। বরিশালের ষাটোর্ধ্ব সিটিজেন ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ও বরিশাল সাহিত্য সংসদ এর সহসভাপতি কাজী মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের সময় পাঠ্যবইয়ে কড়ায়-গণ্ডা, শতাংশ ইত্যাদি পাঠের ব্যাপার ছিলো, এখন কি অবস্থা জানিনা, তবে জমিজমা সংক্রান্ত মাপঝোঁক, হিসাব বুঝতে ছোটবেলা থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান জরুরী বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে সহমত বরিশালের সরকারি কর্মকর্তারাও। উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূম, কানুনগো, তহশিলদারসহ প্রায় সকলেই মনে করেন পাঠ্যবইয়ে জমিজমা সংক্রান্ত বিষয়ের পাঠদান জরুরী। সাধারণ মানুষের ভূমি সংক্রান্ত মৌলিক জ্ঞান থাকা উচিত।
এদিকে অনলাইনে আবেদনের পর করনীয় সম্পর্কে বেশ কয়েকজন কম্পিউটার দোকানের ব্যবসায়ী বা আবেদন সহযোগী, উপজেলা ভূমি অফিসের কাুনগো সহ একাধিক ভূমি কর্মকর্তা জানালেন, আপনার কাগজপত্রে কোনো জটিলতা না থাকলে অনলাইন আবেদনের দু একদিনের মধ্যেই আপনার কাছে প্রথম মেসেজ আসবে ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে। এরপর একসপ্তাহ বা দুই সপ্তাহের মধ্যে আপনার ফোনে শুনানি নোটিশ চলে আসবে। এটি কখনো কখনো দুই সপ্তাহ হতে পারে এর বেশি নয়। এই নোটিশ একইসাথে ইউনিয়ন ও উপজেলা ছাড়াও কেন্দ্রীয় ভূমি অফিসের সার্ভারে যুক্ত থাকে। সেখানে উর্ধতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি চাইলেই দেখতে পাচ্ছেন। তাই জটিলতা থাকলে তহসিলদার কিম্বা সার্ভেয়ার নিজেই ফোন করে আবেদনকারীর সাথে যোগাযোগ করবে এবং সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করবেন বলে জানালেন ভূমি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাদের সাথে কথা বলে আরো জানা যায়, শুনানি সরাসরি উপজেলার সহকারী কমিশনার ভূমি নিজেই পরিচালনা করেন। তার এক্তিয়ার বহির্ভূত হলে, সেটি তিনি জেলা প্রশাসক বরাবরে নোটিশ করেন এবং সেখানেও গ্রাহক নোটিশ পাবেন বলে জানালেন বরিশাল সদর উপজেলার কানুগো রুহুল আমিন। কানুনগো রুহুল আমিন আরো বলেন, অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়ায় একটি সমস্যা হচ্ছে যারা কম্পিউটার জানেনা বা ইন্টারনেট সুবিধা যাদের নেই, তারা বাধ্য হয়ে কম্পিউটার দোকানের মালিক বা কর্মচারীর সাহায্য নিয়ে আবেদন করেন। আর ঐ মালিক বা কর্মচারী আবেদনকারীকে দালাল ধরিয়ে দিয়ে বিপাকে ফেলার অভিযোগ আমাদের কাছে অহরহ আসছে। তিনি পরিষ্কার বলেন, অনলাইনে আবেদন করতে অবশ্যই আপনার ফোন নম্বর ব্যবহার করুন। ফোনে আসা মেসেজ অনুসরণ করুন। আপনাকে কি করতে হবে তা মেসেজে পরিষ্কার বলা হয়েছে। এ বিষয়ে পাঠ্যবইয়ে পাঠ দান জরুরী বলে মনে করেন রুহুল আমিন নিজেও।
সরজমিন এরকম অনলাইন আবেদন শেষে শুনানির কাজ সরাসরি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হলো বরিশাল সদর উপজেলা ভূমি অফিস ও ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলা ভূমি অফিসে।
নলছিটি উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা নুসরাত জাহান বেলা দুটো থেকে চারটার মধ্যে পাঁচ-ছয়টি ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনের পর রায় চূড়ান্ত করে দিলেন। এ জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট এলাকা বা ইউনিয়নের তহসিলদারকে ডেকে এনে ভুল শুধরে নিতে বাধ্য করছেন। তার রায় পেয়ে হাসি ফুটেছে বয়োবৃদ্ধ দুজন মানুষের মুখে। আবার তরুণ এক যুবকের আবেদনের শুনানী আটকে যাওয়ায় তার মধ্যে ক্ষোভ। ডেকে পাঠানো হয়েছে তার এলাকার তহশিলদারকেও। সরেজমিনে ৩ মার্চ দুপুরের পর ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলা ভূমি অফিসে বসে চোখে পড়ে ভূমি কর্মকর্তা নুসরাত জাহান এর এই কর্ম ব্যস্ততা। অসাধারণ মেধা ও দক্ষতার পরিচয় তার কাজে স্পষ্ট হলো। জমির বণ্টন অসংগতি, তহসিলদার ও সার্ভেয়ারের অসমাপ্ত নোট ইত্যাদি অসংগতি দূর করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে তাৎক্ষণিক হাজির হয়ে শুধরে নিতে হয়েছে তার ভুল। নলছিটি ভূমি অফিসে আগত বেশিরভাগ মানুষ জমির আবেদন করেছেন অনলাইনে। সহকারী কমিশনার ভূমি নুসরাত জাহান জানালেন, অনলাইনে আবেদন করার পর দলিলপত্রে সমস্যা না থাকলে তার সমাধান পাওয়া যায় সর্বোচ্চ পনের দিনের মধ্যে। এজন্য সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র নিয়ে হাজির থাকতে হবে৷ কাউকে কোনো বখশিশ বা যাতায়াত খরচ দেওয়ার নিয়ম নেই। প্রয়োজনও নেই। আপনি আপনার ফোনের মেসেজ পড়ুন বা কাউকে দিয়ে পড়িয়ে নিন। মেসেজ অনুসারে কাজ করলেই কোনো ভোগান্তি নেই বলে জানান তিনি।
৫ মার্চ বুধবার বরিশাল সদর উপজেলা ভূমি অফিসের কর্মকর্তা আজহারুল ইসলামও প্রায় একই কথা বললেন। এখানে শুনানির জন্য অপেক্ষারত জমি মালিকদের বেশিরভাগই এসেছেন নামজারি ও ভুল সংশোধন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। তাদের কয়েকজন কম্পিউটার দোকান থেকে ভূমি সংক্রান্ত দালালদের খপ্পরে পরার কথা স্বীকার করে বলেন, সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার ভূমি আজহারুল ইসলাম দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এখানে দালালদের উৎপাত নেই বললেই চলে। সমস্যার কথা তাকে জানানোর পর তিনি নিজেই তার লোক দিয়ে অনলাইনের ভুলগুলো ঠিক করে দিয়েছেন।
তবে বরিশালে ইতিপূর্বে সার্ভেয়ার ও তহসিলদারদের হাতে একাধিক হয়রানির অভিযোগ সংবাদ হয়েছে।
বরিশালে সদর উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার দেলোয়ার, নলছিটিতে সার্ভেয়ার বজলুর রশিদ এবং আগৈলঝারা উপজেলা ভূমি অফিসের দুজন কর্মকর্তার সার্ভেয়ার মাসুদ ও পেশকার নুরুজ্জামান এর বিরুদ্ধে এখানেও বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেল। তারা রীতিমতো সংবাদ শিরোনাম হয়েও এখনো বহাল আছেন দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন অনেকেই। জেলা ভূমি অফিসকে ঘীরে বরিশাল, বাকেরগঞ্জ, পটুয়াখালী ও ঝালকাঠির বেশ কয়েকজন দলিল লেখক সংঘবদ্ধ হয়ে কম্পিউটার দোকানগুলোর সাথে চুক্তি করে নিয়েছে বলে জানা গেছে। কম্পিউটার দোকানের ব্যবসায়ী প্রাথমিক আলাপচারিতা শেষে মক্কেল গছিয়ে দেয় দলিল লেখকদের। কখনো কখনো নিজেই দালালী শুরু করেন। অনলাইন সিস্টেমের কোনো এক ফাঁকফোকর সৃষ্টি করে সংশ্লিষ্ট তহশিলদার বা সার্ভেয়ারের সাথে যোগসূত্র তৈরি করে নিয়েছেন তারা। মেসেজ আসার আগেই তাই কম্পিউটার দোকানের ব্যবসায়ী গ্রাহকদের পাঠিয়ে দেন ইউনিয়ন ভূমি অফিসে। যা অনলাইনে আবেদন করার পর মোটেও অনুচিত বলে মনে করেন বরিশাল সদর উপজেলার কানুনগো রুহুল আমিন। তিনি বলেন, ইউনিয়ন অফিসে আপনার আবেদন যাওয়ামাত্রই আপনার ফোনে মেসেজ চলে আসবে। কাগজপত্র কোনোরকম জটিলতা থাকলে ঐ মেসেজ অনুসরণ করে আপনি ইউনিয়ন অফিসে যেতে পারেন। জটিলতা না থাকলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তহশিলদার তখন বিষয়টি ওকে করে এ্যাসিল্যান্ডকে নোট দেবেন। সে অনুযায়ী শুনানির দিন তারিখ আপনার ফোনে মেসেজ চলে আসবে বলে জানান তিনি।
কিন্তু নলছিটি ভূমি অফিস সহযোগীদের একজন বললেন, এসেই সার্ভেয়ারকে দিয়ে সব ঠিক আছে কিনা তা যাচাই করে নিতে হবে। সার্ভেয়ার যাচাই করে সই করে তা অনলাইনে নোট দেবেন তাহলেই শুনানির জন্য প্রস্তুত হবে। তবে এ কাজটি শুনানি ধার্য হবার আগেই করার কথা বলে জানান একাধিক জমি মালিক বা আবেদনকারী।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বরিশাল সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার ভূমি আজহারুল ইসলাম বললেন, আমার এখানে বেশিরভাগ মানুষ এসেছেন অনলাইনে আবেদন করে। আজ শুনানির দিন এই যে ২২-২৫ জন বসে আছেন এখানে। তাদের ফাইল প্রস্তুত করে দিয়েছেন কানুনগো। এখানে নামজারীতে সার্ভেয়ারদের কোন ভূমিকা নাই। আর আমার অফিসের কানুনগো রুহুল আমিন খুবই সৎ একজন মানুষ।
তিনি আরও বলেন, সদর উপজেলার তহশিলদারদেরও স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে জনগণকে হয়রানি না করতে। এরপরেও কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কেউ জানালে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি বলেন, শুনানিতে আসা আবেদনকারীদের আমি জিজ্ঞেস করি কেউ কোন টাকা নিয়েছে কিনা। তারা তখন অভিযোগ করে না। হয় অভিযোগ নেই, বা কোনো স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কারণে অভিযোগ নেই হতে পারে। তবে সেবাপ্রার্থীদেরও সচেতনতা জরুরী বলে জানান বরিশালের ভূমি কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার সাবেক সহকারী কমিশনার ভূমি এবং বর্তমান সিনিয়র সহকারী বিভাগীয় কমিশনার চট্টগ্রাম সুব্রত বিশ্বাস বলেন, ভূমি সংক্রান্ত মৌলিক জ্ঞান থাকা খুবই জরুরী। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি বরিশাল অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষের এই জ্ঞানটুকু নেই। তারা জমির ভিতর দিয়ে তৈরি রাস্তা বাদ দিয়ে নিজের জমি বুঝে নিতে চান। এজন্য প্রতিটি ইউনিয়ন ভুমি অফিসে গ্রামবাসীকে নিয়ে কর্মশালার আয়োজন প্রস্তাব করেছিলাম। পাঠ্যবইয়ে এখন ভূমি সংক্রান্ত পাঠদান জরুরী বলে জানান সুব্রত বিশ্বাস।
তিনি বলেন, নতুন অনলাইন সিস্টেমে একটা জমির যখন দলিল হয় তখন সংশ্লিষ্ট তথ্য এসিল্যান্ড কার্যালয় থেকেই জেনে নিতে পারেন সাব-রেজিস্ট্রার। পরে এ তথ্যের ভিত্তিতেই দলিলটি হবে। কাজেই এ কাজে আট বা দশ দিনের বেশি সময় লাগার কথা নয়। আমাদের দেশের ভূমি দলিলের কাজটি হয় আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে। আর নামজারির কাজটি হয় ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ের মাধ্যমে। এ কাজে একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে দুই দপ্তরের মধ্যে আন্তঃসংযোগ তৈরি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে গত দু বছর ধরে দলিলপত্র দাখিল, নামজারিসহ যাবতীয় লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ হচ্ছে। যে কারণে নতুন দলিল দাখিল হলেই ভূমি অফিস থেকে যাবতীয় তথ্য জেনে নেবেন সাব-রেজিস্ট্রার। আবার দলিলের পর সেটি এসিল্যান্ডকে জানিয়ে দেওয়া হবে। এরপর সর্বোচ্চ আট বা দশ দিনের মধ্যে নামজারি হবে। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এ কাজ হবে। এসিল্যান্ডও এটি ফেলে রাখতে পারবেন না। তাই ভূমি সংক্রান্ত কিছু মৌলিক জ্ঞান সকলেরই জেনে রাখা জরুরি। তাহলে আর কেউ প্রতারণা বা ভুল যুক্তি দিয়ে অতিরিক্ত টাকা আদায় করতে পারবে না বলে জানান সুব্রত বিশ্বাস।
Sharing is caring!