নারীর মর্যাদায় আঘাত করে অদ্ভুত অমানবিক প্রথা ‘কুসাসা ফুম্বি’ ও ‘কুলোয়া কুফা’
কোন কোন দেশে নারীদের যৌনতা বিষয়ে দীক্ষা দেওয়াকে মানবিক মনে করে এবং এটাকে সামাজিক ভাবেই স্বীকৃতি দেয়া হয়। এরকম একটি দীক্ষা রীতির নাম ‘যৌন শুদ্ধি।’ বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেন এটি একটি প্রচলিত প্রথা। এই যৌন আচার প্রথা অনুযায়ী প্রথম ঋতুমতী কোন কিশোরী এবং সদ্য বিধবা নারীকে কোন পুরুষের সঙ্গে যৌন সঙ্গম করে পরিশুদ্ধ হওয়া উচিত বলে মনে করা হয়। কিশোরী মেয়েদের ক্ষেত্রে যৌন নির্মূলকরণ আচার এবং কিশোরী থেকে নারীত্বে উত্তীর্ণ হওয়ার একটি ধাপ বা রূপ হিসেবে দেখা হয়।
দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার একটি দেশের নাম মালাউয়ি। এই দেশের দক্ষিণাঞ্চলের গ্রামগুলোতে আছে অদ্ভুত দুইটি প্রথা, তার মধ্যে একটি প্রথার নাম কুসাসা ফুম্বি ( Sexual cleansing) অন্যটি ‘কুলোয়া কুফা।‘ মহামারী, রোগ বালাই থেকে মুক্তি বা কোন বিপদ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে কুসাসা ফুম্বি প্রথার উৎপত্তি হয়েছিল। কুমারী মেয়েদের কুমারীত্ব জীবনের অবসান ঘটাতে অর্থের বিনিময়ে পুরুষ ভাড়া করা হয়। স্থানীয় ভাষায় ‘হায়েনা’ (hyena) একটি পেশার নাম। যে সব পুরুষেরা এই অমানবিক পেশার সঙ্গে যুক্ত তারা ‘হায়েনা’ নামেই পরিচিত। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার নামে অনিচ্ছা স্বত্বেও অগণিত কিশোরী কন্যা শত লাঞ্চনা গঞ্জনা সহ্য করে মুখ বুজে এই প্রথার শিকার হচ্ছে। কেননা হাজার হাজার বছর ধরে এই প্রথা চলে আসছে। অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কার থেকে এই প্রথার উদ্ভব হয়েছিল।
‘কুসাসা কুম্বি’ প্রথা অনুযায়ী, কোন কিশোরী প্রথমবার ঋতুমতী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরিবারের অভিভাবক বাধ্যতামূলক ভাবেই একজন হায়েনাকে অর্থের বিনিময়ে ভাড়া করে থাকেন, ঐ কন্যার সঙ্গে যৌনমিলন করার জন্য। তবে এই কাজের জন্য যে কোন পুরুষকে ভাড়া করা যাবে না। শুধুমাত্র হায়েনাদের দিয়ে এই কাজ করাতে হবে। এই প্রথা অনুযায়ী যৌনমিলনের আগে কিছু রীতিনীতি আছে, সেগুলো পালন করতে হয়। যেমন, সদ্য ঋতুমতী হওয়া কিশোরীকে গ্রামের কয়েকজন নারী গ্রামের ভেতরের একটি জঙ্গলে নিয়ে যায়। সেখানে আগে থেকে একটি ঘর বানানো হয়ে থাকে, যা দীক্ষা শিবির নামে পরিচিত। এই দীক্ষা শিবিরে কয়কজন নারী মিলে কয়েকদিন ধরে কিশোরী মেয়েটিকে বড়দের শ্রদ্ধা করা, রান্না ও গৃহকর্ম, সদাচরণ, শালীনতা, পরিস্কার পরিচ্ছনতা, যৌন আচরন তথা কীভাবে পুরুষকে যৌন আনন্দ দিতে হয়- এই বিষয়ে শিক্ষা দিয়ে থাকে। এই পর্বকে বলা হয় যৌন দীক্ষা অনুষ্ঠান (Sexual initiation rites of girls)। শিক্ষা ও দীক্ষা পর্ব শেষে কিশোরীকে অর্থের বিনিময়ে একজন পুরুষ যৌনকর্মীর সঙ্গে যৌন মিলন করতে দেয়া হয়, যিনি হায়েনা ‘নামে’ পরিচিত। হায়েনা একটি পেশা এবং তিনি অর্থের বিনিময়ে একজন কিশোরীকে যৌনতার মাধ্যমে যৌবনে প্রবর্তন করেন। যতদিন না সদ্য ঋতুমতী কিশোরী একজন হায়েনার সঙ্গে যৌন সংসর্গ করবে, ততদিন কিশোরী পরিশুদ্ধ হবে না। পরপর তিনদিন ওই কিশোরীকে হায়েনার সঙ্গে থেকে যৌন সংসর্গ করতে হবে অর্থাৎ এটাই কিশোরী থেকে নারীতে উত্তরণের প্রমাণ, এর মধ্য দিয়েই একজন কিশোরী শুচি হয়, তাই এই অনুষ্ঠানের নাম ‘নারী শুচিকরণ।‘ কিন্তু কিশোরী কোনদিন জানতে পারে না যে সে কার সঙ্গে যৌনমিলন করেছে, কেননা যৌনমিলনের সময় কিশোরীর চোখ বাঁধা থাকে। আর এ সব কিছুরই আয়োজন ও ব্যয়ভার বহন করে কিশোরীর পরিবার। কোন কিশোরী কিংবা কোন পরিবার এই প্রথা মানতে অস্বীকার করলে ধরে নেওয়া হয়, ঐ কিশোরীর পরিবার কোন জটিল রোগে আক্রান্ত। অথবা ঐ কিশোরীর পরিবার, গ্রামের দিকে ধেয়ে আসছে কোন দুরারোগ্য ব্যধি, মহামারী, অমঙ্গল ও ভয়ঙ্কর কোন বিপদ। ফলে গ্রামবাসীরা ঐ কিশোরী ও পরিবারের উপর আক্রমণ করে, অত্যাচার করে, সামাজিক ভাবে হেয় করে।
কোন নারীর স্বামীর মৃত্যু হলে শোকপ্রাপ্ত ঐ নারী অশুচি বলে বিবেচিত হন। ফলে স্বামীকে সমাধিস্ত করার আগে সদ্য বিধবাকে শুদ্ধ করতে একজন হায়েনার সঙ্গে যৌনমিলন করতে হবে, এটাই ‘কুলোয়া কুফা’ প্রথা নামে পরিচিত। যদি সদ্য বিধবা নারী গর্ভবতী হয়ে থাকে তবুও তাকে পুরুষ যৌনকর্মী হায়েনার সঙ্গে যৌন সঙ্গম করার মাধ্যমে বিধবাকে শুচি হতে হবে, এটাই তাদের বিশ্বাস।
এই পুরুষ যৌনকর্মী হায়েনাদের অনেকেই এইডস আক্রান্ত। এদের মধ্যে মালাউয়ির একজন হায়েনার নাম এরিক আনিভা। তিনি দুই স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানের জনক। এরিক আনিভা এইডসে আক্রান্ত হয়ে ভুগছেন বহুদিন ধরে। কয়েক বছর আগে বিবিসি’র প্রায় ২৭ মিনিটের একটি রেডিও রিপোর্ট ‘Stealing innocence in Malawi’এ প্রচারিত হয়েছিল। এই সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে তার স্বীকারোক্তিতে তিনি দম্ভ করে বলেছিলেন, ‘ আমি মোট ১০৪জন কিশোরী ও বিধবা নারীর সঙ্গে যৌন সংগম করেছি। তবে এর মধ্যে বেশীরভাগই ছিল ১২/১৩ বছর বয়সী স্কুল পড়ূয়া কিশোরী। তাদের প্রত্যেকে আমাকে দৈনিক কর্মমূল্য হিসেবে চার থেকে সাত ডলার দিত। তাদের সঙ্গে শারীরিক মিলন করে আমার ভাল লেগেছে, আমি জানি মেয়েগুলোরও। সব মেয়েই তাদের হায়েনা হিসেবে আমাকে পেয়ে গর্ববোধ করে। তৃপ্ত মেয়েরা অন্য মেয়েদের বলে, আনিভা হচ্ছে প্রকৃত পুরুষ। অনিভা জানে, কিভাবে একজন নারীকে আনন্দ দিতে হয়।‘
আনিভা এই কুপ্রথা টিকিয়ে রাখা ও নিজের উপার্জনের স্বার্থে গর্ব করে এইসব কথা রেডিও সাক্ষাৎকারে প্রচার করলেও অনেক মেয়েই জানিয়েছে, তারা নিতান্তই অনিচ্ছায় আনিভার সঙ্গে শারীরিক সংগম করতে বাধ্য হয়েছে। কারণ তারা যৌন সংগমের মাধ্যমে যৌন শুচি না হলে তাদের বাবা-মা ও পুরো পরিবারের উপর আক্রমণ করতো গ্রামবাসী। সামাজিক ভাবে প্রচলিত এই প্রথা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই বলে মন্তব্য করেন মারিয়া নামের একজন কিশোরী। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে যৌনমিলন না করার ফলে, অনেক নারী যৌন বাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কেউ কেউ বা গর্ভবতী হন। ফলে অনেক নারীর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে অমানবিক ও বিভীষিকাময় জীবন যাপন করেন।
বিবিসির রিপোর্টের এক সপ্তাহ পরেই মালাউয়ের রাষ্ট্রপতি পিটার মুথারিকার নির্দেশে এরিক আনিভা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এইচআইভি পজেটিভ হওয়া স্বত্বেও তিনি তা গোপন রেখে অর্থের বিনিময়ে যৌন সংগম করার জন্য তাকে মাত্র দুই বছরের কারদণ্ড দেয়া হয়েছিল।
মালাউয়িতে এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে ‘প্রজেক্ট ডিগনিটি’ নামের মানবাধিকার একটি সংগঠন। ১৩/১৪বছর বয়সে এই কুপ্রথার শিকার হয়েছিলেন মানবাধিকার কর্মী নাতাশা অ্যানি টনথলা। এই প্রথার বিলুপ্তি জন্য প্রাণপণে লড়াই করছেন বহুদিন ধরে।
এছাড়াও আফ্রিকা মহাদেশের জাম্বিয়া, উগান্ডা, তানজানিয়া, কেনিয়া, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, আইভরি কোস্ট, কঙ্গোর বিভিন্ন অঞ্চলে এই প্রথা এখনো টিকে আছে। মোটকথা, নারী অনিচ্ছায় নারীর সঙ্গে যৌনক্রিয়া করা ধর্ষণের সামিল। ‘কুসাসা ফুম্বি’ ও ‘কুলোয়া কুফা’ প্রথা মুলত আনুষ্ঠানিক ভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে নারীকে ধর্ষণ করার স্বাধীনতা ও অধিকার পুরুষেরা পেয়ে থাকে। এই প্রথা নারীর মানবিক অধিকার লঙ্ঘন করে, নারীকে লাঞ্চিত ও মর্যাদাহানি করে নারীকে পুরুষতন্ত্রের দাসী বানিয়ে রাখতে বাধ্য করে। নারীর প্রতি বৈষম্য এবং সকল প্রকার অমানবিক প্রথার বিলুপ্তি হতে আর কত দেরী?