আগামি ফেব্রুয়ারীতে ২৭ বছরে পা দেবে বাংলাদেশের কবিদের একমাত্র জাতীয় সংগঠন জাতীয় কবিতা পরিষদ। কিন্তু গত ২৬ বছরে এই কবিতা পরিষদের অর্জন কি? কি করেছেন তারা কবিতার জন্য। কতটা পথ হেঁটেছে এই সংগঠনটি সাহিত্য-সংস্কৃতির অগ্রগতির জন্য? এ রকম অসংখ্য প্রশ্ন এখন সৃজনশীল সাহিত্যকর্মী ও প্রেমীদের। তবে অর্জন যাই হোক না কেন, আজকের এই অবস্থানটি তৈরি করতে সংগঠনটি ও এর সঙ্গে যুক্ত কবি-সাহিত্যিকদের পাড়ি দিতে হয়েছে অসংখ্য বাঁধা-বিপত্তি, খানা-খন্দ ও চড়াই-উৎরাই। হারাতে হয়েছে প্রিয় সহচরদের। সহ্য করতে হয়েছে নির্যাতন, অনিয়মসহ আরো অনেক কিছু। তারপরও থেমে থাকেনি কবিদের অগ্রযাত্রা, থেমে থাকেনি কবিতা পরিষদের কর্মকান্ড। যদিও এ কর্মকান্ড শুধু রাজধানী কেন্দ্রিক। তারপরও সারাদেশের হাজারো কবি এবং লাখ কবিতাপ্রেমী মানুষের কাছে কবিতা পরিষদ অত্যন্ত প্রিয় একটি নাম।
প্রতিবছর ফেব্র“য়ারী এলেই কবিতা পরিষদকে ঘীরে জমে ওঠে কবি ও কবিতাপ্রেমীদের মিলন মেলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জাতীয় কবিতা পরিষদের মঞ্চে দুদিন/তিনদিন ব্যাপী আয়োজিত কবিতা উৎসবে দেশ-বিদেশের কবিরা এসে জড়ো হন স্বলিখিত কবিতা পড়ে শোনাবার জন্য। প্রতিবছর প্রায় ৫০০-৭০০ কবি নিজের লেখা কবিতা পাঠ করেন এ মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাজারো শ্রোতার সামনে। আর ফেব্র“য়ারীতে তিন বা দুদিনের এই উৎসবের আয়োজনই জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রধান ও একমাত্র কর্মকান্ড। উৎসব শেষ মানেই সারা বছরের জন্য কবিতা পরিষদ নিস্তেজ।
অনেক বিশেষজ্ঞজন তাই আক্ষেপ করে বলেন, বড় মাপের কবিরা কবিতা পরিষদ করেছেন, কবিদের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য। কবিদের কবিত্ব শক্তিকে সারা দেশে; দেশের বাইরে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু কবিতা পরিষদ কোন কবিকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারেনি। যদি পারতো তাহলে প্রযাত কবি সমুদ্র গুপ্ত, কবি ওমর আলীর মত কবির চিকিৎসা সাহায্যের জন্য, কিম্বা ময়মনসিংহের আবৃত্তিশীল্পী তারিখ সালাউদ্দিন মাহমুদকে অর্থসাহায্যের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হত না। কবিতা পরিষদের নিজস্ব ফাণ্ডেই এটা করা সম্ভব হত। নিজেদের সংকটে কবিতা পরিষদ আজ নিজেদের পাশে দাঁড়াতে পারে না, অথচ এই কবিতা পরিষদের জন্ম হয়েছিল জাতীর চরম সংকট মূহুর্তে, রাজনৈতিকভাবে প্রচণ্ড শক্তিশালী ভূমিকার মাধ্যমে।
স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে ১৯৮৭ সালের ফেব্রয়ারীতে অনেকটা রেশারেশি করেই কবিতা পরিষদের জন্ম হয়েছিল। তদানিন্তন দৈনিক বাংলা পত্রিকা থেকে দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান-এর পদত্যাগ এবং একই সময় দেশের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন কবিকে সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্রপতি এরশাদের কবিতা কেন্দ্র ও এশীয় কবিতা উৎসবের আয়োজনকে প্রতিহত করতেই জাতীয় কবিতা পরিষদের জন্ম হয় বলে জানা গেল বরেণ্য কবি রবীন্দ্র গোপ লিখিত “জাতীয় কবিতা উৎসবের দুই দশক” শীর্ষক রচনায়।
ঐ সময় স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রতিবাদ চিত্র “দেশ এখন বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে” শীর্ষক পোস্টারটির জন্ম হয়েছিল এই কবিতা পরিষদ উৎসবেই। এটি ১৯৮৮ সালের কথা! কবিতা পরিষদের ২য় উৎসবের ২য় দিনের সভাপতি ছিলেন শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান। সকাল থেকেই তিনি ছিলেন উৎসব প্রাঙ্গণে। কবি রবীন্দ্র গোপের কবিতার খাতাটি টেনে নিয়ে তিনি আঁকলেন একটি ছবি। নাম দিলেনÑ “দেশ এখন বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে”। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন এ মঞ্চে। তার পাশেই বসে ছিলেন পটুয়া কামরুল হাসান। হঠাৎ তিনি ঢলে পড়ে গেলেন। দ্রুত সবাই ধরাধরি করে তাকে তুলে দিলেন শেখ হাসিনার গাড়িতে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করলেন। সে রাতেই রবীন্দ্র গোপের খাতা থেকে পটুয়া কামরুল হাসানের আঁকা শেষ চিত্রকর্মটি কপি করে নিলেন কবিরা সবাই। রাতারাতি চিত্রকর্ম থেকে পোস্টার হয়ে গেল সেটি। ছড়িয়ে গেল সারা দেশে। সরকারের রোষাণলে বন্দী হল জাতীয় কবিতা পরিষদ। এভাবেই বর্ণনা করেছেন কবি রবীন্দ্র গোপ সে দিনগুলোর কথা।
কবিতা পরিষদের জন্ম প্রসঙ্গে কবি রবীন্দ্র গোপ লিখেছেন- প্রথম বছরেই শুরু হলো কবিতায় লড়াই। লড়াই বাধলো এশীয় আর দেশীয় কবিদের। আমরা রাজপথে আর এশীয় কবিরা ঠান্ডা হল ঘরে। এদের পক্ষে স্বৈরাচার, আর আমাদের পক্ষে প্রগতিশীল মানুষেরা। ভন্ড কবি এরশাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ তখন সৈয়দ আলী আহাসান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দিনের মত মহান কবিরা। সেবার অর্থাৎ ১৯৮৭ সালে কবিতা কেন্দ্র আয়োজন করেছিল ৩১ জানুয়ারী থেকে ২ ফেব্র“য়ারী পর্যন্ত এশীয় কবিতা উৎসব। তিনদিন ব্যাপী এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয় ওসমানী স্মৃতিমিলনায়তনে। রাষ্ট্রপতি এরশাদই ছিলেন এ উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক।
সেসময় দৈনিক বাংলা থেকে পদত্যাগ করে কবি শামসুর রাহমান যোগ দেন জাতীয় কবিতা পরিষদে। একই সময় তিনিই নেতৃত্ব দিলেন জাতীয় কবিতা উৎসবের। দুটি কবিতা উৎসবকে ঘিরে দেশবাসীয় মধ্যে একটা আতংক ছড়িয়ে পড়ে। কখন কি হয়। জাতীয় কবিতা উৎসব অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের খোলা আকাশের নীচে কবিতা চত্বরে। এখানে যোগ দেয় প্রগতিশীল ছাত্র-শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী সহ হাজার হাজার মানুষ। এ শিবিরের কবিরা এশীয় কবিতা উৎসব বর্জন করে।
দীর্ঘদিন দেশের কাব্যাঙ্গন প্রায় নিস্তরঙ্গ থাকার পর প্রায় একই সময়ে এশীয় কবিতা উৎসব ও জাতীয় কবিতা উৎসবের আয়োজন এবং দুই শিবিরে বিভক্ত কবিদের নিজ নিজ উদ্যোগ সফল করে তোলার জন্য কবিরা মহাব্যস্ত। কবিতা রচনার চেয়ে বেড়ে যায় তখন অনুষ্ঠান আয়োজন। পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত এসব সংবাদ দেশবাসীর মনে কিছুটা হলেও কৌতুহলের জন্ম দেয়। সকলের দৃষ্টি তখন কবিদের দিকে। কবিরা কি করতে পারে? স্বৈরাচারের মুখোমুখি হওয়া কবিদের এই প্রথম। দেশে ছিলনা তখন কোন রাজনীতি করার স্বাধীনতা। ছিলনা মত প্রকাশের স্বাধীনতা। রাজনীতির নামে চলছিল তখন ভন্ডামির ছলাকলা আর ঘরোয়া রাজনীতি।
এশীয় কবিতা উৎসবের প্রায় একই সময়ে জাতীয় কবিতা উৎসব অনুষ্ঠানকে ঘিরে মানুষের মধ্যে লক্ষ্য করেছিলাম নানারকম মতামত প্রকাশ করতে। কেউ কেউ বলেছিলেন, এশীয় উৎসবকে জনগণের মধ্যে খাট করতেই জাতীয় কবিতা উৎসবের এই আয়োজন। কিন্তু জাতীয় কবিতা উৎসবের আয়োজকরা এসব বিষয়ে কর্ণপাত করেননি। তাদের মনে একটা বিষয় ছিল ষ্পষ্ট – স্বৈরাচারের গালেতো চপোটাঘাত করা গেল।
এশীয় কবিরা আরো একটা বাঁধা পেল। পশ্চিমবঙ্গে যে সকল কবিকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল তারা আমাদের উৎসবের খবরা খবর জেনে এশীয়দের নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলেন। অথচ জাতীয় কবিতা উৎসবের আমন্ত্রণে পশ্চিমবঙ্গ থেকে এলেন উল্লেখ্যযোগ্য কবিরা।
এশীয় এবং জাতীয় কবিতা উৎসবের মধ্য দিয়েই কবিদের মধ্যে প্রথম বিভাজন শুরু হয়। কবি শামসুর রাহমান প্রগতিশীল ধারায় দিকে আর কবি আল মাহমুদ তখন স্বৈরাচারের পক্ষে। সে থেকেই দু’জনার দু’টি পথ দু’দিকে গেছে বেঁকে। তাদের নেতৃত্বে এখনও দু’ধারায় দু’টি কবি গোষ্ঠী বাংলাদেশে লক্ষ্যণীয়। কোন কোন কবিকে সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রচারযন্ত্রে কালো তালিকাভুক্ত করেছে, আবার কোন কোন কবি তাদের নাচন কোন্দন সবই প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছেন -বিটিভি নামক যাদুর বাক্সে (যেটা গত ২৬ বছর ধরে সব সরকারই করে আসছেন)। কারো কারো মতে – এ বিভাজন সাহিত্যের সমূহ ক্ষতি করেছে। এশীয় কবিতা উৎসবের শ্লোগান ছিল- শান্তি ও সমঝোতার বাহন কবিতা। আর জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রথম শ্লোগান ছিল – শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা। এই বাণীকে সামনে রেখেই প্রথম জাতীয় কবিতা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
উৎসব কমিটির আহবায়ক শামসুর রাহমান দু’দিন ব্যাপী কর্মসূচী ঘোষণা করে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন – মানুষ যেমন রাজনীতিমুক্ত নয়, তেমনি একজন কবি শিল্প-সমাজ ও দেশের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। এই রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ভিত্তিতেই আমাদের কবিতা উৎসবের মর্মবাণী ‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’।
কবি শামসুর রাহমান জাতীয় কবিতা উৎসব অনুষ্ঠানের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, বিভিন্ন সময়ে আমরা বিচ্ছিন্নভাবে কবিতায় অনুষ্ঠান করার সময়ে অনুভব করেছিলাম, কবিতার কর্মকান্ড ঢাকা কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। মফস্বলের কবিদের সহ জাতীয় কবিতা উৎসবের চিন্তা ভাবনা আমাদের আগেই ছিল। সে কথা মনে রেখেই মহান ভাষা আন্দোলনের ঐতিহ্যবাহী ফেব্র“য়ারী মাসের শুরুতেই আমরা প্রথম জাতীয় কবিতা উৎসবের আয়োজন করেছি। এই জাতীয় কবিতা উৎসব এখন থেকে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হবে এবং ক্রমে তা একটি জাতীয় উৎসবে পরিণত হবে বলে আমার ধারণা।
প্রথম বছরের সাংবাদিক সস্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, সাবেক উপচার্য অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সানাউল হক, বাংলাদেশ লেখক ইউনিয়নের সভাপতি ফয়েজ আহমদ, সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, ড. হুমায়ুন আজাদ, বেলাল চৌধুরী, লুৎফর রহমান সরকার, মহাদেব সহা, হায়াৎ মাহমুদ, সাযযদ কাদির, মাশুক চৌধুরী, খালেদা এদিব চৌধুরী, রবীন্দ্র গোপ, রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. মোহাম্মদ সামাদ, মোহন রায়হান, জাফর ওয়াজেদ, এবং আরো প্রায় ত্রিশ জন কবি উপস্থিত ছিলেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ শামসুর হক বলেন – ‘দেশের সর্বস্তরের কবিদের নিয়ে এশীয় কবিতা উৎসব হবে বলে ধারণা করেই আমি ঐ উৎসবের প্রস্তুতি পর্বের গোড়ার দিকে যুক্তছিলাম। কিন্তু কাব্যস্বার্থ বিরোধী কর্মকান্ডের জন্য সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি।”
প্রয়াত ড. হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন – কবিদের মধ্যে যারা গণ বিরোধী সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে কবিতা উৎসব করছেন আমরা তাদের ঐ উৎসবে যোগ দিচ্ছিনা।
এভাবেই একটা সংগ্রামী চেতনায় জাতীয় কবিতা পরিষদ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। প্রথমদিকের সেই দিপ্তীময়তা ৯০-এর গণআন্দোলনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জাতীয় কবিতা পরিষদের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক কবি আসলাম সানী বলেন, ১৯৮৭ সালের ১ ও ২ ফেব্র“য়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সড়ক মোহনায় দুর্বীনীত কবি শামসুর রাহমানের সভাপতিত্বে কবি বেগম সুফিয়া কামাল জাতীয় কবিতা উৎসবের উদ্বোধন করলেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সেদিন দর্শক সারিতে বসে কবিতা শুনলেন। একইসঙ্গে সেদিন দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনরত প্রতিটি প্রগতিশীল মানুষের সহযোগিতা ও সমর্থন ছিল কবিদের কালজয়ী সতীর্থ। ৮৮ সালে কবিতা পরিষদের সাংগঠনিক ভিত্তি তৈরি হল। কবি শামসুর রাহমানকে সভাপতি করে কবি জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সৈয়দ শামসুল হক প্রমূখদের সভাপতি মণ্ডলির সদস্য ও কবি মোহাম্মদ রফিককে সাধারাণ সম্পাদক করে প্রথম কমিটি গঠিত হল। এসময় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কবি রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও কবি মোহন রায়হান। কবি মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী, বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ, মুহম্মদ নুরুল হুদা, রবিউল হুসাইন, হুমায়ুন আজাদ, হায়াত মামুদ, সাযযাদ কাদিরসহ আরো অনেকে প্রথম সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে আমরা কয়েকজন এখনো মাথা উঁচু করে একই পতাকা তলে দাঁড়িয়ে আছি।
১৯৯৩ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ৭ম উৎসবে প্রথমবারের মত কবিতা পরিষদ সম্মাননা ও পুরস্কার ঘোষণা করা হল। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৪ থেকে এ সম্মাননা ও পুরস্কার প্রদান কার্যক্রম শুরু হয়। এ বছর প্রথমবারের মত জাতীয় কবিতা পরিষদ সম্মাননা প্রদান করা হয় কবি সুফিয়া কামালকে এবং পুরুস্কার তুলে দেয়া হয কবি আবুল হোসেন-এর হাতে। এরপর কিছু কিছু বিতর্ক তৈরি হলেও প্রায় নিয়মিতই এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হচ্ছে। তবে শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ সমপর্যায়ের আর কোন কবির কবিতা এতটা মাণদণ্ডে পাঠকের কাছে বিবেচ্য হতে পারেনি যা কবিতা পরিষদেরই ব্যর্থতা বলে মনে করেন কবিতা প্রেমীরা। তাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে এই ২৬ বছরে নিজস্ব কোন ফাণ্ড গড়ে তুলতে সক্ষম হননি। নেই নিজস্ব কোন ভবনও। কবিতা পরিষদের পৃষ্ঠপোষকতায় কোন কবি বা লেখকের বইয়ের প্রকাশ ঘটেছে বা মাসিক ভাতার ব্যবস্থা হয়েছে এমন দাবী কি কবিতা পরিষদ করতে পারে? এ জিজ্ঞাসা আজ অনেক কবিতাপ্রেমীদের।
বর্তমান কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কবি আসলাম সানী কবিতা পরিষদের দারিদ্রাবস্থা সম্পর্কে বলেন, আসলে কবিতা পরিষদ কোন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বা সেবামূলক কোন সংগঠন নয়। এর জন্ম রাজনৈতিক বিরুপ পরিস্থিতিতে, তাই এর চরিত্র একটু প্রতিবাদী। কবিরা সাধারণত সাংগঠনিক হয় না বা হতে পারে না। তাহলে কবিদের সৃজনসত্তাই বিলুপ্ত হবে। কারণ সৃষ্টিশীল মানুষ- মানে কবি। একজন কবি নিজেই একটি সংগঠন বা ইনস্টিটিউশন। সংগঠন করলে তার মৌলিক চিন্তাশীলতার জায়গায় বিপত্তি ঘটবে। তখন সে আর লিখতে পারবে না। তারপরও সমাজের আর দশজন মানুষের মতই সে লিখেই তার দায়িত্ব শেষ করে না, কবিও রাজপথে নামে, মিছিলে-শ্লোগানে অংশ নেয়, প্রতিবাদ করে, লড়াই করে। এখানে কবিতা পরিষদ আরো কিছু ভূমিকা রাখতে পারতো, কিন্তু সেদিক থেকে গত দুয়েকটি নেতৃত্ব সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে এটা আমি স্বীকার করছি। আমার স্বপ্ন বা প্রতিজ্ঞা হচ্ছেÑ আগামীতে কবিতার উৎকর্ষ সাধনের জন্য কাজ করা, নিয়মিত কবিতার আসর, আলোচনা, জেলা পর্যায়ে কবিতার কর্মশালার আয়োজন, নিয়মিত প্রকাশনা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য কিছু কাজের বাস্তবায়নের ইচ্ছা রয়েছে। চেষ্টাও করছি। প্রায় সব জেলাতেই এখন জাতীয় কবিতা পরিষদের কার্যক্রম রয়েছে। রয়েছে জেলা ভিত্তিক কমিটিও।
১৯৮৭ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত প্রতিবছরই নতুন নতুন সময়োপযোগী শ্লোগানে প্রতিবাদ মুখর হয়েছে জাতীয় কবিতা পরিষদের কবিরা।
১৯৮৭ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ১ম শ্লোগাণ ছিল -শৃঙ্খলা মুক্তিও জন্য কবিতা।
১৯৮৮ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ২য় শ্লোগাণ ছিল – স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা।
১৯৮৯ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ৩য় শ্লোগাণ ছিল – সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা।
১৯৯০ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ৪র্থ শ্লোগাণ ছিল – কবিতা রুখবেই সন্ত্রাস।
১৯৯১ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ৫ম শ্লোগাণ ছিল – গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা।
১৯৯২ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ৬ষ্ট শ্লোগাণ ছিল – কবিতা রুখবেই মৌলবাদ।
১৯৯৩ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ৭ম শ্লোগাণ ছিল – জয় বাংলার জয় কবিতার।
১৯৯৪ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ৮ম শ্লোগাণ ছিল – জনতার সংগ্রাম কবিতার সংগ্রাম।
১৯৯৫ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ৯ম শ্লোগাণ ছিল – মানুষের অধিকার কবিতার অঙ্গীকার।
১৯৯৬ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ১০ম শ্লোগাণ ছিল – মানবিকতার প্রত্যয়ে কবিতা।
১৯৯৭ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ১১ তম শ্লোগাণ ছিল – কবিতা মুক্তিও শ্বাশত শক্তি।
১৯৯৮ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ১২ তম শ্লোগাণ ছিল – শান্তি-সম্প্রীতী আনবে কবিতা।
১৯৯৯ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ১৩ তম শ্লোগাণ ছিল – কবিতা তিমির বিনাশী।
২০০০ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ১৪ তম শ্লোগাণ ছিল – মাতৃভাষার আলোক ধারায় কবিতার হোক জয়।
২০০১ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ১৫ তম শ্লোগাণ ছিল – কবিতা উৎসব সত্য সুন্দরের উৎসব।
২০০২ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ১৬ তম শ্লোগাণ ছিল – কালের যাত্রায় কবিতার জয়ধ্বনি।
২০০৩ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ১৭ তম শ্লোগাণ ছিল – জয় কবিতার জয় মানবতার।
২০০৪ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ১৮ তম শ্লোগাণ ছিল – কবিতা আনবেই সুসময়।
২০০৫ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ১৯ তম শ্লোগাণ ছিল – কবিতা প্রতিরোধের হাতিয়ার।
২০০৬ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ২০ তম শ্লোগাণ ছিল – জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে কবিতা।
২০০৭ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ২১ তম শ্লোগাণ ছিল – কবিতা বারবার ফিরে আসে নতুন মিছিলে।
২০০৮ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ২২ তম শ্লোগাণ ছিল – কবিতার মন্ত্র জয় গণতন্ত্র।
২০০৯ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ২৩ তম শ্লোগাণ ছিল – জয় জনতার, জয় কবিতার।
২০১০ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ২৪ তম শ্লোগাণ ছিল – নতুন কবিতা নতুন সময়।
২০১১ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ২৫ তম শ্লোগাণ ছিল – কবিতার উৎসব মুক্তির উৎসব।
২০১২ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ২৬ তম শ্লোগাণ ছিল – কবিতা শোণিতে, স্বপ্নের ধ্বনিতে
২০১৩ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের ২৭ তম শ্লোগাণ ছিল – যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি আজ কবিতার।
২৭ বছরে, ২৬টি উৎসব আর শ্লোগাণ নিয়ে কবিতা পরিষদ এখনও দাঁড়িয়ে আছে একই স্থানে। প্রতিবার উৎসবের আগে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে উৎসবটি কেমন হবে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সাংবাদিকদের মধ্যে থেকেও এসেছে উৎসবকে প্রাণবন্ত করার বিভিন্ন প্রস্তাব। একবারতো দৈনিক ইত্তেফাকের সাবেক সাংবাদিক ও বর্তমানে আনন্দ আলো পত্রিকার সম্পাদক, সাংবাদিক ও নাট্যকার রেজানুর রহমান কবিতা পরিষদ উৎসব কমিটির উদ্দেশ্যে বেশ গুরুত্ব সহকারে বলেছেন যে, আপনারা এভাবে বছরে একটি উৎসব করে থেমে যান কেন। এই যে প্রতিবছর প্রায় শ’পাচেঁক কবি এখানে কবিতা পড়ে যায়, এতে কি লাভ হয়? কেন কবিদের পঠিত এ কবিতাগুলো নিয়ে একটি সংকলন করছেন না। কেন কবিতা পরিষদের কোন নিয়মিত প্রকাশনা নেই?
একই সময়ে দৈনিক ভোরের কাগজে প্রতিবেদক ও বর্তমান সাহিত্য বাজার পত্রিকার সম্পাদক আরিফ আহমেদ বলেছিলেন যে, কবিতা পরিষদ উৎসবটি শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ না রেখে এটিকে রবীন্দ্র সংগীত সম্মেলনের মতই জেলায় জেলায় ছড়িয়ে দিন। ময়মনসিংহ বা কুষ্টিয়ার কুঠীবাড়ী বা বরিশালের ধানসিঁড়ি নদীর তীরে কবিতা উৎসবকে নিয়ে যান। কিন্তু সে জাতীয় কোন প্রস্তাবই আজ পর্যন্ত কবিতা পরিষদ কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করতে বা এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা দেখাতে পারেন নি।
তবে হ্যাঁ! ৯০-এর আন্দোলনে তাদের ভূমিকা এতটাই প্রশংসনীয় ছিল যে সেটার জোরেই তারা আজও মানুষের ভালবাসা পাচ্ছেন। যদিও পরবর্তীতে নির্দিষ্ট একটি দলের লেজুড়াবৃত্তির জন্যই বহুবার ব্যবহৃত হয়েছেন বলে অনেক কবিতাপ্রেমী দর্শক বারবার অভিযোগ তুলেছেন । অনেকেরই অভিযোগ ২৭ বছর অনেক সময়। এতোটা সময়ে কবিতা পরিষদের মত একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবার কথা। এখান থেকে দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মশালা, কর্মকান্ড পরিচালিত হতে পারতো। যে কারণেই হয়ত কবিতা পরিষদের একজন সদস্য সাঈদ আখন্দ বললেন, কবিতা পরিষদের কার্যক্রমকে শক্তিশালী করতে আমার দুটো প্রস্তাব আছে। এক. কবিতা পরিষদে তরুণ-নতুন কবিদের অবস্থান সুদৃঢ় করা এবং তাদের সরাসরি কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করা। দুই.জেলাভিত্তিক কার্যক্রমকে শক্তিশালী করা এবং কেন্দ্রে জেলা সদস্যদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা।
অসাধারণ ! যা ভাষায় প্রকাশ্ করবার ক্ষমতা আমার নেই ! খুব ভালো লেখা I ইতিহাস খুঁজে পেলাম ! জাতীয় কবিতা পরিষদের একজন কর্আমী হবার আমার চরম ইচ্ছে প্রকাশ করলাম !
ভারত /কলকাতা /পশ্চিবঙ্গ