১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। এ দিন পাক-হানাদার মুক্ত হয়ে বিজয়ের উৎসব করেছে বাংলাদেশের বেশিরভাগ জেলার মানুষ। শুধু ঢাকার মীরপুর ও বরিশালের গৌরনদী (২২ ডিসেম্বর) ও চট্টগ্রামের মীরসরাই (১৭ ডিসেম্বর) সহ কয়েকটি এলাকা স্বাধীন হয় ১৬ ডিসেম্বরের পরে। সর্বশেষ ঢাকার মীরপুর স্বাধীন হয় ৩১ জানুয়ারী ১৯৭১। ময়মনসিংহ, রাজশাহী, খুলনা ও যশোর ৬ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে স্বাধীন হয়। ৬ ডিসেম্বর যশোর, ১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ, ১৫ ডিসেম্বর সিলেট মুক্ত হয়। আর বরিশাল মুক্ত দিবস ৮ ডিসেম্বর।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যাকাণ্ড চালায়। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বিশ্বে নজিরবিহীন। এখনো আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি। বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হয় প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের এ-দেশীয় দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় এই হত্যাকাণ্ড চালায়। যুদ্ধ শেষে বধ্যভূমিগুলোতে পাওয়া অসংখ্য মাথার খুলি, হাড়গোড় ও চুল এ ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মমতার সাক্ষী হয়ে আছে বাংলাদেশের অনেক বধ্যভূমি। যেখানে এদেশের মুক্তিকামী মানুষদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।
এমনই প্রায় ১০০টিরও বেশি বধ্যভূমি রয়েছে বরিশাল বিভাগের ছয়জেলায়। যার মধ্যে ৬৮টি এখনো স্বীকৃতি পায়নি বলে দাবী বধ্যভূমি গবেষকদের। হাতেগোনা যে কয়েকটি স্বীকৃতি পেয়েছে তারমধ্যে বরিশালের ত্রিশ গোডাউন কম্পাউন্ড ও ওয়াপদা কলোনির বধ্যভূমি অন্যতম।
ত্রিশ গোডাউন’বধ্যভূমি বরিশাল ওয়াপদা কলোনির পাশে। স্থানটি নদীর পাড়ে হওয়ায় হত্যাযজ্ঞের পর লাশ নদীতেই ফেলে দেয়া হতো। বর্তমান বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজও এখানে। ওয়াপদা কলোনিকে যুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদাররা মিনি ক্যান্টনমেন্টে পরিণত করেছিলো।
বরিশালের এই ‘ত্রিশ গোডাউন’ নামে একটি বধ্যভূমিকে নির্দেশ করলেও মূলত এখানে একসাথে দুটো বধ্যভূমি রয়েছে। এখানে গড়ে তোলা হয়েছে স্মৃতি স্তম্ভ ও রিভার ভিউ পার্ক। এটি বর্তমানে বরিশাল জেলার একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। প্রতিদিন এখানে বেড়াতে আসেন কয়েক হাজার দর্শনার্থী। কিন্তু তাদের অনেকেই হয়তো জানেন না এই ত্রিশ গোডাউনের প্রকৃত ইতিহাস।
মনে করা হয়, বরিশাল বিভাগের সব চাইতে বড় বধ্যভূমি ছিল এটি। শোনা গেছে আনুমানিক প্রায় পাঁচ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিলো এখানে। ত্রিশ গোডাউন’বধ্যভূমি স্থানটি নদীর পাড়ে হওয়ায় হত্যাযজ্ঞের পর লাশ নদীতেই ফেলে দেয়া হতো। এখানে ওয়াপদা কলোনির দক্ষিণ পাশে সাগরদী খালের উপর অবস্থিত ‘বাঙ্কার ব্রিজ’ নামে পরিচিত এই ব্রিজ। এই ব্রিজের উপর এনেই দাঁড় করিয়ে গুলি করে নিরীহ মানুষদের হত্যা করে সাগরদী খালে ফেলে দেয়া হতো। অন্যটি হলো ত্রিশ গোডাউন কম্পাউন্ডের পেছন গেট থেকে নদীর পাড় পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় ত্রিশ বিঘা ধানী জমির পুরোটা। মূলত স্থান দুটি প্রায় একসাথে হওয়ায় এদের একটি বধ্যভূমি হিসেবে গণ্য করা হয়।
’কিশোর ইতিহাস: বরিশাল জেলা’নামের গ্রন্থে বলা হয়েছে, নগরী ছাড়াও গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, বানারীপাড়া, উজিরপুর, বাকেরগঞ্জ, স্বরূপকাঠি থেকে নারী-পুরুষদের ধরে এনে সিলিংয়ে ঝুলিয়ে অত্যাচার করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হতো এবং পরে গুলি করে হত্যা করা হতো। প্রতি রাতেই হানাদাররা ১০-১৫ জনকে হত্যা করতো বলে জনশ্রুতি রয়েছে ।
জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৪ মে পাকিস্তানি হানাদাররা পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস ও আবাসিক বাড়িগুলো দখল করে নেয়। স্থানীয়দের ধরে এনে টর্চার সেলে পরিণত করে। প্রথমে তারা বরিশালের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কাজী আজিজুল ইসলামকে এখানে এনে হত্যা করে।
এরপর ধীরে ধীরে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচর, এলাকাবাসী ও বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষদের ধরে এনে নির্মমভাবে অত্যাচার করতো না হয় সরাসরি গুলি করে হত্যা করতো। তারা হাজী আদম আলীকে আহ্বায়ক করে শহরে একটি শান্তি কমিটি গঠন করে। এরপর তারা শহরে লুটতরাজ করে বেড়াতো। রিফিউজিদের দিয়ে এসব কাজ বেশি করতো। এছাড়াও তারা মানুষদেরকে ধরে এনে নদীর পাড়ে একত্রে দাঁড় করিয়ে সরাসরি গুলি করে হত্যা করতো।
ওয়াপদায় প্রায় পঞ্চাশটি বাঙ্কার ছিলো। বরিশাল পৌরসভার তিন-চার জন সুইপারকে সার্বক্ষণিক নিযুক্ত করা হয়েছিল শুধু লাশগুলো ঠেলে নদীতে ফেলে দেবার জন্য। এভাবেই প্রতিদিনই মানুষ ধরে নিয়ে আসা হতো এবং হত্যা করা হতো। তবে কত মানুষকে এভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা কেউ জানতে পারেনি।
ওয়াপদায় পাকসেনাদের নির্মম অত্যাচার সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধা এ এম জি কবীর ভুলু বলেন, ‘বাটাজোর এলাকায় নৌকায় স্টেনগানসহ জুলাই মাসে ধরা পড়ি আমি, আমার বন্ধু আনোয়ার ও নৌকার মাঝি। ধরা পড়ার পর ওরা আমাদের প্রচন্ড টর্চার করে। এরপর ওয়াপদা টর্চার সেলে নিয়ে আসে। তারা মাঝিকে ছেড়ে দেয়, ওদের নির্মম অত্যাচারের আনোয়ার মারা যায়।’
তিনি বলেন, ‘হানাদাররা আমাকে রশিতে বেঁধে অত্যাচার করেছে, পায়ে তলা ও পেট কাচ দিয় ক্ষতবিক্ষত করেছে, চড় দিয়ে আমার বাম কান নষ্ট করে দিয়েছে। এভাবে আমাকে প্রায় ১৯ দিন নির্মমভাবে অত্যাচার করে।’
বর্তমানে ওয়াপদা ও ত্রিশ গোডাউন বধ্যভূমিতে সংঘটিত এসব পৈশাচিক কর্মকাণ্ড ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে সংরক্ষিত করার জন্য বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের উদ্যোগে সরকারি অর্থায়নে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। এ ছাড়াও দর্শনার্থীদের জন্য সাগরদী খাল পার থেকে ত্রিশ গোডাউন ব্রিজ পর্যন্ত বিভিন্ন গাছ, বসার স্থান নির্মাণ করা হয়েছে। ওয়াপদার বাঙ্কারগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে মিনি হলরুম। ওয়াপদার ভিতরের রাস্তা, টর্চার সেল সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়া পুরো কম্পাউন্ডে দেয়ালের বেষ্টনী নির্মাণ করা হয়েছে।
নদী তীরের ত্রিশ বিঘা জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতি স্তম্ভ ও রিভার ভিউ পার্ক। এসব দেখে মানুষ পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মমতা জানতে পারে একইসাথে কীর্তনখোলা নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে।
বরিশাল জেলার দশ উপজেলায় প্রায় চল্লিশটি বধ্যভূমির সন্ধান জানিয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আনিসুর রহমান স্বপন এবং সুশান্ত ঘোষ। এরমধ্যে কেতনারকোলা বধ্যভূমিটি নতুন আবিস্কৃত হয়েছে বলে জানান সুশান্ত।
কেতনারকোলা বধ্যভূমিটি বরিশালের আগৈলঝাড়ার রাজিহার গ্রামের কেতনারকোলায় পাঁচটি গর্তে যথাক্রমে ৮৫, ৬০, ৪৬, ৪০ ও ৩০টি লাশ পুঁতে রাখা হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শী বিমল পাত্র ও অন্যরা জানান। এখানে বীরেন্দ্রনাথ ঢালীর ভিটায় ৪টি ও অনিল ব্যাপারীর বাড়িতে ৪৬ জনের আরেকটি গণকবর আছে। এ গণকবরগুলোতে নারীদের লাশই বেশি ছিল বলে জানা গেছে। অন্যটি
বদিরপুর পুল বধ্যভূমি। এটি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ থানার সাজেদপুর গ্রামের বদিরপুল এলাকায়। পাকিস্তানি সেনারা এই পুলের নিচে বহু লোককে লাইনে করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯ ডিসেম্বর এখানে শত শত নরকঙ্কাল ও মাথার খুলি পাওয়া গেছে।
বধ্যভূমি ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিঘেরা বরিশাল পাকসেনা মুক্ত হয় ৮ ডিসেম্বর! এদিনটি তাই বরিশালবাসীর কাছে আনন্দ ও উৎসবের দিন। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শনের পাশাপাশি শহীদের প্রতি শ্রদ্ধার্হ অর্পণের দিন।
প্রতিবছরের মতো এবারও ৮ ডিসেম্বর উপলক্ষে বরিশালের রাজনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড, বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্যাতন কেন্দ্র ও বধ্যভূমিতে পুষ্পস্তবক অর্পন করা হয়।
একই স্থানে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ৯০ জন বীরমুক্তিযোদ্ধা ও ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছে।
দিবসটি উপলক্ষে ৮ ডিসেম্বর বুধবার সকাল সাড়ে ১০টায় বধ্যভূমিতে বিভাগীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভাগীয় কমিশনার সাইফুল ইসলাম বাদল পুষ্পস্তবক অর্পন করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন হায়দার, বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান, মুক্তিযোদ্ধা জেলা কমান্ডসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পন করা হয়। পুষ্পস্তবক অর্পন শেষে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক।
এরপর বধ্যভূমি প্রাঙ্গনে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের আয়োজনে ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের সহযোগিতায় ৯০ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। প্রধান অতিথি ছিলেন বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ।
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালের এই দিনে দখলদার পাক বাহিনী অগ্রসরমান মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে এ শহর থেকে ডেরা গুটিয়ে পালিয়ে যায়। বরিশাল শহর কেন্দ্রীক বিভিন্ন সড়ক পথ চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় স্টিমার ও কার্গোতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, পাক মিলিশিয়াসহ শহরের দালাল ও রাজাকাররা বরিশাল ত্যাগ করে। পাকবাহিনীর শহর ত্যাগের খবরে ৮ মাস ধরে অবরুদ্ধ বরিশালের মুক্তিকামী মানুষ বিজয়ের আনন্দে রাস্তায় নেমে আসে।
কিন্তু বিজয়ের এই আনন্দ মলিন হয়ে যায় যখন বধ্যভূমিতে শহীদের তালিকা খুঁজে পাওয়া যায়না। জানা যায়না প্রকৃত শহীদদের নাম।
স্বাধীনতার পর ৫০ বছর কেটে গেলেও এখনও চিহ্নিত হয়নি বরিশাল, ঝালকাঠি ও
পিরোজপুরের ৭০ ভাগ বধ্যভূমি। এমনকি তৈরি হয়নি এসব জেলার শহীদদের তালিকাও । তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগের গবেষকদের দাবি, বরিশালের ১০ উপজেলা, পিরোজপুর ও ঝালকাঠীর বিভিন্ন অঞ্চলে সরেজমিনে অনুসন্ধান চালিয়ে অন্তত ৬৮টি বধ্যভূমির সন্ধান তারা পেয়েছেন।
এ অঞ্চলে ’জেনোসাইড স্টাডিজ’ প্রকল্পের গবেষক সুশান্ত ঘোষ জানিয়েছেন, বরিশাল অঞ্চলে ৬৮টি বধ্যভূমির মধ্যে বরিশাল জেলার সদরে ৩, গৌরনদীতে ৪, আগৈলঝাড়ায় ৬, বাকেরগঞ্জে ৩, বানারীপাড়ায় ৫, বাবুগঞ্জে ২, উজিরপুরে ৫, মুলাদীতে ২, মেহেন্দীগঞ্জে ৩টি সহ ৩৩ টি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়া ঝালকাঠীতে ৯টি, পিরোজপুরে ২৬টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা গেছে।
তিনি বলেন, এই ৬৮টি বধ্যভূমিতে নিহতদের সম্ভাব্য সংখ্যা নিরূপণ করা মুশকিল। তারপরেও প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা, স্মৃতিচারণ, ঘটনার বিবরণ বিশ্লেষণ করে শহীদের সম্ভাব্য সংখ্যা ১০-১৫ হাজার হতে পারে। এই বধ্যভূমির বাইরেও অসংখ্য মানুষ হানাদার বাহিনীর হত্যার শিকার হয়েছেন। এই শহীদদের সংখ্যা বধ্যভূমিতে নিহতের সংখ্যার দ্বিগুণ বা তারও বেশি হতে পারে।