সাতক্ষীরার সাহিত্যে সাত আছে ক্ষীর নেই

সাহিত্য বাজার

Sharing is caring!

sat-2সদানন্দ সরকার (ভ্রাম্যমাণ প্রতনিধি) : সাতক্ষীরা সাহিত্যে সাত আছে ক্ষীর নেই। অর্থাৎ এ জেলাটি যতটা না সাহিত্যে তার চেয়ে অধিক বেশি শক্তিশালী অবস্থান ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে। বলা যায়, ক্ষীর নেই কিন্তু ক্ষীর তৈরির সাত ও তার বেশি উপকরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এ জেলার সাতটি থানাতেই। প্রতিটি থানাতেই রয়েছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন। সাংস্কৃতিক কার্যক্রমও রয়েছে তবে তা কতটা গ্রহণ যোগ্য তা দর্শক বলতে পারেন। কেননা যেখানে সাহিত্য সম্মৃদ্ধ নয়, সেখানে সাংস্কৃতি সম্মৃদ্ধ হতে পারে না। এটাই স্বাভাবিক। যদিও এ সময়ের জনপ্রিয় কলামিষ্ট, সাংবাদিক ও দৈনিক সমকাল পত্রিকার সম্পাদক আবেদ খান, নাট্যাভিনেতা ও নির্দেশক তারেক আনাম খান, আফজাল হোসেন, খায়রুল বাসার প্রমুখদের জন্ম এই সাতক্ষীরা জেলাতেই।
প্রথমদিকে সেই ষাটের দশকে এখানে সাহিত্য ও সাংস্কৃতির নেতৃত্ব প্রগতি সংঘের ব্যাণারে তারেক আনাম, খায়রুল বাসারদের হাতে থাকলেও পরবর্তীতে তারা ঢাকামুখী হয়ে পড়ায় সাহিত্য সাংস্কৃতির ধারক বাহকের দায়িত্বটা চেপে যায় পলাশপোলের বাসার পরিবারের হাতে। বলা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী সাতক্ষীরা জেলার শিল্প-সাংস্কৃতির চর্চার পুরো কৃতিত্বই পল্টু বাসার, শরিফুল বাসার, আমিরুল বাসার, শফিকুল ও রফিকুল বাসারদের উপর বর্তায়। এদের মধ্যে পল্টু বাসার ও আমিরুল বাসার সাহিত্যচর্চা বিষয়টি টিকিয়ে রাখেন বলেই স্বীকার করেন স্থানীয় সাংস্কৃতজনেরা।

ঢাকায় অবস্থানরত সাতক্ষীরার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব নাট্যকার ও নির্দেশক খায়রুল বাসার বলেন, আমি যদিও অনেকদিন সাতক্ষীরার বাহিরে আছি। আমার জানার কিছুটা পার্থক্য হতে পারে তবে খুব বেশি হবে না কারণ নিয়মিত যাতায়াত আছে। আমি বলব সাতক্ষীরা আগের তুলনায় সবদিক থেকে অনেক উন্নত হয়েছে, মানুষের জীবন যাপনের মান বেড়েছে। চিংড়ি চাষ, মাটি পোড়ানো ব্যবসা, বে-আইনী ব্যবসা এ সবের কারণে অনেক টাকা-পয়সার চালাচালি হচ্ছে। অনেক পত্রিকা হয়েছে সেখানে। কিন্তু মূল যে বিষয়টাÑ জেলার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এখন একদমই ভাটা পড়েছে। আমাদের সময় জনসংখ্যা কম ছিল। তখন ষাটের দশকে আমাদের নিজস্ব একটা সাংস্কৃতিক ধারা ছিল। আমাদের সময়ে আবুল হোসেন নামে একজন সাহিত্যমোদী শিক্ষক ছিলেন। তার কাছে শুনেছি আমাদের সাতক্ষীরায় চল্লিশ দশকে ‘রসচক্র’ নামে একটা সাহিত্য সংগঠন ছিল। আমাদের সময় ছিল ‘প্রগতি সংঘ’ ও ‘ক্রোক’ নামে দুটি সংগঠন। ‘ক্রোক’ ছিল স্কুল কেন্দ্রিক। এই ক্রোকে’র নেতৃত্ব দিতেন আমাদের শিক্ষক তবিবুর রহমান। আর ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন আজমলুল হক। এটা ১৯৬৫ সালের দিকে। আমরা তখন প্রগতি সংঘ থেকে ‘প্রগতি’ নামে একটা পত্রিকা বের করতাম। আবুল হোসেন খান স্যারই ছিলেন এর সম্পাদক। ঐ সময় আরেকজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন কাওসার আলী, তিনি ভালো নাটক লিখতেন, নির্দেশনা দিতেন। তখন নাটক মঞ্চায়ন হত এখন যেটা সাতক্ষীরা সাংস্কৃতিক পরিষদ, সেটা আগে ছিল দরবার হল। এ মঞ্চে সেসময়ও সীনেমা প্রদর্শন হত, এখনও সীনেমা হলই আছে। তবে সাতক্ষীরায় নাটকের কাজটাই আগে শুরু হয়েছিল। ১৯১১ সালেই এখানে ড্রামাটিক ক্লাব তৈরি হয়েছিল। সাহিত্যচর্চাটা এখানে পড়ে শুরু হয়। এরপর ‘কাফেলা’ নামে একটি পত্রিকা বের হয যেখানে আমাদের কবিতা গল্প ছাপা হত। ঐ সময় আমরা যখন নাটক নিয়ে ব্যস্ত তখন সাহিত্য নিয়ে কাজ করতেন আবেদ ভাইরা। মানে আবেদ খান। তবে সাতক্ষীরার প্রথম পত্রিকা মানে বৃহত্তর খুলনা থেকে প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা গোলাম রহমানের মাসিক মসজেদ। এ সবের বিষয়ে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ভালো বলতে পারবে এখন পল্টু বাসার, হেনরী সরদার, শহীদুর রহমান শহীদ প্রমূখরা। তবে সাতক্ষীরার বর্তমান শিল্প-সাহিত্য চর্চা নিয়ে আমি হতাশ।
satkhira
সাতক্ষীরার বর্তমান সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নিয়ে জেলা সাংস্কৃতিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হেনরী সরদার বলেন, ১৯৭১ সাল থেকে দরবার হলটি সাংস্কৃতিক পরিষদ নামে জেলার শিল্প-সাহিত্যচর্চার সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ শুরু করে। প্রথমদিকে এর ভূমিকা বেশ শক্তিশালী হলেও ৭৫-এর পড়ে এটি রাজনৈতিক াস্থিরতার স্বীকার হয়ে তার লক্ষ্য তেকে অনেক দূরে সরে যায়। সম্প্রতী নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন হয়েছে এবং পুরাতন গঠনতন্ত্রকে ভেঙে নতুন গঠনতন্ত্র তৈরি করা হয়েছে। এতে জেলার থানা-উপজেলা পর্যায়ের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে নিয়মিত পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের াঙ্গীকারসহ বেশ কিছু উন্নয়নধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যারা মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দারিদ্র অথচ প্রতিভাবাণ সাহিত্যকর্মী, নাট্যকর্মী বা সঙ্গীত ও নৃত্য শিল্পীকে অর্থনৈতিক সহযোগীতা প্রদান, নাটক মঞ্চায়নের জন্য অনুদান প্রদান ইত্যাদি। এখন এ পরিষদের নিজস্ব আয়ের ব্যবস্থা হয়েছে, সে সাথে আয় ব্যয়ের স্পষ্ট জবাবদিহিতারও ব্যবস্থা হয়েছে। বর্তমানে এ সংগঠনের সদস্য সংখ্যাক্রিড়া সংগঠনসহ প্রায় ১০০টি। এর মধ্যে ৫৫টি সংগঠনই সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নির্ভর। সরাসরি সাহিত্য সংগঠন রয়েছে প্রায় ২০টির মত। জেলা সদরে সাহিত্য চর্চা করে ইক্ষণ, সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমী, সাহিত্য পরিষদ, আকার সাহিত্য সংসদ, কবিতাকুঞ্জ ইত্যাদি। এখানে প্রতিটি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনেরই কিন্তু থানা ও উপজেলা পর্যায়ে শাখা রয়েছে। আবার সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় নিজস্ব সংগঠন রয়েছে ১৫/২০টি। সন্দরবনের কাছে শ্যামনগরেও সংগঠন রয়েছে আছে। সাহিত্যের বিষয়ে এখানে পল্টু বাসার নেতৃত্ব দেন।

সাতক্ষীরা সাহিত্য পরিষদের সভাপতি কবি শহীদুর রহমান বলেন, বর্তমানে সাতক্ষীরার সাহিত্য অঙ্গন অনেক সম্মৃদ্ধ। এখানের জেলা সাংস্কৃতিক পরিষদ নেতৃত্ব পরিবর্তনের ফলে সাহিত্য বিষয়ের সমন্বকয়কারীর দায়িত্ব পালন করছেন পল্টু বাসার। প্রতিটি সংগঠনের মধ্যেই এখানে তাই গভীর সম্প্রীতি খুজে পাবেন। কোতাও কোন দ্বন্দ্ব নেই। যে কারণে এখন সত্যিকার সাহিত্যের চর্চাটা হচ্ছে। পল্টু বাসার মূলত কবি ও গল্পকার। এরপর আছেন প্রবীণদের মধ্যে কবি গাজী শাহজাহান সিরাজ, কবি ও ছড়াকার নাজমূল হাসান, কবি শুভ্র আহমদ, কবি সালেহা আক্তার, কবি বেণু খান, কবি ও প্রাবন্ধিক মীর আমজাদ আলী, ছড়াকার আবু হাসান আজাদ প্রমূখ। আর তরুণদের মধ্যে নরেন্দ্র সুসন্ধ্যা, মনিরুজ্জামান মুন্না, ম. জামান, সাব্বির আহমেদ, সায়েম ফেরদৌস মৃদুল, দেবহাটার সাবিলা ইয়াসমিন মিতা, কলারোয়ার আতিয়ার রহমান প্রমূখ নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করছেন। সাতক্ষীরা থেকে বেশ কিছু লিটল ম্যাগও প্রকাশিত হচ্ছে। যেমন জেলা থেকে আমিরুল বাসারের সম্পাদনায় সাম্প্রতীক ও ম জামানের সম্পাদনায় ভোর, কালিগঞ্জ থেকে খড়কুটো, শ্যামনগর থেকে তটনী, আশাশুনি উপজেলা থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা প্রগলভ ইত্যাদি।

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!