সাংবাদিক স্বপনঃ বই পাগল একজন অনুবাদক ও লেখক
চলতি বছর সাহিত্য বাজার সাহিত্য সম্মাননা প্রদান করা হচ্ছে সবসময় অন্তরালে থেকে যাওয়া, প্রচারবিমুখ সাংবাদিক, লেখক ও অনুবাদক আনিসুর রহমান স্বপনকে। এটা তার সম্মান বাড়াতে নয়। বরং এটা করে নিজেরাই সম্মানিত হতে চায় সাহিত্য বাজার ডটকম সম্পাদক ও প্রকাশক।
ঢাকায় জন্মগ্রহণ করা বরিশালের সন্তান আনিসুর রহমান স্বপন এর সাথে আমার পরিচয় ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে। দৈনিক ভোরের কাগজের মফস্বল বিভাগের সাব এডিটর রমেন বিশ্বাস এই পরিচয়টি ঘটিয়ে দেন। কৃতজ্ঞতা সবসময় রমেনদার প্রতি। কারণ, ভোরের কাগজে তার ও বার্তা সম্পাদক অলক গুপ্তের সমর্থন ও সহযোগিতায় আমি ঐ সময় ঘুরে বেড়িয়েছি বাংলাদেশের প্রায় সব জেলায়। পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও মঠবাড়িয়ায় তখন ভোরের কাগজের প্রতিনিধি সন্ধানের প্রয়োজনে রমেন দা আমাকে পাঠালেন বরিশাল প্রতিনিধি আনিসুর রহমান স্বপন এর কাছে। মতিউর রহমান ভাই তখন ভোরের কাগজের সম্পাদক। বরিশালে এসে আনিসুর রহমান স্বপন ভাইয়ের কাছে নিজের পরিচয় জানাই – ভোরের কাগজের একজন কনট্রিবিউটর বা প্রদায়ক হিসেবে। চশমার কারণে খুব গুরুগম্ভীর মানুষ ভেবে কিছুটা দূরত্ব মেনে চলার চেষ্টা ছিলো আমার। প্রথমদিকে তিনিও সেটাই ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু যেই জানতে পারলেন আমিও বরিশালের চাঁদপুরা ইউনিয়নের তালুকদার হাটের সন্তান। তখনই তার গম্ভীরতা ভেঙে খান খান হলো। হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন নিজের ঘরে পরিচয় করিয়ে দিলেন স্ত্রী ও সন্তানের সাথে। দুপুরে তার ঘরেই খেতে হলো এবং পিরোজপুর ও পটুয়াখালীতে কার কার সাথে যোগাযোগ করবো তাও পথনির্দেশ করে দিলেন। (তার দেখানো পথে হেটে পটুয়াখালীতে কাজল বরুণ দাস এবং পিরোজপুরে ওবায়দুল কবিরকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ পেল ভোরের কাগজে।) ঐ অল্পসময়ে বরিশাল প্রেমী একজন মানুষের প্রতি আমার গভীর ভালোবাসা তৈরি হয়ে গেল। যা পরবর্তীতে আরো নির্ভরতা বাড়িয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থান করার পরও বরিশালে ফিরে এসেছেন। ঢাকায় প্রচুর সম্ভাবনা তৈরির পরও তিনি বরিশাল ছাড়েন নি বরং ঢাকাকেই তার কাছে আসতে বাধ্য করেছেন। এমন একজন দেশপ্রেমিক আনিসুর রহমান স্বপন বরিশালের মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে আজো সাংবাদিকতা পেশায় জড়িয়ে আছেন। পড়তে ভালোবাসেন। ভালোবাসেন লিখতে। আর পড়া ও লেখার মাঝেই সময় কেটে যায় তার। বইবাজারে নতুন কোনো বই আসলেই সবার আগে সে বইটি তার চাই। বরিশালের খ্যাতনামা বইয়ের দোকান বুক ভিলার মালিক কর্মচারী তাই নতুন বই এলেই আগে আনিসুর রহমান স্বপনকে ফোন করেন। তারপরের ফোনটি করেন অধ্যাপক তপংকর চক্রবর্তীকে। এই করে নিজের বাড়িটিকেই লাইব্রেরি বানিয়ে ফেলেছেন আনিসুর রহমান স্বপন। তার বই সংগ্রহ ও পড়ার নেশা আজ অনন্য উদাহরণ বরিশালের আগামী প্রজন্মের জন্য।
ছোটোবেলা খেলতে গিয়ে ডান চোখে তীব্র আঘাত পান তিনি। যে আঘাতে তার চোখটি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে। এরপর থেকে একচোখে দীর্ঘ ছয় দশক ধরে নিজের প্রতিটি কাজ করে চলছেন। এ বিষয়ে আনিসুর রহমান স্বপন বলেন, আমার মনে হয় অন্যান্য যে কোনো নেশার থেকে বই সংগ্রহ করা ও পড়া আর মারাত্মক এবং ব্যয়সংকুল নেশা। আর আমি মনে করি পাঠ অভ্যাস করাটা আমাদের সবার জন্য জরুরি। তবে অনেকেই ইউটিউব বা বিভিন্ন মাধ্যমে পড়ার চেষ্টা করে, তবে প্রিন্ট বই পড়ার মজাটাই আলাদা। এটা ইউটিউব বা গুগলে পাওয়া যাবে না। তাই বলতে পারি এখনো মুদ্রিত বইয়ের আকর্ষণ রয়েছে এবং এটা কখনোই শেষ হবার নয়।
তিনি বলেন, বাবা প্রয়াত আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইসমাইল খানকে দেখে ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার খুব সখ তৈরি হয়েছিল। মাত্র চার থেকে পাঁচ বছর বয়সে ডান চোখে আঘাত পাই। এরপর বিভিন্নভাবে চিকিৎসা করালেও চোখটি ভালো হয়নি, শুরু হয়ে যায় একচোখের জীবন। তবে এমনও দিন গেছে চোখের ডাক্তার দেখানোর টাকা দিয়ে নতুন বই কিনে আনতাম। আবার সদররোডের বাসার নিচতলার দোকানের ভাড়া অনেক মাসেই আব্বা নিতে পারতেন না। কারণ বই কিনে কিনে ভাড়ার টাকা খুইয়ে দিতাম। তারপরও বই পড়া কখনো ছাড়িনি। মাত্র একটি চোখের ওপর চাপ দিয়ে বই পড়া চালিয়ে গেছি। এখনও এমন দিন যায় বই পড়তে পড়তে রাত-ভোর হয়ে যায়। আর বই পড়া থেকেই লেখার প্রতি আগ্রহটা সৃষ্টি হয়। তবে বয়স হওয়ায় মাঝে মধ্যে কিছুটা কষ্টও হয়।
আদতে ৭০ প্রায় বয়সের যুবক আনিসুর রহমান সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থেকেও নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাসের ফলে অর্জিত জ্ঞানকে পুঁজি করে লেখালেখির কাজটিও করেন প্রচণ্ড নৈতিকতা নিয়ে। কোথাও তথ্য ঘাটতি হলে সে নিউজটি অপ-সাংবাদিকতা বলে মনে করেন তিনি।
তিনি জানান, সংবাদে তথ্য ঘাটতি থাকা উচিত নয়। কারণ এতে করে পাঠক বিভ্রান্ত হবে। তাই সাংবাদিককে পড়তে হবে। যখন যে বিষয়ে প্রতিবেদন সাজাবে, সে বিষয় সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখতে হলে পড়তেই হবে। পড়ার কোনো বিকল্প নেই। সংগ্রহে তার দুর্লভ কিছু বই রয়েছে। আর তার সংগ্রহশালায় বিভিন্ন ধরনের বইয়ের মধ্যে ইতিহাস ও দর্শনের বই সবচেয়ে বেশি ।
প্রচার বিমুখ, অন্তর্মুখী, বইপোকা মানুষ আ.ব.ম. আনিসুর রহমান স্বপন ১৯৫৭ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকার ১৩ নম্বর নয়া পল্টনে নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার ক্ষিরাকাঠি গ্রামে হলেও বেড়ে ওঠা বরিশাল শহরে। বাবা মো: ইসমাইল খান আইনজীবী ছিলেন এবং মা আয়েশা বেগম (হেলেন)। বরিশালের সিস্টার্স ডে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের শুরু। এরপর বরিশাল ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে ১৯৭১ সালে (১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত) এসএসসি, বরিশাল ব্রজমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ১৯৭৩ সালে এইচএসসি, একই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৭৬ সালে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান ) এবং ১৯৭৭ এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ ড. কাজী দীন মুহম্মদের তত্ত্বাবধানে কথা সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদের ভাষা চিন্তার উপর কিছুদিন এম ফিল এবং পশ্চিম বঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. পবিত্র সরকারের তত্ত্বাবধানে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষার উপর পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণা করলেও তা অসমাপ্ত রাখেন। ১৯৮৬ সালে তিনি জীবীকার সন্ধানে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান এবং ইরানের তেহরানে অবস্থান করেন। ১৯৯৬ পর্যন্ত তিনি তেহরানে ছিলেন। তখন তিনি ইসলামিক প্রপাগেশন অর্গানাইজেশনে অনুবাদক, রেডিও তেহরানের বাংলা বিভাগের ঘোষক, সংবাদ পাঠক, সম্পাদক ও ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ‘ডেইলি তেহরান টাইমস’ পত্রিকায় কাজ করেন। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের পত্রিকা ‘প্রতিক্ষণ’, ‘বিভাব,’ ও ‘সাঙ্কৃতিক খবর’এ লেখালেখি করেছেন।
১৯৭০ সালে ঢাকা ডাইজেস্ট পত্রিকায় ‘সুইজারল্যান্ডের ঘড়ি শিল্প’ এবং ‘ হযরত মুসা (আ:) এর সমুদ্র অতিক্রম ও ফেরাউনের শলিল সমাধি শিরোনামে দু’ টি অনুবাদ কর্মের মাধ্যমে তার লেখক জীবনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বাবা ছাড়াও তৎকালীন’ পাকিস্তানি খবর’ পত্রিকার লেখক ও বামপন্থী ( মার্ক্সবাদী) চিন্তা ধারায় বিশ্বাসী ( পরবর্তীতে পীরের খলিফা) ছোটচাচা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা মোঃ হাবিবুর রহমান খানের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় ছোটবেলা থেকেই আনিসুর রহমান খান স্বপনের লেখালেখি ও পাঠের অভ্যাস গড়ে ওঠে এবং তখন থেকেই বই সংগ্রহ করা তার প্রিয় শখে পরিণত হয়। বর্তমানে তার বিশাল গ্রন্থাগারটিতে বহু দুর্লভ বই রয়েছে। এমনকি মহাকাব্য মেঘদূত এবং ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতও প্রথম সংস্করণ রয়েছে তার সংগ্রহে।
১৯৭৩ সালে বরিশাল থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক গণডাক’ পত্রিকার মাধ্যমে তার সাংবাদিক জীবনের শুরু। এরপর ১৯৮২-১৯৮৪ পর্যন্ত জাতীয় দৈনিক আজাদ, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিদেশে পাড়ি জমানোর আগ পর্যন্ত স্থানীয় সাপ্তাহিক লোকবাণী, দেশে ফিরে এসে জাতীয় দৈনিক ভোরের কাগজ ও বাংলা ট্রিবিউন এ কাজ করেন। বর্তমানে তিনি ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ এবং ঢাকা ট্রিবিউন এর সাথে বরিশাল প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। আনিসুর রহমান খান স্বপন বাংলা একাডেমি, বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি ও এফপিএবি বরিশাল এর আজীবন সদস্য।
প্রকাশিত গ্রন্থ
ফার্সী ভাষার ব্যাকরণ (১৯৯০), পারস্যে রবীন্দ্র চর্চা (১৯৯৩), বাংলাদেশে ফার্সী ভাষা ও সাহিত্য (১৯৯৫), পারস্যে রবীন্দ্রনাথ (২০১৭), একটি মোরগের কাহিনী ( অনুবাদ,১৯৮৬), পারলৌকিক জীবন ( অনুবাদ: ১৯৮৭) এবং তাহেরেহ সফরজাদেহ: স্বনির্বাচিত কবিতা (অনুবাদ: ১৯৯১)
প্রকাশিতব্য গ্রন্থ
মাহাদী সহেলির কবিতা (অনুবাদ), দারাশুকোর অনূদিত উপনিষদ, নাজিম হেকমতের কবিতা (অনুবাদ), কাহলিল জীব্রানের সুভাষিত সুবচন ( অনুবাদ), জরথ্রুস্টের আবেস্তা এবং মওলানা রুমির নেই ও শ্রী কৃষ্ণের বাঁশি। পারস্যে রবীন্দ্রনাথ বইটির জন্য কলিকাতার ‘সাঙ্কৃতিক খবর’ গোষ্ঠী তাকে ভূমেন্দ্র গুহ স্মৃতি পুরস্কারে সম্মানিত করে।
আনিসুর রহমান স্বপন নিজ উদ্যোগে বরিশাল সদর রোডের পৈতৃক ভিটে এবং বরিশালেরই কাউনিয়া প্রধান সড়কে শ্বশুরালয়ে আলাদা আলাদা দুটি সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন। পারিবারিক জীবনে আনিসুর রহমান খান একজন সুখী ব্যক্তি। তার সহধর্মিণী অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক লেখক ও সমাজসেবী বেগম ফয়জুন নাহার শেলী বলেন, এই লাইব্রেরি হচ্ছে আমার সতীন। সারাক্ষণ বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকেন তিনি। সংসারের অন্য সব বিষয়ে উদাসীন একটা মানুষ। তবে তার সাথে সাথে আমারও অভ্যাস হয়ে গেছে এই লাইব্রেরি ব্যবহার করার। ছেলেমেয়েরাও সবাই বই পড়তে খুব ভালোবাসে। এটা এ যুগের জন্য বিরলই বলতে হবে। তাদের সংসারে দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড়ছেলে আরিফুর রহমান খান তানিম একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির হিসাবরক্ষক, ছোটছেলে আসিফুর রহমান খান তামিম এল এল বি (সম্মান) সালাম-আজিজ ল চেম্বরের সাথে যুক্ত রয়েছে এবং মেয়ে তানিমা রহমান খান শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অফ ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি থেকে স্নাতক (সম্মান) পাস করে স্বনির্ভর ব্যবসা করছে।