বরিশালের সাংবাদিকতায় নারীদের অবস্থান ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।এখানে পেশাদার সাংবাদিকতায় পুরুষরাই মর্যাদাহীন।সেখানে নারীদের টিকে থাকা কতটা কঠিন তা অনুমান করা যায়।
বরিশাল জেলার ৪২ থেকে ৪৫ টি পত্রিকার সাংবাদিক সংখ্যা ২০ জনও নেই। নিয়মিত ও অনিয়মিত এসব পত্রিকা চলছে একজন বার্তা সম্পাদক ও একজন কম্পিউটার ডিজাইনার নিয়ে। নামমাত্র বেতনে কঠিন জীবনযাপন। তবে এখানের সাংবাদিক সংগঠন ও প্রেসক্লাবের দেয়া তথ্যে জেলায় সাংবাদিক রয়েছেন প্রায় চারশতজন।প্রেসক্লাবের ৮০ জন এবং সাংবাদিক সংগঠনভুক্ত ২০০ জন।এছাড়া আনুমানিক ১০০জন। যারা বেশিরভাগ পরিচয়পত্র নির্ভর।
জাতীয় আলোচিত দৈনিকগুলোর প্রতিনিধি ছাড়া বাকীদের জীবীকার প্রয়োজনেই খুঁজতে হয় বিকল্প উপায়। আর এই প্রতিযোগিতায় অনেক পিছিয়ে বরিশাল জেলার নারী সাংবাদিকতা। সংগঠনভুক্ত না হলে পরষ্পরের প্রতি সহমর্মিতাটুকুও এখানে অনুপস্থিত বলে জানালেন বরিশালের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ও ছড়াকার তপংকর চক্রবর্তী। সম্প্রতি বই বাজারে পুনঃমুদ্রিত হয়ে এসেছে তার সম্পাদিত গ্রন্থ বরিশালের সাংবাদিকতা।
পুরুষ নারী এই বৈষম্য সাংবাদিকতা পেশার জন্য প্রচণ্ড ক্ষতিকর। নারী কিম্বা পুরুষ উভয়ের পরিচয় এখানে সাংবাদিক বা সংবাদকর্মী। একটি পত্রিকা প্রকাশের জন্য মাঠ সাংবাদিক যেমন কাজ করেন, তেমনি কাজ করেন কম্পিউটারের সামনে বসে মাঠ সাংবাদিকদের পাঠানো তথ্যগুলো এডিটিং এর দায়িত্বে থাকা সহসম্পাদক বা সাব এডিটর। তিনিও সংবাদকর্মী অবশ্যই। সে অর্থে তিনিও সাংবাদিক।
আর যদি সাংবাদিকতার সঠিক শব্দার্থ ব্যবহার করা হয়, তাহলে জার্নালিজম নিয়ে পড়াশুনা করে সংবাদ মাধ্যমে কাজ করতে আসা মানুষগুলো ছাড়া অন্যকেউ ই সাংবাদিক নয়। সেক্ষেত্রে বরিশাল তো ভালো আমাদের ঢাকার জাতীয় দৈনিকের কেউ সেই অর্থে সাংবাদিক নন। সবাই রিপোর্টার বা প্রতিবেদক। অবশ্যই তারা, আমরা সবাই সংবাদকর্মী।
এভাবেই নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন দৈনিক শাহনামা পত্রিকার প্রকাশক শাহ সাজেদা।
বরিশালের প্রথম মহিলা সাংবাদিক দাবীদার শাহ সাজেদা ৮০ দশক থেকেই সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত তিনি। তার দাবীও প্রচণ্ড শক্তিশালী।কেননা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করে তিনি বাবা প্রয়াত মোঃ হোসেন শাহ এর হাত ধরে সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেন।১৯৯০ সালে দৈনিক শাহনামা ডিক্লেয়ারেশন হলে
উপমহাদেশের প্রথম নারী সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে তাঁর অবস্থান উল্লেখ করা হয় জাতীয় দৈনিকসহ বিভিন্ন প্রকাশনায়। আজ পর্যন্ত তিনি দৈনিক শাহনামার প্রকাশনার সাথেই যুক্ত আছেন তবে সম্পাদক হিসেবে আছেন তারই স্বামী, বরিশাল মেট্রোপলিটন প্রেসক্লাবের সভাপতি কাজী আবুল কালাম আজাদ।
শাহ সাজেদা বলেন, ঢাকার মাঠে আলোচিত সংবাদকর্মী বা সাংবাদিকদের কেউই কিন্তু জার্নালিজম স্টুডেন্ট না। সম্প্রতি আলোচিত দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম, বহুল আলোচিত এটিএন নিউজের মুন্নিসাহা, নাদিরা কিরণ ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বাসস এর সাংবাদিক মাহফুজা জেসমিন এরা কেউই কিন্তু জার্নালিজম পড়ে সাংবাদিকতা পেশায় আসেন নাই। তারা কেউই কিন্তু পুরুষদের চেয়ে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। সেখানে জেলা শহরে নারী সাংবাদিকতা ক্রমশ গুটিয়ে যাচ্ছে। আমরা যারা টিকে আছি তারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছি।
একইকথা বললেন সাংবাদিক মর্জিনা বেগম ও সুমাইয়া জিসান।জিসান আরো বলেন, পারিবারিকভাবে সাপোর্ট না পেলে আমাকেও ছেড়ে দিতে হতো এ পেশা।আর কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকার অভিযোগ মর্জিনা বেগমের।
বরিশাল রিপোর্টারস ইউনিটির সদস্য ও বেতারের নিউজ বিভাগের কর্মী মর্জিনা বলেন, বরিশালের সাংবাদিক অঙ্গনে মেয়েদের দৈন্যদশা চলছে।পুরুষদের বেতন ভাতার যেখানে ঠিক নেই,সেখানে মেয়েদের জীবীকা কতটা কঠিন তা আপনারই অনুমান করুন।এখানের পত্রিকায় কাজ না করলে সত্যিকার অবস্থা কেউ বুঝতে পারবেনা ।
বৃহত্তর বরিশাল তথা বরিশাল জেলার সবচেয়ে পুরাতন পত্রিকার তালিকায় যুগান্তর, বিপ্লবী বাংলাদেশ এরপরই দৈনিক শাহনামা ও শাহ শারমীনের বাংলার বনে নামটি উঠে আসে প্রথম সারিতে। পাশাপাশি শোনা যায় দৈনিক দক্ষিণাঞ্চল ও দখিনের মুখ নামটি।তবে পাঠকের কাছে পরিচিত নাম মেহেরুন্নেছা প্রকাশিত দৈনিক আজকের বার্তা। যদিও এ পত্রিকার ছাড়পত্র পেতেও লেগেছিল দৈনিক শাহনামা’য় কাজের সনদ।
আরো আছেন সোনিয়া রহমান, শারমিন আক্তার ও নুসরাত রশিদ প্রমুখ প্রকাশক বা প্রধান সম্পাদক। যাদের এ পদবী শুধু মাত্র প্রেসক্লাবের সদস্য ও নেতা হতে। কিম্বা হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালানোর সুবিধা নিতে বলে জানান সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সাংবাদিক এস এম ইকবাল। বর্তমানে তিনি অসুস্থ হয়ে বিছানায় আছেন, তার সুস্থতার জন্য দোয়া কামনা সকলের কাছে।
কাগজে কলমে এই সম্পাদক ও প্রকাশকরা থাকলেও বাস্তবে তাদের শুধু প্রেসক্লাবের প্রাপ্তি সফলতায় খুঁজে পাওয়া যায়। আর তাদের অধীনে কর্মরত বরিশালের নারী সাংবাদিকদের বর্তমান বা ভবিষ্যত পুরোটাই শূণ্য বলে মনে করেন বরিশালের সুশীল নেতারা।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একান্তই নিজস্ব চেষ্টায় হাতেগোনা যে কয়েকজন টিকে আছেন, তাদের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সহ্য করে কাজ করতে হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্তে। তারা বলেন, বরিশালের সাংবাদিক অঙ্গনে পুরুষদের বেতন ভাতার যেখানে ঠিক নেই, পুরুষদের মান-মর্যাদা যেখানে প্রতিনিয়ত লুট হচ্ছে, সেখানে মেয়েদের কাজ করা কতটা কঠিন তা আপনারই উপলব্ধি করে নিন।
মর্জিনা বেগম ও সুমাইয়া জিসানের এ অভিযোগ বহুল প্রমাণিত এখানের সাংবাদিক নেতাদের বক্তব্যে। সম্প্রতি বরিশাল জেলা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভপতি স্বপন খন্দকার, রিপোর্টারস ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মিথুন সাহা এর বক্তব্য সাহিত্য বাজার ডট কমে এখনো ঝুলছে।
এখানে মাঠ সাংবাদিকতায় আলোচিত নাম চ্যানেল আই প্রতিনিধি ও বিবিসি নিউজ বাংলা প্রতিবেদক শাহীনা আজমিন। বরিশালের স্থানীয় ও দাম্ভিক এই নারীকে বেশিরভাগ মানুষ এড়িয়ে চলেন।এমনকি তার সহকর্মীরাও তাকে এড়িয়ে চলার যে গুজব এখানে ছড়িয়ে রয়েছে তারই সত্যতা প্রমাণিত হলো প্রতিবেদন তৈরিতে তার সহযোগিতা না পাওয়া।বিনয়ের সাথে তার সহয়োগিতা চাইতেই ফোন ধরে তিনি বললেন, কোনো ফ্রীল্যান্স সাংবাদিকের সাথে কথা বলতে রাজী নন তিনি। পরবর্তীতে মুখোমুখি সাক্ষাতে জানা যায় তার রাগ ও ক্ষোভের কারণ। তিনি জানান, সহকর্মীদের অসহযোগিতা এবং বিভিন্ন সভা সেমিনারে নারী হিসেবে প্রশাসনের অবমূল্যায়ন ও উদাসীনতা দেখে দেখে তিনি পেশাই ছেড়ে দিতে আগ্রহী। এমনকি তার নিজ প্রতিষ্ঠান চ্যানেল আই কর্তৃপক্ষও মফস্বলের কোনো সাংবাদিককে মূল্যায়ন সেভাবে করেননা বলেই মনে হয় তার। সাংবাদিক সংগঠনগুলোও এক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখেনা বলে অভিযোগ করেন শাহিনা আজমিন।
মর্জিনা বেগম এবং দৈনিক প্রথম সকাল পত্রিকার বার্তা সম্পাদক সুমাইয়া জিসান ছাড়া বরিশালের সাংবাদিক অঙ্গনে আর কোনো মাঠ সাংবাদিককে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে ডেস্কে বসে যুগ্ম বার্তা সম্পাদক পদবী নিয়ে কাজ করছেন হাফিজা মুক্তা ও আরজু চৌধুরী রুনা।
এদের মধ্যে হাফিজা মুক্তা দৈনিক দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ১০বছর ধরে কর্মরত। বর্তমানে তিনি পত্রিকার যুগ্ম বার্তা সম্পাদক হলেও বরিশালের সাংবাদিক মহলে তিনি কম্পিউটার কম্পোজার বৈ আর কিছু নয়। আর আরজু চৌধুরী রুনা, হীরামনি উকিল এবং তারমতো খণ্ডকালীন কর্মী যারা আছেন তারা এখানে উল্লেখযোগ্য নন।
সুমাইয়া জিসান আরো যা বলেন,
বরিশালে নারীরা সাংবাদিক পেশায় নিয়োজিত আছে কি না তা জানা নেই বেশির ভাগ সাধারণ মানুষদের । যারা জানে তারাও নারী হিসেবে বিবেচনা করে দুই একটি প্রোগ্রামে ডাকলেও । অধিকাংশ সময়ই নারীদের কোথাও ডাকা হয় না । নারীদের পিছিয়ে রাখা হচ্ছে । হাতে গোনা মাত্র 3 / 4 জন নারীরা সাংবাদিক বরিশালে রয়েছে। তাদের সহকর্মীরাই তাদের মূল্যায়ন করেন না। যেকারণে বাহিরেও তাদের মূল্যায়ন কম হয়।
আর সাহায্য সহযোগিতা? সরকারি বা বেসরকারি কোন সাহায্যই পায় না নারী সাংবাদিকরা । মাঠে থাকা নারী সাংবাদিকদের খোঁজ রাখে না কোন দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষরা । যারা পত্রিকার সাথে জড়িত না থেকেও যে সরকারি বেসরকারি এমন কি রাজনৈতিক কর্তা ব্যক্তিদের কাছ থেকে যে সুযোগ সুবিধা ভোগ করে । তার একাংশ তো দুরের কথা কিছুই পায় না এখানের নারীরা । এক কথায় বলতে হয় নারী সাংবাদিকরা চরম অবহেলিত মফস্বলে। তাদের নারী হিসেবে না দেখে সাংবাদিক হিসেবে দেখা উচিত । অন্য পেশায় নারী পুরুষদের বেতন বৈষম্য না থাকলেও, এ পেশায় নিয়োজিত নারীদের ক্ষেত্রে রয়েছে বেতন বৈষম্য । বরিশালে এমন চলতে থাকলে নারীরা আর এ পেশায় আসবে না ।
ডেস্কে বসে যুগ্ম বার্তা সম্পাদক পদবী নিয়ে কাজ করা হাফিজা মুক্তা দৈনিক দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ১০বছর ধরে কর্মরত। এখানে বার্তা সম্পাদক তরুণ সাংবাদিক প্রিন্স তালুকদার জানান, অভিজ্ঞতার আলোকে মুক্তা আপা এতোটাই সমৃদ্ধ যে তিনি শহরের অনেক সিনিয়র সাংবাদিকের তুলনায় কোনদিক দিয়ে কম নন।
আর হাফিজা মুক্তা বলেন,বরিশালের সাংবাদিক মহলে আমি কম্পিউটার কম্পোজার বৈ আর কিছু নই এটা আমিও জানি। তবে আমি এই দৈনিক দক্ষিণাঞ্চল পত্রিকায় দশবছর ধরে কাজ করছি। আমাকে এখানে যা করতে হয়, বরিশালের অন্য পত্রিকার বার্তা সম্পাদকদেরও একই কাজ করতে হয়। আর আমি আমার সহকর্মীদের প্রতি এজন্য কৃতজ্ঞতা জানাই।