পাঠকের জন্য প্রতিবেদনটি হুবহু তুলে ধরা হল।
রানা প্লাজা ধস: শ্রমিকের অধিকার কতটা নিশ্চিত হয়েছে?
আফরোজা নীলা
বিবিসি বাংলা, ঢাকা
ছয় বছর ধরে ঢাকার একটি পোশাক কারখানায় অপারেটর হিসেবে কাজ করছেন তমা ইয়াসমিন। কারখানায় কাজ করতে যেয়ে যে কোন ধরনের অসুবিধায় তারা কার কাছে যান?
মিস ইয়াসমিন অভিযোগের সুরে জানান, তাদের কারখানায় সুবিধা-অসুবিধার কথা বলার মতো জায়গাটুকু নেই। হয়তো কখনো দাবীর কথা বলতে তারা রাস্তায় নামেন, তবে চাকরি হারানোর ভয়ে নিজেদের কথা বলা থেকে বিরত থাকেন তারা।
“আমি কিছু বলার আগে ভাবি এখন যদি কিছু বলি তাইলেতো আমার চাকরিটা চইলা যাইবো। এখন যদি বের কইরা দেয় তাইলে কোন অফিসে ঢোকা সম্ভব না। তখন বাবা-মা নিয়া কি কইরা খামু? তাই ভাইবা আমরা অনেকেই অনেক সময় চুপ কইরা থাকি”
তমা ইয়াসমিন, পোশাক শ্রমিক
“মনে করেন আমরা কেউ কিছু বলতে চাইলে মালিকে ঝাড়ি মারলো এই তোমরা এতো কথা বলবানা, চুপ কইরা বইসা থাকবা, ফ্যাক্টরী থেকে কেউ বাইর হইবানা। আমাদের কারো বের হওয়ার ক্ষমতা নাই। কারণ বের হইতে গেলে আমাদের কইবো তোমাদের কারো চাকরি নাই, তখন আমরা কি কইরা খামু? ”
“আমার সংসারে আমি একা। আমার বাবা-মা বৃদ্ধ। আমার টাকা দিয়া সংসারটা চলে। আমি কিছু বলার আগে ভাবি এখন যদি কিছু বলি তাইলেতো আমার চাকরিটা চইলা যাইবো। এখন যদি বের কইরা দেয় তাইলে কোন অফিসে ঢোকা সম্ভব না। তখন বাবা-মা নিয়া কি কইরা খামু? তাই ভাইবা আমরা অনেকেই অনেক সময় চুপ কইরা থাকি”।
পোশাক শ্রমিকেরা মনে করছেন কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে তাদের কথা বলার মতো জায়গা তৈরি হতো এবং দাবী-দাওয়ার কথা তুলে ধরতে তাদের রাস্তায় নামতে হতোনা।
“আমরা এক পিস প্রোডাকশান কম পারলে বকা দিয়াই বলে যে তোরা বাইর হইয়া যা ফ্যাক্টরী থেকে, তোদের রাখার প্রয়োজন নাই। কিন্তু আমাদের যদি একটা ইউনিয়ন থাকতো সে আমাদের হইয়া কথা বলতে পারে। গার্মেন্টসে যদি আমাদের কোন সমস্যা হয় বা আমাদের বেতন নাই দিয়া বাইর কইরা দিতে চায়, আমাদের ইউনিয়নটা করা থাকলে মালিকে মনে হয় এ ধরনের কিছু করতে পারবোনা”।
পোশাক শ্রমিকদের প্রায়ই দেখা যায় তারা তাদের বেতন বকেয়া, ঈদ বোনাস বা মজুরি বৃদ্ধির দাবীতে এভাবে আন্দোলনে নামছেন। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে অনেক সময় পোশাক কারখানাও বন্ধ রাখতে বাধ্য হন মালিকেরা।
শিল্পের স্থিতিশীলতা আর শ্রমিকদের সাথে মালিকপক্ষের দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে দীর্ঘদিন ধরে শ্রম আইন সংশোধন করে ট্রেড ইউনিয়ন চালুর দাবী জানিয়ে আসছিলেন শ্রমিক নেতারা।
গত বছর তাজরিন ফ্যাশনসে আগুন লাগার ঘটনায় শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু এবং সাভারে ভবনধসে হাজারো শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনার পর শ্রম আইন সংশোধন করে ট্রেড ইউনিয়ন চালুর দাবী আরো জোরালো হয়ে ওঠে।
এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপে ২০০৬ এর শ্রম আইন সংশোধন করে গত ১৫ই জুলাই শ্রম আইন ২০১৩ পাশ করা হয়। নতুন শ্রম আইনে যে কোন পোশাক কারখানার ৩০ ভাগ শ্রমিকের অংশগ্রহণে ইউনিয়ন করার কথার পাশাপাশি আর শ্রমিকদের নিরাপত্তা আর কর্মপরিবেশের বিষয়ে কিছু সংশোধনী আনা হয়।
তবে সংশোধিত এই নতুন শ্রম আইনটি নিয়েও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। প্রশ্ন উঠেছে নতুন এই আইনটি কি পারবে শ্রমিকের যথার্থ নিরাপত্তা দিয়ে অধিকার নিশ্চিত করতে?
বাংলাদেশের জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন মনে করেন পোশাক শিল্পের স্বার্থে নতু্ন আইনটিতেও বেশ কিছু সংশোধন করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, “আমাদের শ্রম আইন শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা করেনা, শিল্পেরও স্বার্থ রক্ষা করেনা। ২০০৬ সালে শ্রম আইন হওয়ার পরই এই সরকারের কাছে যুগোপযুগী শ্রম আইন চেয়েছিলাম। নির্বাচনের আগেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং সরকার গঠনের পরও বারবার প্রতিশ্রুতির কথা বলেছেন। শ্রম আইনের যে মধ্যে কিছু অগ্রগতি আছে।”
তিনি বলেন, “বিশেষ করে শ্রমিক সংগঠন গড়ার ক্ষেত্রে আগে একটা প্রতিবন্ধকতা ছিল যে , যখন শ্রমিকেরা তাদের ইউনিয়ন গঠন করবে তখন ইউনিয়নের যে কর্মকর্তা এবং সদস্যদের তালিকা সেটা লেবার ডিপার্টমেন্ট থেকে মালিকের কাছে দেয়া। যেটা নতুন শ্রম আইন সংশোধনী থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। যার ফলে শ্রমিক সংগঠন করার ক্ষেত্রে, ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে এক ধাপ অগ্রগতি হলো”।
কিন্তু তারপরও এই নতুন শ্রম সংশোধনী আইনের বেশ কিছু জায়গায় আপত্তি আছে। আরো কিছু সংশোধন শ্রমিকদের স্বার্থে, শিল্পের স্বার্থে করা উচিত বলে মনে করেন মিঃ আমিন।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে শ্রমিক অধিকার যথাযথ নিশ্চিত করেই শ্রম আইনে সংশোধন আনা হয়েছে। শ্রম সচিব মিকাইল শিপারের মতে, শিল্পের স্বার্থে শ্রমিক-মালিক উভয়পক্ষের কথা মাথায় রেখেই নতুন শ্রম আইনে ট্রেড ইউনিয়নের বিধান রাখা হয়েছে।
শ্রম সচিব মিকাইল শিপার বলেন, “আমাদের শ্রম আইন যতটা লিবারেল করতে পারবো ততটুকুই করা হয়েছে। আমি বলবো এটা শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমার একাধারে কিন্তু শ্রমিকদের কথা চিন্তা করলে হবেনা। শিল্পের কথাও চিন্তা করতে হবে”।
তিনি আরও বলেন, “শ্রমিকপক্ষ যেটা বলছেন যে এটা ৩০ শতাংশ শ্রমিকের অংশগ্রহণের বিষয়টি বাদ দেয়ার। কিন্তু একটা ফ্যাক্টরিতে আমরা সর্বোচ্চ তিনটার বেশি ট্রেড ইউনিয়ন করতে দিবনা। কিন্তু এই স্লট যদি আমরা তুলে দিই একটা গার্মেন্টসে ধরেন ৫০০ শ্রমিক আছেন। এই স্লট যদি না থাকে তাহলে দেখা যাবে একটা ফ্যাক্টরীতে ১০০টা ট্রেড ইউনিয়ন হয়ে বসে আছে। উনারা ট্রেড ইউনিয়ন করবেন না উৎপাদনের সাথে জড়িত হবেন। এখন সবকিছু সার্বিক বিবেচনা করেতো ব্যবস্থা করতে হবে, আমরা তাই করেছি”।
তবে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা বলছেন মালিকদের অনুমতি ছাড়া ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারলেও শ্রমিকদের চাকরি ও কর্মস্থলে নিরাপত্তার বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে।
শ্রমিক অধিকারের প্রশ্নে মালিকপক্ষের জবাবদিহিতার বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের প্রধান নির্বাহী সৈয়দ সুলতানউদ্দিন আহমেদ।
তাঁর মতে, শ্রম আইনে ট্রেড ইউনিয়নের স্বীকৃতি থাকলেও পোশাক মালিকদের বিরোধিতার কারণে তা পূর্ণরূপ পাচ্ছেনা। রানা প্লাজা, তাজরিনের মতো দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সেকারণে শ্রমিকদের কথা বলার জায়গা তৈরি করে দিতে হবে। এবং কথা বলার জায়গা যদি থাকতো তাহলে হয়তো পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ আর দুর্ঘটনার বিষয়গুলো এড়ানো যেত বলে মনে করেন মিঃ আহমেদ।
শ্রমিকপক্ষের অভিযোগ পোশাক মালিকদের কারণেই গত তিন দশকের পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন সম্ভব হয়নি।
শ্রমিক নেতারা মনে করেন পোশাকশিল্পে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের কোন বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে সরাসরি ট্রেড ইউনিয়ন নেই। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন রয়েছে যাদের বেশিরভাগই কোন না কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত।
বলা হয়ে থাকে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ওপর এমন সংগঠনগুলোর প্রভাব রয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন থাকলেও বাংলাদেশে নেই।
ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে পোশাক মালিকদের বিরোধিতা কেন?
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও গার্মেন্টস মালিক আনিসুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, কারখানায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও রাজনৈতিক প্রভাব তৈরি হওয়ার ভয়ে ইউনিয়ন নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব কাজ করে পোশাক মালিকদের মধ্যে।
পোশাক শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকের অধিকার সবক্ষেত্রে নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করেন মিঃ হক। ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হলেও তা মালিক শ্রমিকের দুরত্ব কমিয়ে এনে তা পোশাক শিল্পের স্থিতিশীলতায় ইতিবাচক ভূমিকা্ রাখবে এমনটা আশা করছেন পোশাক মালিকেরা।
অন্যদিকে শ্রমিক নেতাদের দাবী শ্রমিকের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে মালিকদের জবাবদিহিতার দিকে যেন সরকার নজর দেয়। নেতাদের। শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণে শুধু আইন প্রণয়ন না করে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবীও রয়েছে শ্রমিকপক্ষের । শ্রমিক নেতারা মনে করেন পোশাক শিল্পের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ট্রেড ইউনিয়নের কোন বিকল্প নেই।
মালিকপক্ষের সহযোগিতা থাকলে শ্রমিকেরা সুসংগঠিত হয়ে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে পারবে। আর তাহলে হয়তো পোশাক শিল্পের চলমান সংকট কাটিয়ে সামনের দিকে চলার পথ সুগম হবে-আশাবাদ শ্রমিক নেতাদের।