(গত ৩০ জানুয়ারী ২০১১ বরিশালে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ অঞ্চলীয় সাহিত্য সম্মেলন নিয়ে বিভিন্ন বাক-বিতাণ্ডা এবং এটিকে রাজাকারের সম্মেলন আখ্যা দিয়ে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ এবং সাহিত্য বাজার-এর জেলায় জেলায় সাহিত্যে প্রকাশিত ময়মনসিংহ, খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, রাজশাহী চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলার সংবাদ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আমাদের সাহিত্যের বিভাজনটা খুব বেশি । প্রায় প্রতিটি জেলাতেই লেখকদের মধ্যে গ্রুপিং, একে অপরের নিন্দা লেগেই আছে। এসব কারণে বাংলা সাহিত্যের সৃজনশীলতা নষ্ট হচ্ছে, সাহিত্য হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত এবং স্বাভাবিক কারণেই পাঠক হচ্ছেন বিভ্রান্ত। এ বিষয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা শহরের সাহিত্য সংশ্লিস্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে, বরিশালের কবি ও লেখক ও সংগঠকদের সাথে এবং পাঠকদের সাথে আমরা সরাসরি ও টেলিফোনে যোগাযোগ করে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছি। যা থেকে সত্যিকার অবস্থাটা কী তা পাঠক নিজেই বুঝে নিতে পারবেন। এতে আমাদের যদি কোনো ভ্রান্তি থাকে অনুগ্রহ করে শুধরে দিন। আমরা তাও প্রকাশ করতে দ্বিধা করবো না।)
বাংলা সাহিত্যে কেন এত বিভাজন, গ্রুপিং? মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সুকান্তের পরে কেন কোনো নতুন প্রতিভা তৈরি হচ্ছেনা? আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস, আহমদ ছফা, হুমায়ূন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ প্রমূখরা কেন সব মহলের, সাধারণ পাঠকের কাছে জনপ্রিয় হতে পারেন নি? প্রশ্নগুলো শোনা মাত্রই সৃজনশীল সাহিত্যচর্চার সাথে জড়িত বেশিরভাগ লেখকই আৎকে উঠলেন, “ না না সাহিত্য বিশাল একটা ব্যাপার। বিশাল এর পরিধি। সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক, আবৃত্তি এমন কী সীনেমা এসবই সাহিত্যের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ। এমন কী মানুষের চিন্তা চেতনা, কথা বলার ভাব-ভঙ্গি এ সবও সাহিত্য। সাহিত্যের কোনো বিভাজন নেই। বিভাজনটা সাহিত্যিকদের মধ্যে। যারা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না তারাই গ্রুপিং করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন।” আমাদের দেশে লেখকদের মধ্যে এই গ্রুপিং প্রবণতা বেশি। তাই সৃজনশীলতার প্রকাশ মাত্র তার প্রচারটা থেমে যায়। কেউ একজন ভালো করলে অন্যজন তার নিন্দা শুরু করে তাকে দাবিয়ে দেয়। আর যে ভালো করে সে নিন্দা শোনা মাত্র নিজেকে গুটিয়ে ফেলে।
আবার তারা এটাও বলেন, “আমরা যেহেতু মানুষ, আমাদের চিন্তা-চেতনার পার্থক্য হবেই। তাই সাহিত্যে নানান মতালম্বীদের মিশ্রণ দেখা যায়। কেউ ধর্ম বিরোধী, কেউ ধর্মীয় বোধে আবদ্ধ, আবার কেউ কেউ জাত, ধর্ম থেকে উর্ধ্বে উঠে বিশ্বময় হয়ে সাহিত্যচর্চা করেন। সবাই কিন্তু সৃজনশীল সাহিত্যের-ই চর্চা করেন। সমাজও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ সাহিত্য সবসময়ই সৃজনশীল। এখানে বিভাজন নেই।”
আবার একটা গ্র“প বেশ জোড়ালো ভাবেই স্বীকার করেন বিভাজন থাকবেই, দ্বন্ধ থাকবেই। প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীলদের মাঝে থাকবে এ বিভাজন, এ দ্বন্ধ। তবে এদের বেশিরভাগের বক্তব্য মূলত জামাত ইসলাম ও বিএনপি মনা লেখকদের দিকে আঙ্গুলী নির্দেশ করে এবং তারা নিজেরা আওয়ামী লীগ বা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। যা থেকে এটা স্পষ্ট যে তারা সাহিত্যকে দেখছেন দলীয় গন্ডিতে আবদ্ধ ছোট্ট একটি গ্রন্থ ব-ই অন্য কিছু নয়। যতীন সরকার, হাসান আজিজুল হক, জুলফিকার মতিন, তারাপদ দাস, মোশাররফ করিম, সেলিনা হোসেন, অচিন্ত কুমার ভৌমিক, তপঙ্কর চক্রবর্তী প্রমুখদের বক্তব্য ছিল বিশ্বমানের সাহিত্য সৃষ্টির স্বপক্ষে। তাদের মতে, যে সাহিত্য সমাজ ও মানবতার কল্যাণে নিবেদিত সেটা বিশ্বমানের সাহিত্যচর্চা। পাঠকই সেটা খুঁজে নেবেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আর বিপক্ষের সাহিত্য বলে তুমি আমি যতই চেঁচাই না কেন, সত্যিকার সাহিত্য তার জায়গা সে নিজেই দখল করে নেবে। পাঠক-ই খারাপটা বর্জন করবে।
অন্যদিকে দলীয় গন্ডিতে সীমাবদ্ধ এবং প্রগতিশীলতার দাবী তুলে প্রতিক্রিয়াশীলদের সাথে লড়াই চালিয়ে যাবার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন অনেকেই। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, বরিশালের সাংস্কৃতিকজন নিখিল সেন, জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কবি আসলাম সানী, খুলনার সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সমন্বয়ক কবি আইফা রহমান, সুকান্ত সাহিত্য পরিষদখুলনা শাখার সেক্রেটারী কবি সৈয়দ আবদুস সাদিক, রাজশাহী এ্যসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ড. তসিকুল ইসলাম রাজা, বরিশালের কবি হেনরী স্বপন প্রমূখদের মতে, “ প্রগতিশীল ও আধুনিকতার সাথে প্রতিক্রিয়াশীল অথচ আধুনিক সাহিত্যের দ্বন্ধ থাকবেই।”
রবীন্দ্র গবেষক ও শিকড় সন্ধানী লেখক যতীন সরকার বলেন,
সাহিত্যে কোনো বিভাজন নেই, বিভাজনটা ব্যক্তির ভেতর। একজন ব্যক্তি, তার রাজনৈতিক আদর্শ থাকবেই। সেই রাজনৈতিক দর্শন যদি সে তার সাহিত্যে প্রতিফলিত করে তুলতে চায়, তখন তার সাহিত্যকর্ম আপনা থেকেই সীমিত গন্ডিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। সাহিত্য সীমিত গন্ডিতে আবদ্ধ থাকার বিষয় নয়। আমাদের দেশে যেটা হচ্ছেÑ সাহিত্য চর্চা নয, লেখকরা গ্র“পিং নিয়ে ব্যস্ত। এতে সৃজনশীলতা নষ্ট হয়। একজনের লেখা আমার পছন্দ না হতে পারে, তাই বলে তার প্রতি আক্রোশে আমি তার নিন্দা করে বেড়াবো এটা ঠিক না, আমি লেখার জবাব লেখাতেই দেব। আমাদের বেশিরভাগ সাহিত্যকর্ম যারা করেন তারা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না।এটাই সাহিত্যে বিভাজন, না না সাহিত্যে নয়, লেখকদের মধ্যে, সাহিত্যিকদের মধ্যে গ্র“পিং-এর প্রধান কারণ।
কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেন,
সাহিত্যচর্চা করা আর সাহিত্য হয়ে ওঠা দুটোর মধ্যে অনেক তফাৎ আছে, সকলের সবকিছু যেমন তোমার পছন্দ হবে না, আবার সকলকে সমান গুরুত্ব দিলেও চলবেনা। কোনটা তুমি গ্রহণ করবে কোনটা বর্জন করবে এটা তোমাকেই খুঁজে বের করতে হবে, সবার সাথে কথা বলতে হবে। তা না হলে সত্যিকার চিত্রটা পাবে না। কেউ একজন ভালো করলে অন্যজন তার নিন্দা করতেই পারে, এতে দমে গেলে চলবে না। দমে গেলে এতে সৃজনশীলতা থেমে যায়। সাহিত্য কখনো নির্দিষ্ট গন্ডি মানেনা। দেশ কালের উর্ধ্বে উঠে সাহিত্যকে দেখতে হবে। তোমরা যেটাকে আধুনিকতা বল, আমাদের সমাজ সে অর্থে আধুনিক হয়নি। আধুনিক জীবনে যে উন্নয়নের কথা আমরা ভাবি, সেটা আমাদের এখানে এলেও, এসেছে একেবারে উপরিতলের জিনিস। এখনো তা আমাদের জীবনযাপন, আমাদের মনোভাব আর চিন্তাধারার ভেতর ঢুকে মেশেনি। এর আগে প্রথমআলোতে দেয়া বক্তব্যে, যেটা সাহিত্য বাজারেও প্রকাশ পেয়েছে, সেখানে আমি যে খণ্ডীকরণের কথা বলেছি, এই খণ্ডীকরণের ফলে আমাদের সব বিকাশের একটা বড় অংশ কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সাহিত্যকেও যদি তুমি এই খণ্ডিকরণের মধ্যে ফেলো তাহলে বিকাশটা হবে কোথা থেকে?
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও একুশে পদক প্রাপ্ত নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন,
সাহিত্য নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর সাথে প্রগতিশীল গোষ্ঠী মিশবে না, এটাই স্বাভাবিক। এতে আমি দোষের কিছু দেখছিনা। তবে প্রতিক্রিয়াশীলরা কখনোই টিকবে না। কিন্তু এটা যেন না হয় যে, ব্যক্তিগত বা সাংগঠনিক দ্বন্ধ সাহিত্যে প্রভাব ফেলছে। আমি একজনকে পছন্দ করিনা, হতেই পারে, তবে লেখনীর জবাব লেখনীর মাধ্যমেই দেব।ব্যক্তিকে আঘাত করে নয়। আমি অন্তত তাই বিশ্বাস করি।
কবি ও অধ্যাপক জুলফিকার মতিন বলেন,
এটা সত্যি যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আর রাজশাহী জেলার সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চর্চায় কিছুটা বিভক্তি রয়েছে। শুধু রাজশাহী কেন সারা দেশেই এ বিভক্তি রয়েছে। কেউ কেউ নিজেদের উঁচু দরের ভাবছেন, তবে এটা যাদের মধ্যে কাজ করছে তারা আসলে উল্লেখযোগ্য কেউ নয়। মূলত এ বিভক্তিটা এসেছে সাহিত্যপত্র ও সংগঠন নিয়ে। সাহিত্যকর্ম নিয়ে নয়। আমার মনে হয় সব সাহিত্য পত্রিকারই প্রধান কাজ হওয়া উচিত সব রকমের সাহিত্যচর্চাকেই পাঠকের সামনে তুলে ধরা। কোনটা সাহিত্য আর কোনটা সাহিত্য নয় সে ভাবনাটা পাঠকের হাতেই ছেড়ে দেয়া ভালো। আমি বা হাসান আজিজুল হক সাহেব কেউই কখনো শহর, গ্রাম বা মফস্বল বলে কোনো বোধকে প্রশ্রয় দেই না। হাসান আজিজুল হক সাহেব তো এখন আর শুধু রাজশাহীর নন, তিনি এখন উপমহাদেশের, অথচ তিনি অধ্যাপনা জীবন শেষ করে অবসরে গিয়েও এই মফস্বলেই পরে আছেন। মফস্বলের সাহিত্য হয় কিনা এর তুলনায় বড় উদাহরণ আর কি হতে পারে? তিনি তো কোনো দলীয় গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না।
কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন,
সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক, আবৃত্তি এমন কী সীনেমা এসবই সাহিত্যের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ। এমন কী মানুষের চিন্তা চেতনা, কথা বলার ভাব-ভঙ্গি এ সবও সাহিত্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সাহিত্যে কোনো বিভাজন নেই। বিভাজনটা সাহিত্যিকদের মধ্যে। যারা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না তারাই গ্র“পিং করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। আমাদের দেশে লেখকদের মধ্যে এই গ্র“পিং প্রবণতা বেশি। তাই সৃজনশীলতার প্রকাশ মাত্র তার প্রচারটা থেমে যায়।
জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কবি ও ছড়াকার আসলাম সানী বলেন,
আসলে আমি মনে করি একজন লেখক কাল দর্শী, সে ত্রিকাল দর্শী। সে সবসময়ই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। সে তার লেখায় অতিত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে আলোড়িত, আলোকিত ও উচ্চকিত করে। একজন লেখক আমি মনে করি, লেখক একজন নবী, নবী যেমন মানুষকে আলোর পথ দেখাতেন, তেমনি লেখকেরও দায়িত্ব মানুষকে আলোকিত করা। মানুষের কল্যানের কথা লেখক বলেন শিল্পিতভাবে। একজন লেখক, কবি বা শিল্পি তখনই সার্থক হন যখন তার লেখা বা শিল্পটি নান্দনিক হয়, সর্ব কালের জন্য গ্রহণীয় হয়। অর্থাৎ শিল্পোত্তীর্ণ হয়ে ওঠে। আর এটা করতে হলে তাকে দল-মত-এর উর্ধ্বে উঠতেই হবে। তা না হলে আর একটি কালের মানুষ এসে কী করে বুঝবে যে এটা তারই জন্য লেখা হয়েছে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই একশ’ বছর আগে যা লিখে গেছেন, পড়ে মনে হয় যেন তিনি আজই আমার জন্য এটা লিখেছেন। সাহিত্যে রাজনীতি থাকবেই, কারণ মানুষের মঙ্গল চাওয়াটাই রাজনীতি। তবে একটা কথা কী সেটা সস্তা শ্লোগান যেন না হয়। আর বিভাজন যেটা বলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের, প্রগতিশীলদের সাথে প্রতিক্রিয়াশীলদের সাহিত্য নিয়ে বিভাজন, এটা থাকবে। একজন যে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেবে, তার সাথে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দ্বন্ধ থাকবেই। বর্তমান প্রেক্ষিতে আমাদের সাহিত্যে যদি দেখ, পাকিস্তান আমলে যখন রবীন্দ্রচর্চা নিষিদ্ধ করা হল তখন আমাদের ফররুখ আহমেদ, গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ আলী আহসান প্রমূখ কী করলেন? তারা ঐ মরুভূমির উটের পায়ের ধুলো এনে আমাদের সাহিত্যে যুক্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তারা এর প্রতিবাদ করলেন না। আমার পদ্মা, মেঘনা, যমুনাকে রেখে তারা সিন্ধুর কথা বলতে শুরু করলেন। এটা অন্যায়। এটা যতদিন থাকবে ততদিন এই বিভাজন থাকবেই।
তারা যেটা করে ধর্ম আর জাতিস্বত্তাকে এক করে ফেলে। এখন যদি প্রশ্ন করা হয়- তোমার জাতির নেতাকে। আমি বলবো- বঙ্গবন্ধু, তারা বলবেন, হযরত মোহাম্মদ (সাঃ), জাতির পিতা বলবেন আদম (আঃ)। তারা সবকিছু ধর্মীয় ভাবধারায় টেনে নেবে। বাঙ্গালী জাতিস্বত্তাকে মানবে না বা গুরুত্ব দেবেনা। ধর্ম আর জাতিস্বত্তা যে এক না, এটা তাদের কে বোঝাবে? অথচ তারা যদি একটু লক্ষ্য করে দেখেন যে, এ দেশ থেকে বিদেশে গেলেই কিন্তু তাদের পরিচয় হয়ে ওঠে বাঙ্গালী জাতি। পরে আসে বাঙ্গালী মুসলমান, বাঙ্গালী হিন্দু, বোদ্ধ বা খৃস্টান শব্দটি। কবি আল মাহমুদ যে যৌবনে এক ধরণের সাহিত্যচর্চা করেছেন, ইসলামকে ব্যঙ্গ করে কবিতা লিখেছেন, হঠাৎ সে স্বার্থের জন্য ইসলামের আদর্শ প্রচার শুরু করলেন, এরশাদের দালালী করলেন। তাকে তো আমি কবি হিসেবে মানবো না। কারণ আমরা যারা কবি শামসুর রাহমানের অনুসারি ঐ সময় ১৯৮৭ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠন করেছি এই স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে ঠেকাতে। তখন এরশাদ সরকার আল মাহমুদসহ আরও কয়েকজনকে সাথে নিয়ে এশীয় কবিতা উৎসবের আয়োজন করেছিল। সেটা ঠেকাতেই কবিতা পরিষদ গঠিত হয়। মোটকথা সাহিত্যে যারা সৎ তারা প্রগতিশীল, যারা অসৎ তাদের সঙ্গে প্রগতিশীলদের দ্বন্ধ থাকবেই।
বরিশালের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক নিখিল সেন বলেন,
সাহিত্যে বিভাজন এটা থাকবেই। যতদিন মৌলবাদীরা থাকবে ততদিন প্রগতিশীলদের সাথে প্রতিক্রীয়াশীলদের দ্বন্ধ থাকবে। মৌলবাদ, সে যে ধর্মেরই হোক সবসময়ই প্রতিক্রীয়াশীল। তাদের বিপক্ষে আধুনিক সৃজনশীলতার সাহিত্য সব সময় প্রগতিশীল। এর ছাপ সাহিত্যে পড়বেই। কিছুদিন আগে বরিশালে দক্ষিণ অঞ্চলীয় একটা সাহিত্য সম্মেলন হয়ে গেল। আলোকপত্র নামে একটি সংগঠন এটি করেছিল। আমাকে নিমন্ত্রণ পত্র দিয়ে গেল সাহিত্য সম্মেলনটির আহ্বায়ক বুলবুল আহসান। আমি তাকে ভালোভাবে জানি। তাই আমি কৌশলে ঐ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করিনি। তবে আমাদের বাম ঘরানার অনেকেই বুঝতে পারেনি ওটা জামায়াত ইসলামীর ব্যাণারে হচ্ছে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম তাই যাইনি।
বরিশালের কবি ও গল্পকার অধ্যাপক তপঙ্কর চক্রবর্তী বলেন,
এটা ভুল কথা। বরিশালে দক্ষীণাঞ্চলীয় যে সাহিত্য সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হলো। এটি ছিল জাতীয় পর্যায়ে একটি সাহিত্য সম্মেলন করার প্রাথমিক প্রস্তুতি। বাংলাদেশ হবার আগে বরিশালে অনেক বড় বড় সাহিত্য সম্মেলন হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন এ জাতীয় কিছু না হওয়ায় আমরা বরিশালের কয়েকজন সাহিত্য সাংস্কৃতিকজনকে একত্রিত করে প্রাথমিকভাবে দক্ষিণাঞ্চলীয় সাহিত্য সম্মেলন করার বিষয়ে ঐক্যমত হই। কবিতা পরিষদের সভাপতি দীপঙ্কর চক্রবর্তীসহ আরো অনেকে সেদিন এ বিষয়ে সম্মতি দেন এবং নিজেদের পকেটের টাকায় সম্মেলনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এতে সাহিত্যচর্চা করেন এমন অনেকে বড় অংকের অর্থসাহায্য দেন। বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলার প্রায় ২০০ লেখক, কবি ও সাহিত্যকর্মী একত্রিত হয়ে অতিথিদের সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে সম্মেলনের আরম্ভ হয়। সম্মেলনে উপস্থিত লেখকদের মধ্য থেকে বরিশাল সদরকে বাদ রেখে প্রবীণ সাহিত্যকর্মী খুঁজে বের করে দুজনকে মঞ্চে তুলে দেয়া হয় সভাপতিত্ব করার জন্য। আমরা এখানে দক্ষীণ অঞ্চলের সাহিত্যকর্মীদের একটা মিলন মেলা তৈরি করতে চেয়েছি, আমরা তা পেরেছি, আমরা সার্থকও। এখানে কে রাজাকার ছিল, কে মুক্তিযোদ্ধা ছিল তা বাছাই করতে যাইনি। সাহিত্যতো সর্ব সুন্দরের বিচরণ ভূমি। এখানে উদারমনাদেরই অগ্রাধিকার। যে সাহিত্যে উদারতার স্থান নেই সেটা তো সৃজনশীল সাহিত্য হতে পারেনা। প্রগতিশীলতার দাবীতো আরও পরের কথা।
বরিশালের কবি ও সংগঠক মোশতাক আল মেহেদী বলেন,
কে সৎ আর কে অসৎ এটা নির্ধারণ করার দায়িত্বতো আমাদের নয়, পাঠকই ভালো বলতে পারবেন কারা প্রগতিশীল, আধুনিক। ব্যক্তিগত আক্রোশে আমি যদি কারো দিকে আঙ্গুলী তুলে বলি যে সে প্রতিক্রিয়াশীল বা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের, তাহলে কী কাল জাতি আমাকে ক্ষমা করবে? বরিশালে আয়োজিত সাহিত্য সম্মেলনটা নিয়ে আমি মনে করি তাই ঘটেছে। দু’জন লোক। একজন আরেকজনের কাছে বিভিন্নভাবে দায়বদ্ধ। তারা একজন চেয়েছিলেন তাকে এ সম্মেলনে প্রধান অতিথি করা হোক, অন্যজন নিজেকেই একমাত্র কবি বলে মনে করেন, চান তরুণরা তার অনুকরণ করুক। তার লেখার সমালোচনা কেউ করলেই সে হয়ে যান রাজাকার। এটা ব্যক্তির চিন্তা কোনো সাহিত্য প্রেমীর চিন্তা এটা হতে পারেনা।
বরিশালের কবি হেনরী স্বপন বলেন,
সাহিত্যে বিভাজন থাকবেই। প্রগতিশীলদের সাথে প্রতিক্রিয়াশীলদের সাহিত্য নিয়ে বিভাজন, এটা থাকবে। একজন যে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেবে তার সাথে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে যে থাকবে, তার দ্বন্ধ থাকবেই। এটা দূর হবার নয়। সৃজনশীল সাহিত্য সব সময়ই প্রগতিশীল। সব যুগেই এ দ্বন্ধ ছিল। বরিশালে যে সাহিত্য সম্মেলনটা হয়েছিল সেটা জামাতে ইসলামীর পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছে। সেখানে সভাপতিত্ব করেছেন জামাতের এক নেতা। এটা আমি আগেই জানতাম তাই সম্মেলনে যাই নি, কিন্তু প্রগতিশীলতার কথা বলেন বরিশালের এমন অনেকে সে সম্মেলনে ছিলেন, পুরুস্কার নিয়েছেন, যেটা দুঃখজনক। আমাদের প্রগতিশীল সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এ ব্যক্তিবর্গের জন্যই প্রতিক্রিয়াশীলরা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এটার শুরু কবে হয়েছে তা বলতে পারবো না, তবে সব যুগেই এরা ছিল। সত্যি বলতে সাহিত্যের এ বিভাজনটার জন্য দায়ী তৎকালিন স্বৈর-সরকার এরশাদ। সেই এ বিভাজনটা তৈরি করে গেছে এশীয় কবিতা উৎসব-এর আয়োজনের মধ্যে দিয়ে।
যশোর অঞ্চলের অন্যতম গুনীজন, সাহিত্যিক ও গবেষক শ্রী তারাপদ দাস বলেন,
সাহিত্যচর্চার সবসময়ই একটা দায়বদ্ধতা থাকে। যেটা সংগঠন কেন্দ্রিক লেখকদের মধ্যে ঠিক দেখা যায় না। সাহিত্যকে ঘীরে লেখকদের যে বিভাজন সেটাও কিন্তু এই সংগঠন কেন্দ্রিক। আমাদের অঞ্চলে প্রগতিশীল ধারার সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা বিরোধী আর স্বপক্ষ একটা দন্দ্ব রয়েছে। এটা কেন আমি ঠিক বুঝিনা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে সাহিত্য মান বিচারই প্রধান বিষয় হওয়া উচিৎ। সামাজিক দায়বদ্ধতা স্বীকার করেন এমন সব লেখকই প্রগতিশীল। আমি অন্তত সেটাই মনে করি।
খুলনা অঞ্চলের কবি ও গল্পকার অচিন্ত্য কুমার ভৌমিক জানান,
ষাটের দশকে সন্দীপন ও প্রতিনিধি গ্র“পকে ঘিরে শুরু হওয়া সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আজ অসংখ্য সংগঠনের জন্ম হয়েছে। আজকের খুলনা অঞ্চলের শিল্প সাহিত্যের সবটাই সংগঠন নির্ভর। যে কারণে এদের মধ্যে দ্বন্ধটাও বেশি। বর্তমানে অসংখ্য নতুন লেখক আছেন এবং বেশিরভাগই তারা কবি। আমি বই ধরে যদি হিসেব করি তাহলে প্রায় শ’তিনেক কবির নাম বলতে পারবো। এরা সাংগঠনিকভাবে সকলের মধ্যে বসে কবিতা পড়েনও, কিন্তু অপরের কবিতা আর শোনেন না। চলে যান। কবিতায়ও যে একটা সামাজিক দায়বোধ আছে-এটা যেন কেউ মানতেই চান না। এ কারণেই কবিতার মান আর মানের হয় না। আর একটা বিষয় হচ্ছে স্বাধীনতা বিরোধী ও স্বপক্ষ শক্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব। সাহিত্য-সাংস্কৃতির চর্চা যারা করেন তারাতো সুন্দরের চর্চা করেন। তাদের মধ্যে কেন এ দ্বন্দ্ব আসবে। যারা স্বাধীনতা বিরোধী তারাতো সাহিত্য-সাংস্কৃতিরও বিরোধী হবে, এটাই স্বাভাবিক।
রাজশাহী এ্যসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ড. তসিকুল ইসলাম রাজা বলেন,
আমি সারা দেশের কথা বলবো না। এই রাজশাহী জেলার কথাই বলবো। রাজশাহী জেলার সাহিত্য মূলত দুভাগে বিভক্ত। একঅংশ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক, অন্যঅংশ শহর কেন্দ্রিক। একমাত্র কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক সাহেব বাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক যারা সাহিত্যচর্চা করছেন তারা নিজেদের ব্রাহ্মণ বলে মনে করেন। আমরা যারা জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিরে সাহিত্যচর্চা করছি তাদেরকে তারা মনে করেন অচ্ছুত। আর রাজধানী ঢাকার লোকেরাতো আমাদের লেখক বলেই মনে করেন না। তবে মফস্বলেও যে সাহিত্যচর্চা হয়, গবেষণা হয় তার প্রমাণ তো যতীন সরকার, হাসান আজিজুল হকই রেখেছেন। আসলে শহরের সাহিত্যিকরা ও তাদের তল্পিবাহকরা মফস্বলের সাহিত্যচর্চাকে কোন মূল্য দিতে চান না, এটাই আসল কথা। বরং গ্র“পিং আর লবিং-এর দিকে ঠেলে দিয়ে আমাদের অস্তিত্ব সংকটে ফেলেন দেন তারা, এটাই সত্যি। তুমি রবীন্দ্রনাথ পড়েছো না নজরুল বেশি পড়েছো? তুমি শামসুর রাহমান, ফররুখ আহমদ না আল মাহমুদ পড়েছো? এমন প্রশ্নও শুনতে হয় আমাদের। আমরা যারা মফস্বলে থাকি তারা রবীন্দ্র, নজরুল, শরৎ, বঙ্কিম, মাইকেল, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ সব মিলিয়ে জগাখিচুরী বানিয়ে তারপর পড়ি। আমাদের কাছে কারো ব্যক্তিচরিত্রের দর্শন পেঁৗছে না, যেটা পেঁৗছে মানবতার পক্ষের জয়গান, সত্যিকার সাহিত্যচর্চার যে দর্শন। তাই আমরা সাহিত্যে ভেদাভেদ খুজে পাইনা, ওটা উপরতলার শহুরে ব্যাপার, শহুরেই পরে থাক। এখানেও জেলা শহরের সাহিত্যে এখন জামাত পন্থিরা রাজত্ব করছে। তারা সাহিত্য সাংস্কৃতিকে নিজেদের কব্জায় নিতে বেশ শৃঙ্খলবদ্ধ উদ্যোগ গ্রহণ করছে। আমরা তাদের কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছি, বাধা দিতে পারছি না। তাদের মধ্যে অনেকের লেখা বেশ মান সম্পন্ন, কিন্তু আমাদের দলেও টানতে পারছি না। রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে। সরলভাবে এই বিভাজনটাই আমাদের চোখে পড়ে যে, ওরা জামাত করে, তাই ওদের সাথে আমাদের মেশেনা।
জাতীয় কবিতা পরিষদের খুলনা শাখার সাধারণ সম্পাদক কবি আইফা রহমান বলেন,
আমরা এখানে সাংগঠনিকভাবে অনেক শক্তিশালী ভূমিকা রাখছি। আমাদের এখানের সাহিত্যচর্চায়ও দুটি ধারা আছে। একটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্যটি বিপক্ষের। আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যারা আছি তারা বিপক্ষ ধারার কাউকে নিয়ে কাজ করতে রাজি নই। তাদের সাথে আমাদের দ্বন্ধ থাকবেই। এটা দূর হবার নয়। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি কখনো প্রগতিশীল হতে পারেনা। ওদের বাবা-দাদারা ছিল মুসলিম লীগ তাই ওরাও সেই চিন্তা চেতনা ধারণ করে।
যশোরের সাংবাদিক, সংগঠক ও কবি তৌহিদ মনি জানান,
সৌভাগ্যক্রমেই বলতে হবে যশোর সাংস্কৃতিচর্চার মাদার সংগঠন যশোর ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন শাখার মধ্যে একটি হচ্ছে সাহিত্য শাখা। এই শাখার বদৌলতেই বলতে পারেন এখানে সাংগঠনিক দলাদলিটা কম। আবার সাংগঠনিক দ্বন্ধ থাকলেও তা কখনো ব্যক্তি আক্রোশে পৌঁছে না। আমাকে যে পছন্দ করে না, সেও এখানে আমার লেখা সম্পর্কে আলোচনা করে। বাহির থেকে কেউ এলে দেখিয়ে বা চিনিয়ে দেয়। যেমন এখানে জামায়াত ইসলামীর বিভিন্ন সংগঠনও আছে, তাদের ভালো কাজটা নিয়ে সবাই কথাও বলবে, কিন্তু তাদের সাথে মিশবে না। যশোরে কিন্তু ফুলকুড়ি আসর, নজরুল সাহিত্য পরিষদ এদের কার্যক্রমও ভালো। যেটা ভালো সেটা এখানের সবাই স্বীকার করবে।