কেউ যদি তোমাকে প্রশ্ন করে তুম বাঙালি না বাঙ্গালী? তাহলে কি উত্তর দেবে বলতো শোনামনিরা। এমনি একটা উদ্ভট প্রশ্ন যখন বড়দের মাথায় জট পাকিয়ে দেয় তখন প্রাইমারি স্কুলের একজন ছাত্রী কী উত্তর দেবে এ প্রশ্নের। হঠাৎই একদিন শ্রেণী কে বাংলা স্যার মুক্তিযুদ্ধে গল্প বলতে গিয়ে ব্লাকবোর্ডে লেখেন – তুমি বাঙ্গালী না বাঙালি? তারপর রেবাকে ডেকে জানতে চান, রেবা তুমি কোনটা, বাঙালি না বাঙ্গালী? একে একে স্যার কাশের সবাইকে এ প্রশ্ন করেন। কেউই কোনো উত্তর দিতে পারেনা দেখে স্যার হাসেন। তারপর বইটা ছুড়ে ফেলে চলে যান।
ছোট্টমনি রেবা আদর্শ স্কুলের ৫ম শ্রেণীর ছাত্রী। প্রতিদিন সে নিয়ম করে স্কুলে যায়। হাতের কাজ জমা দেয় এবং স্কুলের সব নিয়ম নীতি মেনে চলে। এ কারণে শিকরাও তাকে খুব ভালোবাসেন। সে বরাবরই কাসে প্রথম হয়। এ জন্য তার বাবা মাও খুব খুশি। কিন্তু বাংলা স্যারের প্রশ্নের উত্তর না দিতে পেরে রেবার খুব মন খারাপ হয়। সে ঘরে গিয়ে খুব কাদে। বাবা এসে রেবা কান্না দেখে তারাতাড়ি বাংলা স্যারকে ডেকে আনে। বাংলা স্যার এসেই ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ছিঃ মা মনি কাদে না। তোমাকে যে প্রশ্নটা করেছি, তার উত্তর যে আমি নিজেও জানিনা মা। বলে ওকে খুব আদর করে বাংলা স্যার সেদিন চলে যায়। কয়েকদিন পর আবার একদিন বাংলা স্যার কাশে বীরশ্রেষ্ঠদের গল্প পড়াচ্ছেন। তিনি বীরশ্রেষ্ঠ পড়াতে গিয়ে হঠাৎ প্রচণ্ড রেগে উঠলেন এবং ভুল ভুল বলে হাতের বইটি ছুড়ে ফেলে দিয়ে কাশ থেকে বের হয়ে গেলেন। ছাত্রছাত্রীরা তো সবাই খুব অবাক। কারণ স্কুলের সবচেয়ে শান্তশিষ্ট এবং নরম মনের এ শিকটি ছোটদের খুবই প্রিয়। তাকে কেউ কখনো রাগ করতে দেখেনি। সবসময় ছোটদের সঙ্গে গল্প করেন। মজার সব গল্প বলে বলে বইয়ের পড়া শেখান। আজ হঠাৎ স্যারের একি আচরণ। রেবার মন খুব খারাপ হয়। কারণ বাংলা স্যার ওর কাছে শুধু স্যার নয়, ওর বড়চাচা সে, বাবার আপন বড়ভাই।
রাতে রেবা বিছানায় ঘুমাতে গিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে স্কুলের গল্প করে। বাবার কাছে বাংলা স্যারের হঠাৎ রেগে যাওয়া ও বই ছুড়ে ফেলার কথা বলে। জানতে চায় চাচ্চু কেন এটা করেছে। বাবা তখন রেবাকে বলে, দেখিতো মা মনি – তোমার বাংলা বইটা। রেবা দ্রুত বাংলা বইটা বাবার হাতে দেয়। বাবা সেটা উল্টে-পাল্টে দেখে। বীরশ্রেষ্ঠদের গল্প অংশে এসে বাবাও থেমে যান। এমনিতেই পুরো বইয়ের মধ্যে অসংখ্য বানান ভুল। তারউপর বীরশ্রেষ্ঠদের গল্পে এসে বাঙ্গালী বানানটা হয়েছে বাঙালি আর যোদ্ধা হয়েছে যোদ্দা। বিষয়টা দেখে বাবা বলে, মা মনি তোমার চাচ্চু এমনিতেই কোনো বানান ভুল দেখলে রেগে যান। আর সেটা যদি হয় মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা নিয়ে তাহলে তো ভয়ানক ব্যাপার। কারণ তোমার চাচ্চু নিজেও যে একজন মুক্তিযোদ্ধা।
রেবা তখন বলে, কিন্তু বাবা, এ বইয়ে তো এরকম অনেক ভুল আছে, চাচ্চু পড়াবার সময় নিজেই সেসব ভুল বানান ঠিক করে দিচ্ছেন। তাহলে এখানে কেন ঠিক করলেন না?
বাবা – কারণ এখানে যে ‘বাঙালি’ শব্দটা লিখেছে। এটা নিয়ে তোমার চাচ্চুর যুক্তি হচ্ছে -“আমরা বাংলাদেশীরা বাঙালি না, আমরা বাঙ্গালী। কারণ প্রাচীন ইতিহাসে আমাদের এ অঞ্চল ছিল মূলত বঙ্গ নামেই পরিচিত ছিল। খ্রিস্টিয় অষ্টম শতাব্দীতেও বঙ্গ ছিল গুরুত্বপূর্ণ স্থান। অনেক পরে সেটা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমাদের বাংলাদেশ হয়েছে। বঙ বা ব্যঙ জাতীয় কোনো শব্দ এখানে নেই। এ কারণে বঙ্গ থেকে বাঙ্গালী হবে, এটাই তোমার চাচ্চুর যুক্তি। এটা তুমি এখন বুঝবে না। বড় হলে বুঝতে পারবে।
রেবাÑ কিন্তু চাচ্চু এতো রেগে গেল কেন?
কারণ এইযে আজ আমরা বাংলায় কথা বলছি, আজ পৃথিবী জুড়ে যে বাংলা ছড়িয়ে পড়েছে। এ বাংলার জন্য ১৯৫২ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে কত লোক প্রাণ দিয়েছে। তুমি তো সালাম, জব্বার, রফিকের কথা পড়েছো। এদের মাঝে আরো অনেকে ছিলেন, তোমার দাদাও শহিদ হয়েছেন এই ভাষা আন্দোলনে। তাদের রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা বাংলায় কথা বলছি। আজ সারাবিশ্বে বাংলার প্রচলন। তুমিই বলো মা-মনি সারাবিশ্বে এখন যে ভাষার ব্যবহার চলছে, সেই ভাষার একটা শব্দ যদি অনেক রকম বানান হয় তবে কি মান থাকে। একই বইয়ে এক জাযগায় বাঙালি আর এক জায়গায় বাঙ্গালী হলে তুমি কোনটা লিখবে? এরকম আরো অসংখ্য ভুল আছে তোমাদের পাঠ্যবইতে। এইযে, ‘আরো’ বললাম এটাও কোথাও কেউ কেউ লিখছেন আরও, আরো, আবার ‘কারো’কে কেউ লিখছেন কারও এটার একটা নীতিমালা হওয়া উচিত। কোনটা ব্যবহার হবে তা দেশের বাংলা একাডেমিকে নির্ধারণ করে দিতে হবে। আমরা বাংলাদেশি না বাংলাদেশী লিখবো, বাংলা একাডেমি না আকাডেমি বলবো এটা যতদিন নির্ধারণ না হবে ততদিনে এ ভাষার যাচ্ছে তাই ব্যবহার বন্ধ হবে না। আর পাঠ্যবই যারা ছাপেন তাদের হতে হবে অনেক বেশি সচেতন। কারণ তোমাদের বয়স থেকেই তো সত্যিকার শিা শুরু হয়। প্রথম ধাপেই যদি ভুল শিা পাও তবে তো সারাটা জীবন এই ভুলটাই করে যাবে। এটা ভেবেই তোমার চাচ্চু খুব রেগে গেছেন। সে তখন কল্পনার চোখে দেখতে পেয়েছেন, তোমরা সবাই বড় হয়ে বাংলাভাষার অপমান করছো। নিজের মাতৃভাষাকে ব্যঙ্গ করছো।
রেবা – এটা কেন ঠিক করা যাচ্ছে না বাবা। আমরা কেন ভুল শিখবো?
বাবা – এটা করতে হলেও যে আবার একটা আন্দোলন লাগেরে মা। সেই মানুষ কই যে এ সব নিয়ে কথা বলবে।
রেবা এ কথা শুনে চুপ হয়ে যায়। ওর কানে ভাসে একুশে ফেব্র“য়ারির সেই গান। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো——–।
পরদিন স্কুলে গিয়েই রেবা তার শ্রেণীকরে সব ছাত্রছাত্রীকে বাবার বলা কথাগুলো বুঝিয়ে বললো। ছাত্ররা সবাই তাদের বই খুলে বিষয়টি ল্য করলো। সকলের মাঝে একটা গুঞ্জন ওঠে। আমরা সঠিক শব্দের বানান চাই। বিষয়টা একে একে ৫ম শ্রেণী থেকে ছড়িয়ে পড়লো ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত। সবাই বই খুলে দেখে একই শব্দের একাধিক বানান। ১ম থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত এ নিয়ে তুমুল ােভ প্রকাশ শুরু হয়ে যায়। রেবাদের কাশে তখন রেবা ও তার সহপাঠীরা বানান সংশোধনের দাবি তুলে প্রধান শিকের করে সামনে বসে পড়েছে। ছোট্ট বাচ্চারা এটা করছে শুনে লজ্জায় কলেজ পড়–য়া ছেলেমেয়েরা রাস্তায় বের হয়ে পড়ল ব্যাণার ও মিছিল নিয়ে। ওদের ব্যাণারে ফুটে উঠলো আরো অসংখ্য শব্দ। বই পড়া, আর ঢলে পড়া না পরা। পড়া, পরা’র ব্যবহার ঠিক করতে হবে। বারাবারি না বাড়াবাড়ি হয়তো না হয়ত, ছিল না ছিলো, ছিলনা, করিনা, পারিনা এ শব্দে না কি যুক্ত না অযুক্ত। ইত্যাদি শব্দের সঠিক ব্যবহারের দাবিতে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যোগ দিলেন অভিভাবকও। সবাই গিয়ে হাজির হলেন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। সঠিক বানানের দাবিতে একাডেমি প্রাঙ্গনে মানুষের ঢল দেখে বিস্মিত একাডেমি কর্তৃপ। এতোদিন তারা দায় সারা ভাবে কোনোরকম বাংলা অভিধান পূন:মুদ্রন করে আসছিলেন। আন্দোলনের মুখে তারা এসে হাতজোড় করে মা চাইলেন জনতার কাছে। স্বীকার করলেন তাদের গাফলতি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেও ছুটে এলেন এ সংবাদে। এসেই রেবকে তিনি কোলে তুলে নিলেন। ভাষার এ বানান সংকটে তিনি নিজেও বেশ সমস্যায় পড়েছেন বলে স্বীকার করলেন এবং তিনমাসের মধ্যে সব বানান ঠিক করে নতুন অভিধান ও পাঠ্যবই প্রকাশের নির্দেশ দিলেন বাংলা একাডেমি ও পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনা দপ্তর কর্তৃপকে।