রাজশাহীর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং উত্তরাধিকার
ড. তসিকুল ইসলাম
বাংলাদেশ শিক্ষানগরী নামে খ্যাত রাজশাহী জেলার সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে ইতিহাসের পাতায় আশ্রয় খুঁজে পেতে হয়। সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে কাজে লাগালে অনুভব করা সহজ হবে যে, আজকের রাজশাহীর ভৌগলিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সাহিত্য সাংস্কৃতিক জীবন চর্চার ক্ষেত্র সীমিত। কিন্তু প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ, আধুনিক যুগ তথা ইংরেজ আমল, পাকিস্তানকাল এবং বর্তমান বাংলাদেশের পটভূমিকায় বারেন্দ্রীয় ঐতিহ্য লালিত শিক্ষা সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র হিসেবে রাজশাহীর প্রসিদ্ধি সর্বজনবিদিত।
পদাবলী রচনা করে বৈষ্ণব সমাজের শ্রদ্ধাভাজন হন। ৩ রাজশাহী শহরের উপকণ্ঠে সিন্দুরী কুসুমী গ্রামের মাসুদ ১৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে৪ যোগীর পুথি কাব্যরচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। উল্লেখ্য ইনি বিখ্যাত কবি ভারতচন্দ্রেরও (১৭১২-১৭৬০) পূর্বসুরি ছিলেন। ৫ এছাড়াও গিরিশচন্দ্র লাহিড়ী ‘মহারাণী শরৎসুন্দরীর জীবনী’ রচনা করে প্রশংসা অর্জন করেন। তিনি পুঠিয়ার অধিবাসী ছিলেন। মির্জ্জা মৌ. মুহম্মদ ইউসুফ আলী (১৮৫৮-১৯৩০) সমাজ সংস্কারক ও ধর্মীয় পুস্তক রচনা করেন। তন্মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ‘ইসলামতত্ত্ব’ ‘দুদ্ধ সরোবর’ এবং বিখ্যাত দার্শনিক ইমাম গাজ্জালীর ‘কিমিয়া সাদাত’ এর বঙ্গানুবাদ ‘সৌভাগ্য স্পর্শমণি’। কান্তকবি রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯২৪) সিরাজগঞ্জে জন্ম হলেও ছাত্রজীবন কর্মজীবন রাজশাজী শহরেই অতিবাহিত করেন। তিনি ‘বাণী’ ‘কল্যানী’, আনন্দময়ী’, অভয়া ‘বিশ্রাম’ প্রভৃতি কাব্যগ্রস্থ ও গান রচনা করে যশস্বী হয়েছেন। ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় (১৮৭০-১৯৮৫) ‘মোঘল সাম্রাজ্যের পতন’ও ‘আওরঙ্গজেব’ তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। তিনি কলকতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইসচ্যান্সলার ছিলেন। বিনোদী বিহারী রায় (১২৬৯-১২৫২ বাং) রাজশাহী শহরের অধিবাসী। ‘পৃথিবীর পুরাতত্ব’ তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। মহম্মদ মহসেন উল্লাহর ‘বুড়ীর সূতা’ কাজী জসিমুদ্দীনের ‘দীন ও দুনিয়া,’ হাজি কেয়ামতুল্লাহ খন্দকারের ৫০ খানা গজল গীতি, মৌলভী শামসুদ্দীন আহমদ এর ‘Inscriptions of Bengal’ সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাসে অনন্য বলা যেতে পারে।
দুই
বাংলাসাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের অবদান গবেষনা ও অনুসন্ধানের ব্যাপার। বরেন্দ্র অঞ্চলকে ইদানীং কেউ কেউ বাংলা ভাষার আদি নীড় বলে দাবি করছেন। ৬ বৌদ্ধ, নাথধর্ম, বৈষ্ণব প্রভাব এবং পুথি সাধনায় প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাজশাহীতে সাহিত্য সাধনার নমুনা লক্ষ্য করা যায়। বিশেষত মুসলমানদের আগমনের পর আউলিয়া দরবেশদের ইসলাম প্রচার ও ইসলামী শিক্ষার প্রসারে ‘সুফী সাহিত্যের পরিচয় এ অঞ্চলে পাওয়া যায়।’৭ এই প্রেক্ষপটে শাহ মখদুম (রহঃ) (মাজার শহরে পদ্মা নদীর ধারে অবস্থিত) এর আগমনে রাজশাহীর জনজীবন ধন্য হয়েছে।
আধুনিক যুগে অনুসন্ধান ও গবেষণার মাধ্যমে ‘বরেন্দ্র সমিতি’র (১৯১০) কার্যক্রমে এবং ‘বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম’ (১৯১৬) এর তৎপরতায় সেই সাথে বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শরৎকুমার রায়ের অবদানে সমিতি ইতিহাসের অনেক হারানো অধ্যায়কে উদঘাটিত করে আমাদের অতীত ঐতিহ্যে লালিত আলো ঝলমল জীবনের সন্ধান দিয়েছে। অবশ্যি রাজশাহী শহর ও আশেপাশের এলাকায় নাটোরে রানি ভবানী ও মহারানি হেমন্তকুমারী পূন্যকর্মের যে দানের অবদান রেখেচেন তা নজীরবিহীন। এছাড়া রাজশাহী শহরে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে ২১শে জুলাই ‘রাজশাহী এসোশিয়েশন’ (রাজশাহী সভা), ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী কলেজ’ ও ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ১৯শে জুলাই ‘রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগার’ প্রতিষ্ঠান ফলে কলকতার বাহিরে শিক্ষা-দীক্ষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার জোয়ারে রাজশাহী জনজীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়। সেই ধারাকে অব্যাহত রাখতে গিয়ে ১৯৪৭ এ দেশ বিভাগের পূর্বে রাজশাহীর রাজা জমিদারেরা সাহিত্র সম্মেলন সঙ্গীত সম্মেলনের আয়োজন করে এবং দেশ বিভাগের পূর্বে রাজশাহীর রাজা জমিদারেরা সাহিত্য সম্মেলন সঙ্গীত সম্মেলনের আয়োজন করে এবং দেশ বিভাগের পর সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব লক্ষ্য করা যায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর রাজশাহীতে ওস্তাত মোজাম্মেল হোসেন, ওস্তাদ হরিপদ দাস, জনাব আবদুল আজিজ ওরফে মুন মাষ্টার এর সুরবানী সঙ্গীত বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সর্বজনাব আবদুল মালেক খান, আবদুল আজিজ বাচ্চু ও মরহুম আবদুল জব্বার সঙ্গীতকে জনসমাজে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এর ফলে সাংস্কৃতিক জীবধার গতিশীল পথ খুঁজে পেয়েছে।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ভাষা আন্দোলনের ঢেই রাজশাহীতে চাঞ্চল্যকর অবস্থার সৃষ্টি করে এবং ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠান পর রাজশাহীর জনজীবন মন মানসিকতার দিক থেকে উন্নত ও রুচিশীল পর্যায়ে উন্নীত হয়। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে গণ আন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জোহার মৃত্যু এবং পরবর্তীতে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ সমস্ত কর্মকান্ডের অগ্রভাগে রাজশাহীতে তরুণ ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে এবং এই সকল কর্মপ্রয়াসকে সার্থকভাবে বাস্তবায়িত করে তুলতে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদী কণ্ঠের বহিঃপ্রকাশ সাহিত্য চর্চা ও সাংস্কৃতিক জীবন চর্চার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। মহত্তর জীবনবোধ ও মননশীল কর্মকান্ডে বিশেষত সাহিত্যে বরেন্দ্র একাডেমী, উত্তরা সাহিত্য মজলিশ, স্পন্দন সাহিত্য -সাংস্কৃতিক সংসদ, স্বপন, রবিবাসরীয় সাহিত্য সংসদ, কিশোর সাহিত্য সংসদ, রাজশাহী লেখিকা সংঘ, কতিপয় সাহিত্য গোষ্ঠী, কবিতা সারথী, বাংলা সাহিত্যিকী, প্রফেসর আবদুল হাই সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক সংঘ, রংধনু নাট্যচক্র, রাজশাহী সাংস্কৃতিক সংঘ, পলাকার নাট্যগোষ্ঠী, কথাকলি নাট্য গোষ্ঠী, হিন্দোল সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, উত্তরা নাট্য গোষ্ঠী, সুরবাণী সঙ্গীত বিদ্যালয়, সঙ্গীত শিক্ষা ভবন (১৯৪৩), জেলা শিল্পকলা একাডেমী, শিশু একাডেমী, আন্দোলন নাট্য গোষ্ঠী, সুরবিতান, গুঞ্জন সাংস্কৃতিক একাডেমী, ত্রিবেণী সাংস্কৃতিক পাকিস্তান আমলে এবং অব্যবহিত পরে এখানে কবি আবদুর রশীদ কানের ‘আইডিয়াল প্রিন্টিং প্রেস’ অধ্যাপক একরামুল হকের ‘মর্ডান প্রিন্টিং প্রেস’ ইত্যাদি প্রকাশনালয় থেকে বেশ কিছু প্রতিনিধিত্বশীল বই প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে কবি আবদুর রশীদ খানের ‘নিরন্তন স্বর’ আবদুর হাফিজের ‘সুকান্তের সমগ্র কবিতা’ ও ‘লোক-কাহিনীর দিগ-দিগন্ত’ ডকটর মযহারুল ইসলামের ফোক লোর পরিচিত ও লোক সাহিত্যের পঠন-পাঠন ডকটর কাজী আবদুল মান্নানের ‘মুসলিম সাহিত্য সাধনা’ ডকটর এবনে গোলাম সামাদের ‘বাঙালীর জন্ম পরিচয়’ মুস্তাফিজুর রহমানের ‘নিরবধি আলোকে আধারে (কাব্য) কবি বন্দে আলী মিয়ার ‘দক্ষিণ দিগন্ত’ (কাব্য) শামসুল হক কোরায়শীর ‘গোধূলির কান্না’ (কাব্য) জুলফিকার মতিনের স্বৈরিণী স্বদেশ দুই’ (কাব্য) এস.এম আবদুল লতিফের ‘ছন্দ পরিচিত কবি রুহুল আমিন প্রামাণিকের ‘না তুমি না আমি না ঈশ্বর’ (কাব্য) শেখ আতাউর রহমানের ‘একজন হত্যাকারীর গল্প’ (কাব্য) প্রবীণ সাংবাদিক ও সাহিত্যিক মুহম্মদ আবদুস সামাদের ‘দিক-দিগন্ত’ তসিকুল ইসলামের ‘শিশু সাহিত্যে বন্দে আলী মিয়া,’ ডকটর মুহম্মদ মজির উদ্দিনের ‘ডকটর মুহম্মদ এনামুল হক’ বরেন্দ্র একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত ‘রাজশাহী পরিচিত,’ রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারের শতবর্ষ পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে প্রকাশিত ‘শতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ: ১৯৮৪’ এবং রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস’ উল্লেখ্যযোগ্য।
প্রসঙ্গত বলা দরকার,‘রাজশাহীর লোকসাহিত্য ও লোক-সংস্কৃতি নানা উপাদান ও উপকরণে সমৃদ্ধ’। লোকজ জীবন যাপনে রাজশাহী অঞ্চলের প্রকৃতি, আবহাওয়া এবং পরিবেশ কৃষি নির্ভর হলেও তাদের নানা রকম বিশ্বাস বা সংস্কার লোকসাহিত্যেন মূল্যবান সম্পদ। লোকসাহিত্য লোক-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ’। ১০ নানা প্রকার ছড়া, সারি, জারী গম্ভীরা, কবি বা ছন্দ (কবিগান), হাপু, জাগ, মেয়েলী গীত বা বিয়ের গান, বারমাসী, আলকাপ, প্রভৃতির দ্বারা রাজশাহীর লোক-সাহিত্য ভান্ডার পূর্ণ।
তিন
রাজশাহীর পত্র-পত্রিকা
সাহিত্য ও সমাজের মধ্যে সম্পর্ক চিরন্তর’ ১২ এই সম্পর্কের চিরন্তনী রূপকে বলিষ্ঠতর করে তুলতে সাহিত্য পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন ইত্যাতির ভূমিকা প্রশংসনীয়। মানুষের জীবন যাত্রার আর্থিক সামাজিক রূপ, তার মানসিক রূপ, তার মানসিক ও আধ্যাত্মিক, নানা বৈজ্ঞানিক আবিষক্রিয়া আর শিল্পসৃষ্টি সমস্ত কারুকলা ও চারুকলা। ১৩ ইত্যাদি প্রয়াসকে টিকিয়ে রেখেছে পত্র-পত্রিকার ইতিহাসে অতীত ঐতিহ্যের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে রাজশাহীতে ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বাবু শ্রীনাথ সিংহ রায়ের সম্পাদনায় ধর্মীয় মাসিক পত্রিকা ‘হিন্দু-রঞ্জিকা’ প্রকাশ করেন। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে ‘জ্ঞানাস্কুর’ পরে ১২৮২ বাংলা সালে সাপ্তাহিক আকারে ‘জ্ঞানাস্কুন ও প্রতিবিম্ব’ নামকরণে রামসর্ব্বম্ব বিদ্যাভূষণের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে মানিস ‘শিক্ষাপরিচয়’ কুমার মৈত্রের সম্পাদনায় ‘ত্রৈমাসিক সমাচার,’চিকিৎসা নামে মাসিক চিকিৎসা বাংলা ভাষার পত্র পত্রিকার ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা’১৪ এবং ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ‘আঞ্জুমানে হেমায়েত ইসলাম’ এর মুখপত্র ‘নূর অল ইমান নাট্যকার ও মোক্তার এম,মেহেরুদ্দীনের সম্পাদনের প্রকাশিত হয়। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘উৎসব’ ১৯২৯’ খ্রিষ্টাবেদ ‘রাজশাহী থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘পল্লীবান্ধব’ এখানকার সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার জগতে আধুনিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে উপস্থিত হয। ১৫ মীর্জা মুহাম্মদ ইয়াকুব আলী পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। রাজশাহীতে ‘হেমা ক্লিয়ার প্রিন্টিং প্রেস’ (মুসলমানদের প্রথম ছাপাখানা) থেকে পত্রিকাটি ছাপা হতো। প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক ঋত্ত্বিক ঘটকও রাজশাহী থেকে ‘অভিধারা’ এবং ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে সাপ্তাহিক ‘দীপালী’ সম্পাদনা করেন।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগের পর রাজশাহীতে সাহিত্য চর্চায় রক্ষণশীলতার পরিবর্তে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার উন্মেষ ঘটতে দেখা যায়। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে দিশারী সাহিত্য মজলিশ ‘দিশারী’ মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাহিত্য কর্মীদের প্রচেষ্টায় দিশারী নতুন জীবনের স্বাদ উপলব্ধি করতে বিশেষ ভুমিকা পালন করে। এর প্রথম সম্পাদক ছিলেন এ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান শেলী, পরে অধ্যাপক একরামুল হক ও সাইদ উদ্দীন আহমেদ। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মুহম্মদ আব্দুস সামাদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মাসিক ‘প্রবাহ’, ১৯৬০ খ্রিষ্টাবেদ খন্দকার সিরাজুল হকের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ত্রৈমাসিক ‘যাত্রী’। রাজশাহীর পত্র-পত্রিকার জীবনে সবচেয়ে গৌরবের কথা ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে মুস্তাফা নুরুউল ইসলাম ও জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর সম্পাদনায় ও রাজশাহী জেলা পরিষদের অর্থানুকূল্যে ‘রাজশাহী বার্তা’ মোহসীন রেজার ‘সুনিকেত মল্লার,’ ডক্টর মযহারুল ইসলামের সম্পাদনায় ‘উত্তর অন্বেষা’ শাহ নজমুল হক চৌধুরীরর সম্পাদনায় সাপ্তহিক ‘উত্তর বাংলা’ সরদার আমজাদের সম্পাদনায় ‘সোনার বাংলা’ এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কবি ও মুক্তিযোদ্ধা ওবায়দুর রহমানের ‘বাংলার কথা,’ সাইদ উদ্দীনের সম্পাদনায় ‘নতুন কাল’ প্রকাশিত হয়। এছাড়াও সাপ্তহিক ‘আন্তরিক,’ উত্তরা সাহিত্য মজলিশের মুখপাত্র ‘প্রভীতিদ এবং পূর্ণাশা চিৎকার কোষিক এক উল্লাস মুখোমুখি চেতনা নব প্রবাহ সুপ্রীতি সিড়ি নন্দিনী রবিবাসরীয় সাহিত্য সংসদের মুখপত্র পরিলেখ ইত্যাদি পত্র-পত্রিকা সংলকন স্মরণিকা প্রকাশ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে অবদান রেখেছ্ ে১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই অকটোবর রাজশাহীর জীবনে আরেকটি উল্লেখযোগ্য গটনা এই দিন রাজশাহী থেকে প্রকাশিত হয় জাতীয় ‘দৈনিক বার্তা’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত ‘সাহিত্যকী’তে গবেষণা ও মননশীল প্রবন্ধ প্রকাশ করে সারাদেশ বিশেষ স্থান লাভ করেছে। এই সকল পত্র-পত্রিকাকে কেন্দ্র করে সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্র নানাভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং বাংলাভাষা ও সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি ও উৎকর্ষ সাধনে অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।
চার
রাজশাহীতে সাহিত্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার থেকে লালিত হয়ে আজকের রাজশাহীতে কাব্য কবিতা কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ সাহিত্য সঙ্গীত, নৃত্য শিল্প, চিত্রকর্ম প্রভৃত্তি শাখায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। তবুও বলা যায়, মৃদ্রণ ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে নানা সঙকট ও জটিলতার কারণে আশানুরূপ ফল লাভ হয়নি।
রাজশাহী শহরে কবিতা চর্চা করে একসময় মীর আজিজুর রহমান মাস্তানা (১৯০০-১৯৭৮) রবীন্দ্র সান্নিধ্য আশীবার্দধন্য কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। পরবর্তীতে লক্ষ্য করা যায় চাকরি কিংবা পড়াশুনার প্রয়োজনে রাজশাহী অবস্থান কালে সাহিত্য সাধনা করে যারা দেশ ও বিদেশে খ্যাতি লাভ করেছেন তন্মধ্যে প্রয়াত বন্দে আলী মিয়া, মযহারুল ইসলাম, সৈয়দ আলী আহসান, আতাউর রহমান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, ওমর আলী, মহাদেব সাহা, আবুবকর সিদ্দিক, আসাদুজ্জামান, জুলফিকার মতিন কাব্যজগতে স্বনামখ্যাত ব্যক্তিত্ব কথাসাহিত্য হাসান আজিজুল হক, প্রবন্ধ ও গবেষণায় মুহম্মদ আবূ তালিব, ড. মখলেসুর রহমান, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, ড. গোলাম মকসুদ হিলালী’ প্রমূখ মনীষীগণ রাজশাহীতে বসে সাহিত্যচর্চা করেছেন এটা রাজশাহী বাসীর জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয়।
বর্তমানে ইতিহাস, সমাজসেবা, গবেষণা ও সাহিত্য সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক কর্ম প্রয়াস ও কর্মকান্ডের দ্বারা যারা দেশ বিদেশে সুখ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন তাদের মধ্যে ড. কাজী আবদুল মান্নান, ড. মুহম্মদ মজিরউদ্দীন, অধ্যাপক এস,এম, আবদুল লতিফ, ড. ইবনে গোলাম সামা, ড. খোন্দকার সিরাজুল হক, ড. সারোয়ার জাহান, ড. খন্দকার আবুদস রহীম প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ এবং সঙ্গীতে ওস্তাদ সারদাকিংকর মজুমদার, ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চু, শামসুজ্জামান, শেখ আবদুল আলীম, রবিউল হোসেন, গোলাম মোস্তফা, রঘুনাথ দাস, আমানুল্লাহ, তালেবর আলী, তোফাজুল হোসেন, ফজলুল হক, আবদুর রশীদ, নূর আহমদ বদিউল আলম ভুুলু, মুস্তাকিম উদ্দীন আহমেদ টুলু, মাহমুদুল ইসলাম সাজু, মুক্তিযোদ্ধা নওশের আলী এবং নৃত্যে বাদল ও আবদুল হাসিব পান্না প্রমুখ শিল্পী গুণী ব্যক্তিবর্গ রাজশাহীতে সফল পদচারণার দ্বারা আমাদের জীবনে স্মরণীয় হয়ে আছেন, স্মরণীয় হয়েই থাকবেন।
সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় এখানের মহিলারাও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তাঁদের মধ্যে দৌলতুন্নেছা, চৌধুরী শামসুন্নাহার বকুল, ডা. রাজিয়া সালাম, রওশন, সুলতানা হক, সেলিনা হোসেন প্রমুখ মহিলারাও খ্যাতির শীর্ষে রয়েছেন। রাজশাহী ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে স্বীকৃত যে, এই রাজশাহীর ‘রামপুর বোয়ালিয়ার থেকে প্রকাশিত ‘জ্ঞানাস্কুর’ পত্রিকায়’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়েছিল। এই রাজশাহীতেই প্রথম ইংরেজি প্রথায় মঞ্চাভিনয় আরম্ভ হয়। এইভাবে সাহিত্য সাংস্কৃতিক জীবনধারা ও চেতনাকে সমৃদ্ধ করে রাজশাহীর সাহিত্য সংস্কৃতিসেবী সাধক ও কর্মীরা গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।
১৯৮৪ সালে রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারের শতবর্ষ উদযাপন ও ‘শতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ: ১৯৮৪’ প্রকাশ এবং রাজশাহীতে ২০০৬ সালে প্রথম বৈশাখী মেলার আয়োজন ও স্মরণিকা প্রকাশ সাহিত্য-সংস্কৃতি কর্মী ও সচেতন মানুষের মাঝে প্রাণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে দেশের ও বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিসেবী, সমাজসেবক গুণী, ব্যক্তিদের পুরস্কার, পদক, সনদপত্র প্রদান ও সংবর্ধনার, মাধ্যমে তাঁদের কর্ম ও সাধনায়, মূল্যায়ন, করে যথার্থ সম্মান প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়। এই বিষয় স্পন্দন সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংসদের ‘মাদার বখশ স্মৃতি পুরস্কার,’ তরুণদের জন্য ‘স্পন্দন সংসদ পুরস্কার,’ প্রফেসর আবদুল হাই সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদের ‘আবদুল হাই স্মৃতি পুরস্কার’ রাজশাহী লেখিকাস সংঘের ‘আবদুর রাজ্জাক ২১ স্মৃতি পুরস্কার,’ উত্তরাসাহিত্য মজলিশের ‘উত্তরা সাহিত্য পুরস্কার’ সারাদেশে সাহিত্য সংস্কৃতিসেবী মানুষের হৃদয়ে একটি বিশেষ মর্যাদার সমজ্জুল হয়ে আছে। এই ধরনের মহৎ পদক্ষেপের ফল সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।
আশা ও আনন্দের কথা, রাজশাহী শহরের বিভিন্ন শিক্ষা সাহিত্য-সংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী তরুণ ছাত্র-ছাত্রী ও কিছুসংখ্যক শিক্ষক সাহিত্যচর্চা, সংস্কৃতিচর্চা, পত্রিকা প্রকাশ, চিত্র বিদ্যা, আবৃত্তি ও সঙ্গীত শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করে, অনেকের প্রশংসাভাজন হয়েছে। যে সকল সংগঠক, কর্মী ও তরুণ লিখিয়ে বন্ধুরা এই ধরনের মহৎকর্মে নিয়োজিত থেকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তাদের মধ্যে নাজিম মাহমুদ, হাসান আজিজুল হক, জুলফিকার মতিন, ডকটর মুহম্মদ মজিরউদ্দীন, অধ্যাপক এস,এম, আবদুল লতিফ, অধ্যাপক ফজলুল হক, অধ্যাপক রুহুল আমিন প্রামাণিক, অধ্যাপক তসিকুল ইসলাম এবং বিশেষত তরুনদের মধ্যে মামুন হুসাইন, নাজিব ওয়াদুদ, মোহাম্মদ কামাল, সরকার মাসুদ, তারিকউল ইসলাম, মোহাম্মদ মুসা, হাসনাত আমজাদ, মালেক মেহমুদ, মীর রবিউল ইসলাম পাভেল চৌধুরী, আশরাফুল আলম, পিন্টু, রাশেদ রাইন প্রমুখ উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অধিকারী।