মানবমুক্তি ও রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান ভাবনা
আাফজাল রহমান
প্রতিবছর পচিশে বৈশাখ আসে বাঙালির জীবনে নুতনতর প্রেরণা নিয়ে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনটিকে আমরা খুব আপন করে নিয়েছি, প্রয়োজনীয় করে নিয়েছি। নানা রকমের আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে আমরা রবীন্দ্রনাথের আরো কাছে পৌছাতে চাইছি। বোধকরি এই জন্যেই যে কবি মনীষী রবীন্দ্রনাথকে বর্জনের জন্যেই এই জনপদে একদা মাতম ওঠেছিলো। দ্বিজাতিতত্ত্বের ছুড়ি দিয়ে বাংলা ভাগ করে যে সাম্প্রদায়িক দল মুসলিম লীগ সাম্প্রদায়িক বিষবাস্প ছড়িয়ে দিয়ে কিম্ভুত ভৌগলিক রাষ্ট্র পাকিস্তান কায়েম করেছিলো। তারাই সেসময় রবীন্দ্রনাথকে বাঙলা থেকে নির্বাসনে পাঠাতে ওঠে পড়ে লাগে। এই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্টী আপাত মনে করেছিলো রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশ থেকে উচ্ছেদ করতে পেরেছে কিন্তু বাঙালি সে অন্ধ উন্মাদনায় যোগ দেয়নি। একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের পর রবীন্দ্রনাথের গানকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয়সঙ্গীত করে সেই হীনমন্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকদের মোক্ষম জবাব দিয়েছিলো বাঙালি। এবারের পচিশে বৈশাখ আমরা এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে পালন করছি যখন একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী সেই পুরানো কায়দায় সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়বার জন্যে মাঠে নেমেছে। তারা এতোটাই মরিয়া কবি গুরুর জন্মদিনটিও তারা ছাড় দেয়নি।আমরা নিরাশ নই। একটি ঐতিহাসিক সত্য আমাদের সামনে প্রেরণা হয়ে আছে আর সেই সত্যটি হলো অমন বৈরী পরিস্থিতির মধ্যেই রবীন্দ্র চর্চায় আমরা অভ্যস্থ হয়ে ওঠেছি। সার্ধশতবর্ষের বিভিন্ন আয়োজনে আমি নানা পত্র পত্রিকায় ময়মনসিংহে রবীন্দ্রনাথের আগমন এবং আনন্দ মোহন কলেজ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে দেয়া কবির দীর্ঘ লিখিত গুরুবক্তৃতাটির প্রান্ত উন্মোচনের চেষ্টা করেছি। সেখানে কবির শিক্ষা ভাবনার প্রাসঙ্গিকতা ও সময়োপযোগিতা আলোচিত হয়েছে।
এবারের পচিশে বৈশাখকে সামনে রেখে আমি রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানদৃষ্টি পর্যবেক্ষন করেছি। কবি মনীষী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেম সৌন্দোর্য্যরে অপরূপ স্রষ্ঠা হলেও তিনি প্রবলভাবে বিজ্ঞানমনষ্ক। রবীন্দ্রনাথের গোটা জীবনকর্মই মানুষের কল্যান সাধনের অভিপ্রায়ে ধাবিত। তবে এই কবি মনীষী কিভাবে এবং কোন ভাবনায় নিজের চেতনায় বিজ্ঞানের ভিত গড়েছিলেন? সেটা বুঝে নিতে আমাদের তাকাতে হবে তার শৈশব জীবন চর্চার দিকে। জীবন সাধক রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, ‘আমি বিজ্ঞানের সাধক নই সে কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু বাল্যকাল থেকে বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিলোনা’।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের(১৮৬১-১৯৪১) জীবনকাল উনিশ বিশ শতকে সমভাবে বিস্তুৃত ছিলো। উনিশের শেষ ভাগে এবং বিশ শতকের প্রথমভাগে রবীন্দ্রনাথ বেঁেচ ছিলেন। উনিশ শতকের প্রথম ভাগেই ইউরোপে শিল্প বিল্পব ঘটে যায়। স্টিম ইঞ্জিন ব্যাপকভাবে চালু হলে পৃথিবীর দূরত্ব ঘুচতে শুরু করে, সভ্যতার বিকাশ দ্রুততর হয়। রবীন্দ্রনাথের জন্মের ঠিক আগেই ডারউইনের অভিব্যক্তিবাদ জীববিদ্যার ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন ঘটিয়ে বসে। প্রায় একই সময়ে রসানবিদ্যায় নানা আবিস্কার, বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহার, জীবাণুতত্ত্বসহ নানা উদ্ভাবণা মানুষেন জীবন যাত্রায় ব্যাপক রূপান্তর ঘটাতে শুরু করে। রবীন্দ্রনাথ জন্ম গ্রহণ করার পরই শৈশবেই সকল নব উদ্ভাবণা কথা জানতে পারলেন। আমরা তো জানিই যে শিশু রবীন্দ্রনাথ নর্মালস্কুলের মনোযোগী ছাত্র না হয়ে ওঠতে পারলেও ঠাকুরবাড়ীর পাঠশালায় গৃহশিক্ষকদের রুটিন পাঠের হাত থেকে নিস্তার ছিলোনা তাঁর। গণিত, জ্যামিতি,ইতিহাস,ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যায় পাঠ নিতে হতো ঠাকুরবাড়ির কিশোর বালকদের। আর সাহিত্যে পাঠ নিতে হতো মেঘনাদবধকাব্য থেকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’() তে আমাদের জানিয়েছেন যে, কঙাল খুচিয়ে খুচিয়ে মানব দেহের খুটিনাটি শেখাতেন এক পন্ডিত। আর মানব দেহের বৈজ্ঞানিক পাঠ নিতে ম্যাডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে লাশকাটার আদ্যোপান্তও দেখতে যেতে হতো ঠাকুরবাড়ীর কিশোর বালকদের। অল্প বয়সে বিজ্ঞানের এসব চর্চায় রবীন্দ্রনাথের কিশোর মন বিরূপ হয়ে ওঠেনি বরং সে সবে বিজ্ঞান চর্চায় আগ্রহের যোগ হয়েছিলো তা আমরা জানতে পারি রবীন্দ্রনাথের কথা থেকেই। কবি জানাচ্ছেন, সপ্তাহে একদিন রবিবার ‘সীতানাথ দত্ত (ঘোষ) মহাশয় আসিয়া যন্ত্রতন্ত্রযোগে প্রকৃতি বিজ্ঞান শিক্ষা দিতেন।.. যে রবিবার সকালে তিনি না আসিতেন, সে রবিবার আমার কাছে রবিবার বলিয়াই মনে হইত না।’’ (জীবনস্মৃতি,পৃ-৪১)
আমরা আরো জানতে পারি পিতার সাথে যখন ডালহৌসি পাহারে বেড়াতে যেতেন সেটা নিছক পাহার দর্শন পর্ব থাকতোনা; পাহারে বেড়ানোর প্রতিটি সন্ধ্যা অবলিলায় জ্যোতিবিদ্যার প্র্যাক্টিকাল সেশন হয়ে ওঠতো। জ্যোর্তিবিদ মহর্ষী দেবেন ঠাকুর পুত্রকে পাহারের চূড়া থেকে সন্ধ্যাবেলায় দূরবীক্ষণ যন্ত্রযোগে নক্ষত্রমন্ডলীর গ্রহ নক্ষত্রদের চিনিয়ে দিতেন। জ্যোর্তিবিদ্যার পাশাপাশি পিতার কাছ থেকে বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কারগুলোর বিষয়েও পাঠ নিতেন কিশোর রবীন্দ্রনাথ। পিতার কাছ থেকে পাওয়া ধারনা নিয়েই তিনি লিখেছিলেন প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা ‘ভারতবর্ষীয় জ্যোতিষশাস্ত্র’ (১৮৭৩) বার বছর বয়সে। এই লেখাই পরিবারে বিজ্ঞানের লেখক হিসাবে প্রতীষ্ঠা দেয়। যে কারণে রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরে পতœী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ঠাকুর বাড়ি থেকে শিশূ কিশোরদের জন্য ‘বালক’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। রবীন্দ্রনাথকে সে পত্রিকায় পদার্থবিদ্যা, জ্যোর্তিবিদ্যা ও ভূবিদ্যা প্রভৃতি বিজ্ঞান বিষয়ে শিশূ কিশোর উপযোগী লেখা দেবার জন্য নিয়মিত লেখক হিসাবে মনোনিত হন। ‘বালক’ পত্রিকায় বালক কবি প্রায় প্রতি সংখ্যায় লিখেছেন। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দ থেকে সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সাধনা’ নামে পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ সাধনায় প্রাণিবিদ্যা ও জ্যোর্তিবিদ্যা বিষয়ে বেশ অনেকগুলো লেখা দিয়েছিলেন। তাঁকে নুতন ইংরেজি শিক্ষিতজন তখন বিজ্ঞান বিষয়ে বাংলায় কিছু কিছু লিখতে শুরু করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের সে সব রচনা পড়েও প্রাণিত হয়েছিলেন। কিছুকালের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের জোর্তিবিজ্ঞানের আগ্রহ প্রাণবিজ্ঞানে সঞ্চারিত হয়েছিলো।
বিশ শতকের গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞান বিষয়ক এক প্রবন্ধ লিখে বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্রকে চমকে দিয়েছিলেন। বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহবশেই তিনি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের সাহচার্য পেয়েছিলেন। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্রের গবেষণার বিষয় নিয়ে ‘বঙ্গদর্শন’এ রবীন্দ্রনাথ ‘জড় কি সজীব?’ এই শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন যেটি ১৯০১ ছাপা হয়েছিলো। সেটি পড়ে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু বিস্মিত হয়েছিলেন আর তিনি তার সেই বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে ,‘তুমি যদি কবি না হইতে তো শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক হতে পারিতে।’
রবীন্দ্রনাথ শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক হতে চান নি বটে কিন্তু আজীবন বিজ্ঞান চর্চাকে গুরুত্ব দিয়েছেন বিজ্ঞানের লোকহিত প্রায়োগিক দিকটি মাথায় রেখেই। তিনি যর্থাথই মনে করতেন বিজ্ঞানের হাত ধরেই পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের ক্রম অগ্রগতি তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষনে রাখতেন। তিনি যখন ১৯২৬ ইউরোপের পথে বেরুলেন, গেলেন জার্মানীতে গেলেন আইনস্টাইনের সাথে দেখা করতে। আইনস্টাইন তখন তাঁর আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব প্রকাশ করে বিজ্ঞানের জগতে আলোড়ন তুললেন। সেখানে আইনস্টাইনের কাছে ভারতীয় বিজ্ঞান গবেষক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কথা জানতে পারলেন। ফিরে এসে তিনি অনুজ সত্যেন বোসকে খুজে বের করলেন এবং তার সাথে বিজ্ঞান চর্চায় যুক্ত হন। ৪ বছর পর ১৯৩০ এ আবার তিনি জার্মানিতে যান আইনস্টাইনের সাথে দেখা করেন। এ সময়ই বেতারযন্ত্র, আকাশ বিজয়, তেজস্ক্রিয়া, পরমাণুর গড়ন, ইলেকট্রন-প্রোটন, দুধরণের তড়িৎকণা, কোয়ান্টামবাদ, জ্যোতিষ্ক লোকের রহস্য, জীবাণুতত্ত্ব, বংশগতিবিদ্যা – এসব বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবণা রবীন্দ্রনাথের মনেও প্রবলভাবে দোলা দিয়েছিলো।
রবীন্দ্রনাথ যর্থাথই বুঝেছিলেন অন্ধ বিশ্বাসের মুঢ়তার প্রতি অবিশ্বাস বা অশ্রদ্ধা জাগাতে বিজ্ঞানের চেতনার বিকল্প নেই। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন সমাজের অধিকাংশ মানুষ বিজ্ঞানবোধের অভাবটি বুঝতে পারেন না কিন্তু। এ নিদারূণ এক দৈন্য। এই দৈন্য কাজের ক্ষেত্রে আমাদের পিছিয়ে রেখেছে।এ দৈন্য মানুষকে নিরিহ করে রেখেছে যা তাকে নানা নির্যাতন ভোগে বাধ্য করে রাখে।
রবীন্দ্রনাথ তারা গোটা জীবনের বিজ্ঞান ভাবনাকে পরিণত বয়সে এসে গ্রন্থিত করার কথা ভাবেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো তিনি ১৯৩৭ এ ‘বিশ্বপরিচয়’ নামে যে প্রবন্ধ সংকলনটি প্রকাশ করেন সেটি মুলত বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ। তাহোলে কি ভারতের বাইরের বিশ্বকে রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানের জগৎ বলেই জ্ঞান করেছিলেন? আজকের অধুনা বিশ্ব মানেই বিজ্ঞান সৃষ্ট সভ্যতা সে নিরিখেই সম্ভবত কিশোর রবির চিত্তে অমন প্রণোদনা । ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থের প্রবন্ধের সূচিটি দেখলেই হতবাক হতে হয়। পরমাণুলোক, নক্ষত্রলোক, সৌরজগৎ, গ্রহলোক, ভূলোক — সহজ বাংলায় বিজ্ঞানের অমন কঠিন বিষয়গুলো পরিচিতি দিয়েছেন ‘বিশ্বপরিচয়’ নামের গ্রন্থে। রবীন্দ্র অনুধ্যানে আরো বিস্ময়জাগে যে, জীবনের শেষ পর্বে কবি নাকি বৈজ্ঞানিক মায়াবাদ আর নবপ্রাকৃতত্তে ¡ অভিভূত ছিলেন।
কবি মনীষী রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞান চর্চাকে এগিয়ে নেয়া শিক্ষিতজনের অত্যাবশ্যক কর্ত্যব্যকর্ম হিসাবেই মনে করতেন।
প্রতিক্রিয়াশীল, পশ্চাদপদ ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠী জোট বেধে আজ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের জন্য বড় অপশক্তি হয়ে দাড়িয়েছে। যে কারণে নানা উপলক্ষে, যে কোন আয়োজনে এক বিজ্ঞানপ্রেমী রবীন্দ্রনাথকে উন্মোচন আজ জরুরী হয়ে পড়েছে।