বাংলাদেশ আমজনতা পরিষদ = বাপ

আরিফ আহমেদ

Sharing is caring!

Untitled-11অনু-উপন্যাস
বাংলাদেশ আমজনতা পরিষদ  = বাপ

ভূমিকার বদলে

এক
লেখকের মাথায় ভুতের মতো চেপে বসেছে ভয়ংকর দুটি মতবাদ। অনেকটা পাগলের মতোই সে বিরবির করছে –
স্টুডেন্ট বা ছাত্র-ছাত্রী শব্দটি নিয়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা যে আন্দোলনে নেমেছে তা কি অযৌক্তিক? ছাত্র সংসদ কেন ছাত্র-ছাত্রী সংসদ হবে না। যদি ছাত্র সংসদই হয়, তাহলে মেয়েদের আর ছাত্রী বলা চলবে না তারাও ছাত্র। তাহলেই ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল শব্দটি মেনে নেয়া যায়। এতে ছাত্রের কোনো স্ত্রী লিঙ্গ থাকেনা। মেয়েদেরও আর ছোটো করা হয় না। তাদের এ দাবী অবশ্যই যুক্তিসংগত। তাহলে কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবী ও মাদ্রাসার শিক্ষরা কেন তাদের বিরোধীতা করছেন?
এ দেশের ভবিষ্যত দুটি রাজনৈতিক দলের হাতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তালিকায় এরপর নেতা কে? শেখ রেহানা নাকি জয়? অন্যদিকে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিএনপিতে সভানেত্রী তার স্ত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, এরপর তারেক জিয়া, তারপর কে হবেন নেতা? শেখ রেহানা বা জয়ের বংশধর নাকি তারেক রহমানের বংশধর। বংশক্রমিক রাজনীতির চর্চায় গণতন্ত্র কতটা সফল?
এই কি তাহলে সফল গণতন্ত্রের নমূনা? নিজেরাই নিজেদের খুন করা বা দলীয় কোন্দলে পরে খুন হয়ে যাওয়া ? আর কতদিন এই অরাজগতা আর অশান্তির মধ্যে দিন কাটাবো আমরা ? আমাদের রাজনৈতিক অস্থিরতা, হানাহানি, নেতাদের অসদাচরণ ও বার বার প্রতারণা এতোটাই চরমে পৌঁছেছে যে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাচি’ অবস্থা। এমনকি দলীয় সাধারণ সমর্থকদের মাঝেও নিজ দলের নেতাদের প্রতি চরম অসন্তোষ ক্রমশ বাড়ছে। কেন এই দুরাবস্থা আমাদের? দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য যারা ভালো কিছু করতে চায় তারা আর যা-ই হোক কথা বলে সময়ের অপচয় করে না। কাজ করে দেখায়।

দুই
আমার বাপ প্রায়শই একটা কথা বলতেন – যে নিজেকে ভালোবাসেনা সে কাউকে ভালোবাসেনা।
বাপ’ কেন এ কথাটি বলতেন আজও তা ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারি নাই। কারণ সব মানুষই নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে এটাই স্বাভাবিক। আর নিজেকে বেশি ভালোবাসে বলেই মানুষ কখনো কখনো অতিমাত্রায় স্বার্থপর। এই উপন্যাসটির লেখকের পাল্লায় না পরলে আমি কখনো বুঝতেই পারতাম না যে, নিজেকে ভালোবাসার মানেটা এতো সাধারণ নয়।
পাঠক আপনি কি নিজেকে সত্যি-ই ভালোবাসেন? গভীরভাবে ভেবে দেখুনতো, কারণ এই উপন্যাসের নায়কের মতে – যে নিজেকে ভালোবাসে সে কখনো নিজের আত্মা বা বিবেকের অশান্তি হয়, এমন কোনো কাজ করতে পারে না। তাহলে নিজেকে ভালোবাসায় প্রচণ্ড ফাঁকি থেকে যায়। অশান্তি কখনো তার পিছু ছাড়েনা। এই ভালোবাসার-ই অপর নাম আল্লাহ-ঈশ্বর-ভগবান। তবে কি আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষই আজ নিজেকে ফাঁকি দিচ্ছি?
লেখক সাহেব বলেন – নিজের বিবেককে কষ্ট দিয়ে আমরা বুদ্ধিকে প্রশ্রয় দিচ্ছি, মনের ডাক এড়িয়ে যুক্তিকে মেনে নিচ্ছি বলেই আজ আমাদের এই দশা। বাসে, ট্রেনে, স্টীমারে, রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানে মানুষের আলোচনায় একটু কান পাতলেই বোঝা যায়, তারা সবাই এখন বিকল্প একটা রাস্তা খুঁজছেন। বাপের উপর বাপ হতে পারে এমন একজন নেতার সন্ধানে সাধারণ মানুষ আজ প্রার্থনা করছেন আল্লাহ, ইশ্বর বা ভগবানের কাছে।
সাধারণ মানুষের এই প্রার্থনা কতদিনে পূরণ হবে তা স্রষ্টা-ই বলতে পারেন। তবে এই উপন্যাসটি তাদের একটি স্বপ্ন দেখাতে পারে। নিষক একটি স্বপ্ন। যা বাস্তবায়ন খুব কঠিন নয়। পাঠক চাইলে এ স্বপ্নের পথটিতে নিজেই হাঁটতে পারেন, নিজেই উদ্যোগী হয়ে এটিকে বাস্তব রূপ দিতে পারেন। শুধু অনুরোধ – এ স্বপ্নটি বাস্তবায়ন করতে হলে বুদ্ধি বা যুক্তি নয়, বিবেক আর মনের ডাক শুনুন। এই উপন্যাসের ভিতরে লুকানো বাপ (ব +আ +আ +প) মানে বাংলাদেশ আমজনতা  পরিষদ বা পার্টি-এর গঠনতন্ত্র বুঝে নিন এবং গড়ে তুলুন আপনার স্বপ্নের দেশ। তবে প্রকৃত গঠনতন্ত্র হচ্ছে – ঈশ্বর রচিত মুসলমানদের জন্য কোরানুল করিম, হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য পবিত্র বেদ এবং খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের জন্য তাদের ইঞ্জিল শরীফ বা বাইবেল (ওল্ড টেস্টামেন্ট)। এর বিকল্প কোনো উত্তম গঠনতন্ত্র হতেই পারেনা।
(আজ রবিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৬ বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য বাপ’কে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। আমি থাকি বা না থাকি এ বইটি তোমাদের নিয়ে যাবে আগামী সুন্দর জীবনের কাছে। যদি তোমরা এর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ কর। শুধু শর্ত একটাই – তোমরা কেউ নাস্তিক হতে পারবেনা, সবাই যার যার ধর্মে আস্তিক হয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করো। ফল আসবেই ইনশাহআল্লাহ।)

বাপ

এক
অবাস্তব ভাবনায় পটিয়সী একজন লেখক যখন তার সস্তা মানসিকতা নিয়ে গুরুগম্ভীর বা রাশভারী কিছু লিখতে চায়, তখন তা কতটা কষ্টদায়ক আর হাস্যকর হয়ে ওঠে তার প্রমাণ ‘এবং অভিনয়’ নামের উপন্যাসটি যারা পড়েছেন, তারা অক্ষরে অক্ষরে টের পেয়েছেন। বিশেষ করে আমার মতো আনাড়ি একজনকে জোর করে মঞ্চে তুলে দিয়ে অভিনেতা বানানোর চেষ্টাটা ছিল আরও বেশি হাস্যকর।
লজ্জা ও ভয়ে আমি যে শুধু নাটকপাড়া ছেড়েছি তাই না, লেখকের পাল্লায় পরে আবার কোনো ভুল করে ফেলার ভয়ে, শহর ছেড়ে আস্তানা গেড়েছি দূর পাড়াগায়ে। দীর্ঘ সাতটি বছর এই পাড়াগায়ে মুদির দোকানে চা সিগারেট ও রকমারী পণ্য বিক্রির পাশাপাশি গ্রামের সাধারণ কৃষক-শ্রমিকদের সাথে আড্ডা দিয়ে বেশ ভালোই কাটছিল আমার একক সংসার। কিন্তু প্রবাদ আছে ‘সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয় না, আর যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত্র হবে-ই’।
লেখক থেকে বাঁচার জন্য অজপাড়া গাঁয়ে লুকিয়ে থেকেও আমার শেষ রক্ষা হলো না। সাত বছর পর গন্ধ শুঁকে শুঁকে সালা আমাকে ঠিকই খুঁজে বের করে ফেলল। বাপ নামে কোনো একটা মঞ্চনাটকের প্রধান চরিত্রে আবার অভিনয় করতে হবে। আমি ‘না’ বলায় কি সব মানবিকতা, দায়বদ্ধতা ইত্যাদি কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করে আমাকে ছিন্ন ভিন্ন করার প্রয়াস পেল।

আমি মূর্খ মানুষ। শহুরে সংস্কৃতির সাথে মোটেও অভ্যস্ত নই। এই মুদি দোকানটিকে সম্বল করে বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছে দিন, কারো সাথে প্যাঁচে নেই। স্ত্রী ছিল, এই সালা লেখকেরই বোন, দূরারোগ্য ব্যাধিতে সে চলে গেছে। কোনো সন্তান নেই। একেবারে ঝাঁড়া হাত-পা। যে কারণে কোথাও আমার কোনো দায়বদ্ধতা আছে বলে মনে হয়নি কখনো। এই সালা লেখক যখন-ই এসেছে, তখন-ই পিলে চমকানো সব বাক্যবাণে আমাকে কাবু করেছে। আমার এককীত্বের গর্ব খর্ব করে দিয়েছে। ওর এসব জটিল শব্দে আমি এবারও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছি। তবে এবার আমি অনড়, অটল। ওর কথায় মোটেও নরম হবো না, এমন একটা জেদ নিয়েই ফিরিয়ে দিলাম। পরিস্কার বাংলায় বললাম – তুমি যত যাই বল, আমি আর তোমার সাথে নাই।
স্বপ্ন ভেঙে গেলে মানুষের মুখটা কেমন হয় দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি, তবে বিষন্ন মনে লেখক যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন ওর কাঁদো কাঁদো মুখটা দেখে আমার ঐ স্বপ্ন ভংগের কথাটাই মনে এল। অনেকটা দূর থেকে লেখক আবার ফিরে এসে বলল – সাধনরে! অনেক বদলে গেসছ তুই। একটা কথা সত্যি করে, বুকে হাত দিয়ে ভেবে দেখিস প্লিজ।
বললাম – কী কথা?
উত্তরে ও বিমর্ষ হাসলো – আমাকে উত্তর দিতে হবে না। নিজেকেই পরে উত্তরটা দিস। তুই কি সত্যি নিজেকে ভালোবাসিস সাধন? যদি বাসিস, তাহলে এই দেশের মানুষের প্রতিও তোর ভালোবাসা সমান হবে। কারণ যে নিজেকে ভালবাসে শুধু সেই পারে মানুষকে ভালোবাসতে। তুই একটা মানুষ, তুই-ই একটা দেশ। এই ভালোবাসার-ই অপর নাম আল্লাহ-ঈশ্বর-ভগবান। কথাটা ভেবে দেখিস।
কথাগুলো বলে আর দাঁড়ায়নি লেখক। আমিও আর ওর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে দোকানের কাজে ব্যস্ত হয়েছি, বলা যায়, ব্যস্ততায় ভুলে ছিলাম। রাতে ঘুমাতে গিয়ে-ই মনে হলো – ছোটবেলা বাবার মুখে এ কথাটি বহুবার শুনেছি। বাপ আমার প্রায়-ই বলতেন – শোন্ সাধন, সবসময় মনে রাখিস – যে নিজেকে ভালোবাসে না, সে কাউকে ভালোবাসে না। এ কথাটি বাপ শুধু আমাকে-ই কেন বলতেন? কী এর গুরুরহস্য? তা আজও আমার মাথায় ঢোকেনি। আমি যেটা বুঝি – এমন একজন মানুষ কি আছে পৃথিবীতে যে নিজেকে ভালোবাসেনা? মানুষ মাত্রই নিজেকে ভালোবাসবে এটাই স্বাভাবিক। তাহলে?
ভাবনাটা আমাকে এতোটাই পেয়ে বসলো যে রাতে আর ঘুম এলো না। সকাল হতেই আমি ছুটে গেলাম স্থানীয় মসজিদের ইমাম, বরিশালের বাকেরগঞ্জ থানাধীন দুধলের পীরজাদা মুফতি মাওলানা সাইফুল্লাহ-এর কাছে। তার কাছে এ কথাটির ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তিনি বললেন – কথাটি আসলে দুনিয়াদারী নিয়ে নয়, আখেরাত নিয়ে। আখেরাতের শাস্তির হাত থেকে নিজের দেহকে বাঁচাতে চাইলে, দেহের কোনো অংশকেই কোনোরকম পাপ কাজে উৎসাহ বা লিপ্ত করা যাবেনা। যে মানুষ নিজেকে আখেরাতের শাস্তি থেকে মুক্ত রাখতে চায়, সে অবশ্যই নিজেকে ভালোবাসবে এবং দুনিয়ায় কোনো পাপ, কোনো অন্যায় করবে না। আর যে নিজে অন্যায় করে না, সে অন্যকেও বিশেষ করে তার চারপাশের মানুষদেরকেও কোনো অন্যায় করতে দিতে চাইবে না এটাই স্বাভাবিক।
পীরজাদা সাহেবের উত্তর আমার মনপুঃত হয়নি। আমার কেবলই মনে হচ্ছে এ কথাটি আরও জটিল, শুধু আখেরাত আর পাপ-পূণ্য বিচারে সীমাবদ্ধ হলে ছোটবেলা আমার বাপ আর আজ লেখক এ কথাটি এতো গুরুত্ব দিয়ে বারবার বলতো না।

মুদি দোকানের পণ্যসামগ্রী কিনতে শহরে এসেই পরলাম একটা মিছিলের সামনে। বিশাল লম্বা একটা মিছিল। কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের দীর্ঘ লাইন। কৌতুহল থেকে জানতে পারলাম – জেলা শহরের চারটি কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা একত্র হয়ে এই মিছিল নিয়ে যাচ্ছে। মিছিলের সামনে কালো কাপড়ে সাদা রং-এ লেখা “শিক্ষাঙ্গনে দলীয় রাজনীতি বন্ধ কর” “মেয়েদের ছাত্রী বলা চলবে না”। তাদের এই মিছিলে ব্যবহার করা শ্লোগান গুলো আমার মনোযোগ কেড়ে নিল, আমি প্রতিটি শ্লোগান কাগজে লিখে নিতে চাইলাম।

রাজনীতির নোংরাচালে সাধারণ ছাত্র মরবে কেন?
রাজনীতিবিদ জবাব দাও, দিতে হবে।

ছাত্রসমাজ, ছাত্রশিবির, ছাত্রদল আর ছাত্রলীগ,
সকল প্রকার দলবাজী শিক্ষাঙ্গন থেকে বিদায় নিক।।

নিরিহ ছাত্র আবু বকর মরলো কেন জবাব চাই, দিতে হবে।
দলীয় কোন্দলে ফারুক, নোমান আর রিপনরা মরবে কেন,
জবাব দাও, দিতে হবে।

নেতাদের ছেলে মেয়ে
বিদেশে শিক্ষা পায়
দেশে ফিরে তারাই আবার
বড় বড় নেতা হয়।

আমজনতা আমরা তাই
সু-শিক্ষার সুযোগ চাই
শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি
করবে এবার নির্দলীয় ছাত্ররাই।।

মিছিলটি আমাকে পার হয়ে চলে যাওয়ায় অন্য শ্লোগানগুলো আমি আর শুনতে পেলাম না। তবে কোথাও সেই ব্রিটিশ বা পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনের শ্লোগান যুক্ত হয়নি দেখে খুব ভালো লাগল। রাজনৈতিক দলগুলোর শ্লোগান মানেই- জালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও, গদিতে আগুন দাও ইত্যাদি বস্তা পঁচা বাসি শব্দ। যা স্বাধীনতার পূর্বে বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল। কিন্তু স্বাধীন দেশে কি ঐ শ্লোগান মানায়? এ কথাটি নেতারা একবারও ভেবে দেখেনি। আজ এই ছাত্রদের মিছিলটি কি তবে নতুন কোনো আশার আলো জ্বেলে গেল? ওরা শুধু নিরিহ ছাত্রদের হয়ে কথা বলছেনা রাজশাহীর ফারুক, যশোরের রিপন এবং ছাত্র শিবিরের নোমান হত্যারও নিন্দা করছে। এই তো সত্যিকার ছাত্রের কাজ। বাঃ চমৎকার! আমি তোমাদের সালাম জানাই। আপনমনেই বিরবির করে ওদের প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। ছাত্র-ছাত্রীদের এই শান্তিপূর্ণ মিছিলটির পিছনে ও সামনে পুলিশের প্রহরা ও তাদের উৎকন্ঠিত আচরণ ছিল রহস্যজনক। মিছিলটি চলে যাবার পর রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে বসে পরলাম, দোকানিকে এককাপ চায়ের জন্য বলে মনোযোগ স্থির করলাম চারপাশে আমজনতার গুঞ্জনে। এই চায়ের দোকানগুলোই হচ্ছে খবরের এবং দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের প্রথম রাশিচক্র। আমি অন্তত তা-ই মনে করি। চায়ের কাপে চুমুক দেবার আগেই শুনতে পেলাম, কেউ একজন বলছেন – এত পুলিশ কেন বলতে পার?
অন্য কেউ উত্তর দিলেন – শুনলাম! এই মিছিলে রাজনৈতিক দলের যে কেউ হামলা চালাতে পারে, তাই কলেজের প্রিন্সিপালরা সবাই একসাথে পুলিশ প্রোটেকশন চেয়েছেন।
আর একজন কেউ বললেন – আরে ভাই আপনারা জানেন না, এরা এই মিছিল নিয়ে নামার আগে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কাছে চিঠি দিয়েছে এবং প্রত্যেকের নামে থানায় জিডি করে এসেছে, কোনো হামলা হলে-ই খবর আছে। সরকারী দলকেও বাদ দেয় নাই।
আর একজন কেউ বলে উঠলেন – আরে বাপ, এদের তো বেজায় বুদ্ধি। এদের নেতা কে?
আমজনতার মধ্যে থেকে এবার এক তরুণকণ্ঠ উত্তর দিল – আমাদের কোনো নেতা নাই, আমরা সবাই মিলে, পরামর্শ করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। চায়ের কাপে শেষ চুমুকটি দিয়ে আমি তরুণ ছাত্রটিকে দেখলাম, তার কাঁধের ব্যাগ আর ঘামে জবজবে পোষাক বলে দিচ্ছে সে এই মাত্র মিছিল ছেড়ে এসেছে।
আমি তাকে ভাইয়া সম্বোধন করে জানতে চাইলাম – আপনারা হঠাৎ এ রকম একটা সিদ্ধান্ত কেন নিলেন। সবাইকে একত্র করা তো খুব কঠিন কাজ, এটা কি করে সম্ভব হলো।
তরুণ ছাত্রটি বললো – না এ হঠাৎ কোনো সিদ্ধান্ত নয়, বুয়েটের সনি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু বকরের মত নিরিহ ছাত্র আমরাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিম্বা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবার পর কি তাহলে এভাবে লাশ হয়ে ফিরে আসবো আমরা? রাজনীতি করে সুবিধা নেবে বড় বড় পেশাদার নেতারা, আর আত্মহুতি দেবে সাধারণ ছাত্ররা। কেন? তাছাড়া এই যে দলীয় কোন্দলের শিকার হয়ে যে সব কর্মী মারা যাচ্ছেন, এতে ক্ষতিটা কার হচ্ছে? শুধু ঐ কর্মীটার পরিবারের বা আত্মীয়-স্বজন ছাড়া আর কারো কি কোনো ক্ষতি আজ পর্যন্ত হয়েছে। আমাদের বড় বড় নেতাদের ছেলে মেয়েরা বিদেশে পড়াশুনা শেষে দেশে এসেই মন্ত্রী-এমপি হচ্ছেন, অথচ দেশের শিক্ষাঙ্গনে পড়তে গিয়ে রাজনীতির পাল্লায় পরে প্রাণ দিচ্ছে কারা?
প্রশ্নটা করে তরুণছাত্রটি নিজেই আবার উত্তর দিলেন – আমার, আপনার ভাই, কাকা অথবা সন্তানরা প্রাণ দিচ্ছে, বিনিময়ে নেতার ছেলে নেতা হচেছ, তাইনা?
এবার আমজনতার অনেকেই বলে উঠলেন – একদম খাটি কথা, একদম সত্য, এটাইতো হচ্ছে।
কেউ একজন ফোঁড়ন কেটে বললেন – নেতার পোলা নেতা হবে না তো কৃষকের ব্যাটা নেতা হবে?
তরুণ ছাত্রটি আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল – এই যে ঢাকায় ছাত্র-ছাত্রী শব্দটার ব্যবহার নিয়ে মেয়েরা আন্দোলনে নেমেছে। এতে কার কি ক্ষতি বলুন?
আমি বললাম – বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলবেন? আমি এটার কথা কিছু শুনিনি।
ছাত্রটি বলল – ঢাকার ইডেন কলেজ, রোকেয়া ও শামসুন নাহার হলের মেয়েরা এ নিযে প্রথম আন্দোলন শুরু করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নেত্রীকে যখন নেতা, সংসদ নেতা বলা শুরু করেছে, তখন এটা দেখে মেয়েরা প্রথমে এ দাবী তোলে। পরে তারা ছাত্র শব্দের সাথে যৌথভাবে ছাত্রী ব্যবহার করার অনুরোধ জানায়। যেমন ছাত্র-ছাত্রী লীগ ও দল, ছাত্র-ছাত্রী সংসদ। কিন্তু কিছু বুদ্ধিজীবী ও মাদ্রাসার শিক্ষাকরা তাদের বাধা দিলে তারা আরও ক্ষেপে যায় এবং ছাত্রী শব্দের ব্যবহারই তুলে দিতে আন্দোলন শুরু করেছে। এতে তাদের উপর হামলা হয়েছে, তাই সারা দেশের নিরপেক্ষ ছাত্র-ছাত্রীরাও তাদের এ আন্দোলনে ঐক্যতা ঘোষণা করেছে। ‘ছাত্রী’ বলা চলবে না।
আমি তরুণটির জন্য আরও এককাপ চা দিতে বললাম। সে নিতে চাইলো না, আমি জোর করায় না করতে পারলো না। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সে বলল – তারপর দেখেন, একটা দেশের সরকারের প্রধান কাজই হচ্ছে – সে দেশের উন্নয়নের জন্য, মানুষের ভালোর জন্য কাজ করা। বেকারত্ব দূর করতে উদ্যোগী হওয়া। অথচ সয়ং প্রধানমন্ত্রী এখানে ব্যস্ত নাম পরিবর্তন আর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার কৌশল তৈরি নিয়ে। এটা করতে যেয়ে তিনি তার কর্মিদের খুশি রাখছেন যেকোনো উপায়ে। যখন তখন বাড়াচ্ছেন জ্বালানী পণ্যসহ বিভিন্ন পন্যের দাম। এখন আবার বলছেন, সাধারণ মানুষ পাইপের গ্যাস লাইন পাবেনা, সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করবে। একশ্রেনীর বুদ্ধিজীবী আবার এটাকে সমর্থন করে উচ্চপ্রশংসিত কলাম লেখেন পত্রিকায়। ছিঃ কি লজ্জার কথা। কোথায় একজন দেশপ্রেমিক সরকার তার মানুষর সুবিধা আগে দেখবে তা নয়, বরং তার কর্মীরা কি করে রাতারাতি ধনী হবে এ সরকার তাই গুরুত্ব সহকারে দেখছেন। বিরোধী দলের নেতাদের এ নিয়ে কোনো প্রতিবাদ কি দেখেছেন? সবচেয়ে কষ্ট লাগে যখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামবদলের কারণ নিয়ে এ দেশের একজন প্রধানমন্ত্রী বলেন – বিরোধীদলকে শিক্ষা দিতেই আমরা এটা করছি। তাদের শিক্ষা দেয়া উচিৎ। তাদের (আওয়ামী ও বিএনপির) সাপ বেজির লড়াই, এটা চলবেই।
তার এ কথা শুনে আমাদের এক ছাত্র ছোটবেলায় পড়া উত্তম ও অধম কবিতাটিকে প্যারোডি করে লিখেছে – আসলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলতে চান –
কুকুর যখন কামড়ে দিল
ভীষণ ব্যাথা লেগেছে আমার পায়
তাই কুকুরকে কামড়ে দিলাম
ওটাও বুজুক ব্যাথা কেমন হয়।।
তরুণের এই প্যারোডি শুনে আমার সাথে অনেকেই হেসে উঠলেন – আসলেও তো ঠিক। কারণ কুকুরকে কামড়াতে একমাত্র কুকুরই পারে। (তাইতো ৯৬তে বিএনপি যে ভুল করেছে এখন এই ২০১৬ তে এসে সেই একই ভুল করতে যাচ্ছে নব্য সৌরাচার খ্যাত আওয়ামী লীগ সরকার।
তরুনটি তখন বলছে – আমরা এই জেলার চারটি কলেজের সব সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী একসাথে বসে ঠিক করেছি – এসব আর মানা যায় না। আমাদের প্রতিবাদ করা উচিৎ। আমরা ছাত্র। ইংরেজীর স্টুডেন্ট-এর সাতটি বর্ণেরই রয়েছে পৃথক পৃথক ব্যাখ্যা। ১) এস -স্ট্যাডি (পড়াশুনা বা জ্ঞান), ২) টি -ট্রুথনেস (সত্যবাদীতা), ৩) ইউ -ইউনিটি (একতা), ৪) ডি -ডিফেন্স (প্রতিবাদী), ৫) ই -এনার্জিটিক (পরিশ্রমি), ৬) এন -নিউট্রালিটি (নিরপেক্ষতা), ৭) টি -ট্রাস্টি (বিশ্বস্ততা)। (ছাত্রটি বলছে আর আমি দ্রুত কাগজ কলম বের করে লিখে নিলাম, কারণ এটা আমিও জানতাম না।) ইতিমধ্যে তরুণটির পাশে আরও কয়েকজন ছাত্র এসে দাঁড়িয়েছেন।
তাদের একজন বললেন – এই সব ব্যাখ্যা একত্র করে দেখুন ‘ছাত্র’ নিজে-ই একটি পৃথক পূর্ণাঙ্গ সত্তা। এ সত্তাটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হাতে পরে খন্ডিত হয়েছে। আমরা আর তা হতে দেব না। যদি মেয়েদের দাবী মেনে নিয়ে সরকার ছাত্রী শব্দটি তুলে দেয় তাহলে আমরা ছাত্র সংসদ নামেই সরাসরি রাজনীতিতে অংশ নেব, অন্যথায় ছাত্র-ছাত্রী সংসদ লেখা হবে। চেষ্টা করবো খন্ডিত সত্তাগুলোকে অর্থাৎ ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্রমৈত্রী, ছাত্রসমাজ বা শিবির যা যা আছে সবাইকে একত্র করে পুরানো কাঠামো ফিরিয়ে আনতে। ইতিমধ্যেই শিক্ষাঙ্গন থেকে তাদের সব কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ার জন্য আমরা সবাইকে লিখিত অনুরোধ জানিয়েছি। দেশের সব শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র সংসদ থাকবে, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের কোনোরকম ছায়া সেখানে থাকবে না। সাধারণ মানুষ ছাত্রদের কাছে আবার আশ্রয় চাইবে, তাদের সমস্যা নিয়ে ছুটে আসবে। আমরা সারা দেশের প্রায় পঁচিশ হাজার শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানকে পত্র দিয়ে যাচ্ছি, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এখন থেকে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ছাত্র সংসদ উম্মুক্ত করার অনুরোধ করেছি। শর্ত একটাই এই ছাত্র সংসদ সদস্যরা কখনো কোনো চাঁদাবাজী বা টেণ্ডারবাজীতে জড়াবে না। প্রতিজেলার যেকোনো অন্যায় অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রথমেই রুখে দাঁড়াবে এই ছাত্র বা ছাত্র-ছাত্রী সংসদ। যেটা ঘটেছেও অলরেডি, রাজশাহীতে একজন কলেজ ছাত্রী ধর্ষণের সাথে জড়িত তিন ধর্ষককে জনসমুক্ষে শাস্তি দিয়েছে এই ছাত্রজোট। তাদের লিঙ্গকর্তন করে যাবজ্জীবন সাজা আদায় করেছে তারা। আমরা সবাই সমর্থন দিয়েছি এতে। এখন থেকে এটাই হবে বাংলাদেশে।
হঠাৎ করেই ছাত্র বন্ধুরা একযোগে আওয়াজ তুলল –
আমরা ছাত্র
আমরা জাতির ভবিষ্যত… আমরা ছাত্র।
আমাদের মাঝে ছেলে-মেয়ে
নাই কোন পার্থক্য ।
আমরা আমাদের ভালোবাসি
তাই দেশের প্রতি
আমাদের রয়েছে অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
আমরা ছাত্র।।
একজন ছাত্রের হলে অপমান
দেশের তথা বিশ্বের সব ছাত্রের হবে অপমান,
একজন ছাত্র অপরাধী হলে
বিশ্বের সব ছাত্রের থাকবে না যে মান।
আমরা ছাত্র,
আমরাই রাখবো আমাদের সম্মান।।

দ্বৈতকন্ঠে তারা কোরাস গাইতে গাইতে চলে গেল।
চমকে উঠলাম আমি। এ কী করছে লেখক। এ তো সে-ই! ওর-ই কথার প্রতিশব্দ – যে নিজেকে ভালোবাসে না, সে কাউকে ভালোবাসে না। তবে কি ছাত্রদের ঐক্যতা সৃষ্টির একটা ব্যর্থ চেষ্টায় মেতেছে লেখক, এ সব তাহলে ওর-ই সাঁজানো চরিত্র।

দুই
সকালবেলা মানুষের ভিড় ঠেলে বাসে চড়া আর বিশ্বজয় করা যেন সমান কথা। এরপর আছে একঘন্টার পথ পেরোতে তিনঘন্টার প্রস্তুতি। রোডজ্যামে আটকে থাকার সময়টা পেপার পরেই কাটিয়ে দেয় বেশিরভাগ অফিসগামী মানুষ। আর দশজনের মতো লেখক নিজেও জানালার পাশের একটি সিট দখল করে পেপার পড়ায় ব্যস্ত। জানে, ওর গন্তব্যে পৌঁছতে দু’ঘন্টা লেগে যাবে। পত্রিকার প্রথম পাতাটি লেখক সব শেষে পড়ে। আগে দেখে গ্রামগঞ্জের খবর, মফস্বল পাতা। কৃষকের সংবাদ ওর প্রধান আগ্রহের বিষয়। যদিও কৃষি সম্পর্কে কোনো ধারণা ওর নেই। তবু ভালো ফসল হয়েছে বা হবার সম্ভাবনা শব্দটি ওর খুব ভালো লাগে।
হঠাৎ বাসের ভিতর তীব্র উত্তেজনা ও হট্টগোল শুনে পেপার থেকে মুখ তুলল লেখক। ভ্রু কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করল কেন এই উত্তেজনা। কিন্তু মারমুখী যাত্রীদের আচরণে কিছুই বোঝার উপায় নেই। ও দেখল বাসের কন্ট্রাক্টর ছেলেটি সকলের হাতে পায়ে ধরে থামাবার চেষ্টা করছে আর বার বার বলছে – আগে আমাকে ভাড়া কাটতে দিন, তারপর আপনারা যা ইচ্ছা করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে চালক রাস্তার একপাশে গাড়ি থামিয়ে দিল। ক্ষিপ্ত ও মারমুখী যাত্রীদের সব রাগ গিয়ে পরল এবার চালকের উপর, কেন সে গাড়ি থামাল? চালকের জামার কলার চেপে ধরার চেষ্টায় ব্যস্ত হলো একডজন হাত। উপায় না দেখে বেচারা গাড়ির জানালা দিয়ে বের হয়ে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করছে। যাত্রীরা কেউ কারো অনুরোধ শুনছে না। প্রায় সকলের মধ্যেই প্রকাশ পাচ্ছে চরম উত্তেজনা। কেউ কেউ বসে শ্রেফ মজা নিচ্ছেন। সব দোষই যেন এখন চালক ব্যাটার।
অবস্থা বেগতিক দেখে লেখক চিৎকার করে উঠল – কী হচ্ছে এ সব। থামুন আপনারা। এ ভাবে গাড়ির ভিতর অশান্তি তৈরি করলে, অফিসে বা কর্মক্ষেত্রে গিয়ে কি হাসি মুখে কাজ করতে পারবেন কেউ?
লেখকের বলার ভংগিতে নয়, শেষের বাক্যটিতেই হয়তো যাত্রীদের মধ্যের উত্তেজনা কিছুটা কমল, শান্ত একটা ভাব ফিরে এল। চেঁচামেচি থামলেও মৃদ গুঞ্জন থামল না। লেখক তখনও বলছে – এই যে ড্রাইভার ভাই, আপনি সিটে বসেন আর গাড়ি চালান। এদিকে যা-ই হোক আপনি কান দেবেন না।
কথা শেষ করে লেখক তার সিট ছেড়ে সেখানে একজন বয়স্ক লোককে বসিয়ে দিল, নিজে চলে এল চালকের পিছনের আসনটিতে। ভাগ্যিস বাসটি চড়া ভাড়ায় সিটিং যাচ্ছিল, তাই দাঁড়ানো কোনো যাত্রী নেই। সব মিলিয়ে জনা চল্লিশে যাত্রী হবে। এতক্ষণ যে মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক খুব জোর গলায় সব রাজনৈতিক দলের গুষ্টি উদ্ধার করছিলেন, লেখক তার দিকেই প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন – জ্বী কাকা বাবু, আপনি-ই বলুন, সমস্যাটা আসলে কি? কেন সবাই এভাবে ক্ষেপে গেলেন?
লোকটি আমতা আমতা করতে লাগলেন, যেন তার গলায় ব্যাঙ ঢুকেছে – আ.. আ.. আমি, না তো কই, এই…
পাশেই বসা কঠিন চেহারার এক যুবক। গাঁয়ের রঙটা কালো হলেও খুব সু-দর্শন। সে গর্জে উঠলেন – কেন আপনাকে কি ব্যাখ্যা দিতে হবে নাকি?
যুবকের কথার ধরণ আর ভাবসাব দেখে মনে মনে আৎকে উঠলো লেখক – না ভাই, ভুল বুঝবেন না। একটু আগে এ বাসটিকে আমার রণক্ষেত্র মনে হয়েছিল, এখন আপনি যে ভাবে আমার সাথে কথা বলছেন, ঠিক এই ভাবটা যদি আরও আগে দেখাতেন, তাহলে হয়ত আমাকে আমার সিট ছেড়ে এখানে আসতে হতো না।
এ কথায় হেসে উঠল যুবক – না না আমি কোনো ভাব নিয়ে বলিনি, আমি এভাবেই কথা বলি। আসলে হয়েছে কি…
যুবকের হেসে ওঠায় পরিবেশ বেশ হাল্কা হয়ে গেল, যুবকই আবার মুখ খুললেন – আসলে কথা উঠেছিল বাজারের অবস্থা নিয়ে। সিলেটে টমেটো চাষীদের বিক্ষোভ দিয়ে শুরু, হঠাৎ করে চালের দাম আবার বাড়ছে, এদিকে বিদ্যুতের দাম বাড়াবার ঘোষণা দিয়েছেন সরকার, এই বিদ্যুৎ প্রসঙ্গ উঠতেই যাত্রীদের কে যেন বলে উঠলেন যে, দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো চেষ্টা বা উদ্যোগ নেই অথচ প্রধানমন্ত্রী তার সব ভাষণেই ডিজিটাল সোনার বাংলা বানাচ্ছেন। এই সোনার বাংলা শব্দটি শুনেই কেউ একজন ফোঁরণ কেটে বলেছে ‘সোনার বাংলা’ বানাতে হলেতো দেশটা আবার ৭২ সালে ফিরিয়ে নিতে হবে। কারণ এটাতো ৭২-এ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল।
এবার কথা বললেন পাশের বৃদ্ধ – এই ৭২-এর কথা থেকে এসে গেল ৭৫-এর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রসঙ্গ। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার যখন করা হচ্ছে, তাহলে জিয়া হত্যার বিচার কেন হচ্ছে না? জেনারেল মঞ্জুকে কেন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মেরে ফেলা হল? সে বিচারও হওয়া উচিত। সাধারণ মানুষতো আর এটা সমর্থন করতে পারে না। কিন্তু কে যেন এটার সাথে এই বিডিআর হত্যাকাণ্ডের তুলনা করে ফেলল। বলল – এ দেশের সরকারে যে যায় সেই রাবন হয়, তারা এ দেশের মানুষের মানসিকতাকে খুব ভালোভাবে পড়ে ফেলেছে। তারা জানে এ দেশের মানুষ ভয়ংকর সব ঘটানাগুলো তিনমাসের মধ্যে বেমালুম ভুলে যাবে। তাই ক্ষমতায় এসেই প্রথমে তারা জঘন্য আর নোংরা কাজগুলো আগে করে ফেলে। জানে তিনমাস পর এ নিয়ে আর তেমন কথা হবে না। যেমন হয়নি অতীতের অনেক বড় বড় ঘটনা নিয়ে, রমনার বোমা, উদীচীর বোমা, যশোর, খুলনার হত্যাযজ্ঞ গুলো যে ভাবে মাটি চাপা পড়েছে, তা থেকে এটা বলাই যায়।
একটা বাসে জনাচল্লিশেক যাত্রী। তাদের কেউ নিরপেক্ষ আমজনতা, কেউ কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক। তাই দলীয় সমর্থক কেউ এ কথায় ক্ষেপে গিয়ে প্রতিবাদ করেছেন – কেন ভাই, এই যে বিডিআরে বিচার চলছে। আগে বিচার শেষ হতে দেন। তারপর না হয় দোষ দেবেন।
আর একজন কেউ ফোঁড়ন কেটেছে – এ বিচার কোনোদিন শেষ হলে তো?
ব্যস! এতেই শুরু হয়ে গেল লড়াই, তাই না? একটু ভেবে দেখুনতো এতে আপনাদের কার কতটা লাভ হলো? বরং ঝগড়ার কারণে বাস থামল, পথে বাড়তি লেট, তাই না? বলে হ্যাঃ হ্যাঃ করে হাসিতে ফেটে পরল লেখক। তার হাসি সংক্রমিত হল প্রথমে যুবক, পরে একে একে বাসের ভিতর প্রতিটি মানুষের মুখে। সকলে চুপ করলে লেখক আবার বলল – আচ্ছা আপনারা একটু আগে যে আচরণ করেছেন, সত্য করে বলুনতো – এখন সেটা ভেবে আপনাদের লজ্জা লাগছে না। মনে হচ্ছে না যে, কি ভুলটাই না হল? একে অপরের কাছে ক্ষমা চাইতে ইচ্ছা করছে না? একবার সকলে সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে দেখুন, মনটা ভালো হয়ে যাবে।
বৃদ্ধ যাত্রীটি বললেন – তুমি বাবা একেবারে আমার মনের কথাটা বলেছো। সত্যিই আমার ক্ষমা চাইতে ইচ্ছা করছে, বলেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে সকলের উদ্যেশ্যে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলেন আর বললেন – কী বোকা আমরা দেখুন, কথা বলতে বলতে ভুলেই যাই, যে বিষয়ে কথা বলি বা যার পক্ষ নিয়ে ঝগড়া করি, সে বা তারা কোনোদিনই আমাদের কথা ভাবে না। না আওয়ামী লীগ না বিএনপি। তারাতো সবসময় তাদের নেতাকর্মীদের স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত। আজপর্যন্ত গরিবের জন্য কি তারা কোনো আন্দোলন করেছে? না ভবিষ্যতে করবে?
এবারও বাসের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন উঠল – ঠিক বলেছেন, একদম সত্য কথা।
তারপরই যেন ক্ষমা চাওয়ার একটা হিড়িক পরে গেল বাসের ভিতর। লেখক সকলের উদ্যেশে আবার মুখ খুললো – আমার একটা অনুরোধ আছে আপনাদের সকলের কাছে। আজকের পর যদি আপনারা কখনো বাসের ভিতর রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন, তাহলে সবার আগে, নিজের বুকে হাত দিয়ে, যা সত্য তা-ই বলবেন ও স্বীকার করবেন। আপনাদের দেখে, আপনাদের কথা শুনে ছোটরা শিখবে। তাই সবসময় খেয়াল রাখবেন – ওরা যেন কোনো ভুল বা অন্যায় না শিখে। যদি পারেন আপনাদের একান্ত সমস্যার কথাটি নিয়ে আলোচনা করবেন, দেখবেন আলোচনা থেকে একটা সমাধানের পথ তৈরি হয়ে যাবে। আর যদি কোনো রাজনীতিবিদদের নিয়ে কথা বলেন, তাহলে সবার আগে সৎ ও ভালো নেতাদের কথা বলবেন। ভালো যতটুকু জানেন, ততটুকু বলবেন প্লিজ।
এ কথায় কেউ একজন আবার ফোঁড়ন কেটে উঠলেন – সৎ আর ভালো নেতা? এ দেশে?
লোকটির চোখে চেয়ে কথা বলে উঠলো লেখক – ছিঃ ভাইয়া, নিজের শক্তিকে কখনো খাটো করে দেখতে নেই। শের-এ বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানসহ অনেক অনেক নেতা ছিলেন আমাদের। তারা তখনকার পরিবেশে, তাদের মতো করে সত্যিকার অর্থেই আপনার আমার তথা দেশের মঙ্গল করতে চেষ্টা করেছেন। এ সত্য অস্বীকার করা আর নিজের পূর্বপুরুষকে অস্বীকার করাটা সমান। আপনি যদি মানুষ হন, তাহলে অবশ্যই আপনি আপনার পূর্বপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
কিন্তু ভাই, বলেই লোকটি লেখকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থামলো – এই যে ওয়ান-এলিভেন-এ সব রাজনৈতিক দলই যে বদলে যাওয়ার একটা লোভ আমাদের দেখালেন, এখন কি তা হয়েছে? তারা ঠিক তাদের আগের চরিত্রে ফিরে এলো না? প্রতিদিন জাতীয় সংসদের অনুষ্ঠান আমি দেখি, সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যদের আচরণ, তাদের ভাষার নোংরা ব্যবহার ও কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয় না তারা জনপ্রতিনিধি? এর চেয়ে বাঈজীপাড়াও বুঝি অনেক ভালো। তাদের আচরণে মনে হয় এই দেশটা তারা কিনে নিয়েছে, যা ইচ্ছে বলছে, করছে, ভবিষ্যতেও তারা এমনই করবে।
পাশের ভদ্রলোক এই প্রথম মুখ খুললেন – আসলে আমরা এই আওয়ামী লীগ বা বিএনপি ঘরাণার বাইরে কিছু চিন্তা বা আশা করতে পারি না। ভবিষ্যতেও পারবো না। এটা তারা বোঝে ও জানে বলেই আজ আমাদের এই দশা।
এ কথায় গম্ভীর হলেন লেখক – না। আমাদের আজকের এই দশা’র জন্য তারা না আমরা-ই দায়ী। আমি অন্তত এটাই মনে করি। কারণ, আমরা একে-অপরকে বিশ্বাস করি না। আমাদের পরষ্পরের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা, ভালবাসা এগুলো নেই। সত্যি বলতে কি জানেন? আমরা আমাদের নিজেকেই বিশ্বাস করি না, অন্যকে বিশ্বাস করবো কি করে? যেমন আমি, আমি যদি নিজের উপর খুব আস্থা বা বিশ্বাস রাখতে পারতাম, তাহলে এই মূহূর্তে বলতাম – ঠিক আছে, আগামী একবছরের মধ্যে আমি আপনাদের সামনে তৃতীয় একটি রাজনৈতিক দল এবং এক বা একাধিক বলিষ্ঠ-যোগ্য নেতা দাঁড় করিয়ে দেব। কেন তা বলতে পারি না জানেন। বিশ্বাসের অভাব তাই। আর এ বিশ্বাস আসবে কোথা থেকে? নিজের প্রতি নিজেরই গভীর ভালবাসা থেকে।
ভালবাসা শব্দটা উঠলেই আমরা মনে করি নারীর প্রতি পুরুষের ভালবাসা বুঝি। না, এটা সত্যি না। ভালবাসা অনেক রকম হয়। মায়ের প্রতি ছেলের, সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের ভালোবাসা যেমন। আমরা আসলে নিজেকে ভালোবাসার নিয়মটাও জানিনা। আমরা সব ছেড়ে দেই স্রষ্টা বা নিয়তির হাতে। এমন একটা ভাব দেখাই যেন আমরা মানুষেরা প্রচন্ডভাবে আল্লাহ-ইশ্বর বা ভগবানের ভক্ত। কিন্তু তার কাছে কিছু চেয়ে না পেলে, তাকেও গালি দিতে ছাড়ি না। অথচ বুকে হাত দিয়ে বলেনতো – কোনো কিছু প্রাপ্তির আশা ছাড়া কেউ কি কখনো আল্লাহ, ঈশ্বর বা ভগবানের কাছে গিয়েছেন? কথাগুলো যদি পারেন ভেবে দেখবেন। বলেই বাস থেকে নেমে গেল লেখক, ওর গন্তব্য এসে গেছে। লেখক নেমে যাবার পর অনেকটা সময় বাসের ভিতর পিনপতন নিস্তব্দতা কাজ করল। তারপর কেউ একজন ফোঁড়ন কাটলেন – সালা, সুযোগ পেয়ে জ্ঞান ঝাড়লো। কেউ আর এ কথার প্রতিবাদ করল না। এমন ভাব যেন কেউ কিছু শোনেনি, দেখেনি। সকলেই ভদ্রলোক। যার যার গন্তব্যে নেমে যাবার অপেক্ষায় আছেন সবাই।

বাস থেকে নেমেই লেখক পরলো নির্দলীয় ছাত্র-ছাত্রীদের বিশাল এক মিছিলের সামনে। ছাত্রী শব্দটি তুলে দেয়ার আন্দোলনে নেমেছে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা। একই সাথে ওরা রাজশাহীতে ছাত্রী ধর্ষকদের জনসমুক্ষে ফাঁসীর দাবী জানাচ্ছে। যাবজ্জীবন নয়, ওদের ফাঁসী কার্যকর করার এ আন্দোলনটি নতুন যুক্ত হয়েছে। এদের যুক্তি এই পশুদের জন্য কেন খামকা দেশের খাদ্য নষ্ট করছে সরকার? বাঃ চমৎকার মেয়েদের এই মিছিলে ছেলেদের দেখে লেখকের মনটা খুশিতে নেচে উঠলো। তারচেয়েও ভালো লাগলো সাথীকে মিছিলের সামনে দেখে। লেখকের সামনে বিরোধীতা করলেও সাথী সবসময়ই যে ওর পক্ষে তার প্রমাণ এই মিছিলে ওর অংশগ্রহণ। সাধনের কাছ থেকে ফিরে এসে খুব হতাশায় ভুগছিল লেখক। সাধন ওকে এভাবে মুখের উপর না করে দেবে আশা করেনি, খুব কষ্ট পেয়েছে ও সাধনের আচরণে। সাথী অবশ্য বলেছিল – তুমি বিনাকারণে টেনশন করছো, সব জানলে, দেখ সাধন ভাই নিজেই ছুটে আসবে।
এই মূহুর্তে লেখক পাবলিক লাইব্রেরীতে গিয়ে সাথীর জন্য অপেক্ষা করবে। পকেটে টাকা নেই লেখকের। সাথীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে ঢাকার বাইরে যেতে হবে। জেলাশহরের চারটি কলেজের অধ্যক্ষরা একত্র হয়ে তাকে নিমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়েছেন। পত্রে তারা এটাও লিখেছেন যে, জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত লেখকের ধার্মিক ও বাপ দুটি উপন্যাস-ই পড়েছেন তারা। বরেছেন বাপ এর চিন্তাধারার সাথে তারাও একমত। অর্থাৎ তারা কি বিষয়ে কথা বলবে তা লেখক জানে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সাথী কিছুতেই বাপ উপন্যাসের চিন্তাধারা মানতে পারছে না। সে ভয় পাচ্ছে। সাধন এখানে অভিনয় করবে না শুনে, সে আরও বেশি ভীত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় সাথীর থেকে টাকাটা নিতেও বিবেকের সায় পাচ্ছে না লেখক। যদিও সাথী সরাসরি কখনো লেখকের কোনো কাজে বাঁধা দেয়নি, বরং উৎসাহ দিয়ে এসেছে। কিন্তু এবারই প্রথম বেচারী ভয় পাচ্ছে। ভালোবাসার মানুষটিকে হারাবার ভয়। লেখকের বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যাবার ভয়।

তিন
সাধনের মুদি দোকানের সামনে জমায়েত হয়েছেন পাশাপাশি দুটি গ্রামের প্রধান ব্যক্তিবর্গ। চেয়ারম্যান, মেম্বার, কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকরা। এলাকার এমপি বা সাংসদ-এর পক্ষ থেকে এসেছেন তার মেয়ে ব্যারিষ্টার তানিয়া। গ্রাম্য শালিশ বা বিচার ব্যবস্থার এটাই নিয়ম। এভাবেই নিজেদের সমস্যা সমাধানের প্রথম চেষ্টা করেন, সকলে বসে, আলোচনার মাধ্যমে। যদিও এবারের শালিশের বিষয় ভিন্ন। গত কয়েক মাস ধরেই এদিকের গ্রামগুলোতে রাতে বিদুৎ থাকে না। সব মিলিয়ে চব্বিশ ঘন্টায় গড়ে বিদুৎ পাওয়া যাচ্ছে মাত্র দু’ঘন্টার মতো। চাষীরা ক্ষেতে সেচ দিতে পারছেন না। মাঠের পর মাঠ কৃষিজমি ফাঁকা পরে আছে। গ্রামগুলোতে এ বছর কোনো চাষী আলু, পটল, মুলা, কলাই বা শরিষার চাষ করতে পারেন নাই। সামনে ধানের মৌসুম। মাঝরাতে সেচপাম্প চালাবার কথা থাকলেও বিদ্যুতের অভাবে এখনো তা সম্ভব হয় নাই। এ নিয়ে কৃষকদের অসন্তোষ ক্রমে বেড়েছে। মেম্বারদের কাছে বার বার অভিযোগ করার পরও তারা কোনো ব্যবস্থা দিতে পারেন নাই। রাগে ক্ষোভে গ্রামের মেম্বারদের ধাওয়া করেছেন কৃষকরা। তিনদিন আগে গ্রামের বাজারে দুই মেম্বার কে পেয়ে কৃষকদের কয়েকজন একজোট হয়ে তাদের মারতে গিয়েছিলেন। ভিড়ের মধ্যে দু’একজন জামার কলারও ধরতে ছাড়েন নি। সাধন বাধা না দিলে মেম্বর দু’জন হয়ত হাসপাতালে থাকতো এখন। তাই বিষয়টা নিয়ে আলোচনায় বসেছেন সবাই। এখানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সরকার দলীয় সাংসদ ফজলে রাব্বি সংসদ অধিবেশনে অংশ নিতে রাজধানীতে অবস্থান করায় তার মেয়ে তানিয়া এসেছেন বিশেষ নিমন্ত্রণে। তানিয়া দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে আইন নিয়ে পড়াশুনা করেছেন। ব্যারিস্টারী পাশ করে সম্প্রতী দেশে ফিরে একটি মানবাধিকার সংস্থার হয়ে আইনি বিষয় দেখছেন তিনি। গ্রামের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মানুষের কাছে তার উপস্থিতি তাই সয়ং সাংসদের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক। এমনকি চেয়ারম্যানরাও তাকে বেশ সমিহ করে কথা বলছেন।
সাধনের দোকানে এখন চা তৈরির পাল্লা দিচ্ছে দু’জন কিশোর। কে কত ভালো চা বানাতে পারে তার প্রতিযোগীতা করছে ওরা। সাধনই ওদের শিখিয়েছে কীভাবে থনথনি পাতা আর পুদিনা পাতার রসে ভালো চা বানাতে হয়। রং চা শরীরের জন্য উপকারী- এ খবরটি জানার পর থেকে সাধনের দোকানে দুধ চা বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। গ্রামবাসীকেও দুধ চা  খাওয়া থেকে বিরত রাখার কঠিন দায়িত্ব পালন করছে ও। অবশ্য এটাও সত্যি যে এখানের আশেপাশের পনেরটি গ্রাম ঘুরে দশটি দুধেল গরু পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। খাবারের সংকট হওয়ায় গ্রামবাসী এখন আর গরু-ছাগল পালার প্রতি কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না বরং ভাড়ায় জমিচাষের ট্রাক্টর পাওয়া যাচ্ছে শোনার পর থেকে হালের বলদটিও বিক্রি করে দিতে ব্যস্ত সবাই। সাধন তাদের কাউকে কাউকে অনেকটা জোর করেই পতিত জমিতে ঘাসের চাষ করতে বাধ্য করেছে -এই বলে যে, তোমরা হালের গরু বিক্রি করে দিচ্ছ, কিন্তু একদিন আবার এই হালের গরু’র জন্য কাঁদবে। তেলের অভাবে ট্রাক্টর যখন চলবে না। কিছু চাষী অবশ্য সাধনের কথা শুনেছে, তারা অবশ্য গরু পালে না তবে শহরের খামারে ঘাস বিক্রি করে বেশ সুফল পেয়েছে। এই লোকগুলো তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে কারণে অকারণে ছুটে আসে সাধনের দোকানে।
গ্রাম্যশালিশকে কেন্দ্র করে মোট পনেরটি চেয়ার আর তেরটি পাটি বিছিয়ে গ্রামবাসীদেরসহ সকলের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গ্রামের ছেলে-বুড়ো-মহিলারাও ভিড় করেছেন এ শালিশ শুনতে। সকলের দৃষ্টি এখন সাধনের দিকে। কারণ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর খাঁ প্রথমেই জানতে চান – সেদিন বাজারে কি ঘটেছিল, কারা কারা মেম্বারদের মারতে চেয়েছে? প্রত্যক্ষদর্শী একমাত্র সাধন। তাই সাধনের বক্তব্য শোনার আগ্রহ সকলের।
প্রথম থেকেই সাধন তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে দেখছিল চেয়ারম্যান, মেম্বারদের আচরণ ও কথার ধরণ। তাদের চোখে লুকানো জ্বলজ্বলে প্রতিহিংসার ছবি সাধনের কানে কানে বলে দিল – এ ব্যাটারা এখন বেশ উদারতা দেখালেও পরে ঐ কৃষকদের ক্ষতি করতে একবিন্দু ভাববে না। সুতারং কে কে ছিল বিষয়টা এড়িয়ে যেতে হবে। অন্যদিকে কৃষকদের বেশিরভাগের চোখে করুণ মিনতী – আমাদের নাম বল না, ভাই।
সবাই তাকিয়ে আছে সাধনের মুখের দিকে। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে-ই তানিয়া বললেন – আপনার কিছু বলার থাকলে বলুন, অযথা সময় নষ্ট করবেন না।
সাধন – বলার অবশ্যই আছে ম্যাডাম। তার আগে আপনারা বলুন, আপনারা এখানে কেন জমায়েত হয়েছেন? গ্রামের সমস্যার সমাধান করতে, নাকি মেম্বারদের সাথে যারা খারাপ ব্যবহার করেছে তাদের শায়েস্তা করতে?
সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারম্যান মেম্বারদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিল, মৃদু গুঞ্জন উঠল, মেম্বারদের কেউ কেউ প্রতিবাদ করে বলে উঠল – আগেই বলেছিলাম, এ ব্যাটা বেয়াদপ।
পাশের দরিয়া গ্রামের চেয়ারম্যান কল্যাণ বাবু হিন্দু মানুষ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মাঝে নিজেকে তিনি অসহায় মনে করেন। না – এ জন্য কিন্তু মুসলমানরা দায়ী না। তিনি নিজেই নিজেকে গুটিয়ে রাখেন, এটা তার আত্মবিশ্বাসের অভাব, নিজেও তা স্বীকার করেন। তার ভয়ের কারণ অবশ্য সাধন জানে, তাই সাধনের সাথে খুব ভালো খাতির তার। সাধন অবশ্য প্রথম থেকেই চেষ্টা করছে তার ভয় দূর করতে। কিন্তু সুন্দরী যুবতী কন্যার বাবার মনে লুকানো ভয় দূর করা খুব কঠিন। এই ভীত বাবাটি তার আরও ভীত কণ্ঠে সবাইকে থামার জন্য অনুরোধ করলেন। তার অনুরোধে নিজ এলাকার মেম্বাররাই থামে না, আর এখানেতো অন্য এলাকার লোক বেশি। ব্যরিষ্টার তানিয়া সাধনের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন, ওর পাল্টা প্রশ্নে তিনি কিছুটা অপমান বোধ করলেও বুঝতে পারলেন, সাধন কেন এ প্রশ্ন করেছে। তিনি নতুন চোখে সাধনকে দেখলেন, একইসাথে ধমকে উঠলেন – থামুন আপনারা, উনি তো ঠিক প্রশ্নই করেছেন, তাকে বা এই গ্রামবাসীকে তো জানতে হবে যে, আমরা এখানে তাদের সমস্যা সমাধান করতে এসেছি, মেম্বারদের সাথে খারাপ ব্যবহারের বিচার করতে না। সাধন সাহেব আপনি বলুন প্লিজ, আমরা সমস্যাটা জানতে চাই। নিশ্চিন্তে বলুন, আমরা কারো খারাপ আচরণ নিয়ে কথা বলবো না।
এতে কাজ হলো, থেমে গেল সবাই। সাধন বলল – গত তিন মাসে এখানের কোনো গ্রামে ফসল উৎপাদন হয়নি। তাহলে কৃষকদের ঘরে খাবার আসবে কোথা থেকে বলুন? শীতের এই সময়টায় মৌসুমী ফসল, শাক-সবজী চাষ করে তা বাজারে বিক্রি করেই নিজেদের খাবার জোগায় কৃষকরা। এ সময়টা তারা পুরোপুরি সেচযন্ত্রের উপর নির্ভর থাকে। সেচ চলে বিদ্যুতের উপর নির্ভর হয়ে। সেই বিদ্যুৎ-ই যদি না থাকে? কৃষকরা কি করবে? এরা তো বসত ভিটায় বিদুৎ চায় না, চায় সেচপাম্পটি যেন ঠিক সময় বিদ্যুৎ পায়। কিন্তু কৃষকদের বার বার অভিযোগ সত্বেও চেয়ারম্যান সাহেব বা মেম্বারদের কেউ এদিকে নজর দেন নাই।
না না নজর দিয়েছি কিন্তু… সাধনকে থামিয়ে প্রতিবাদ করে উঠলেন জাহাঙ্গীর খাঁ। তানিয়া হাত তুলে তাকে থামতে বলায় চুপসে গেলেন তিনি। তানিয়া – জ্বী সাধন, আগে আপনার কথা শেষ হোক, পরে চেয়ারম্যান সাহেবের কথা শুনবো।
সাধন – আমরা কৃষকরা জানি যে বিদ্যুৎ চেয়ারম্যান সাহেবের হাতে না, তিনি চেষ্টা করেও হয়তো এর সমাধান করতে পারেন নাই। কিন্তু তিনি যে চেষ্টা করেছেন তা আমরা কি করে বুঝবো? যদি তিনি সেটা আমাদের বুঝিয়ে না বলেন। আমরা কৃষকরা বারবার অভিযোগ করি, কোনো ফল হয় না। এতে সাধারণ কৃষক যদি ক্ষিপ্ত হয় এবং কেন বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হলো না, জবাব দাবী করে, তাহলে তাদের দোষ দেয়া যায় না। মেম্বার ও চেয়ারম্যান সাহেব যদি কৃষকদের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতেন তাহলে আর যাই হোক আপত্তিকর কিছু ঘটতো না।
জাহাঙ্গীর খাঁ আবার রেগে উঠলেন – আমি কেন ব্যাখ্যা দিতে যাবো। মেম্বাররা এসে বলেছে না যে বিদ্যুৎ আমার হাতে না, আমি চেষ্টা করছি। এমপি সাহেব কে জানিয়েছি, ডিসিকে স্মারকপত্র দিয়েছি।
সাধন – আমার কথায় অপরাধ হলে মাপ করবেন চেয়ারম্যান সাহেব। একজন ভালো ও সৎ চেয়ারম্যান সবসময়ই তার এলাকার মানুষের কাছে তার সব কাজের ব্যাখ্যা দেন। আপনার এলাকায় এই সাত বছরে আমি আপনার কোনো দুর্নাম শুনিনি। আপনিও যে একজন সৎ মানুষ। সবাই আপনাকে ভালেবাসে ও মান্য করে বলেই আপনি পর পর দু’বার এ গ্রামের চেয়ারম্যান হয়েছেন। সাধনের এ কথায় চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর খাঁ বেশ লড়ে চড়ে বসলেন, তার মুখে আত্মতৃক্ষিপ্তর লাজুক হাসি।
সাধন বলে চলছে – এখানের মানুষ এমপি সাহেবকে চেনে না, তিনি কি করবেন না করবেন তা জানতেও চায় না, কারণ আপনাকে চেনে তারা, আপনি এমপি সাহেবকে দিয়ে সব করিয়ে নেবেন এটাই তাদের বিশ্বাস। আর এ জন্যই যদু-মদু কাউকে চেয়ারম্যান না বানিয়ে আপনাকে বানিয়েছে। গ্রামবাসী সবাই আপনাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। আপনি এসে যা বলেন তা-ই তারা মেনে নেয়। আজ এই যে বলছেন – ডিসিকে স্মারকপত্র দিয়েছেন, ঐ সময় যদি এই চাষীদের কয়েকজন আপনার সাথে থাকতেন, তাহলে আপনার সম্মান আরও বেড়ে যেত এবং ঠিকই বিদ্যুৎ এসে যেত।
সাধন চেয়ারম্যান সম্পর্কে গ্রামের মানুষের ভালবাসা আর শ্রদ্ধার কথা বলছিল, ওর চোখে তখন একটা দুষ্ট হাসি খেলছিল। ব্যারিষ্টার তানিয়া সেই প্রথম থেকেই একটু পরপরই দেখছিলেন সাধনের চোখে। ঐ চোখে কখন কি অনুভুতি তা যেন সে পড়ে নিচ্ছিল প্রতিটি মূহূর্তে। এখানের মানুষ এমপি সাহেবকে চেনে না, শব্দটা ব্যবহার করেই সাধন তাকিয়েছিল তানিয়ার চোখে, সে চোখে ও খুঁজে পেল প্রশ্রয়ের হাসি।
থানা কৃষি কর্মকর্তাও সাধনের সাথে মিল রেখে একই কথা বললেন। তিনি অবশ্য আরও বললেন – এ আলোচনায় ডিসি বা এডিসি কাউকে রাখলে আরও ভালো হত।
শালিশ শেষে ঠিক হলো – আশেপাশের গ্রামগুলো নিয়ে কৃষকদের একটা সমিতি হবে, সেই সমিতির কয়েকজন সদস্য একত্র হয়ে চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের নিয়ে ডিসি অফিস ও পল্লি বিদ্যুৎ অফিসে যাবে। বিদ্যুৎ না পাওয়া পর্যন্ত তারা গ্রামে ফিরবে না। ব্যারিষ্টার তানিয়া তাদের নেতৃত্ব দেবেন। প্রয়োজনে তারা ডিসি অফিস ও বিদ্যুৎ অফিস ঘেরাও করার কথা বললেন।
এখানে বাঁধা দিলো সাধন। না ম্যাডাম, এটা ভুল সিদ্ধান্ত হবে। বিদ্যুৎ পর্যাপ্ত না থাকলে ঘেরাও করে কোনো ফল হবে না। বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য জোর দিচ্ছেন। অথচ ডিজিটাল শব্দটাই বিদ্যুৎ নির্ভর। বিদ্যুৎ না থাকলে ডিজিটাল এর ডিজি থাকবে না, টাল নিয়ে সরকার নিজেই বেতাল হয়ে যাবেন। আমরা বরং সরকারকে বিকল্প বিদুৎ উৎপাদনের একটা রাস্তা দেখাতে পারি কিনা সে চেষ্টা করা যাক। শুধু ততদিন যেন গ্রামে বিদ্যুৎ থাকে।
তানিয়া – বিকল্প বিদ্যুৎ, সেটা কি আমাদের এখানে সম্ভব? এখানেতো খরস্রোতা নদী নেই।
সাধন – ঠিক জানিনা ম্যাডাম, তবে শুনেছি বুয়েটের কিছু ছাত্র বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গবেষণা করছে। ইতিমধ্যে তারা সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে কিছু একটা করেছে। তাছাড়া বায়োগ্যাস নাকি টয়লেট থেকে….।
তানিয়া – আপনার এতো কষ্টকরে টয়লেট বলতে হবে না সাধন, আপনি নির্ভেজাল বাংলায় হাগুঘর বা পায়খানা বলতে পারেন, আমি কিছু মনে করবো না। আর এই আমাকে ম্যাডাম ম্যাডাম করতেও আপনার বেশ কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি, আপনি আমাকে তানিয়া বলেই ডাকুন।
সাধন – ধন্যবাদ আপু, আসলে আমি শুনেছি সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে গবেষণার জন্য বুয়েটের ছাত্রদের যে পর্যাপ্ত অর্থ ও স্থানের দরকার তা তারা পাচ্ছেন না। আবার বায়োগ্যাস প্রকল্পের জন্যও অনেক বড় জায়গা দরকার। যা আমাদের গ্রাম-গঞ্জে অভাব নেই। তাছাড়া গ্রামগুলোতে প্রতিটি বাড়িতে যে পায়খানা আছে, গরু-বাছুরের পায়খানা ও মানুষের পায়খানা একত্র করে সেটার ব্যবহারে বায়োগ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব কিনা? আপনি যদি পারেন এ বিষয়টা একটু দেখুন।
সু-মিষ্ট স্বরে হেসে উঠলেন তানিয়া, সাধনের সাথে তার এ হাসির ঝলকে চেয়ারম্যান মেম্বারদের চোখে জ্বলনি স্পষ্ট টের পেল সাধন। দূরে সরে যাওয়া মেম্বারদের কেউ কেউ আরও কাছে এসে কথা শোনার চেষ্টা করলো, তানিয়া তখন বলছেন – সাধন আপনি এই আপু শব্দটা খুব বিশ্রিভাবে উচ্চারণ করেন। শুধু তানিয়া বলুন। সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে গবেষণা চলছে, এটা সত্যি। ঢাকায় প্রাথমিকভাবে বাড়িওয়ালাদেরকে এটা ব্যবহার করতে অনুরোধ করেছেন সয়ং প্রধানমন্ত্রী। তবে এটা নাকি খুবই ব্যয়বহুল। তাই শিল্প-কারখানায় এটা ব্যবহারের কথা চিন্তা করা যাচ্ছে না। আর বায়োগ্যাস সম্পর্কে আমারও কোনো জ্ঞান নাই, তবে এটা সম্ভব হলেতো সবার আগে রাজধানী ঢাকাতেই এর ব্যবহার সবচেয়ে সহজ। কারণ সেখানে অসংখ্য পাবলিক টয়লেট আছে, যার এক একটি পৃথকভাবে কাজে লাগানো যেত। শহরে বিদ্যুতের চাপ কমলে গ্রামে সংকটই হবে না। আমি অবশ্য বিদেশে অবস্থানকালে দেখেছি- ওরা উইন্ড মিল (এক ধরণের বিদ্যুৎ তেরির চাকা বা হুইল, যা বাতাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাহায্য কর) ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। আমাদের এখানে বাতাস এবং সূর্য দুটোই রয়েছে, অন্যসব দেশের তুলনায় অনেক বেশি-ই বলা যায়, তাহলে আমাদের দেশে কেন এটা সম্ভব হবে না।
দরিয়া গ্রামের চেয়ারম্যান কল্যাণ বাবু এতোক্ষণ ওদের কথা শুনছিলেন, বললেন – আমি রংপুরে ব্রাক-এর এরকম একটা প্রজেক্ট দেখেছিলাম। সেটা অবশ্য বায়োগ্যাস না যেন কি?
তানিয়া – কাকা বাবু, আপনি তাহলে ব্রাকের সাথে আলোচনা করে দেখেন, ওই রকম একটা প্রজেক্ট এখানে করা যাবে কিনা। আর জাহাঙ্গীর কাকা।
চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কাকা একটু দুরে তার মেম্বারদের নিয়ে আলোচনা করছিলেন, তানিয়ার ডাকে ছুটে এলেন – জ্বী মা বলেন।
কাকা এই গ্রামে কতগুলো সেনিটারি পায়খানা আছে, কতগুলো বাড়ি তার একটা সঠিক হিসেব আমাকে কালই দেবেন। কাল জেলা প্রশাসকের সামনে আমরা এ বিষয়ে কথা বলবো। চলুন আজ যাওয়া যাক। আর সাধনের দোকানের চা ও অন্যান্য যে খরচ তা আমার থেকে আপনি নিয়ে নেবেন। এখন আপনি নগদে ওর বিল পরিশোধ করুন।
সাধন বাঁধা দেয়ার জন্য না না বলতে চাইলে ওর গলা দিয়ে গো গো শব্দ হলো, তানিয়া ওকে বলল – আপনি অবশ্যই চেয়ারম্যান কাকাকে একটা হিসাবের রশিদ দেবেন। তানা হলে কিন্তু আমি দাম দেব না। বলেই নিজের হাতব্যাগ খুলে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে সাধনের হাতে দিলেন তিনি। মুখে বললেন – এতে আমার মুঠোফোন নম্বর আছে। আপনি যখন খুশি আমাকে ফোন করতে পারেন, যেকোনো প্রয়োজনে।
একে একে সবাই চলে গেল। থেকে গেল শুধু দরিয়া গ্রামের চেয়ারম্যান কল্যাণ বাবু, তাদের একজন মেম্বর আমজাদ ও এই গ্রামের মেম্বর জাফরউল্লাহ, যার কলার ধরে কৃষকরা মারতে চেয়েছিল। সমবয়সী হওয়ায় সাধন তাকে নাম ধরেই ডাকে।
সবাই চলে গেলে জাফরউল্লাহ অনেকটা ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন – তোমাকে আমি বোকা শোকা ভালো মানুষ ভেবেছিলাম। তুমিতো দেখছি আমাদের বাপ। কি চালাকী করে কৃষকদেরও বাঁচালে আবার চেয়ারম্যানকেও খুশি করে দিলে। আবার এমপি সাহেবের মেয়েকে নাম ধরে ডাকার অনুমতিও পেয়ে গেলে। কী দারুণ। এবার বলতো আমার কলার যারা ধরেছে, তাদেরকে কি আমি চিনি না। তোমার কি মনে হয়?
সাধন – দেখ জাফর মিয়া, তুমি তাদের হয়ত চেন, আবার চেনও না, কিন্তু তুমি যখন চিনেও তাদের নাম বল নাই, তাহলে তুমি অবশ্যই তাদের ভালো চেয়েছো বলেই বল নাই। কারণ তুমিও বিশ্বাস করো যে তারা আসলে অন্যায় কিছু করে নাই। সত্যি কথা কি জান জাফর, তুমি আসলে খুব খুব একজন ভালো মানুষ, খারাপ হবার চেষ্টা করেও পার নাই। আর কখনো খারাপ হতেই যেয়ো না।
এ কথায় চেয়ারম্যান কল্যাণ বাবুসহ সবাই হেসে উঠল। জাফর মেম্বর সাধনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল – আমি না, তুমি আসলেই খুব ভালো মানুষ মিয়া, তাই সবাইকে ভালো বানাতে উঠে পড়ে লেগেছো। কারণ তুমি জান যে, খারাপ লোকটাও ভালো শব্দটা খুব পছন্দ করে। সাবধানে থেকো। আজ তুমি কিছু বন্ধু যেমন পেলে তেমনি শত্রুও পেলে। কী কল্যাণ বাবু আপনি থাকবেন না যাবেন? প্রশ্নটা করে জাফর মেম্বর তাকালেন কল্যাণ বাবুর দিকে।
কল্যাণ বাবু – আজ যে সাধনের ঘরে আমার নিমন্ত্রণ আছে। দু’জন একসাথে খাব বলে কথা দিয়েছি আমার মেয়েকে। তুমি চাইলে আমাদের সাথে খেতে পার এ বেলা।
জাফর – সাধনের ঘরে, ও তো একা থাকে। রান্নাটা করবে কে? এখান থেকে গিয়ে ওর রান্না, তারপর খাওয়া, সেতো রাত্র হয়ে যাবে।
কল্যাণ বাবু – তুমি খাবে কিনা সেটা আগে ভেবে দেখ। ক্ষিদেয় আমার পেটে শিয়াল ডাকছে। তারউপর আমার মেয়ে আন্না’র হাতের রান্না, একবার খেয়ে দেখ, সারাজীবন ভুলতে পারবে না।
জাফর মেম্বর – মানে আপনার মেয়ে শ্রীমতি আন্না রাণী এখন তাহলে সাধনের ঘরে রান্না করছে। তাহলে তো একবার স্বাদটা নিতেই হয়।
কথার ফাঁকেই দোকান বন্ধ করছিল সাধন। শেষ ঝাঁপটা ফেলে তালা দিতে দিতে বলল – তার আগে তোমাকে ভেবে দেখতে হবে হিন্দু মেয়ের হাতের রান্না কিন্তু।
জাফর – তোমার যদি তাতে অরুচি না হয়, আমার কেন হবে। তাছাড়া ছোটবেলা নাপিতের মেয়ের সাথে প্রেম করতে গিয়ে বাবার হাতে মার যখন খেতে পেরেছি, তখন তাদের কারো রান্না খেতে আপত্তি করার মতো ভালো লোক আমি নই। তবে হ্যাঁ এতোদিন লোকের মুখে শুনেছিলাম যে, তোমার কাছে জাত-ধর্ম বলে কোনো ভেদ নেই। আজ তা নিজেই প্রমাণ পেলাম। কল্যাণ কাকুর মত চেয়ারম্যন যখন নিজের মেয়েকে নিয়ে তোমার ঘরে এসে রান্না করে খায়, তখন বুঝতেই পারছি তুমি সাধারণ মুদি আর চা বিক্রেতা নও। সত্যি করে বলতো সাধন, তুমি আসলে কে? কেন পরে আছ আমাদের গ্রামে? সেদিন যে লোকটা তোমাকে শহরে নিতে এল সেই বা কে? সে যে কোনো সাধারণ লোক নয়, তা তার হাঁটার ভঙ্গিতেই আমরা টের পেয়েছি। সবচেয়ে বড়কথা, যেদিন শহরে নির্দলীয় ছাত্রদের মিছিল বের হল, সেদিন কলেজের প্রিন্সিপালদের সাথে তারও ছবি পেপারে ছাপা হয়েছে।
কথা বলতে বলতেই সাধনের ঘরের দিকে সকলে হাঁটা ধরেছিল। সাধনের মনে তখন লেখককে নিয়ে ভাবনার ঝড় বইছে। লেখকের দেয়া শিক্ষাই আজ ওকে দিয়ে অনেক কথা বলিয়েছে, বলা যায আজ ও যা বলছে সবই লেখকের শিখানো কথা। হয়ত আজ এখানে থাকলে লেখক নিজেও এসব কথাই বলতো। পেপারে ছবি ছাপা হওয়ার বিষয়টা ওর মনোযোগ কাড়লো। জানতে চাইলো কোন পেপারে। জাফর বললেন – পল্লী বার্তা আর যুগান্তর পত্রিকায়। তুমি দেখতে চাইলে আমার কাছে কপি আছে, পরে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না।
সাধন – সব-ইতো জানো, নতুন কিছু বলার নেই। আমার এই বন্ধুটি একজন লেখক। ওটাই ওর একমাত্র পরিচয়। আগে পৈত্রিকসুত্রে ধনি ছিল, এখন আর তা নেই। শিল্প-সাংস্কৃতির চর্চা করেই দিন কাটায়।
কল্যাণ বাবু বাধা দিলেন – না সাধন, তোমার এই বন্ধুটি সাধারণ কোনো লেখক নয়, তার ‘বাপ’ নামে উপন্যাসটা আমি ‘দৈনিক বাংলার চিঠি’ পত্রিকায় ধারাবাহিক পড়েছি। ওটা শুধু উপন্যাস না। তৃতীয় একটি রাজনৈতিক শক্তি তৈরির দলিলপত্র। এ উপন্যাসটি যেদিন পূর্ণাঙ্গ বই আকারে বাজারে আসবে, সেদিন থেকে এ দেশে আর সে থাকতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। আর যদি থাকে তাহলে সব শ্রেণী পেশার মানুষের ভালোবাসা নিয়ে সর্ব্বোচ্চ ক্ষমতায় সে-ই থাকবে।
কি বলছেন কাকা বাবু?
সত্যি বলছি। সাধন। বাপ – একটি নতুন রাজনৈতিক দলের পথ নির্দেশ। যে দলটি তৈরি হবে ধর্মীয় সম্প্রীতি আর আমজনতার প্রচন্ড ভালোবাসা নিয়ে, একটি সমিতি বা সমাজসেবা মূলক সংগঠনের আদলে। যে দলের শীর্ষ নেতারা কেউ কখনো নির্বাচনে অংশ নেবেনা। শিল্পপতিদের কাছে বা বিদেশী শক্তির কাছে সংগঠন চালানোর জন্য ভিক্ষা নেবে না এ সংগঠনটি। তারা নিজেদের ফাণ্ড তৈরি করতেই এ উপন্যাস বাজারে ছাড়বে। বেশি দরকার হলে সংগঠনের নামে দানবাক্স তৈরি করে সাধারণ আমজনতার থেকে দু’ টাকা এক টাকা করে দান নেবে, ঠিক যেভাবে পীর-আউলিয়াদের নামে দান বাক্স রাখা আছে রাস্তার মোড়ে মোড়ে, সেভাবে বাপ নামে দান বাক্স থাকবে, দানবাক্সের গায়ে লেখা থাকবে – দান করুন, সেবা নিন।(বাপ সদস্যরা ডাকা মাত্র সাদারণ মানুষকে সেবা দিতে বাধ্য থাকবে।) তবু শিল্পপতিদের কাছে জিম্মি হবে না এ সংগঠন।
ওদের গঠনতন্ত্রে প্রথমেই লেখা আছে – ১) এ সংগঠনের সদস্যদের নিজ নিজ ধর্মের প্রতি গভীর বিশ্বাস ও ভালোবাসা থাকতে হবে। লোভ বা কিছু প্রাপ্তির আশা নিয়ে নয়, অন্তরের গভীর ভালোবাসা থেকে স্রষ্টাকে যারা ডাকেন শুধু তারাই এ সংগঠনের সক্রিয় সদস্য হতে পারবেন।
২) পূর্ববর্তী সকল নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিয়ে কথা বলতে হবে, না জেনে কোনো উদ্ভট কথা বাপ -এর কোনো সদস্য বলবেন না।
৩) সদস্যদের ভোটেই উপজেলা, জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তৈরি হবে। বাপ-এর সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ জেলা পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কোনো নেতা স্ব-পদে বহাল থেকে কখনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। সাধারণ সদস্যদের ভোটেই দলীয় প্রধান নির্বাচিত হবে কিন্তু পর পর তিনবারের বেশি দলীয় প্রধান বা সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক পদে কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
এখানের এই দুটি বিষয় সাধন, এই যে বাপ -এর গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কোনো নেতা স্ব-পদে বহাল থেকে কখনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না এবং সাধারণ সদস্যদের ভোটেই দলীয় প্রধান নির্বাচিত হবে কিন্তু পর পর তিনবারের বেশি দলীয় প্রধান পদে কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।  এটাই ‘বাপ’কে তার সন্তানদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলবে। এরপর কথার সাথে যদি কাজের মিল পাওয়া যায়, তাহলে বিশ্বাস কর কেউ ঠেকাতে পারবে না ‘বাপ’ এর উত্থান। কিন্তু ভয় হচ্ছে – তোমার বন্ধুটি ততদিন বাঁচবেতো? এখনো হয়তো অন্যদলের নেতারা বাপ উপন্যাসটি বুঝে উঠতে পারে নাই। তাই সে ছাত্রদের নিয়ে কাজে নেমে যেতে পেরেছে। কিন্তু যখন বুঝবে যে – সামাজিক সেবা সংগঠন হলেও এটা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ক্ষতিকর কিছু, তখন কেউ-ই আর ছেড়ে কথা বলবে না।
অবশ্য বাপ উপন্যাসটির পৃথক পৃথক পর্ব পড়ে পরিষদ শব্দের আঢ়ালে এটা যে একটি রাজনৈতিক সংগঠন -এর পথ নির্দেশ তা সহজে বোঝা যাবে না। কিন্তু শেষটায় পৃথক ভাবে ওদের গঠনতন্ত্র দেয়া আছে। যা বুঝতে তোমার সময় লাগবে। কিন্তু একসাথে বইটি হাতে পেলে যে কেউ এটা বুঝে যাবে। তখন তোমার বন্ধুর চরম বিপদ হবে। এদিকে ছাত্রদের নিয়ে সে ইতিমধ্যেই যা শুরু করেছে, তা বাপ উপন্যাসের প্রথম পর্বে আমি পড়েছি। ছাত্ররা ওর কথা ও কাজে মিল খুঁজে পেয়েছে। তাই ওকে বসিয়েছে বিশেষ সম্মানের স্থানে। আমার মেয়ে আন্না তোমার সাথে এ বিষয়েই কথা বলতে এসেছে। বলেই কল্যাণ বাবু আমজাদ মেম্বর ও জাফর মেম্বরকে দেখলেন, তাদের নাম ধরে ডেকে বললেন – তোমরা যা শুনছো, প্লিজ ভুলেও দু’কান করো না। এদেশে একটা পরিবর্তন খুব জরুরী তা তোমরাও জান। আমরা সবাই আসলে একজন নেতার অপেক্ষা করছি। নতুন একটি রাজনৈতিক দলের অপেক্ষা করছি। যারা শুধু স্বপ্ন দেখাবে না। কাজ করে দেখাবে। যদি পার তোমরাও বাপ উপন্যাসটি পড়ে ফেল। আমার মেয়ে আন্না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্রী। ও ‘দৈনিক বাংলার চিঠি’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত বাপ উপন্যাসটির প্রায় সব পর্বই একত্র করেছে। সেগুলো দিয়ে কয়েকটি বইয়ের মত বাঁধাই করে এনেছে। তোমরা চাইলে নিয়ে পড়তে পার।

চার
যখনই কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি খুব অস্থিরতায় পেয়ে বসে আমাকে। নাওয়া-খাওয়া, ঘুম সবই প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এরকম পরিস্থিতিতে আমি মসজিদে ছুটে যাই। নামাজে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে মুখস্থ করা সূরাগুলো পড়ি, সেজদায় যাই এবং নামাজ শেষে আমি যখন মসজিদ থেকে বের হয়ে আসি – আপনা থেকেই আমি আমার করনীয় ঠিক করে ফেলতে পারি। আজও আমি ভীষণ অস্থিরতায় ভুগছি। কল্যাণ কাকুর মেয়ে আন্না আমাকে বাপ-এর একটি কপি দিয়েছে। তিনদিন ধরে সেটি পড়ছি, বার বার পড়ছি। লেখক আসলে কি চাচ্ছে তা বোঝার চেষ্টা করছি। কিন্তু এখনো আমার কাছে কিছুই পরিস্কার না। অথচ আন্না’র কথা শুনে আমি প্রচন্ড ভীত হয়ে পড়েছি। আন্না যা বলেছে তা যদি সত্যি হয়, তাহলে এ মূহুর্তে আমার লেখকের পাশে থাকা উচিত।
আন্নারা অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা খুব আশাবাদী। ইডেন কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া ও শামসুন্নাহার হলের মেয়েরা ইতিমধ্যে বাপ-এর দেখানো পথে হাঁটতে শুরু করেছে। ওরাই প্রথম নির্দলীয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদ-এর দাবী তুলে আন্দোলনে নেমেছে। শুধু ছাত্র সংসদ লেখা যাবে না। তাহলে ছাত্রী শব্দটি তুলে দিতে হবে। এ আন্দোলন ইতোমধ্যে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
কেন ছাত্রী বলা যাবেনা? প্রশ্নের উত্তরে বইটিতে যে যুক্তি দেখানো হয়েছে তা তুলে ধরে আন্না বলল – ইংরাজী স্টুডেন্ট- শব্দটির কি কোনো স্ত্রী লিঙ্গ আছে? আমরা বাংলায় এটিকে ছাত্র ও ছাত্রী লিঙ্গান্তর করে ব্যবহার করি। অথচ দেখেন যখনি বৃহৎ প্রয়োজন হয় তখন কিন্তু ছাত্র শব্দটি দিয়েই ছাত্র-ছাত্রী উভয়কে বুঝানো হচ্ছে। যেমন ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল শব্দে দেখুন। ঢাকায় ইডেনে আওয়ামী লীগ সমর্থক দু’গ্রুপ মেয়েদের মধ্যে সংঘর্ষের যে সংবাদ জাতীয় দৈনিক গুলোতে ছাপা হলো, সেখানে আহতদের ছাত্রী বলা হলেও একই সংবাদে পত্রিকায় লেখা হল ছাত্রলীগকর্মী বহিস্কার। এতে কি আমাদের খাটো করা হয় না? তাই আমাদের দাবী ছাত্রী বলে কোনো শব্দ আর থাকবেনা। সবাই ছাত্র। ছাত্র হবে উভয়লিঙ্গ। এ দাবীতে আন্দোলন শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা। স্কুল-কলেজের ছাত্রীরাও তাদের সাথে ঐক্যতা ঘোষণা করেছে। এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও কিছু সংগঠন এ আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। মেয়েদের মিছিলে হামলা করে তারা সারাদেশের শিক্ষাঙ্গনকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে।

আন্না প্রায় দু’ঘন্টা ধরে আমাকে বুঝাতে চেষ্টা করেছে, আমরা খেতে খেতে কথা শুরু করেছি। চেয়ারম্যান ও মেম্বর দু’জনও অবাক হয়ে গিলেছে আন্নার কথা। সব শুনে আমার মনে হয়েছে – এ সবের পিছনে যে বাপ নামের কোনো উপন্যাস কাজ করছে তা হয়তো এখনো বুঝে উঠতে পারেনি সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরাও। তাই এখনো লেখকের তেমন কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি। কিন্তু আন্না’র বিশ্বাস আর বেশি দিন এটা লুকানো থাকবে না। কারণ বুদ্ধিজীবীদের চাপের মুখে মেয়েরা এখন মুলত ছাত্র-ছাত্রী শব্দের যৌথ ব্যবহার দাবী করছে সর্বত্র। আর ছাত্রী শব্দটি তুলে দেয়ার জন্য বিশেষ আবেদন করেছে বাংলা একাডেমী ও সংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় বরাবরে। পুনরায় ডাকসু নির্বাচন দাবী তুলেছে ওরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরাও এ আন্দোলনে মেয়েদের সঙ্গে একত্র হয়েছে। মধুর ক্যান্টিন থেকে-ই সব কার্যক্রম শুরু করছে তারা। এমনিতেই নিরিহ ছাত্র আবু বকর-এর মৃত্যুতে এখানে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একটা ঐক্যতা তৈরি হয়েই ছিল। লেখকের দেখানো পথে হাঁটতে তাই খুব কষ্ট হচ্ছে না।
আন্না নির্দলীয় ছাত্র-ছাত্রীদের কাজের পদ্ধতী বিশ্লেষণ করে জানাল – সাধন ভাই, আপনি দেখলে অবাক হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেরাই একটা অলিখিত সংসদ তৈরি করে নিয়েছে। এই সংসদ সরকার ও বিরোধী দলের অনৈতিক কাজ গুলোর একটা তালিকা করে সেগুলোর নিচে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের সাক্ষর সংগ্রহ করে প্রতিবাদ লিপি পাঠিয়ে দিচ্ছে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীনেত্রীর কার্যালয়ে। এমনকি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বা জাতীয় দৈনিকে কোনো মন্ত্রী, নেতা বা এমপি’র বারাবারি বক্তব্যকেও তারা ধরিয়ে দিয়ে, সে বক্তব্য তুলে নেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছে। জাতীয় সংসদ অধিবেশন পর্যালোচনার জন্য সংসদ বার্তা নামে একটি বুলেটিন প্রকাশ করছে নিজস্ব অর্থায়নে। বলবেন অর্থ কোথায় পাচ্ছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের তেত্রিশ হাজার ছাত্রছাত্রী। তাদের সবাই এখন ঐক্যজোট। তারা তাদের টিফিন খরচ থেকে যে যা পারছে দান করছে এই ছাত্র বা ছাত্র-ছাত্রী সংসদ ফাণ্ডে। এই ছাত্র সংসদের রয়েছে নিজস্ব ছায়া সরকার কাঠামো। সেখানে প্রতিদিন সংসদে যে যা বলে বা করে তার ছবিসহ বিস্তারিত তুলে ধরা হচ্ছে। কে কি মন্তব্য করছে, সে মন্তব্যে ওয়াক আউট করা যায কিনা তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। তুলে ধরা হচ্ছে সংসদ খাতে প্রতিদিনের আয়-ব্যয় ও লাভের পরিসংখ্যান। মন্ত্রী-এমপিদের আয় ব্যয়, বিদেশ ভ্রমণ ইত্যাদি অনিয়ম খুঁজে বের করে তা প্রকাশ করা হচ্ছে। এই বুলেটিন সাধারণ মানুষের কাছে ২ টাকা মূল্যে বিক্রি করছে ছাত্ররা। এতেও কিছুটা টাকার জোগার হচ্ছে। যদিও এতে জাতীয় সংসদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে দাবী করে নির্বাচিত সাংসদরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন, তারাও পাল্টা প্রতিবাদ শুরু করেছেন। তবে সরকার দলীয় কয়েকজন তরুণ সাংসদ এটা সমর্থন করছেন। ছাত্র ছাত্রী সংসদকে তারা উৎসাহও দিচ্ছেন, যা অকল্পনীয় সাধন ভাই।
আন্না আরো বলেছে – সাধন ভাই, ছাত্র-ছাত্রীদের ভূমিকা সারা দেশে যেভাবে দ্রুত বদলে যাচ্ছে। তাতে সাধারণ মানুষ খুব স্বস্তি পাচ্ছেন। এমনকি সাধারণ কৃষকরাও এখন ছাত্রদের কাছে ছুটে যাচ্ছেন তাদের সমস্যা নিযে। বাপ-এর প্রথম পর্বে লেখক ঠিক এটাই দেখিয়েছেন। ছাত্র-ছাত্রীরা এসে কৃষককে ধান কাটায় সাহায্য করছে, তারা বাজারে ধান বিক্রিতে সাহায্য করছে। আলু-পটল, টমেটো ইত্যাদি গুদামজাতে সমস্যা হলে তা সরাসরি রাজধানীর বাজারে বিক্রির উদ্যোগ নিচ্ছে তারা। সরকারের কৃষিমন্ত্রীর সাথে কথা বলে তারা মন্ত্রণালয়ের সাহায্য এনে দিচ্ছে, যা সত্যি চমৎকার চিন্তা। আপনি পড়ে দেখুন। আপনার ভালো লাগবে। এসব শুরু হয়ে গেছে সাধন ভাই। ছাত্র-ছাত্রীদের ভয়ে এখন আর কেউ ঘুষ নিতে চাচ্ছে না। পুলিশও এখন আর নেতাদের তোয়াজ করে কথা বলছে না। লেখক ছাত্র-ছাত্রীদেরকে দিয়েই পরিবর্তনটা শুরু করতে চেয়েছেন, পরিবর্তন শুরু হয়েছে। আমাদের এখন তার পাশে দাঁড়ানো উচিৎ। তা না হলে বাপ-এর শেষ পর্বটা তিনি আর দেখাতে পারবেন না।
আমি আন্নার কথা শুনে স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, ও নিজেই এর সাথে জড়িয়ে গেছে। তাই ওকে প্রশ্ন করলাম – এ সব করে তোমরা পড়াশুনার বারটা বাজাচ্ছ না তো?
আন্না খিলখিলিয়ে হেসে উঠল – কী যে বলেন না সাধন ভাই। এতে আরও পড়ার চাপ বেড়েছে। আমরা পালা করে সংসদের কাজ করছি, তাই ক্লাশের পড়ার ক্ষতি হচ্ছে না, বরং আমাদের বাড়তি জ্ঞান অর্জনের জন্য আরও বেশি পড়তে হচ্ছে। আমরা এখন ব্রিটিশ বা আমেরিকান পার্লমেন্ট-এর কাজের নমূনাও জানি। পড়ে পড়ে শিখেছি। আমাদের দেশের আদি ইতিহাস, দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ এগুলো না জানলে আমরা সত্যটা বলবো কি করে?
আন্নাকে নিয়ে ওর বাবা চলে যাবার পরও মেম্বর দু’জন অনেক সময় বসে গল্প করেছে আমার সাথে। তাদের গল্পের বিষয় বাপ-এর কাজ কতটা অকাজ। সত্যি কি এটি ছায়া সরকার রূপরেখা নিয়ে পথ চলবে? তাদের নিজস্ব মন্ত্রীসভা থাকবে? তারা টাকা পাবে কোথায়? বিদেশী কোনো সংস্থা’র স্পাই হবে না তো? গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত দু’জন সদস্যের সচেতন প্রশ্ন শুনে আমি অবাক হয়েছি। আমাদের মানুষ কতটা রাজনীতি সচেতন বুঝতে পেরে আমার বুকটা গর্বে ভরে উঠল। তারা বাপ বইটি হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখল – আমরা দু’জন একটা বই পড়ে দেখি সাধন, বলে বইটা নিয়ে চুপচাপ চলে গেল তারা।
সবাই চলে যেতেই আমি ব্যস্ত হয়ে পাতা উল্টিয়ে দেখেছি ফটোকপি করা দৈনিক বাংলার চিঠি-এর লোগো সম্বলিত লেখাগুলো। এখানে শেষপর্ব নেই। আছে চলবে লেখা। উপন্যাসটি পড়ে পাগলামো ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি। আমজনতার মধ্যে থেকে নতুন নেতা খুঁজে বের করার শপথ নিয়েছে এ উপন্যাসের নায়ক। সে দেশের বিভিন্ন স্থানে, অলিতে গলিতে, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে একটা জরিপ চালিয়ে দেখেছে – বর্তমান রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের উপর সাধারণ মানুষের আর কোনো আস্থা নেই। সবাই মৌন-হতাশায় ভুগছেন। সকলেই চাচ্ছেন দৈবিক আশ্রয়। দেবদুতের মতো কোথাও থেকে এক বা একাধিক নেতা এসে তাদের উদ্ধার করবেন। নায়কের সাথে সাধারণ আমজনতার যে কথাবার্তা তাতে তারা শের-এ বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান-এর মতো আর একজন নেতাকে খুঁজে বেরাচ্ছেন এ দেশে? তাদের বিশ্বাস দৈব কিছু ঘটবে। ষোল কোটি লোকের মধ্যে থেকে কেউ না কেউ এক বা একাধিক নেতা বের হয়ে আসবেন। তাহলে দলবদ্ধ ভাবেই তৈরি হবে নতুন নেতৃত্ব। একজনের স্থানে দশজন মিলে সৃষ্টি করবে নতুন একটি রাজনৈতিক দল। এই দশজনের দলটিকে পরিচালনা করবে সয়ং আমজনতা। ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক সব শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে বসে আলোচনা করে কাজ করবে এই দশজন প্রতিনিধি।
এ উপন্যাসের নায়ক ইতিহাসের ছাত্র। সে পড়েছে – বাংলায় পাল রাজবংশের উত্থানের ইতিহাস। জানে কীভাবে চরম অশান্তি আর অরাজগতা দূর করতে আমজনতা একত্রিত হয়ে তাদের মধ্যে থেকেই গোপাল নামের একজনকে রাজা বানিয়ে দিয়েছিল। এই গোপাল থেকে বাংলামূলুকে পালবংশের সূচনা হয়েছিল অতীতে। তাহলে আজ এই আধুনিক যুগে কেন তা সম্ভব হবে না। নায়ক বেচারা তাই প্রথমেই গিয়েছে ছাত্রদের কাছে, তাদের বুঝিয়েছে ছাত্র নিজেই একটা প্রচণ্ড শক্তি, একটা পৃথক সত্তা। এর কোনো ভাগ হতে পারে না। অন্য যেকোনো রাজনৈতিক দলের তুলনায় ছাত্র নিজেই অনেক বেশি শক্তিশালী একটি সত্ত্বা। এর কোনো স্ত্রী লিঙ্গ হতে পারে না। ছেলে-মেয়ে সবাই ছাত্র। যেমনটি মহিলা পুরুষ সবাই মানুষ। নায়কের দৃঢ় বিশ্বাস এই ছাত্রদের মধ্যে থেকেই তৈরি হবে আগামীর পথপ্রদর্শক। আর এটা লেখকেরও দৃঢ় বিশ্বাস।

পাঁচ

আমি দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছি। সত্যি বলতে তানিয়া ম্যাডাম, ব্যারিস্টার তানিয়াকে না দেখলে হয়তো এ গ্রাম ছাড়তে এতোটা কষ্ট আমার হতো না। যাবার আগে কি তার সাথে একবার কথা বলে যাব? সেটা কি ঠিক হবে? অথচ আমার যত তারাতারি সম্ভব লেখকের কাছে যাওয়া উচিত। ওর কাছে চলে যাওয়া মানেই এদিকে সব গুটিয়ে ফেলতে হবে। সাতবছর ধরে একটু একটু করে গড়ে তোলা ঘর, দোকান, এই গ্রাম, গ্রামবাসী মানুষের ভালবাসা, সব ত্যাগ করতে হবে। উফ! কি করা উচিৎ। আমি দ্রুত ছুটে গেলাম মসজিদে। জহুরের নামাজের আযান হয়ে গেছে। মসজিদের ইমাম পীরজাদা সাইফুল সাহেব আমাকে দেখেই ছুটে এলেন – আরে সাধন, আপনাকেই খুঁজছিলাম। সেদিন আমি আপনাকে সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারি নাই। শুনুন – যে নিজেকে ভালোবাসেন, সে আল্লাহ বা স্রষ্টাকে ভালোবাসেন। এই ভালোবাসা নির্মোহ, নির্লোভ, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। আর আল্লাহকে ভালোবাসা মানেই আল্লাহ’র সৃষ্টিকে ভালোবাসা। এ পৃথিবীর সব, আসমান-জমিনের সব কিছু আল্লাহ’র সৃষ্টি। তাই এ সব কিছুকে যে ভালোবাসে না, সে আল্লাহ’কে ভালোবাসার কথা বলে কি করে। ভালোবাসার অপর নামই যে আল্লাহ-ইশ্বর-ভগবান। তাকে বাদ দিয়ে আমারতো কোনো অস্তিত্ব নাই। শুধু মসজিদে এসে নামাজ পড়লে বা রোজা রাখলেই আল্লাহ কে ভালোবাসা হয় না। নবীজী তার হুদায়বিয়ার সন্ধিতে দেখিয়েছেন ভালবাসার বিজয়। ঐ সন্ধি না হলে আজ সারা বিশ্বে ইসলামের জয় পতাকা উড়তো না।
আমি পীরজাদার মুখের দিকে হ্যাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম। এতোদিন তাকে আমি গোড়া ভেবে এসেছি। আজ সে-ই কি চমৎকার ভাবে আমাকে সমস্যার সমাধান দেখিয়ে দিলেন। ভালোবাসাই আল্লাহ-ইশ্বর-ভগবান। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে মনের গোপনে লুকানো তার প্রতি জমে থাকা সব ক্ষোভ স্বীকার করে ক্ষমা চাইলাম। তিনি মৃদু হেসে বললেন – সাধন আমি আপনার বন্ধু লেখকের ধার্মিক উপন্যাসটি পড়েছি। যেখানে লেখক প্রতিটি মুসলমানকে পবিত্র কোরআনের বাংলা জানতে ও বুঝতে অনুরোধ করেছেন, আর জুম্মার খুতবার প্রথম পর্বে এলাকার সমস্যা নিয়ে আরেঅচনা ও সমাধান খোঁজা এবং দ্বিতীয় পর্বে বাংলায় পড়ার বাধ্যবাধকতা চেয়ে আবেদন জানিয়েছেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ে। আপনি কখনো এখানে জুম্মা পড়তে আসেন নি, যদি আসতেন, দেখতেন – জুম্মার খুতবায় আমি বর্তমান সময়ের সমস্যা নিয়ে কথা বলি, বাংলায় বলি, আরবীতে বলি না।

আমি ধার্মিক বইটি পড়িনি। তাই ওটার কথা জানাও নেই। ঈমাম সাহেবের কথায় জানলাম, শুধু বাপ নয়, ধার্মিক নামের কোনো উপন্যাসও এবার লেখকের হাতিয়ার।
নামাজ শেষে আমি দ্রুত বের হয়ে এলাম। আমার করনীয় কি তা জেনে গেছি। এখনই সব কিছু গুছিয়ে আমাকে ফিরে যেতে হবে লেখকের কাছে। এ বিপদ মূহূর্তে ওকে একা রাখা যায় না। গোঁছগাছ করতে সময় লাগবে। কিন্তু কে জানতো ঘরে আমার জন্য আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। ব্যারিস্টার তানিয়া পায়চারি করছেন আমার ঘরের সামনে। আমাকে দেখেই মিষ্টি হাসলেন – আপনার সঙ্গে জরুরী কথা আছে তাই নিজেই চলে এলাম।
জ্বী বলুন, বলেই আমি আগ্রহ নিয়ে তার মুখের দিকে তাকালাম। সবুজীর ভিতর কালো ছোপের শাড়িতে দারুন লাগছে মেয়েটিকে। শাড়ি পড়ার কৌশলটাও দৃষ্টিনন্দন এবং চমৎকার রুচীশীলতার পরিচয় ফুটে উঠেছে। এমনকি বুকের উপর আঁচল পেঁচানোর ধরণটাও আলাদা। হঠাৎ করে কোনো পুরুষের নজর কাড়ে না শাড়ির ফাঁক গলে বেড়িয়ে থাকা শরীরের কোনো বাড়তি অংশ। এমন সুন্দর শাড়ি শুধু আমার মা পড়তেন। আজ তানিয়াকে অনেকটা মা মা লাগছে।
আমার চোখের মুগ্ধতায় তিনি আরও গুটিয়ে গেলেন। বাংলার লজ্জাভূষণ নারীটির গাল ধীরে ধীরে লাল হতে দেখলাম। নার্ভাস ভাবটা কাটাতে তিনি তারাতারি বললেন – চলুন আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি, যেতে যেতে পথে কথা বলি।
আমি দ্রুত ঘরে ঢুকে কয়েকটি কাপড় একটা হাত ব্যাগে ভরে নিলাম, পেস্ট আর টুথব্রাশ নিতে ভুললাম না। ঘরটায় তালা দিয়ে গাড়িতে তানিয়া-জ্বীর পাশে বসতে সব মিলিয়ে বিশ মিনিট সময় অপচয় হল। কিছুটা অবাক চোখেই তানিয়া বললেন – জরুরী কোথাও কি যাচ্ছেন? যেখানেই যান আজ দুপুরের খাবারটা আপনি আমার সাথে খেয়ে তারপর যাবেন।
একটু বিরতি দিয়ে তানিয়া আবার বললেন – গতকাল একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। রাতে জেলা শহরের শিক্ষক সমিতির কয়েকজন শিক্ষক, সর্বদলীয় ছাত্র সংসদের দু’জন করে ছাত্র (নারী ও পুরুষ) এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীসহ তিনটি দল আমার কাছে এসেছিল। তাদের মধ্যে মেম্বর জাফরউল্লাহ ও আমজাদ সাহেবও ছিলেন। তারা সবাই মিলে কি এক আমজনতা পরিষদ নামে একটি সমবায় সমিতি করতে চাচ্ছেন। তারা নিজেরাই ভোটাভুটির মাধ্যমে আমাকে সমিতির প্রেসিডেন্ট এবং আপনাকে সেক্রেটারী বানিয়ে দিয়েছেন। আপনাকে রাজী করানোর দায়িত্ব দিয়েছেন আমাকে। তাদের কি করে এ বিশ্বাস তৈরি হয়েছে আমি জানি না, তারা ভাবছে আপনি আমার কথা ফেলতে পারবেন না। অথচ আপনার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে মাত্র দু’দিন হলো। পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে খুব রহস্যময় লাগছে। তবে তাদের সমিতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য শুনে আমার ভালো লেগেছে।

যেমন – তারা এ সমিতির দ্বারা সারাদেশে শিল্প কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে বেকারত্ব দূরীকরণ, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন, সর্বস্তরের আমজনতার কর্মউদ্যোগ গ্রহণ ও বৃহৎ কোনো সমস্যার সমাধানে সবসময় কাজ করে যাবে। সমিতির সদস্যরা পাবে ঝুঁকিসেবা। তবে তারা তাদের সদস্য চাঁদা থেকে কোনো সুদ বা এককালিন কোনো মুনাফা পাবেন না, তারা পাবেন গড়ে ওঠা শিল্প প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বা মালিকানার লভ্যাংশ।
আমি হেসে উঠলাম – এতো স্পস্ট ভাওতাবাজী ম্যাম।
তানিয়া – কেন, সেটা মনে হলো কেন?
বললাম – সদস্যরা চাঁদা দেবে, কোনো মুনাফা পাবে না, পাবে প্রতিষ্ঠানের লভ্যংশ? যে প্রতিষ্ঠান কোনোদিন তৈরিই হবে না। একটা প্রতিষ্ঠান গড়তে কি পরিমান টাকার প্রয়োজন? সে ধারণা থাকলে….
সাধন, আগে পুরোটা শুনুন, আপনার মনে লুকানো সব প্রশ্নের উত্তর এখানে আছে -কথাটি বলে হাত নেড়ে একটা ভাজ করা কাগজ দেখালেন তানিয়া। বললেন – এ সমিতি সর্বসাধারণের জন্যও উম্মুক্ত থাকবে, প্রতিটি সদস্য সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করবে। সদস্যসংখ্যা একশ না হওয়া পর্যন্ত সমিতি ফাণ্ডের টাকা কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না।
এখানে দেখুন বলে তানিয়া কাগজটি খুলে একটি সদস্য ফরম দেখালেন – কেউ এ সমিতির সদস্য হতে চাইলে ৫০ টাকা দিয়ে সদস্য ফরম কিনে সাধারণ সদস্য হতে পারবে। এই ৫০ টাকা ব্যয় হবে সমিতির খরচ খাতে। একজন সদস্য প্রতি মাসে মাত্র ১০ টাকা সমিতি সদস্য ফি দেবেন। এই ১০টাকা জমা হবে সমিতি ফাণ্ডে। বিনিময়ে তিনি পাবেন সব ধরণের ঝুঁকিসেবা। এই ঝুঁকিসেবা হচ্ছে – ধান কাটা মৌসুমে কৃষকের সাহায্য, জমিজমা সংক্রান্ত, স্কুল-কলেজে ভর্তি বা অন্য যেকোনো পারিবারিক বা ব্যত্তিগত ঝামেলায় এই সমিতি একে-অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। এমন কি আইনি সাহায্য পাবে বিনা খরচে। কেউ খামার বা এ জাতীয় উৎপাদনশীল কিছু করতে চাইলে সমিতি তাকে লোন দেবেনা, তবে তার সাথে যৌথ মালিকানায় টাকা বিনিয়োগ করবে। এরকম আরও অনেকগুলো বিষয়।
কিন্তু আমার কাছে ওদের যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে সাধন, এই যে দেখুন – বলেই তানিয়া তার হাত ব্যাগ থেকে অন্য একটি ডাকে আসা কাগজ বের করলেন। খামটি এসেছে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ আমজনতা পরিষদ (বাপ) নামে।

সাধন দেখল পেপারটিতে বেশ কয়েকটি প্রস্তাবণা রয়েছে। প্রস্তাবণার প্রথমেই লেখা আছে – দেশের প্রতিটি জেলায় ভালো সৎ ও পরিশ্রমি লোকদের নিয়ে বাংলাদেশ আমজনতা পরিষদ (বাপ) সমিতি কার্যক্রম গঠিত হবে। এই সৎ লোকেরা ভোটের মাধ্যমে তাদের যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করবেন। সমিতির মূল উদ্দেশ্য থাকবে নিজ জেলায় শিল্প-কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে জেলাভিত্তিক কর্মসংস্থান তৈরি করার চেষ্টা।

যেমন -বরিশাল অঞ্চলের এই সমিতি অবশ্যই আটঘর কুড়িয়ানার আমড়া ও পেয়ারাকে ঘিরে জেলি কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। যে সব অঞ্চলে নারিকেলের উৎপাদন বেশি, সেসব অঞ্চলে নারিকেল তৈল ও ছোবড়া থেকে উৎপাদনকৃত পণ্য তৈরি কারখানা স্থাপন করার কাজ এই সমিতির। আনারস, টমেটো, আখ কিম্বা পাট উৎপাদশীল এলাকায় অবশ্যই শিল্প কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে। জেলার রাস্তাঘাট তৈরি ও যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতির জন্য এ সমিতির সদস্যরা প্রথমে সরকারী সহযোগিতা পেতে করণীয় যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সরকার সহযোগিতা না করলে নিজ উদ্যোগে এলাকাবাসীর সহযোগীতা নিয়ে কাজ সম্পন্ন করতে হবে। এ রকম আরও কিছু প্রস্তাবণা রয়েছে। একদম নীচে একটি সাক্ষর ও সিল রয়েছে। তাতে লেখা – আহ্বায়ক- বাংলাদেশ আমজনতা পার্টি (বাপ)।
প্রস্তবণাগুলো দেখে আমার চোখে বিস্ময় ঝরতে শুরু করেছে। আমি আর বাকরুদ্ধ থাকতে পারলাম না। চিৎকার করে উঠলাম – লেখক সালা তুই মরবি। আমার চিৎকারে তানিয়া চমকে উঠলেন। চালক ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে পিছনে তাকাল। আমি লজ্জা পেয়ে তারাতারি বললাম – স্যরি।
ইশারা পেয়ে চালক আবার গাড়ি চালু করলে তানিয়া জানতে চাইলেন – কোনো সমস্যা সাধন?
বললাম – সমস্যা মানে, এই যে এখানে দেখেন, বলে আমি পেপারটির নীচে দিকে শেষ দুটি প্রস্তাবণা দেখালাম। সেখানে লেখা – একটি জেলায় অন্য অনেক সমিতি রয়েছে, থাকবে। এ সব সমিতি ইচ্ছে করলে তাদের সকল সদস্য নিয়ে এই সমিতির সদস্য হতে পারবে। সেক্ষেত্রে সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যৌথভাবে চুক্তি সাক্ষর করবেন ও তাদের সকল সদস্যের মাথাপিছু হিসেব করে মাসিক ফি দিয়ে যাবেন। সাধারণ যেকোনো সদস্য যখন তখন সমিতি ফাণ্ডের হিসেব চাইতে পারবে। সমিতি ফাণ্ডের টাকা কোনো ভাবেই সুদের উপর ধার দেয়া বা ছোট কোনো কাজে ব্যয় করা যাবে না। মনে রাখতে হবে এ টাকার উপর ই গড়ে উঠবে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান যা এই জেলার বেকারত্ব দূর করবে।
এরপর আমি তানিয়াকে নীচের সীল ও সাক্ষর দেখালাম। বললাম তানিয়া আমরা একটি রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হয়ে গেছি। এই সমিতি সেই দলেরই একটি শাখা মাত্র। দেশের সব জেলাতেই এ রকম একই নামে সমিতি তৈরি হচ্ছে এবং নিশ্চয়ই এর প্রধান কার্যালয়টি রাজধানীতে। এটি মূলত বাংলাদেশ আমজনতা পার্টি (বাপ)-এর নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ঠিক যেমনটি আওয়ামী লীগ বা বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন রয়েছে, তেমনটি।
তানিয়া – কি বলছেন? এটা সত্যি হলে আমাকে বা আপনাকে কেন এর সঙ্গে যুক্ত করবে। আমার বাবা সরকার দলের সাংসদ। আপনাকে না হয় মানা যায় আমাকে?
সাধন – আপনার বাবা সাংসদ হলেও আপনিতো কোনো রাজনৈতিক দলের সংগে যুক্ত নন, হয়তো তাই।
তানিয়া – আপনি জানেন না তাই এ কথা বলছেন। আমি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয়া মহিলা লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছি এবং ওরা তা জেনেই আমাকে নির্বাচন করেছে। তাছাড়া আপনি হয়তো লক্ষ্য করেননি যে ওদের নীতিমালায় বলা আছে- এই সৎ লোকেরা ভোটের মাধ্যমে তাদের যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করবে।’ অর্থাৎ নির্বাচিত এই নেতৃত্ব যদি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হয়, তাতেও ক্ষতি নেই।
সাধন – বিষয়টা আমার কাছে সত্যি বিস্ময়কর লাগছে তানিয়া জ্বী। ওদের নীতিমালা অনুযায়ী অন্য রাজনৈতিক দলের সদস্যরা যদি এ সমিতির সদস্য হতে পারে তাহলেতো এটা আর যাই হোক কোনো রাজনৈতিক দলের শাখা নয়। কিন্তু কেন্দ্রিয় একটা নিয়ন্ত্রণ না থাকলে এটির কার্যক্রম পরিচালিত হবে কীভাবে? এটা একটা উদ্ভট চিন্তা বলে মনে হচ্ছে আমার। আর এরকম উদ্ভট চিন্তা একজনই করতে পারে, সে হচ্ছে আমার বন্ধু ও স্যালক। যে বাপ নামে একটা উপন্যাস লিখে নিজেকে কেউকেটা ভাবতে শুরু করেছে।
ঠিক এমন সময় তানিয়ার মুঠোফোনটি বেঁজে উঠল। কারো সাথে কথা বললেন তিনি। আমি কথার ধরণ ও কয়েকটি নাম শুনে বুঝতে পারলাম সাথী নামের কেউ ফোন করেছে এবং আমাকেই খুঁজে বের করার জন্য বারবার অনুরোধ করছে। হঠাৎ করেই সাথীকে চিনতে পারলাম আমি। লেখকের প্রেমিকা বা হবু স্ত্রী’র নাম সাথী। একবার দেখা হয়েছিল। ফোন রেখে তানিয়া খুব চিন্তিত হয়ে পরলেন। বললেন – এখন আমি বুঝতে পারছি, আপনি কেন একটু আগে ওভাবে চিৎকার করে উঠলেন। ঠিকই বলেছেন, এ সবের পিছনে লেখক আর বাপ নামের উপন্যাসটাই কাজ করছে। আমি না চিনলেও আপনার বন্ধু লেখক মশাই আমাকে চেনেন। কারণ সাথী আমার স্কুল ও কলেজের বান্ধবী, ঢাকায় গেলে আমি ওর সাথেই বেশি সময় কাটাই। সাথীও আপনার বন্ধুকে নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তায় আছে। ওর এখন আপনার সাহায্য দরকার। আমাকে বলেছে, যেভাবে হোক আপনাকে খুঁজে বের করে আমি যেন ঢাকায় পাঠিয়ে দেই। আপনি লেখককে ফিরিয়ে দেয়ার পর থেকেই নাকি সে বিমর্ষ হয়ে আছে। কারো সাথে, এমনকি সাথীর সাথেও কথা বলছে না। একা একা কি সব বিরবির করছে।
সাধন – কিন্তু এদিকে এই সমিতির কি হবে? এরাতো আমাদের বিপদে ফেলে দিয়েছে। কোনো রকম আলাপ আলোচনা না করেই আমাকে সাধারণ সম্পাদক করে দিয়েছে। আমি আসলে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। তাছাড়া আমিতো ঢাকায চলে যাবার জন্যই আজ বের হয়েছি। জানি ওর কাছে গেলে সহজে আর ফেরা হবে না। তাই সব কিছু গুছিয়ে নিতে যাচ্ছিলাম।

তানিয়াদের বাড়ির সামনে গাড়ি ব্রেক করেছে। দু’জনের মনোযোগ একে অপরের প্রতি থাকায় গাড়ি ব্রেক করতেই আমরা ভারসাম্যহীন হয়ে পরে যাচ্ছিলাম, দু’জনই দু’জনকে ধরে ফেললাম। বিষয়টা দৃষ্টিকটু হলেও আত্মরক্ষার কারণে ক্ষমার যোগ্য। তাই অনেকটা জড়তা নিয়েই গাড়ি থেকে নামলাম। তানিয়া জ্বীর পিছু নিয়ে হেঁটে এলাম বসার ঘরে। দোতলা বাড়িটির বসার ঘরে রাখা সুন্দর দু’জোড়া সোফা ছাড়া আর কিছু আমার নজরে এল না। অনেকক্ষণ আমাদের কারো মুখে কথা ছিলনা। তানিয়া-জ্বী নিরবতা ভাঙলেন – দেখেন সাধন আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি, তাই সরাসরি বলছি, আমার কথার ধরণ আপনার পছন্দ না হলে সরাসরি বলে দেবেন। এতোদিন আপনি বেচলর ছিলেন, তাই কোথাও আপনার যাবার প্রসঙ্গ এলেই ভেবে বসেন – সারা জীবনের জন্য যেতে হচ্ছে। আমাদের এখান থেকে ঢাকা মাত্র ছয় ঘন্টার পথ। আপনার যে কাজ, তাতে দু’দিন পর ঠিকই ফিরে আসতে পারবেন, প্রয়োজনে আবার যেতেও পারবেন। এই মূহুর্তে লেখকের পাশে আপনাকে দরকার, তাই আমিও আমার বান্ধবীটার ভালোর জন্য আপনাকে যেতে দিচ্ছি। মনে রাখবেন, আগে আপনার পিছু টান ছিল না, আজ আছে। বলেই তানিয়া লজ্জায় লাল হয়ে উঠলেন। দ্রুত উঠে ভিতর ঘরে চলে গেলেন। কাজের লোককে ডেকে টেবিলে খাবার দিতে বললেন। এমন সময় আবার বেজে উঠলো তানিয়ার মুঠোফোন – হ্যালো
ও প্রান্তের কথা শোনা গেল না, একটু পরই তানিয়া এসে ফোনটা আমার হাতে দিল। আমি কানে ঠেকাতেই – ও প্রান্ত থেকে উচ্ছ্বসিত গালির ঝড় বইতে শুরু করলো, তারপর লেখক সালা বলল – ঢাকায় আসতে হবে না, আমার ছোট বোনটার কাছেই থাক সালা, আমরাই আসছি। তোদের ওখানেই প্রথম বাপ-এর মিটিং শুরু হচ্ছে। জেলার সব ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষকসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমিতির নেতৃবৃন্দ কাল সকালে তোদের গ্রামে জড়ো হচ্ছে। তোদের দুজনকেই তাদের বুঝাতে হবে আগামীর পথটি। আমি সাথীকে নিয়ে আজ রাতেই পৌঁছে যাব। আর হাঃ , সব রাজনৈতিক দলের হেড অফিস ঢাকা কেন্দ্রিক হলেও বাপ এর হেড অফিস গ্রাম কেন্দ্রিক। বুঝলি উজবুক?
আমি খুশিতে আটখানা হয়ে তানিয়াকে প্রায় জড়িয়ে ধরলাম। আমার মন থেকে একটা বোঝা যেন নেমে গেল। আমার দু’বাহুতে বন্দী তানিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার চোখে – সাধন, এখন যদি তুমি এই বাঁধন ছেড়ে দাও, আমি কিন্তু পরে যাব।
আমার হাতের উপর আমি ওর শরীরের ভর টের পাচ্ছিলাম। ছেড়ে দিলেই একবারে মাটিতে চিৎ হয়ে পরে যাবে তানি, একবার মনে হল ছেড়ে দিয়ে একটু মজা করি, পরক্ষণেই মন না বলে উঠল, এই মেয়েটিকে যে একটুও ব্যাথা পেতে দেব না আমি। আমার হাতের বাঁধন আরও শক্ত হল টের পেয়ে নিজেকে আমার বুকে এলিয়ে দিল তানিয়া। মুখে বলল – আমি তোমার সম্পর্কে সব জানি, সব। কিন্তু তুমি আমার কথা জান না।
ওর মুখ চেপে ধরে বললাম – একদম যে কিছু শুনি নাই, তা ঠিক না। কিছু টা যা জানি তা খুব একটা ভালো কিছু না, তাই আর জানতে চাই না। অতীত থেকে আমরা শিক্ষা নেব, অতীত নিয়ে পথ চলবো না। (সমাপ্ত)

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!

About the author

ডিসেম্বর ৭১! কৃত্তনখোলার জলে সাঁতার কেটে বেড়ে ওঠা জীবন। ইছামতির তীরঘেষা ভালবাসা ছুঁয়ে যায় গঙ্গার আহ্বানে। সেই টানে কলকাতার বিরাটিতে তিনটি বছর। এদিকে পিতা প্রয়াত আলাউদ্দিন আহমেদ-এর উৎকণ্ঠা আর মা জিন্নাত আরা বেগম-এর চোখের জল, গঙ্গার সম্মোহনী কাটিয়ে তাই ফিরে আসা ঘরে। কিন্তু কৈশরী প্রেম আবার তাড়া করে, তের বছর বয়সে তের বার হারিয়ে যাওয়ার রেকর্ডে যেন বিদ্রোহী কবি নজরুলের অনুসরণ। জীবনানন্দ আর সুকান্তে প্রভাবিত যৌবন আটকে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় পদার্পন মাত্রই। এখানে আধুনিক হবার চেষ্টায় বড় তারাতারি বদলে যায় জীবন। প্রতিবাদে দেবী আর নিগার নামের দুটি কাব্য সংকলন প্রশ্ন তোলে বিবেকবানের মনে। তার কবিতায়, উচ্চারণ শুদ্ধতা আর কবিত্বের আধুনিকায়নের দাবী তুলে তুলে নেন দীক্ষার ভার প্রয়াত নরেণ বিশ্বাস স্যার। স্যারের পরামর্শে প্রথম আলাপ কবি আসাদ চৌধুরী, মুহাম্মদ নুরুল হুদা এবং তৎকালিন ভাষাতত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রাজীব হুমায়ুন ডেকে পাঠান তাকে। অভিনেতা রাজনীতিবিদ আসাদুজ্জামান নূর, সাংকৃতজন আলী যাকের আর সারা যাকের-এর উৎসাহ উদ্দিপনায় শুরু হয় নতুন পথ চলা। ঢাকা সুবচন, থিয়েটার ইউনিট হয়ে মাযহারুল হক পিন্টুর সাথে নাট্যাভিনয় ইউনিভার্সেল থিয়েটারে। শংকর শাওজাল হাত ধরে শিখান মঞ্চনাটবের রিপোটিংটা। তারই সূত্র ধরে তৈরি হয় দৈনিক ভোরের কাগজের প্রথম মঞ্চপাতা। একইসমেয় দর্শন চাষা সরদার ফজলুল করিম- হাত ধরে নিযে চলেন জীবনদত্তের পাঠশালায়। বলেন- মানুষ হও দাদু ভাই, প্রকৃত মানুষ। সরদার ফজলুল করিমের এ উক্তি ছুঁয়ে যায় হৃদয়। সত্যিকারের মানুষ হবার চেষ্টায় তাই জাতীয় দৈনিক রুপালী, বাংলার বাণী, জনকণ্ঠ, ইত্তেফাক, মুক্তকণ্ঠের প্রদায়ক হয়ে এবং অবশেষে ভোরেরকাগজের প্রতিনিধি নিযুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়ান ৬৫টি জেলায়। ছুটে বেড়ান গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। ২০০২ সালে প্রথম চ্যানেল আই-্র সংবাদ বিভাগে স্থির হন বটে, তবে অস্থির চিত্ত এরপর ঘনবদল বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, আমাদের সময়, মানবজমিন ও দৈনিক যায়যায়দিন হয়ে এখন আবার বেকার। প্রথম আলো ও চ্যানেল আই আর অভিনেত্রী, নির্দেশক সারা যাকের এর প্রশ্রয়ে ও স্নেহ ছায়ায় আজও বিচরণ তার। একইসাথে চলছে সাহিত্য বাজার নামের পত্রিকা সম্পাদনার কাজ।