বরিশাল জেলার অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান গজনীর দিঘী । জল সরকারের পাড় ব্যক্তির দাবি তুলে বিভিন্ন অপকৌশলে এই দিঘীটি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে এর সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য। চারপাশের পুকুর পাড়ে গড়ে উঠছে বসতবাড়ি। এখনই যদি এই বেদখল প্রক্রিয়া থামানো না যায় তাহলে অচিরেই এই বিশাল দর্শনীয় পুকুরটি চলে যাবে ভূমি দস্যুদের পেটে। কেউ কি আছেন গজনীর ঐতিহ্য ফিরিয়ে দেবেন?
গজনীর দীঘী ? একটি মেয়ে গজাল মাছ – গজনী আর বাঘের লড়াইয়ে গজনীর জয়ী হওয়া এবং সেটির আধ খাওয়া শরীরে মৃত বাঘের পাশে আরো দু’দিন বেঁচে থাকার গল্প নিয়ে বরিশালের কাউয়াচর এর চাঁনপুরা ইউনিয়নের এই গজনীর দীঘী । (এটা নেহাত গুজব।) সত্যটা হচ্ছ – সুলতানী আমলে গজনীর কোনো এক সুলতান বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজনে এই দীঘী খনন করেন এবং স্থানীয় জাগীরদার বা জমিদারকে এটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেন । যে কারণে এ দিঘীটির নাম গজনীর দিঘী হয়েছে।
আহঞ্জী বা ইসলাম ধর্মের প্রচারকারী হবার সুবাদে বরিশালের চাঁনপুরা ইউনিয়নের মানুষের কাছে আহঞ্জীদের আদিপিতা ইয়ারউদ্দিন আখনের গ্রহনযোগ্যতা ছিল অনেকটাই জমিদারদের মত । বিচার আচার, সামাজিক যেকোন সমস্যার সমাধানে এ অঞ্চলের মানুষেরা এখনো আহঞ্জী (বর্তমান তালুকদার) বাড়ি নির্ভর । যে কারণে গজনীর দীঘীটাও আহঞ্জীদের নিয়ন্ত্রণে দেন তদানিন্তন গজনীর সুলতান । পরবর্তীতে এই গজনীর দিঘীর বিশুদ্ধ পানির সুবিধা গ্রহণ করতে এখানে বাতাস ফকির নামের একজন দরবেশ আশ্রয় গ্রহণ করেন। আহঞ্জীরা ঐ দরবেশের থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সুব্যবস্থা করে দিলে তাকে ঘীরে এখানে আশে পাশে বসত শুরু হয়। জমে ওঠে ধর্ম ীয় নানান উৎসব ও মেলা। গজনীর মেলায় নিয়মিত ঘোড়দৌড়ের আয়োজন হত বলে এ মেলা অনেকদূর পর্যন্ত সুখ্যাতি লাভ করে।
পুকুরের উত্তর পারে একটি গাছ ছিল, যেটির কষ ছিল রক্ত লাল । গাছটিতে কোপ দিলেই রক্ত বের হতো আর তা দেখতে ভিড় করত দূর দূরান্তের মানুষ । হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা তখন এ গাছটির পূজা শুরু করলে বাতাস ফকির এটি কেটে ফেলার নির্দেশও দিয়েছিলেন। এটা দেশভাগের অনেক পূর্বের কথা। বাতাস ফকিরের পরামর্শে আহঞ্জীরা গজনী কে দান করে দেন জনগণের কল্যানে । যা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব চাপে ইউনিয়ন পরিষদের উপর । স্বাধীনতার পরেও গজনীর মেলা বা থৈল ছিল এ অঞ্চলের সেরা বিনোদন। সেখানে নিয়মিত ঘৌড় দৌড় হতো । পরবর্তীতে নাসির নামে এক যুবক হত্যার ঘটনায় ঐ মেলা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং গজনী চলে যায় উপজেলা পরিষদের অধীনে ।
খুবই চমত্কার আর বিশাল এই পুকুরটি পিকনিক স্পট করার কথা উঠেছিল ১৯৮৫ সালে । ১৯৮৯ থেকে ৯২ সময়ে স্থানীয় কতিপয় যুবক মনির দর্জি সহ ফ্রেন্ডস সোসাইটি বা এ রকম একটি সংগঠনের মাধ্যমে গজনীকে বাঁচাও আন্দোলন শুরু করে এবং তারা গজনীর পাড়ে চন্দ্রদ্বীপ পরিষদ ভবন নির্মাণের আহ্বান জানান। তাদের সে দাবী আজো ঝুলে আছে উপজেলা দপ্তরে।
চমৎকার ও বিশাল নলি পানির পুকুরটির সাথে রামসাগর ও দূর্গা সাগরের তুলনা চলে। অথচ আজ একী দেখছি ? পুকুরের দক্ষিণ পাড় পুরোটাই দখল করে গড়ে উঠেছে বসতভিটা । পূর্বপাড়ও অনেকটা বেদখল । আজ থেকে প্রায় ২৫০ বছর আগে এই গজনীর দীঘী ছিল আহঞ্জীদের ব্যাক্তিগত সম্পত্তি । এরপর কিভাবে এটি জল সরকারের আর পাড় ব্যাক্তিগত হলো? আহঞ্জী বাড়ীর লোকরা ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা কীভাবে এই পাড় বিক্রী করছে তা বোধগম্য নয় ।