‘সাহিত্য’ গণ্ডিটা এত বিশাল যে কোনো জেলার সাহিত্য নিয়ে কথা উঠলে স্বভাবতই সেখানে উঠে আছে ঐ জেলার সাংস্কৃতিক পটভূমি সংগীত, নৃত্য, নাটক, গান, কবিতা, উপন্যাস, গল্প, প্রবাদ প্রবচন ইত্যাদি সবকিছুই সাহিত্যের অংশ। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটার মূল্যায়ন করা খুব কঠিন। মোদ্দাকথা মানুষের প্রাত্যহিক জীবনই যে সাহিত্য এ সত্য অস্বীকার করার উপায় আছে?
‘সাহিত্য বাজার’ প্রতিসংখ্যায় জেলাভিত্তিক সাহিত্যকে তুলে ধরার যে অঙ্গীকার করেছে তা একটি জেলার সাহিত্যের ঐতিহ্যকে ধারণ তো দূরে থাক কাছাকাছির যাবার জন্য যোগ্য হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কেননা সাহিত্যের পরিমন্ডল এতটাই বিশাল যে, নির্দিষ্ট কোন জেলার সাহিত্য নিয়ে ধারাবাহিকভাবে এ পত্রিকার দশটি সংখ্যা প্রকাশ করলেও তা সঠিক ভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হবে না। তারপরও একটি জেলা শহরের সাহিত্যচর্চা, সাহিত্যিকদের কর্মচাঞ্চল্য বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে উৎসাহ দিতেই আমাদের ‘জেলায় জেলায় সাহিত্য’ পর্বটি সাঁজানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এটা মূলত একটি প্রতিবেদন পর্ব। এতে জেলাভিত্তিক সাহিত্যচর্চা, সাহিত্যিকদের কর্মকা-, সাহিত্য সংগঠন কার্যক্রম ইত্যাদি খুটিনাটি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশই আমাদের মূল লক্ষ্য। আর এ পর্বে আমরা সাহিত্য বাজারের প্রথম সংখ্যার সূচনা করেছিলাম বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার সাহিত্যচর্চা নিয়ে। তিন বছর পর আবার যখন ময়মনসিংহের সাহিত্যাঙ্গনে ফিরে তাকালাম, সেখানে কিছু চমক যেমন ছিল তেমনি ছিল গতানুগতিকতার প্রতিফলন।
একমাত্র সাহিত্য সংগঠনটি বন্দি রাজনৈতিক বেড়াজালে। ক্ষমতার বলে অযোগ্য নেতৃত্ব এখানে সাহিত্যচর্চার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানালেন বিশিষ্টজনেরা। সুখবর একটি যে, এই ময়মনসিংহের মাটিতেই আগামী ৮, ৯ ও ১০ মার্চে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তিনদিনের জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মেলন-১৪১৮ এর একত্রিংশত্তম জাতীয় অধিবেশন। জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত পরিষদের এই উদ্যোগটিকে সাধুবাদ জানিয়ে ময়মনসিংহবাসী নিচ্ছেন উৎসব প্রস্তুতি।
ময়নমসিংহ মানেই চন্দ্রাবতী, মলুয়া, ময়মনসিংহ গীতিকা, অর্থাৎ ময়মনসিংহ মানেই কবি ও কবিতা। এখানে ব্রহ্মপুত্র নদীর দু’কুল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সাহিত্যের অফুরন্ত ভা-ার। নদীর স্রোতে খেলা করে কবিতারা। যে কারণে বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী, এ সময়ের যতীন সরকার, নির্মলেন্দু গুণ, তসলিমা নাসরিন, হুমায়ুন আহমেদ, মোহাম্মদ জাফর ইকবাল, নাসরীন জাহান প্রমূখসহ অনেক খ্যাতনামা ও আলোচিত কবি-সাহিত্যিকই বেড়ে উঠেছেন এই নদীর জলে খেলা করে। যেমনটি এখনো খেলা করে চলছে ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ ও তার পাঠচক্র বীক্ষণ সংগঠনটি। যদিও এটি হারিয়েছে তার পুরাতন ঐতিহ্য। এই সংগঠনটি রাজনৈতিক জটিলতা ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে ক্রমশ মুখ থুবরে পড়ছে বলে জানালেন ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের সাবেক সভাপতি ইয়াজদানী কোরায়শী কাজল, কবি শামসুল ফয়েজ প্রমূখ।
জেলাশহরের কবিদের খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, এখানের কবিরা এখন তিন ভাগে বিভক্ত। চার বছর আগে তারা ছিলেন দু’ভাগে বিভক্ত। তখন একদল কবিদের আড্ডাস্থল ছিল কোরায়শী প্রাঙ্গণ, অন্যদলের ফয়েজ অঙ্গন। এখন নতুন আরেকটি আড্ডাস্থল যুক্ত হয়েছে আওয়ামীলীগ নেত্রী ও সাহিত্য সংসদের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারা সুলতানা আনুকে কেন্দ্র করে। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় দাঁড়িয়ে সাহিত্য সংসদের বৈধ কমিটিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সাহিত্য সংসদের বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক প্রদীপ কুমার ও সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারা আনু ক্ষমতাসীন হয়েছেন। যে কারণে এখানের সাহিত্য সংস্কৃতি এখন ত্রীমুখী আকার ধারণ করেছে। দুদিনের অবস্থানকালে কবি আনোয়ারা আনু বা প্রদীপ কুমার কোলকাতায় থাকার কারণে তাদের বক্তব্য পাওয়া যায় নাই। তবে এ বিষয়ে তাদের মতামত আগামীতে তুলে ধরা হবে।
কোরায়শী প্রাঙ্গণটি মূলত একটি মুদ্রণ ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। এখানে বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিছু প্রবীণ কবিরা এসে জড়ো হন। অন্যদিকে জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে কবি শামসুল ফয়েজ নেতৃত্ব দিচ্ছেন তৃতীয় গ্রুপটির। জেলা রেল স্টেশনের কাছের একটি চায়ের দোকানকে ফয়েজ অঙ্গন নাম দিয়ে তিনি এখানে নিয়মিত কবিতার আসর বসান। তরুণ-যুবা, বৃদ্ধসহ প্রায় সব বয়সের কবিদের ভিড় এখানে।
কবি শামসুল ফয়েজ
কবি শামসুল ফয়েজ একাধারে কবি, লেখক এবং অনুবাদকও। বাংলা ও ইংরাজী বাদেও তিনি লিখতে ও পড়তে জানেন উর্দু ও ফারসী ভাষা। নিয়মিত অনুবাদ করেন ফরাসী কবি ও কবিতার বিভিন্নাংশ। ময়মনসিংহের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, রাজনীতির কারণে এখানের সাহিত্যের পরিবেশ দুষিত হয়ে গেছে। সাহিত্য সংসদ নামের সংগঠনটি এখন দখল করে নিয়েছে অপসাহিত্যের পূজারীরা। তারা বৈধ কমিটি ভেঙ্গে নিজেরাই কমিটি বানিয়ে গায়ের জোরে যাকে ইচ্ছে রাখছেন, বহিস্কার করছেন। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকেও উত্তম মাধ্যম প্রহার করতে ছাড়ছেন না। ফয়েজ অঙ্গনের আড্ডা নিয়ে তিনি বলেনÑ সাংসারিক মানুষ মাত্র ঝামেলা থাকবেই। আমারও আছে। তবে আমি মনে করি, সিনিয়র অনেক কবি লেখকদের কাছে তরুণরা যেতেই পারেন না। তাদের ব্যক্তিত্বের মুখোশে ভীত তরুণরা। এদের লেখা দেখে আমি উচ্ছসিত হই, আনন্দ পাই, ওদেরকেও কবিতার বিভিন্ন দিক (আমি যতটুকু জানি) তা বুঝিয়ে দেই। আমি ওদেরই একজন, আমার মধ্যে এটাই আগে কাজ করে। তাই ওরা ফয়েজ অঙ্গনে আসেন।
শাহাদাত হোসেন খান হীলু
ময়মনসিংহের নাট্যাঙ্গনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ও বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সহ সভাপতি শাহাদাত হোসেন খান হীলু বলেন, সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চাটা এখন একটা বন্ধা সময়ে আটকে আছে। চলমান রাজনীতির ধারাবাহিকতায় প্রতিটি সংগঠনই এখন রাজনৈতিক। সেটার প্রভাব সাহিত্যে যেমন, তেমনি নাটকে। তারউপর আছে মিডিয়া কেন্দ্রিকতা। তরুণ প্রজন্ম এখন তারাতারি মিডিয়ার সংশ্লিষ্টতা চায়। যে কারণে মযমনসিংহের সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গন এখন আর আগের মত নেই।
স্বাধীনতা পূর্ব যে নাট্যদলগুলো ময়মনসিংহে গড়ে উঠেছিলো কালের স্রোতে তা হারিয়ে গেেেছ, শুধু রয়ে গেছে তাঁদের নাট্যচর্চার গৌরবময় উজ্জ্বল ইতিহাস যা এখনো বর্তমান নাট্যকর্মীদের প্রেরণার উৎস। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের ফলে বিশেষ করে রাজধানীর বাইরে মফম্বল জেলাগুলোতে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড কিছুটা গতি হারায়। তদুপরি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, নাট্যচর্চার জন্য প্রশাসনিক ভাবে যে সুযোগ-সুবিধা থাকা প্রয়োজন তা খুবই সীমিত থাকায় এবং সময়ের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় সখের বশে যারা নাট্যচর্চায় জড়িত হয়েছিলেন সংসার জীবনের কঠিন বাস্তবতায় এখন আর নিজেদের এই অঙ্গনে ধরে রাখতে পারছেন না। ফলে কোন কোন নাট্যদল একেবারেই ঝিমিয়ে পড়েছে আবার কোন কোন দল কালের গর্ভে নিমজ্জিত হয়েছে। কিন্তু ঐ দলগুলোর সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ময়মনসিংহের নাট্যাঙ্গনের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে।
বর্তমান ময়মনসিংহে নাট্যচর্চার একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু টাউন হল মিলনায়তনটি সংস্কারের নামে দীর্ঘদিন ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পরে আছে। শিল্পকলা একাডেমী মিলনায়তনে আধুনিক সুযোগ সুবিধা না থাকায় সেটি ব্যবহার করা কষ্টকর। তবু সেখানেই চলছে নাটকের প্রদর্শনী।
সহিদ আমিনী রুমি
তরুন কবি সহিদ আমিনী রুমি মূলত একজন রাজনীতি কর্মী। গত নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য পদে প্রার্থী হয়েছিলেন এবং বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন। জেলা শহরের কবি বন্ধুদের সান্নিধ্যে এসে তারও ইচ্ছে হল কবি হবেন। চেষ্টা মানুষকে বদলে দেয়। আর তাইতো রুমী লেখেন-
ভরা পূর্ণিমায়ও
হাসনা হেনার কাছে যেতে নেই
শুভার্থীরা বলেছে এমনটি শতবার
হাসনা হেনায় বিষধর সাপ থাকবেই
এ শুধু সন্দেহ নয়; চাক্ষুষ…
কিম্বা যদি পড়ি
পাখি আঁকতে যেওনা
অযথা রঙ নষ্ট হবে
সাত রঙ দিয়ে তাকে রাঙানো যায় না
ওর বায়না হাজারো
রুমির এই কবিতা কতটা কবিতা তা নির্নয়ের ভার পাঠকের। আমরা তাকে পেয়েছি এখানের কবিদের আড্ডায়, যেখানে তিনি শুধুই কবিতা প্রেমী একজন হিসেবে ময়মনসিংহের সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে বলেন, কী বলবো ভাই, বীক্ষণই ছিল এইখানের সাহিত্যের প্রাণ। এখন সেইটা কেমন থিঁতিয়ে গেছে। ফয়েজ ভাইর এইখানে চায়ের দোকানে, কাজলভাইর প্রেসে আবার ঐ সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক কবি আনোয়ারা আনু আপার বাসায় কিম্বা বীক্ষণের অফিসে যাই কবিদের সাথে কিছুটা সময় কাটাতে। আমি কবিতা লিখি, বছর দু তিন ধরে কবিতা আমার ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে। তাই আমি চাই ময়মনসিংহের সাহিত্যচর্চাকে ঐক্যবদ্ধভাবে একটি প্রয়াস দিতে। যাতে আমাদের ঐতিহ্য আরো সম্মৃদ্ধ হতে পারে। এভাবে ভাগ হয়ে থাকলে এটা কোনোদিনই সম্ভব হবে না।