ফজল মোবারক : প্রান্তবাসী আত্মমগ্ন কবি
সৌমিত্র শেখর
সৃষ্টি বয়স সাপে নয়; শিল্প সাহিত্য তো নয়ই। কোন বয়সে সৃষ্টির প্রাণবন্যা দু-কূল ভাসিয়ে দেবে; ধ্যানস্থ ঋষির মতো যে, কখন তার ধ্যান ভাঙ্গা হবে অথবা গ্রিক ঞড়হরপ দৈববানীর মতো কখন গগন গর্জে শব্দ-বৃ নিনাদ করবে আমরা কেউ জানি না। রবীন্দ্রনাথ কি জানতেন, নিজে ষাট বছর অতিক্রম করার পর চিত্রকলায় মনোনিবেশ করবেন? সাহিত্যিক সত্যেন সেনের প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একান্ন বছর বয়সে। আবার কবি সমর সেন একাত্তর বছর বাঁচলেও নিজের আটত্রিশ বছর বয়সে কবিতা থেকে অবসর নিয়েছেন, আর কবিতা লেখেন নি বা বলা যায় কাব্যলক্ষ্মী ধরা দেয়নি তাঁর কাছে। ফলে ফজল মোবারক যে নিজের ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন, তাকে তির্যক দৃষ্টিতে দেখবার কোনো অবকাশই নেই। বরং ব্যতিক্রম ইতিহাস স্রষ্টা বহু গুনীদের কাতারে নাম লিখালেন তিনি। কবি ফজল মোবারকের স্বাতন্ত্র্য এখানে যে, তিনি প্রতি নিয়ত লিখছেন এবং গত প্রায় দুই দশকে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থসংখ্যা দুই ডজন অতিক্রম করেছে। গ্রন্থ প্রকাশের দিক থেকে কবির জন্য এটা কম আত্মশ্লাঘার বিষয় নয়।
ফজল মোবারক আত্মমগ্ন কবি। মিছিলের মুখ বা মিছিলে মুখ নেই তাঁর। তিনি প্রশান্তি সন্ধানী, প্রেম তাপিত। পাথরে কাঠিন্যের চেয়ে স্নিগ্ধ ঘ্রানই তিনি কল্পনা করেন, লোক অনুষঘোর সম্মিলনে আশাবাদী হয়ে ওঠেন :
‘বাউলের একতারা হাতে
সুরে সুরে ছুঁয়ে যাই বেদনার ঘাট;
চোখের তারায় ভাসে
দারুচিনি দ্বীপ।’
দুঃখ বা বিপন্নতার মধ্যেও আশা জাগালিয়া কবির হৃদয়। তাই দ্বীপের দেখা সহজেই পেয়ে যান তিনি। প্রেমের উদ্দীপনা আছে তাঁর কবিতায়, বিকলতা নয়। প্রেমে বুঁদ হয়ে সময় ও সমাজ থেকে পালিয়ে যাননি কবি। তিনি কবিতায় মিছিল আনেন নি সত্য, কিন্তু সমাজ সচেতনা তাঁর কবিতায় নেই, একথা বলা যাবে না। বরং তিনি বিরূপ সয় ও বিকট সভ্যতাকে অপূর্ব বাণীময়তায় ফুটিয়ে তুলেছেন কবিতায়। তাঁর সমকালীন অর্থাৎ নব্বইয়ের কবিকূল যেখানে উত্তরাধুনিকতার নামে নিজের সময় থেকে পলায়নে ব্যস্ত সেখানে কবি ফজল মোবারক লিখলেন:
‘শতাব্দীর সভ্যতার সবকটি শবাধার শনাক্ত করেছি; অপঘাতে মৃত্যু সকলের। নিষাদ বাসে আছে বিনাশী বন্যায়। সুরতি অট্টালিকার অদৃশ্য ফাটলে, ঘাতক ঘুনপোকা ঘোরা ফেরা করে। এখানে বাতাসও সংক্রামিত মৃত্যুর ছোবলে। নির্ভেজাল জোছনাও ছোঁয়াচে ভাষণ; আঁধেরের গায়ে গন্ধ মহামারীর! সূর্যের কিরণে উপ্ত বিদেশী ভাইরাস!’
(-তৃণমূলে তীরন্দাজ)
কবি এথেকে পরিত্রাণ চেয়েছেন, তিনি কামনা করেছেন চাঁদ-ছোঁয়া নীল জোৎসা। মনের ময়ূর তাই তাঁর পেখম মেলে, তিনি সর্বদা নির্মাণ করতে াকেন আশাপ্রদ সময়। বাণিজ্য র্অনীতির এই যুগে সবই যখন কেন্দ্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তখন প্রান্তবাসী কোনো শুভবোধ সম্পন্ন কবি যতোই শুদ্ধ-সুন্দর পৃথিবী ও ভবিষ্যতের কল্পনা করুন না কেন, সেই কল্পনারেখা খুবই ম্লান মনে হয়। অথচ ফজল মোবারকের কবিতায় যে শব্দ চেতনা, বোধের যে গভীরতা, প্রকাশের যে আকুলতা তা কেন্দ্র থেকে প্রান্তে রশ্মির গতি নিয়ে বিচ্ছুরিত গওয়ার মতো, সে যোগ্যতা এই কবির আছে। তিনি অমর হতে পারেন, মানুষের হৃদয়ে আমন নিয়ে কালকে জয় করে কালোত্তীর্ণ হতে পারেন। অথচ আলোচনার অভাবে, যোগ্য বিশ্লেষণ না হওয়ায় লোকচুর আড়ালেই রয়ে গেলেন এই প্রান্তবাসী আত্মমগ্ন কবি। আত্মপ্রাচারে বিমুখ কবি ফজল মোবারক নীরবে ঋষির মতো কবিতার ধ্যানে মগ্ন। তাঁর অন্তরে শিল্পিত দহনঃ ‘বুনোগন্ধ ময়ূরের/প্রণয় পেখম/ময়ূরীর বুকে তোলে/শিল্পিত দহন! এই শিল্পিত দহনে কবি ফজল মোবারক মহামূল্যবান সবর্ণে পরিণত হোন, সর্বকালে সমাদর পাবেন যিনি।
জন্ম ১০ অক্টোবর ১৯৪১। ষাটের দশকের এই কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ পাথরের ঘ্রাণ’ প্রকাশিত হয় ৯০ দশকে। এ পর্যন্ত তার ২৫ খানা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এবং অতি সম্প্রতী খুলনার একটি প্রসিদ্ধ প্রকাশনী থেকে তাঁর আরও দুটি গ্রন্থ মুদ্রিত হয়েছে বলে জানা গেছে।