এ ব্যাপারে বরিশালের জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন হায়দার বলেন, আমাদের উচ্ছেদ অভিযান চলমান আছে। আগৈলঝাড়ায় এই মূহুর্তে উচ্ছেদ অভিযান চলছে। পর্যায়ক্রমে অন্যত্রও অভিযান চলবে। তবে পাউবি ও বিআইডব্লিউটিএ মূল বিষয়টি দেখে। তারা যখনই প্রয়োজন মনে করবে আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। সীমানা পিলার বিষয়টিও আসলে তাদের এখতিয়ারে।
প্রায় ২২শত দখলদারের হাতে বন্দী বরিশালের নদী; রক্ষায় প্রয়োজন পৃথক মন্ত্রণাল
আরিফ আহমেদ
নদী দখল ও নদী দূষণ নিয়ে কথা বলতে গেলেই দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতার চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাংলাদেশের সর্বত্র। সিটি মেয়র বলেন, ডিসি জানেন, ডিসি বলেন পাউবি ও বিআইডব্লিউটি উদ্যোগ নিলেই আমরা সহযোগিতা করবো। আর বিআইডব্লিউটি তাকিয়ে আছেন জেলা প্রশাসক এর নির্দেশনার দিকে। এরপর আছে ভূমি ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। সবাইকে সমন্বয় করে কাজ সম্পন্ন করা যেমন সম্ভব নয়। তেমনি অসম্ভব নদী দখল মুক্ত রাখা।
সম্প্রতি দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল জেলায় এমনটাই ঘটেছে সরেজমিন পরিদর্শনে। এখানে জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী বরিশাল জেলায় দখলদার ২১’শ ৪৮ জন। এর মধ্যে বরিশাল সদর উপজেলায় ২৯৩ জনের মধ্যে কীর্তনখোলা নদী দখলকারীদের সংখ্যাই ১২৩ জন। জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দখলকারী আগৈলঝাড়া উপজেলায়। ওই তালিকায় উপজেলায় ১ হাজার ৮২ জন দখলকারীর নাম পাওয়া যায়। গৌরনদী উপজেলার অবৈধ দখলকারীদের সংখ্যা ২৭৩ জন। বাকেরগঞ্জ উপজেলায় ১৮৬ দখলদার চিহিৃত করা হয়েছে। মুলাদী উপজেলার ১০৯ জন দখলদার রয়েছে। বানারীপাড়া উপজেলার মোট দখলদারদের সংখ্যা ৭৩। উজিরপুর উপজেলার দখলদারদের সংখ্যা ৫৯ জন। মেহেন্দিগঞ্জে অবৈধ দখলকারীদের সংখ্যা ৭৩ জন।
বরিশালে কীর্তনখোলা নদী থেকে শুরু করে জেলার ২৩টি নদীর দুপাড় দখল করে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মান করেছেন ক্ষমতাসীন দল থেকে শুরু করে বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত ইসলামীসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রভাবশালী নেতারা। আর তাদের মদদে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, আইনজীবী, শিক্ষক. শ্রমিকসহ ছোটবড় সংগঠনের নেতৃবৃন্দও নদী দখলে বড় ভূমিকা রাখছে।
বছর যেতে না যেতেই যে যার মত করে দখলদারিত্ব বাড়িয়েই চলছে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। আর তাদের দাপটের কাছে অসহায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। নদীর পাড় দখলের অভিযোগ রয়েছে খোদ সরকারের বিরুদ্ধেও।
এ জেলায় সাধারণ মানুষ ও বিশিষ্টজনের মধ্যে ইতিমধ্যে দাবি উঠেছে সিএস মৌজা ম্যাপ অনুযায়ী কীর্তনখোলা নদীর প্লাবন ভূমি সুরক্ষায় তীর ভূমি (ফোরসোর) এলাকায় স্থায়ী সীমানা পিলার স্থাপন এবং অবৈধ দখলদারদের তালিকা অনুযায়ী উচ্ছেদসহ জরিমানা আদায় করা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর সমন্বয়কারী রফিকুল আলম বলেন, বৃটিশ শাসনামলে ১৮০০ সালের দিকে ডিস্ট্রিক কালেক্টর হেনরী বেভারেজ এর উদ্যোগে বরিশাল শহর কীর্তনখোলা নদীর ভাঙ্গন থেকে রক্ষায় বাঁধ নির্মান করেন। কালের বিবর্তনে ওই বাঁধের উপর সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। যা নগরীর বাঁধ রোড বলেই পরিচিত। বাঁধ রোডের নদীর সংলগ্ন এলাকায় চর পড়তে শুরু করলে তা না কেটে কিছু প্রভাবশালীদের ইশারায় নদী থেকে বালু তুলে চরের জমি বাড়ানো হয়। যেখানে পোর্টরোড থেকে স্টেডিয়াম হয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস পর্যন্ত বিস্তৃত এ রোডটি। লম্বালম্বি প্রায় দুই কিলোমিটার এবং কীর্তনখোলা নদীর পাড় পর্যন্ত চওড়াভাবে সর্বোচ্চ এক কিলোমিটার এবং সর্বনিম্ন আধা কিলোমিটার এলাকা বহু আগেই দখল হয়ে গেছে। এখনো চলছে দখলদারিত্ব।
এছাড়া বরিশাল নগরী ঘিরে রাখা কীর্তনখোলা নদীর নগরীর প্রান্তে আশির দশকে ২৩ একর জমি নিয়ে জেগে ওঠে রসুলপুর চর। এরপর যে দল ক্ষমতায় এসেছে সে দলের প্রভাবশালী নেতাকর্মী ও সমর্থক চর সংলগ্ন নদী দখল করে সৃষ্টি করেছে কৃত্রিম বড় চর। তাদের সাথে রয়েছে রাজনৈতিক পরিচয়ধারী প্রভাবশালী নেতারা। ২৩ একর চর এখন ৫০ একরে পরিণত হয়েছে। আর সেখানে বহুতল ভবন থেকে শুরু করে মাছের ঘের, মুুরগীর ফার্ম, বালুর ব্যবসা, ডকইয়ার্ড এবং ছোট ছোট ঘর করে তা ভাড়া দেয়া হয়েছে। এমনকি প্লট আকারে বিক্রি করা হচ্ছে সেখানকার জমিও।
এভাবে কীর্তনখোলা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে জেগে ওঠা মোহাম্মদপুর চর, দপদপিয়ার চর, কর্ণকাঠী চর, পলাশপুর চর, খোন্নারের চর এবং চর বাড়িয়ার চর একইভাবে বৃদ্ধি করা হয়। খোন্নারের চরে রয়েছে দু’টি ইটভাটা। প্রশাসনের কঠোরতা না থাকায় চর ছাড়াও বিভিন্ন নদীর তীর দখল করে নির্মিত হচ্ছে পাকা স্থাপনা। যার অন্যতম উদাহরণ সিটি এলাকার মুক্তিযোদ্ধা পার্ক থেকে ত্রিশ গোডাউন এলাকা। অবৈধ ঘর তুলে এখানে বেদখল হয়ে আছে প্রায় ৫ কিমি পাড় এলাকা।
বরিশাল বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬০ সালে বরিশাল নদীবন্দর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কীর্তনখোলা নদীর পানির স্তর থেকে স্থলভাগের দিকে জমির ৫০গজ পর্যন্ত বিআইডব্লিউটিএ’র। সে অনুযায়ী নৌ-বন্দরের উত্তর ও দক্ষিণে প্রায় ৩৭একর জমি বিআইডব্লিউটিএর। তবে ওই জমিতে সীমানা প্রাচীর না থাকায় বিভিন্ন সময়ে ভূমিখেকোরা এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা প্রভাবশালীরা দখলে নিয়ে গড়ে তুলেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বসতঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা। রসুলপুর চরের ৮একরেরও অধিক জমি এবং জেলখাল থেকে এপিবিএন দপ্তর পর্যন্ত কীর্তনখোলা তীরের ২৮ একর জমির মধ্যে এক তৃতীয়াংশ এখন বেদখল হয়ে গেছে।
ভূমিহীনদের সংগঠন কৃষক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) এবং বরিশাল জেলা সভাপতি হারুন ভান্ডারী বলেন, ২০২০ সালে কীর্তনখোলা নদীর তীর থেকে শুরু করে জেগে ওঠা চর দখলের সাথে জড়িতদের তালিকা তৈরী করে বিভিন্ন দপ্তরে প্রেরণ করা হয়। ওই তালিকায় ৩১ জন প্রভাবশালী ভূমিদুস্যর নাম উল্লেখ করে তাদের ঠিকানাও দেয়া হয়। যার আজ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি সংশ্লিষ্ট দপ্তর। আর অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে কোন অভিযান না থাকায় প্রতিনিয়ত দখলকারী বাড়ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
হারুন ভান্ডারী আরো বলেন, দখল দারিত্বের সাথে জড়িত রয়েছে খোদ সরকারও। বরিশাল নগরীর বেলতলা এলাকায় নদীর তীরবর্তী স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে সারফেজ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। যা এখন ভাঙ্গনের মুখে রয়েছে। নদীর তীর ঘেষে সিটি কর্পোরেশনেরর নির্মিত মুক্তিযোদ্ধা পার্কও নদী দখল করে করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বরিশাল জেলার বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এতে করে নদীর যেমন ক্ষতি হচ্ছে। একইভাবে সরকারও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বলে জানান এই ভূমিহীন নেতা।
নদী-খাল বাঁচাও আন্দোলন এর সদস্য সচিব এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে যা কিছু সবই অবৈধ। আর এর বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান না থাকায় প্রতিনিয়ত দখলদার বাড়ছে। এতে করে সংকুচিত হয়ে পড়ছে কীর্তনখোলা নদী। তিনি অনতিবিলম্বে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ এবং তাদের তালিকা করে সামাজিকভাবে বয়কট করার দাবি জানান।
এদিকে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ ফারুক আহমেদ বলেন, আসলে নদী শাসন পুরোটাই জেলা প্রশাসনের অধীন। তাদের মাধ্যমেই অভিযান পরিচালিত হয়। এছাড়া বিআইডব্লিউটিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্ব রয়েছে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে। সে ক্ষেত্রে কোনভাবে সিটি কর্পোরেশনকে প্রয়োজন হলে, আমাদের সহযোগিতা চাইলে শতভাগ সহযোগিতা করার জন্য আমরা প্রস্তুত।
বিআইডব্লিউটিএর বরিশাল বন্দর ও পরিবহন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দখলদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে। এ জন্য তালিকা প্রনয়নের কাজ শেষ হযেছে। এখন জেলা প্রশাসনের সাথে যৌথ জরীপের কাজ করোনার কারণে শেষ হয়নি। যৌথজরিপ শেষ হলেই অবৈধ দখলদারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ ও একই সাথে সীমানা পিলার স্থাপনের কাজও করা হবে।
বরিশালে বাপা’র সমন্বয়কারী রফিকুল আলম বলেন, নদীর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ এবং নদী রক্ষায় বাপার ২৩টি সুপারিশমালা তাদের হাতে রয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে – উচ্চ আদালতের রায়ে সিএস মৌজা অনুযায়ী কীর্তনখোলা নদীর প্লাবন ভূমি সুরক্ষা (জোয়ারের সময় যে পর্যন্ত নদীর ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে)। এরপর তীর ভূমি ফোরসোর এলাকা রক্ষা (ঢেউ আছড়ের পড়ার পর থেকে ৫০ ফুট পর্যন্ত তীর ভূমি এলাকা, যাকে বলা হয় ফোরসোর)। জেলার সকল নদী, শাখা নদী সিএস মৌজা ম্যাপ অনুসরন করে ডাটাবেজ তৈরীসহ নদী সিস্টেমের উন্নয়ন ও কার্যকর ব্যবস্থাপনার জন্য ডাটাবেজ করা। সিএস মৌজা ম্যাপ অনুযায়ী নদীর তীরবর্তী স্থানে স্থায়ী পিলার স্থাপন ও দখলকারীদের উচ্ছেদ করে তাদের নিকট থেকে জরিমানা আদায়।
লঞ্চ মালিক ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সমন্বিত উদ্যোগে ক্যাপিটাল ড্রেজিং এর মাধ্যমে নদীর সাথে শাখা নদী ও খালের উৎসমুখ সচল করার উদ্যোগ নিতে হবে। নদী-খাল দখল ও দূষন রোধে বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন। সরকারের ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ পরিকল্পনায় নদীর দু’পাশের সীমানাকে সংকোচিত করে ভূমি বের করে নদীতে আরো গভীর করে খনন অযৌক্তিক হওয়ায় তা বাতিল করে নদীকে তার মতো প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। জাতিসংঘ পানি প্রবাহ আইন-১৯৯৭ অনুস্বাক্ষর করার মাধ্যমে উজানের নদীর পানির অববাহিকা ভিত্তিক সংকট নিরসন এবং জয়েন্ট রিভার কমিশনকে স্বক্রিয় করার মাধ্যমে উজানের অববাহিকা ভিত্তিক পানির ন্যায্য হিসাব আদায়ের মাধ্যমে পানি প্রবাহ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।
২০১৯ সালের ২৩ মে বরিশালে অবৈধভাবে দখল হওয়া নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়-জলধারার তালিকা চেয়ে বরিশালের জেলা প্রশাসক বরাবরে চিঠি প্রেরণ করেণ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান। এরপর অবৈধ দখলদারদের তালিকা প্রেরণ করেন জেলা প্রশাসক।
যতদূর জানা যায়, ছোট-বড় মিলে দেশে নদীর সংখ্যা দুই সহস্রাধিক। অথচ নদী দেখভাল করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো মন্ত্রণালয় নেই। নদীর অংশবিশেষের সঙ্গে যুক্ত এখানের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। নদী রক্ষায় তাই এই মন্ত্রণালগুলোর কার্যকর সমন্বিত উদ্যোগ আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। নদীর সামগ্রিক কাজের তদারকির জন্য একক কোনো মন্ত্রণালয় না থাকায়, সমন্বয় করে করে নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনার কাজ করতে হয়। যে কারণে আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত আমাদের নদীগুলো।
দেখা যায়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীগুলোর ক্ষতি করার অন্যতম প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। গুটিকয় কর্মকর্তা ছাড়া অন্য সবাই এখানে ফুলেফেঁপে উঠেছেন। কিন্তু নদীর সুরক্ষা নেই। নদী খনন করার নামে তাঁরা দেশের নদীগুলোকে খালে পরিণত করছেন। নদী খননে সিএস নকশাও আমলে নেওয়া হচ্ছে না। এমনও ঘটেছে, নদীর প্রস্থের তিন ভাগের এক ভাগ খনন করছে এবং মাটি নদীর ভেতরেই ফেলছে। জেলা শহরে এ রকম অনেক নদী খনন চোখে পড়ে । আবার নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশের সব নদী নেই। নামের মধ্যেই বোঝা যাচ্ছে তারা মূলত পরিবহনকেন্দ্রিক বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে নদীর তদারক করে। সব নদী রক্ষা করার কাজ তাদের নয়।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় নদীকে ঘিরে জলবায়ু পরিবর্তন হলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না এবং দূষণে যাতে ক্ষতি না হয়, সেসব দেখার দায়িত্ব তাদের। নদীর পানির মান ঠিক আছে কি না, সেটিও পরীক্ষা করে এ মন্ত্রণালয়। তাই বলে নদী রক্ষার কাজ এ মন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে করা কঠিন। আর ভূমি মন্ত্রণালয় কি আদৌ নদীবান্ধব? দেশে ভূমি দেখাশোনা করার দায়িত্ব ভূমি মন্ত্রণালয়ের। নদীর ভাঙন-দূষণ-দখলের মাধ্যমে নদীর যখন সর্বনাশ রচিত হয়, তখন এ মন্ত্রণালয়ের এগিয়ে আসার কথা। কিন্তু এ মন্ত্রণালয় তখন ব্যস্ত নদীকে বিল হিসেবে ইজারা দিয়ে নদীর অস্তিত্বই শেষ করে দিতে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ভূমি সহকারী কর্মকর্তারা নিয়োজিত। স্থানীয়ভাবে জেলার সব ভূমি দেখাশোনার দায়িত্ব এসব কর্মকর্তার। মাঠপর্যায়ের এসব কর্মকর্তা নদীর প্রতি আন্তরিক হলে এবং প্রচলিত আইন প্রয়োগে কঠোর হলে নদীর দখল-দূষণ বন্ধ হতো। কিন্তু তাঁরাও এ কাজে আন্তরিক নন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও যৌথ নদী রক্ষা কমিশনও এ বিষয়ে যথেষ্ট উদাসীনতার প্রমাণ রেখেছেন বিগত সময়ে। আমাদের দেশে তালিকাভুক্ত অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪টি হলেও বাস্তবে এই সংখ্যা শতাধিক। মিয়ানমারের সঙ্গে তিনটি নদী বাদ দিলে আর সবগুলোই ভারতের সঙ্গে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও যৌথ নদী রক্ষা কমিশন এ নদীগুলোর ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা আজো দেখাতে পারে নাই। ফলে ভারত থেকে আগে যে পরিমাণ পানি আমরা পেতাম, বিভিন্ন নদীর পানি একতরফা প্রত্যাহারের কারণে সেই পানির প্রাপ্তি আমাদের অনেক কমে গেছে। আর রয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও একটি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।
এ বিষয়ে নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও অধ্যাপক
তুহিন ওয়াদুদ বলেন,
নদী রক্ষা কমিশনের কার্যপরিধিতে ১২টি বিষয়ে শুধু সুপারিশ করার কথা বলা হয়েছে। গত বছর সারাদেশে সব নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ থেকে যে রায় দেওয়া হয়েছে, সেখানে এ কমিশনকে নদীর অভিভাবক ঘোষণা করা হয়েছে। আইন পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত এ কমিশন নদী রক্ষায় পূর্ণাঙ্গ সক্ষম প্রতিষ্ঠান হতে পারবে না। তবে কমিশন যেভাবে এগোচ্ছে, এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে হয়তো নদীর দেখভাল করার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান আমরা পেতে পারি।
তিনি আরে বলেন, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। নদী নিয়ে তাদের গবেষণা কিংবা নদী সুরক্ষায় তাদের কোনো পরামর্শ কিংবা নির্দেশনা আমরা পাই না।
নদীর সঙ্গে যুক্ত অনেক মন্ত্রণালয়, কিন্তু নদী রক্ষা করার দৃষ্টান্ত কোনো মন্ত্রণালয় করতে পারেনি। যতদিন পর্যন্ত নদী রক্ষা করার জন্য স্বতন্ত্র কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে না, তত দিন নদীগুলোর সরকারি তদারকি আমরা পাব না। ততদিন পর্যন্ত জবাবদিহিও তৈরি হবে না। মনে হবে অনেকেই আছে, বাস্তবে কেউ নেই।