পুস্তক আলোচনা/ এই পথে আলো জ্বেলে / মুস্তাফির রনি

অতিথি লেখক

Sharing is caring!

পুস্তক আলোচনা/ এই পথে আলো জ্বেলে / মুস্তাফির রনি


বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ, যে দেশ সৃষ্টির নৈপথ্যে রয়েছে একজন কিংবদন্তির সংগ্রাম। যার জীবন শুরু হয়েছে সংগ্রাম দিয়ে আর শেষ ও হয়েছে সংগ্রামে! যে
দেশের মহা আখ্যানের সূচনা হয় এক বর্ষার বৃষ্টিতে যেন তা শেষ হয়েছে ফাগুনে সমারোহতে। যাঁর মূল কেন্দ্রে আবর্তিত হয়েছে মহান এক পুরুষ। যার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৬২ থেকে ১৯৬৯ সাল সময়পরিসরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের মাটিতে চলমান রাজনৈতিক-সামাজিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত এ উপন্যাসের কাহিনি। লেখকের যারা ভোর এনেছিল,উষার দুয়ারে, আলো-আঁধারের যাত্রীর পরবর্তী খণ্ড এই উপন্যাস ‘এ পথে আলো জ্বলে’।
উপন্যাসের শুরুটা ১৯৬২ সালের আষাঢ়ের এক সকালের স্মৃতিতে ধানমন্ডি ৩২ নাম্বার সড়কের ৬৭৭ বাড়ির এক জলসার চিত্র। তারপর যেখানে উঠে এসেছেন ৬২র ছাত্র আন্দোলনের নায়কেরা। ৬৬’র ৬ দফার আদ্যপ্রান্ত, রাজনীতির হালচাল, বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমেদ সহ রাজনৈতিক বন্দীদের কারাগারের জীবন, এক বিদ্রাহী নারীর দৈনন্দিন সংগ্রাম, অজস্র যাত্রা। কি অবিচল, ক্ষুরধার যিনি কঠিন বিপদেও অবিচল থাকেন।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবি উত্থাপন, তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠা আন্দোলন, তাঁর গ্রেপ্তারের পর গ্রেপ্তার হওয়া, সর্বংসহা সহধর্মিণী ফজিলাতুন্নেছা রেনুর সংগ্রাম, শেখ হাসিনার সক্রিয় ছাত্ররাজনীতিতে আসা, মওলানা ভাসানীসহ বামপন্থীদের ভূমিকা, জেলে তাজউদ্দীনের জীবন, পিতার সান্নিধ্যবঞ্চিত শেখ মুজিবের ছোট ছেলেমেয়েদের দুঃখ-বেদনা আনিসুল হক স্যার এমনভাবে তুলে ধরেছেন যে পড়তে গিয়ে মনে হবে বর্ণিত ঘটনাগুলো চোখের সামনে দিব্যি ঘটে চলেছে। এই পৃষ্ঠা পড়তে গিয়ে কিছুক্ষণ থেমে থাকলাম, অশ্রুতে বিমোরিত হলাম, আহ্!আমাদের কি কষ্টের ইতিহাস!
ঘটনার মুখে শেখ মুজিব ‘মাটিতে বসে পড়লেন। বাংলার ধূলিমাটি তিনি স্পর্শ করলেন পরম মমতায়।’ তারপর ‘বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, “আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি।”
দেখতে দেখতে এসে যায় আটষট্টি সাল। শুরু হলো কথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। আগরতলা মামলায় জড়ানো হলো জাতির এই কিংবদন্তিকে, কারাগারে থাকতে হলো দীর্ঘদিন। এই ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষিতে ফুঁসে উঠল ছাত্রসমাজ। তারা সারা দেশে গড়ে তুলল ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’। শুরু হলো মিছিল। সংগ্রাম। সৃষ্টি হলো গণজোয়ার। এই সংগ্রামে, মিছিলে গেল কত প্রাণ!
১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যখন জেল কর্তৃপক্ষের পদস্থ আঞ্চলিক সেনাপ্রধান মোজাফফর আহমেদ এসে বলেন, তাঁকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। সন্দেহ হয় মুজিবের। মাথা উঁচু করে বাইরে বেরিয়ে দেখতে পান সামরিক বাহিনীর গাড়ির বহর। তিনি বঙ্গবন্ধুকে
বলছেন ‘আপনি প্যারোলে মুক্তি নেন।’ তিনি বললেন, ‘আমার নাম মুজিবুর রহমান। আমি কথার নড়চড় করি না।’ তার এই অনুপ্রেরণার মূলে রয়েছে তাঁর স্ত্রী রেণু। বারবার চোখ ভিজে আসছিলো কতোখানি শক্তিমান আর বিদ্রোহী সে অনিন্দ্য নারীটি। যিনি এত্ত বিপদের পর ও স্বামীকে সাহস, অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন।
প্রিয়তম স্বামী জেলে অথচ তিনি কষ্ট লুকিয়ে দৃঢ চিত্তে এগিয়ে নিচ্ছেন একটি দেশের মানুষকে নিয়ে।
কারাবন্দী বাবাকে লেখা রেহানার আবেগঘন চিঠি থরথর করে দিবে প্রতিটি পাঠকের হৃদয়কে,চিঠির কথাগুলো নিয়ে যাবে হৃদয়ের গভীরতায়! অশ্রুতে ভাসবে পাঠকের চোখ!
“আব্বা আপনার কথা খুব মনে পড়িতেছে। এবার কি আমি আপনাকে প্রথম ফুল দিতে পারিবো না? যদি ১৭ মার্চ আমাদেরকে দেখা করতে দেয়, তাহা হইলে অবশ্যই আমি আপনার জন্য বেলি ফুল নিয়া যাইব।”
দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর শেষে শেখ মুজিবের নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হলো , সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তরফ থেকে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধীতে ভূষিত করা হয় তাকে।
এই উপন্যাসে উঠে আসলো আরেক কিংবদন্তি তাজউদ্দীন আহমেদের সংগ্রামের কথা, যার সংগ্রামের পিছনের আরেক নারীর অবদান লিলি তথা জোহরা তাজউদ্দীনের সংগ্রাম।
এই উপন্যাসে উঠে আসে শেখ হাসিনার রাজনীতির উত্থান, তাঁর বিয়ে; কবি নির্মলেন্দু গুনের বাউন্ডুলে জীবন, কবিতার আকুতি।
.
মিছিলের স্লোগানে যখন সাথে জনতার কন্ঠে রব উঠে “আয়ুবশাহির গদিতে, আগুন জ্বালো একসাথে। জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।” তখন মনে হয় আমিই যেন মিছিলে শামিল। মাকে লেখা মতিউরের আবেগঘন চিঠি, “মা, মিছিলে যাচ্ছি। যদি ফিরে না আসি, মনে করো মা তোমার ছেলে বাংলার মুক্তির জন্য শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য জীবন দিয়েছে।” এই চিঠি যেন এক সন্তান নিশ্চিত মৃত্যু যেন ও মরতে যাচ্ছে সে পথে। কারণ- সে পথ ভালোবাসার পথ, দেশের পথ, ন্যায্যতার পথ,অধীকার আদায়ের পথ,এই কখনো থেমে থাকে না কারণ এই পথেই আলো জ্বলে!
চিঠিটি পড়ে অশ্রু সংবরণ করতে পারলাম না।
এভাবে দুঃখ বেদনায় বর্ণিত হয়ে ‘এই পথে আলো জ্বলে’ উপন্যাস।
পাঠ সমালোচনা ও মন্তব্যঃ
বঙ্গবন্ধুর কারাগারের দিনলিপি। ত্রিকালদর্শী ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী একে অপরকে বলছে সেই কাহিনী। দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি শেখ মুজিবের ভালোবাসা, ভালোবাসার টানে মিছিলে শামিল হওয়ার ঘটনা এবং কারাগারে শেখ মুজিবুর মনবল যেভাবে নিক্ষুত ও সূঙখানো ও সাবলীল ভাবে লেখক, তুলে ধরছেন তা সত্যি প্রশংসানীয় আমাদের করুণ ইতিহাসের বইয়ের প্রতিটি লাইন যেন ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো কল্পনায়। আমি যেন তাদের সামনেই বসে আছি। আমার বিশ্বাস প্রতিটি পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে এই বই, বইয়ের চরিত্রে আবেগপ্রবণ হয়ে যাবে সবাই।
বইয়ের শিক্ষাঃ
০১.নিজের জীবন থেকে ও মাতৃভূমিকে বেশি ভালোবাসা।
০২দেশ রক্ষায় ঝাপিয়ে পড়া।
০৩.যেকোন বিপদে মনোবল না হারিয়ে সাহস অনুপ্রেরণায় এগিয়ে যাওয়।
০৪. যেকোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বুদ্ধি ও বিচুক্ষণতার সাথে জাস্টিফাই করা।
০৫.সততা আর ন্যায্যা অধীকারে জন্য নিজেকে সংগ্রামে লিপ্ত করা
বই সম্পর্কিত তথ্য 📖
বইয়ের নামঃ এই পথে আলো জ্বলে
লেখকঃ আনিসুল হক
প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারী ২০১৯
প্রকাশনীঃ প্রথমা।

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!