পটুয়াখালীর সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড
মুজাহিদুল ইসলাম প্রিন্স
সংস্কৃতি জীবনের প্রতিচ্ছবি। সমাজের বিক্ষিপ্ত অগোছালে কথাগুলোই শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপিত হয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এখন শুধু বিনোদনের বিষয়ই নয়, প্রতিবাদের ভাষাও বটে। বিষয়টিকে আরও ব্যাপকভাবে ব্যাখ্যা করলে বলা যায় এটি শুধু সমাজের নান্দনিকতার পরিচয়ই বহন করে নাা বরং সমাজ কাঠামো, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্ম এবং শিক্ষা ব্যবস্থার পরিপুরক হিসেবেও কাজ করে। সংস্কৃতিকে আমরা আবহমান কালের স্্েরাতধারার সমষ্টি ও কল্পনার পরিশীলিত একটি রূপ হিসেবেই দেখি।
দেশের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ যৎসামান্য। রাজধানী শহরসহ বড় বড় শহরগুলোতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে কিছু মানুষের অংশগ্রহণ চোখে পড়লেও জেলা শহরগুলোতে অংশগ্রহণের হার খুবই কম। পাশাপাশি বিগত একশ বছরে পটুয়াখালীর সাংস্কৃতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই এ অঙ্গণে নারীদের অংশগ্রহণ ছিলোনা বললেই চলে। যদিও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে প্রগতিশীল পরিবারের কিছু নারী এ কার্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন।
১৯০১ সালে তৎকালীন পটুয়াখালী মহাকুমার সাংস্কৃতিক নাট্য প্রতিষ্ঠানরুপে জন্মলাভ করে পটুয়াখালী ‘ড্রামেটিক ক্লাব’। মোতাহার মিয়া, জ্ঞান ভূষণ দাস, জোয়াদুল করিম, ফণি ভূষণ দাশগুপ্ত, নলিনী রঞ্জন মজুমদার, বেচা ঠাকুর, নকুলেশ্বর ভট্টাচার্জ, সুখময় সমদ্দার এবং অন্যান্যদের উদ্যোগে ক্লাবটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৬ সালে সাংস্কৃতিক অঙ্গণে অনগ্রসর মুসলমানদের সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ‘মুসলিম আট রেনেসাঁ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়। আসাদুল হক, মোয়াজ্জেম হোসেন, এটিএম ওবায়েদুলাহ নান্নু মিয়া, কেবিএম শামসুল হক, আলী আশ্রাব, আঃ রাজ্জাক প্রমুখ ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় এ সংগঠনটি গড়ে ওঠে। তৎকালীন ছায়াবানী (বর্তমানে পুরাতন টাউন হল ) সিনেমা হলে নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত। এসব অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত শিল্পী আব্বাস উদ্দিন সহ সে সময়ের প্রথিতযশা অনেক শিল্পী অংশ গ্রহণ করতেন। এ সময়ে ‘ইয়াং ড্রামেটিক ক্লাব’ ‘মুকুল ফৌজ’সহ আরও কয়েকটি সংগঠনের আত্ম প্রকাশ ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৪৪-৪৫) তৎকালীন পটুয়াখালীর প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী প্রায়ত গোপাল দে এর পুত্র পবিত্র কুমার দে গ্রামোফোন রেকর্ডে প্রথম গান রেকর্ড করেন। নবাব পাড়ার আরেকজন প্রখ্যাত নাট্যশিল্পী প্রায়ত কাপ্তান বিশ্বাস প্রথম কলকাতার ছায়াছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৫২ সালে কবি খন্দকার খালেক, জলিল উদ্দিন আহমেদ, আবদুল করিম, আজাহার উদ্দিন আহমেদ, আবদুল আজিজ, সৈয়দ আশ্রাব প্রমূখ প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গের প্রচেষ্টায় আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘শহীদ স্মৃতি পাঠাগারের’। ১৯৫২ এর ভাষা শহীদদের স্মরণে এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম পাঠাগার। সে সময়ে শহরের অন্যতম সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র ছিলো শহীদ স্মৃতি পাঠাগার। স্বাধীন বাংলাদেশে পটুয়াখালীর প্রথম সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘উদীচীর’ জন্ম হয় ১৯৭২ সালে। ১৯৭৭ সালে সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ‘জেলা শিল্পকলা একাডেমী ’এবং ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জেলা শিশু একাডেমী ’। এ বছরই ‘জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ’ পটুয়াখালী জেলা শাখার আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৮২ সালে নির্মল কুমার দাশগুপ্ত, অতুল চন্দ্র দাস, মঞ্জু প্রমুখ ব্যাক্তি মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সুপ্তি’ খেলাঘর আসর। ১৯৮৫ সালে জন্ম নেয় ‘প্রতিভা’ শিল্পীগোষ্ঠীর। ঝন্টু দাস, অজিত চক্রবর্তী, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, চিম্ময় কর্মকার, আক্রাম খান প্রমূখ ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৮ সালে সৈয়দ মিজানুর রহমান, অধ্যাপক সুকুমার দত্ত, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রব আকন, সজলেন্দু দাস, গাজী মঈনউদ্দিন টারজান প্রমূখ ব্যক্তিদের উদ্যোগে ‘দখিনা খেলাঘর আসরের’ আত্মপ্রকাশ ঘটে। ’৯০এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দলনে গণমানুষকে সম্পৃক্ত করার জন্য পটুয়াখালী সরকারি কলেজের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিষ্ঠা করে ‘বিহঙ্গ’ সাংস্কৃতিক সংগঠনের। ১৯৯৪ সালে ‘নন্দন’ নামে আরও একটি সংগঠন কলেজে যাত্রা শুরু করে। একই সময়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে পটুয়াখালী ‘গণনাট্য ফোরামের’। ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীর বছর আত্মপ্রকাশ ঘটে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সুন্দরম’র। ফরিদুজ্জামান খান, মশিউদ্দিন টিপু, তৌফিকুর রহমান, এম নূরুল ইসলাম, রবিউল আমীন, আমিনুল ইসলাম টিটো, মুজাহিদুল ইসলাম প্রিন্স, হিরন্ময় কর্মকার, অনামিকা দত্ত, আঞ্জুমান আরা আঁখি, শারমিন সুলতানা নীতু, লিটন বণিক প্রমূখ ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পর সম্প্রতি সময়ে পটুয়াখালীতে আরও কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন কাজ শুরু করে যার মধ্যে ‘কলকাকলী সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন’ ‘গ্রামীণ শিল্পী গোষ্ঠী ’ ‘লোক সাংস্কৃতিক সংঘ’ উলেখযোগ্য।
বিভিন্ন সময়ে পটুয়াখালীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করতে যে সকল সংগঠন কিংবা ব্যাক্তিবর্গ কাজ করতে এসেছেন তারা অধিকাংশই স্থানীয় ভাবে কাজ করে খুশি থেকেছেন। জাতীয় প্রচার মাধ্যমে তারা কখনও খুব একটা কাজ করার সুযোগ পাননি। ব্যাক্তিগত ভাবে দু’একজন বেতারে কাজ করার সুযোগ পেলেও সংগঠনকে তারা সে পর্যন্ত পৌছতে ব্যার্থ হন। পটুয়াখালী সরকরি কলেজের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘নন্দন’ এম নূরুল ইসলাম রচিত ও নির্দেশিত নাটক ‘কুয়াকাটা’ এ অ লের সর্ব প্রথম অনুষ্ঠান হিসাবে বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রচার করে ১৯৯৮সালের ১৪ এপ্রিল। নন্দন এর আগে ১৯৯৬ সালে খুলনা বেতারেও একটি নাটক প্রচার করে। বরিশাল বেতার কেন্দ্র স্থাপনের পর পটুয়াখালীর অনেক সংগঠনই সেখানে মাঝে মধ্যে অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেলেও তা কখনই নিয়মিত রুপ লাভ করেনি।
পটুয়াখালীর মঞ্চ এক সময় নাট্য কর্মীদের পদচারণায় মুখর ছিল। সে সময় প্রায় প্রতি সপ্তাহে নাটক মঞ্চস্থ হত। স্থানীয় শিল্পীদের পাশাপাশি কলকাতা থেকে এবং পরবর্তীতে ঢাকা থেকে শিল্পী এনেও এখানে নাটক ম ায়ন হত। কালের আবর্ত্তে সেই নাট্যচর্চা হারিয়ে গেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে গ্র“প থিয়েটার চর্চা জোড়েসোরে শুরু হলেও পটুয়াখালীতে তার বাতাস লাগেনি। অনিয়মিত ভাবে কিছু সংগঠন নাটক নিয়ে কাজ করলেও তারা থিয়েটারকে নিয়মিত চর্চার দ্বারপ্রান্তে নিতে সক্ষম হননি। ১৯৯৬ সালে নাটকের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে পটুয়াখালীতে যাত্রা শুরু করে সুন্দরম নাট্য ম । গ্র“প থিয়েটার চর্চা এবং সম্মানীর বিনিময়ে নাটক প্রর্দশন সুন্দরমই এখানে প্রথম শুরু করে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্য উৎসব ২০০৪ এ সুন্দরম নাট্যম এম নুরুল ইসলাম রচিত ও মুজাহিদুল ইসলাম প্রিন্স নির্দেশিত লোকজ নাটক ‘কাজল লতার পালা’ ম ায়ন করে ব্যাপক প্রশংসা কুরিয়েছে। এর আগে ১৯৭৭ সালে নির্মল কুমার দাশগুপ্ত রচিত ও নির্দেশিত নাটক ‘ নন্দিত আলোকে এস ’ শিল্পকলার একটি উৎসবে পটুয়াখালীর প্রথম নাটক হিসাবে ঢাকায় ম স্থ হয়। একই উৎসবে পটুয়াখালীর ড্রামেটিক ক্লাব বাংলাদেশর সবচেয়ে পুরাতন নাট্য সংগঠন হওয়ার সুবাদে টিপু সুলতান নাটক করার সুযোগ পায়। নাট্য চর্চায় সফলতার জন্য সুন্দরম চিলড্রেন্স থিয়েটার ২০০৪ সালের মাঝের দিকে বাংলাদেশ পিপ্লস থিয়েটার এসোসিয়েশনে সদস্য পদ লাভ করে এবং প্রায় প্রতি বছর বাংলাদেশ পিপলস থিয়েটার আয়োজিত জাতীয় শিশু কিশোর নাট্য উৎসবে গৌরবের সাথে অংশগ্রহন করে যাচ্ছে। এ বাইরে ২০০২ সালে বঙ্গবন্ধু শিশুকিশোর মেলা এবং ২০০৬ সালে পটুয়া খেলাঘর আসর এবং অতি সম্প্রতি সুর বিহার,সাগরকন্য শিল্পাঙ্গনসহ আরো কয়েকটি সংগঠন তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছি।
ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে যে সব কর্মীরা পটুয়াখালীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছিলেন সময়ের স্রোতে তারা কেউ হারিয়ে গেছেন আবার কাউকে অস্বীকার করা হয়েছে। সংগঠনের প্রধান ব্যক্তিরা শোভাবর্ধনের জন্য কিংবা অন্য কোন প্রয়োজনে নারীদের ডাকলেও সংগঠনের ক্ষমতা কখনই নারীদের হাতে অর্পণ করেননি। ফলে একটি গান করা বা একটি নাটকে অভিনয় করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে নারীদের অংশগ্রহণ। পাশাপাশি সামাজিক প্রতিকূলতা বিচার করেও অনেক অভিভাবক তাদের কন্যা সন্তানদের এ অঙ্গণে কাজ করতে আসতে দিতে চাননা। প্রতিবেশীদের সমালোচনা ও ধর্মীয় গোড়ামীর কারণে অনেক নারীর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কাজ করতে পারে না। পটুয়াখালীতে মেয়ে শিশুদের কাজ করার ক্ষেত্রে প্রথমে খেলাঘর আসর এবং পরবর্তী সময়ে সুন্দরম নারী কর্মী তৈরির ক্ষেত্রে উলেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। বর্তমানে পটুয়াখালীর সাংস্কৃতিক অঙ্গণে হাতে গোনা কয়েকজন নারী কর্মী কাজ করনে তারা অনেকেই মনে করেন; এ অঙ্গণে নারীদের আরও বেশি সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। বিয়ের আগে অনেক নারী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকলেও বিয়ে পরবর্তী সময়ে তারা এ অঙ্গণ থেকে ছিটকে পড়েন। বিশেষ করে হিন্দু নারীরা ছোট বেলা থেকেই সাংস্কৃতিক অঙ্গণের সাথে জড়িত থাকেন কিন্তু বিয়ে পরবর্তী সময়ে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। নারীদের এ অঙ্গণ থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণ সমন্ধে ভিন্ন ভিন্ন মতামত পাওয়া গেছে। কেউ কেউ সাংসারিক ঝামেলাকে দায়ী করেছেন। কেউ সামাজিক সমস্যাকে প্রধান সমস্যা হিসেবে অভিহিত করেছেন। আবার অনেকে ধর্মীয় গোড়ামী ও নিজের আলসেমীকে এ অঙ্গণ থেকে পিছিয়ে পড়ার জন্য দায়ী করেছেন।
সবকিছুর পরেও সাংস্কৃতিক অঙ্গণে সকলের সম্পৃক্ততা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আলোকিত মানুষ তৈরি করতে অনেক অভিভাবক নিজের সন্তানকে এ অঙ্গণে নিয়ে আসছেন। নারীদেরও এ অঙ্গণে আসার এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে, সকলের মত একজন সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে এ আমারও প্রত্যাশা। আমরা চাই, দেশভক্ত.. আলোকিত নব প্রজন্ম, যাদের অনিবার্য সুফলে সমৃদ্ধ হবে বাংলাদেশ।
মুজাহিদুল ইসলাম প্রিন্স
সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠক
তথ্যসূত্র ঃ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, পটুয়াখালীর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সমস্যা ও করণীয়- আমিনুল ইসলাম
নির্মল কুমার দাশগুপ্ত, প্রবীন সাংস্কৃতিক কর্মী পটুয়াখালী।