নস্টালজিয়া ০১
আলমগীর রেজা চৌধুরী
চাচা মিয়ার দোকান থেকে বের হতে চোখে পড়লো কমলা রঙের স্নিগ্ধ বিকেল। বাঁ পাশে চলমান রাস্তা, নোমানদের বাসার সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছ। ঝিরঝির করে ওর চিরল পাতাগুলো কাঁপছে। সামনে বুড়া বাবার মাজারে লাল চাঁদোয়া।
ওরা আজকাল কেউ আসে না। কদাচিৎ আমার মতো হঠাৎ করে এসে চাচা মিয়ার দোকানের স্মৃতির উষ্ণ পরশ খুঁটে নিয়ে যার যার মেরুতে চলে যায়। থমকে দাঁড়িয়ে পুরনো জায়গাগুলো ভালো করে দেখে নেয়।
চাচা মিয়ার দোকানের ঘিঞ্জি পরিবেশ থেকে বের হয়ে একটু অন্যরকম মনে হলো। ওরা কেউ আসবে না। অথচ এক সময় ছিলো বিকেল গড়িয়ে এলে আমরা কয়েক বন্ধু মিলে চাচা মিয়ার এই টি-স্টলে বসে রাত দশটা পর্যন্ত চা খেতে খেতে জীবনকে উত্থান থেকে পতন, পতন থেকে উত্থানে নিয়ে যেতাম। হেঁশেলের গনগনে আগুন চোখে লাগতেই কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত বন্ধু আতা সরকারের গল্পের কথা মনে পড়ে যেতো। কি চমৎকার বর্ণনা দিয়েছিলো! আমি চাচা মিয়ার হেঁশেল দেখিয়ে বলতাম, ‘আতার আগুন।’ এই রকম এক জীবনের চরম মুহূর্তকে কেন্দ্র করে আমাদের রাস্তাগুলো ভাগ হয়ে গেলো। আমাদের কয়েক বন্ধুর দুরন্ত আবেগের সাথে মিশে থাকে চাচা মিয়ার দোকান।
ব্রহ্মপুত্রের জল এখন অনেক দূরে চলে গেছে। অনেক দূর। ওর বুক জুড়ে জেগে উঠেছে ধবল বালির চর। কলকল স্রোতধারার গতিবেগ শ্লথ হয়ে আসছে। তেমনি পরিবর্তিত হয়েছে এই শহরের মুখ। কিছুটা সময়ের ব্যবধানে পাল্টে গেছে জীবন প্রণালী। শুধু চাচা মিয়াকে মনে হলো ঠিক আগের মতো ক্যাশ বাক্সের ওপর হাত রেখে চারিদিক সুতীè দৃষ্টি নিয়ে তদারক করছে। বুড়া বাবার মাজারে আজকাল লোকজন আসে প্রচুর। গমগম করছে মানুষ। বাইরে সিন্দুকটায় যেখানে লেখা রয়েছে ‘এখানে ফেলুন’ একটা লোক টাকা ফেলতে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে আমার অনুভূতি অনেক পিছনে হেঁটে এলো।
রিনির একটা ছবি ভাসতে লাগলো। ওর দুরন্ত স্বভাব অনুভব করতে এক দৃশ্যমান দিন হাসনাহেনার হালকা সুরভির মতো মুহূর্তটাকে সপ্তবর্ণের ক্যানভাসে আটকিয়ে রাখলো পিছনে তাকিয়ে দেখার জন্য। সাহেব কোয়ার্টার পার্কে বসে গল্প করতে করতে সন্ধ্যে নামলো। আমি রিনি হেঁটে যাত্রা করলাম। এখন ঘরে ফেরার পালা। মফস্বল শহরে ল্যাম্পপোস্টে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। পাশ দিয়ে কলকল করে ব্রহ্মপুত্র বয়ে যাচ্ছে। নদীর ওপারে শম্ভুগঞ্জের পাটকলের বাতিগুলো এক আলোকিত স্বপ্নের বোধ হয়ে আমাদের মধ্যে ছায়া ফেলে। রিনির হাতে একটা শিউলি ফুলের মালা। তা থেকে একটু মিষ্টি গন্ধের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এই মুহূর্তে আমরা পরস্পরের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে মিশে যাচ্ছি। বুড়া বাবার মাজারের কাছে এসে রিনি একটি টাকা এবং শিউলি ফুলের মালাটা সিন্দুকের ওপর রেখে পথ ধরলো।
আমি বললাম, ‘বিশ্বাসকে সহজভাবে গ্রহণ করার অসীম মতা তোমার। আমার তেমন নেই। কোনো সময় ছিলো না। একটু কিছুতেই ভেঙে পড়া আমার জন্মের স্বভাব।’
এইদিক দিয়ে রিনি ছিলো ব্যতিক্রম।
একদিন সন্ধ্যেবেলা সকাল সকাল ঘরে ফিরতেই মা বলল, ‘অনু বাবা চলতো ওই যে রাস্তার শেষ মাথায় সাবরেস্টার সাহেব আছেন তার মেয়ে রিনি পেয়ারা গাছ থেকে পড়ে প্রচণ্ড রকম ব্যথা পেয়েছে। বাসায় খবর দিয়ে গেছে তাকে দেখতে যেতে হবে।’
মা নিজেকে গোছগাছ করে রেখেছিলো। শুধু কারো অপোয় ছিলো। বাবা-মাকে ছোটবেলা থেকে দেখছি, সামাজিকতা রা করতে চেষ্টা করতেন। আমার এইসব খুব ভালো লাগতো। পাড়ার মধ্যে ভদ্রলোক বলে বাবার শুনাম ছিলো।
নিঃশব্দ মনে হলো সমস্ত বাড়িটা। গেটের কাছে কামিনী ফুলের সুবাস নাক স্পর্শ করলো। ঘরে ঢুকে দেখলাম রিনি বিছানায় শুয়ে আছে। ওর মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মুখে মলিনতার ছাপ। লাইটের আলোয় রক্তশূন্য পাণ্ডুর দেখাচ্ছে রিনির মুখ। ওর উজ্জ্বল চোখ দুটো চারিদিক তাকিয়ে দেখছে। মাকে দেখে ওর মা বলল, ‘ডাক্তার বলেছে কিছুই হয়নি হঠাৎ করে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। ঠিক হয়ে যাবে। রেস্টের প্রয়োজন। তাছাড়া ওর বাবা বাইরে গেছে ফিরবে দু’একদিন পর। একেবারে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’
সেই দিন আমার রিনিকে ভালো করে দেখা। এক দৃষ্টিতে ওর চেখের গভীরতায় হারিয়ে যাওয়া। কী চরম অর্থময় ছিলো সেই একটি রাত। উজ্জ্বল আলোজ্বলা ঘরে মা এবং রিনির মা সাংসারিক বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ করতে করতে রাত বাড়িয়ে তোলে। শুধু আমি তীè দৃষ্টিতে রিনিকে দেখছিলাম। কলেজে পড়া উনিশের যুবক হঠাৎ করে নাগরদোলায় ঘুরপাক খেতে খেতে এক সংগীত প্রবাহের অতলান্তে খুঁজে পেলো এক জীবনের মধুরতা। রিনিও আমাকে দেখছিলো। মনে হচ্ছে কতো জন্মের পরিচয় আমাদের। বাসায় ফিরে একটা উষ্ণবোধ আমাকে ক্রমাগত অনন্ত এক পথের দিকে ঠেলে নিয়ে গেলো। যেখানে আমি নিতান্তই ক্রীড়নক।
একদিন ব্রহ্মপুত্রের বালির চরের সন্ধ্যাকালীন স্নিগ্ধ ফুরফুরে হাওয়ার সাথে রিনির চুলগুলো অবিন্যস্ত হয়ে চোখে-মুখে পড়ছিলো। রিনি বাঁ হাত দিয়ে বারবার সরাতে চেষ্টা করে।
বিকেলবেলায় চর জেগে ওঠা ব্রহ্মপুত্রের বুক দিয়ে হেঁটে হেঁটে গল্প করা আমার রিনির প্রাত্যহিক কর্মের সাথে ছিলো জড়িয়ে। খুব ভালো লাগতো ওর। মনোরম এই সন্ধ্যার আবছায়ায় বালির ওপর বসে আমি রিনি সেদিনই প্রথম অনুভব করলাম কবোষ্ণ চুম্বনের আরক্ততা। কী স্বাভাবিক ভাবে ঘটে গেলো সবকিছু। রিনিকে কী বিপন্ন মনে হলো! রিনির প্রতি মমতায় মৃদু কম্পন হতে থাকে মনের ভেতর। নদীর তটে বসে কলকল শব্দে সুনীল দিগন্ত জোড়া আকাশ দেখতে দেখতে আমি রিনির জন্মের কাছে ঋণী হয়ে গেলাম। রিনি তখন অধরে আলতো লজ্জার ছোঁয়া মেখে নত্রের মৃদু আলোতে কল্লোলিত জলের পতন দেখছে। আসলে রিনির জীবনের সামান্যতম সুখ দেখতে আমার প্রচণ্ড ভালো লাগতো। ওর কোনোরূপ দুঃখ আমার কল্পনার মধ্যে এলে, কষ্ট অনুভব হতো। আমার সবকিছুতেই রিনির উপস্থিতি পরিলতি হতে থাকে।
মৃদু হিন্দোলায় খসে গেলো সময়ের সেতুপথ। আমাকে দিয়ে বাবা-মা’র খুব বড় একটা আশার মধুচক্র গড়ে ওঠেছিলো। তাই ডিগ্রি পাস করার পর এই মফস্বল শহর ছেড়ে দিতে হয়। রিনি তখন বিয়ের পিঁড়িতে বসার স্বপ্ন দেখছে।
রিনি বলে, ‘আমি ছাড়া ওর জীবন অর্থহীন?’
শারদীয় পূর্ণিমায় ব্রহ্মপুত্রের জলে চাঁদের তুলকালাম কাণ্ড দেখতে দেখতে আমার পঞ্চইন্দ্রিয়ের মধ্যে রিনির জন্য মমতায় বেদনার প্লাবন প্রবাহিত হতে থাকে।
আমি বললাম, ‘রিনি কাল আমি ঢাকায় চলে যাচ্ছি। নিজকে গুছিয়ে নিয়ে আমরা নতুন করে জীবন শুরু করবো।’
রিনি কোনো কথা বলে না। জোছনার আলোয় ওর চোখের জল চিকচিক করতে থাকে। আমার কেবলি মনে হতে থাকে, ফের দেখা হবে রিনি। তোমার ভালোবাসার ঋণ আমি শোধ করে দেবো।
রিনিকে নিয়ে এটাই আমার শেষ স্মৃতি। এই শহরে এলেই আমি স্মৃতি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়ি। নস্টালজিক এক জীবনের কাছে সমর্পিত দুঃখের স্বাদ গ্রহণ করতে ভালো লাগে। আমার নিজস্ব কোনো ভালো মন্দ নেই। একদিন চৈতী সন্ধ্যায় রেলওয়ে ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে রিনির চলে যাওয়া দেখে আমার সবকিছু বদলে গেছে। আজকাল এই শহর একেবারে পরিত্যাজ্য। বাইরে থাকতে মন চায়। দূর থেকে চৈতী হাওয়ায় শীতলতা বয়ে আনে স্মৃতির সুরভি। আকাশে নত্রের চোখ দেখতে দেখতে বোধ হয়-আমি তো রিনিকে মনে রেখেছি। এক জীবনের রিনিকে আজীবন মনে রাখার মাঝে আমার প্রথম প্রণয়ের অযাচিত সুখ লুকিয়ে। মাঝে মাঝে মনে হয়, রিনি তুমি আজ কার ঘরে, কোন পথে যেতে হয়?
বুড়া বাবার মাজার পেরিয়ে নদীর চর দিয়ে হাঁটতে ব্রহ্মপুত্র নদের রুগ্ন রূপান্তরের সাথে আমার জীবনের এক অদ্ভুত সাদৃশ্য মনে হলো। ব্রহ্মপুত্র তার জীবনের অনাদিকালের চাওয়া-পাওয়ার ইতি ঘটিয়ে পরাজিত এক ছবিকে বুকে জড়িয়ে নীলস্রোতে বয়ে যাচ্ছে। এইভাবে ব্রহ্মপুত্র তার কুমারত্ব হারিয়ে এক যৌবনের স্বপ্ন দেখে। যেমন আমি এই মুহূর্তে ধবল বালির চর হাঁটতে হাঁটতে জীবনের উত্থান থেকে পতন, পতন থেকে উত্থানের স্বপ্ন দেখছি। শম্ভুগঞ্জের রেলওয়ে ব্রিজের উপর দিয়ে ট্রেন চলে গেলো তীব্র আলো ছড়িয়ে। পিছনে পরে রইলো দুঃসহ অন্ধকার। আমি তখন বাবার মাজারকে পিছনে ফেলে শহরমুখী হলাম। রাত বাড়ছে। মাজারে তখন এক তারায় টুং টাং করে গান ভেসে এলো, ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।’