দুরূহ কবিতা : সৃষ্টি ও শিল্পের ক্যানভাসে
খসরু পারভেজ
কবিতা সাহিত্যের পুরাকালীন শিল্প। কবিতার সমঝদার কম, কিন্তু উপেক্ষিত নয়। উপেক্ষিত নয় বলেই সাহিত্যের অন্যান্য শাখা নিয়ে যতখানি আলোচনা-সমালোচনা, গবেষণা হয়েছে; সবচেয়ে বেশি হয়েছে কবিতাকে নিয়ে। একজন লেখকের মৌলিক সৃষ্টি কবিতা। প্রাচীনকালে কবিতা বলা হত মুখে। কেউ কেউ মুখস্থ করে রাখত। কখনও চিহ্ন এঁকে উৎকীর্ণ করে রাখত গাছের পাতায়, বাকলে, এমনকি পাথরের বুকে। ক্রমান্বয়ে সভ্য হয়ে উঠেছে মানুষ। উদ্ভব হয়েছে বর্ণ বা লিপির। অতঃপর তা লিপিবদ্ধ হবার প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। প্রাচীন কালের সে সব কবিতাকে আমরা মূলত প্রবাদ, প্রবচন, শ্লোক, গীত, বলেই বুঝি। ধর্মগ্রন্থের বাণীও এ থেকে বাদ যায় না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, ‘পৃথিবীর আদি কবি বাল্মীকি’। বাল্মীকির রামায়ণ ধর্মগ্রন্থ। অন্য অর্থে মহাকাব্য। সে সময়ে কবিতা ছিল শ্লোক। সুর করে গাওয়া হত এবং তা মানুষের মুখে মুখে ফিরত। পৃথিবীর প্রাচীনতম কবি হোমার। অন্ধ হোমারের অমর সৃষ্টি ওডিসি ও ইলিয়ড। এ দুটো মহাকাব্যের বাণীও সুর সহযোগে গীত হত। মানুষের কন্ঠেই ছিল যেগুলোর অবস্থিতি। আমরা যদি আমাদের আদি বাংলা কবিতার দিকে ফিরে তাকাই, দেখব সেখানেও সুর, সেখানেও গীতলতা। প্রাচীন যুগ ও মধ্যযুগের কবিতাও গান হিসেবে বিবেচিত। বাংলা সাহিত্যের সর্বপ্রথম কবি অর্থাৎ বাংলা কাব্যে আধুনিকতার জনক মাইকেল মধুসূদন দত্ত গানের আসর থেকে কবিতাকে মুক্ত করলেন এবং কবিতাকে সাহিত্যের সমৃদ্ধতম শাখায় পর্যবসিত করলেন। তার ‘তিলোত্তমা সম্ভবকাব্য’ থেকেই মূলত কবিতার পথ চলা শুরু। কবিতা যখন গান থেকে মুক্তি পেল, তখন থেকেই সাধারণ পাঠকের কাছে তা হয়ে উঠেছে দূরূহ বা দুর্বোধ্য।
বাংলা কবিতায় দুর্বোধ্যতার অভিযোগ মধুসূদন থেকে শুরু। সে অভিযোগ সোচ্চার ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় দুর্বোধ্যতার প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু ত্রিশের দশকে এসে এ অভিযোগ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। আর এ বিষয় নিয়ে বুদ্ধদেব বসুসহ ত্রিশের জন্য কবিরাও তাঁদের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে অভিযোগ খ-ন করার চেষ্টা কম করেন নি। কিন্তু বিতর্ক থামে নি। পাঠক ও সমালোচকদের মুখে বাংলা কবিতার বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ যখন তুঙ্গে ঠিক তখনই কাজী নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দীন সহজবোধ্যতার ঝা-া উড়িয়ে এলেন কবিতাঙ্গনে। সহজবোধ্যতা পাঠককে অনেকখানি ফিরিয়ে নিয়ে এল কবিতার দিকে। যদিও তাঁদের দুজনের কবিতাকে আধুনিক বলতে অনেক সমালোচক বিব্রত হয়েছেন। তাকে কিছু যায় আসেনি। সাধারণ মানুষের কাছাকাছি কবিতাকে পৌঁছে দিয়েও তাঁরা শিল্পসম্মত আধুনিক ও প্রতিনিধিত্ব শীল কবি।
বাংলা কবিতার ধর্মই হল গীতল অর্থাৎ সুরধর্মী। মাইকেল মধুসূদন দত্ত অন্ত:মিল পরিহার করে পয়ারের বেড়ি ভেঙে কবিতাকে মুক্ত করলেন শৃঙ্খলা থেকে। বাংলা কবিতায় সে ধারা আজও বহমান। যদিও আপত:চক্ষে আমরা দেখব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মধুসূদনের শৃঙ্খল মুক্তি না মেনেই ফিরে গেলেন গীতি কবিতার জগতে। কিন্তু এ কথা সুস্পষ্ট যে মধুসূদন দরজা উম্মোচন না করলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রবহমান পয়ারের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে পারতেন না। এখানেও রয়েছে শৃঙ্খল মুক্তি। রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র কবিতা, ছন্দের পরীক্ষা-নীরিক্ষা মধুসূদনের আর্বিভাবের ফলেই সম্ভব হয়েছিল। এ কারণে জীবনের প্রথম লগ্নে রবীন্দ্রনাথ মধুসূদনকে অস্বীকার করলেও পরিণত বয়সে অগ্রাহ্য করতে পারেন নি। রবীন্দ্রনাথের প্রবল প্রতিপত্তির যুগে তাঁকে টপকিয়ে অর্থাৎ রবীন্দ্র বলয় থেকে বেরিয়ে আসা জরুরী ভেবেছিলেন ত্রিশের কবিরা। এ সময়ের কবিরা বাংলা কবিতাকে নিয়ে গেলেন সম্পূর্ণ অচেনা, অদেখা এক বন্দরে। তখন থেকেই বাংলা কবিতার বিরুদ্ধে দুরূহতার অভিযোগটি প্রবল হয়ে উঠে ।
পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল, তবে সত্যিকার অর্থে ত্রিশের নিরঙ্কুশ ইউরোপ মনস্কতা বাংলা কবিতাকে স্বদেশের মাটি থেকে বিচ্যুত করে উড়িয়ে নিয়ে গেল অচেনা উত্তপ্ত মরুভূমিতে। এ সময়ে একমাত্র জীবনানন্দ দাশ ছাড়া অন্যরা সবাই বাঙালি হলেও তাদের মন ও মননের নিবাস ছিল ইউরোপ। প্রকৃতপক্ষে কবিতা থেকে পাঠকের দুরত্ব তখন থেকেই সূচিত হয়েছে।
কবিতা সাহিত্যের সূক্ষ্মতম শিল্প। এ কথাটি যদি আমাদের মানতে হয়, তাহলে ত্রিশের কবিদের ঘাড়ে ঢালাও ভাবে দুরূহ বা দুর্বোধ্যতার অভিযোগটি চাঁপিয়ে দেয়া যায় না। শিল্প কখনও সহজসাধ্য নয়। শিল্প কি সর্বসাধারণের জন্য? যদি তা না হয়, তবে কবিতাও সর্ব সাধারণের জন্য নয়। অর্থাৎ সব মানুষের জন্য পাঠযোগ্য নয়। যদিও কবিতা মানুষকে বাদ দিয়ে নয়। তবে সব মানুষের জন্য নয়, সহজবোধ্য হতে তার কোন বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে না। একজন কবি প্রকৃতপক্ষে একজন শিল্পী। তিনি তাঁর চিন্তা, চেতনা, অভিজ্ঞতা, আবেগ, শিল্পীত ভাষায়, শিল্পীত পরিবেশের মধ্য দিয়ে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেন। তাই তা গ্রহণের সামর্থ সব পাঠকের থাকার কথা নয়। শিল্প সম্মৃদ্ধ কবিতা বুঝার জন্য দীক্ষিত এবং শিক্ষিত পাঠক আবশ্যক। সে দীক্ষা ও শিক্ষা অবশ্যই কাব্য ও শিল্প সংক্রান্ত।
শিল্প নিয়েও রয়েছে মতানৈক্য। প্লেটো বলেছেন, ‘শিল্প হচ্ছে ইমিটেশন অর্থাৎ নকল। এ কারণে তা সত্য থেকে অনেক দূরে।’ সত্য দিয়ে সবকিছুর বিচার হয় না। তাই বলে মিথ্যেও টেকে না বেশিদিন। এ্যারিষ্টটল প্রতিবাদ করেছেন প্লেটোর এ কথায়। তিনি বলেছেন, ‘শিল্প ইমিটেশন, কিন্তু সত্যের চেয়ে অধিকতর জীবন্ত।’ এরপরও ফ্রান্সিস বেকন তাঁর কবিতায় শিল্পের প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘কবিতা হচ্ছে শয়তানের মদ।’ কিন্তু এত সব নেতিবাচক মন্তব্য ছাড়িয়ে আজও কবিতা শিল্পের বিচারে বিচার্য। কবিতায় লুকিয়ে থাকে বিচিত্র রহস্য যা একজন কবি শিল্পীত ভাষায় শিল্পীত অভিব্যক্তিতে রূপায়িত করেন, যে কথা আগেই বলেছি। প্রকৃত কবির কাজ এটাই। যদিও শিল্প সর্বস্বতাই কবিতার সাফল্য নয়। সেখানে প্রয়োজন হয় কবির রুচি, বোধ, পরিপার্শ্ব থেকে গ্রহণ ও বর্জনের ক্ষমতা। এখানে রেনে ওয়ালেকের মন্তব্য মনে পড়ে। তিনি বলেছেন, ‘পরিপার্শ্ব থেকে গ্রহণ এবং তার নির্যাসকে নিখুঁত শিল্পরূপ দেয়ার মধ্যেই কাব্যের পরম সার্থকতা । এমন কাব্যের স্রষ্টাই তো কবি।
তারপরও প্রশ্ন জাগে, কবিতায় কি লেখেন কবি? বাংলা কবিতার রাজপুত্র জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবি জীবনের প্রস্তুতি পর্বে লিখেছিলেন-
‘কেউ যাহা জানে নাই
কোন এক বাণী
আমি বয়ে আনি।’
অসাধারণ বক্তব্য। সাধারণের বোধগম্যের বাইরে কবির চেতনা বিস্তৃত। সাধারণ মানুষ যা দেখেন, কবি দেখেন তার চেয়ে বেশি। অর্থাৎ তাঁর অন্তর চোখ তাঁকে দ্রষ্টা করে তোলে। দেখার মধ্যে অদেখার অবলোকন , উৎসের মধ্যে উৎসরণের সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করা কবির কাজ। একজন কবি অনন্ত সময়কে হৃদয়ে ধারণ করেন। সময়ের যাবতীয় সৌন্দর্য তিনি হাতড়ে বেড়ান প্রকৃতির ভেতর। তাঁর শাণিত বোধ শিল্পীত রূপে রূপায়িত হয়ে কবিতা হয়ে ওঠে। যেখানে থাকে চিত্রকল্প, প্রতীক, মিথ, অলঙ্কার, রসবোধ, সর্বোপরি স্বাতন্ত্র জীবনবোধ। একজন পাঠকের মধ্যে কবিতাকে অর্ন্তগতভাবে অবলোকন করার শক্তি নাও থাকতে পারে। কবিতা সবাইকে বুঝতে হবে এবং সবাইকে পড়তে হবে এটা আশা করা অনর্থক। কবিতা মেধাবী পাঠকের পাঠ্য। মেধাবী পাঠকের সংখ্যা অপ্রতুল, এ কারণে কবিতার পাঠকও অপ্রতুল।
অভিযোগ ওঠে কবিতা দূরগামী । পাঠক বিমুখ। সাধারণ পাঠকের উপযোগী কবিতা লিখতে হলে তো কবিদের লিখতে হবে হাটকবিতা। আর তাদের জন্য রয়েছে সাধারণ পদ্য, ছড়া। খুব রূঢ় ভাষায় বলা হয়ে গেল নাকি? আমি কখনও বাংলার লোক সাহিত্য পুথি, জারি, সারি, হাটকবিতাকে ছোট করে দেখছি না। এটা আমদের ঐতিহ্যগত সম্পদ। আর ছড়া বা পদ্যে শিল্প নেই, আমি সেটিও বলছি না। দুর্বোধতাই শিল্পের অনুষঙ্গ নয় একমাত্র। তারপরও সরাসরি বা সহজবোধ্যতা কখনও কখনও শিল্পের শর্তকে শিথিল করে।
কবিতার দুর্বোধ্যতা প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলি। রবার্ট ব্রাউনিং দুর্বোধ্য কবি হিসেবে খ্যাতিমান। তাঁর কবিতা তাঁর সময়ে শিক্ষা কার্যক্রমে পরীক্ষার সিলেবাসে অন্তর্ভূক্ত ছিল। একজন ছাত্র একটি কবিতা নিয়ে আসে ব্রাউডিং এর কাছে কবিতার সারমর্ম বা অর্থ বুঝে নেবার জন্য। তিনি ছাত্রটির কাছ থেকে কবিতাটি নিয়ে পরপর তিনবার পড়লেন। কিন্তু কবিতার অর্থ উদ্ধার করতে পারলেন না। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর তিনি বললেন, ‘কবিতাটি যখন আমি লিখি তখন দুজন মাত্র এর অর্থ জানতেন। একজন আমি, অন্যজন ঈশ্বর।’ ব্রাউনিং এর ঈশ্বর ভরসায় সবাই আশ্বস্ত নাও হতে পারেন। তবে তাঁর এ উক্তি আমাদেরকে জানান দেয় যে, কবিতার স্রষ্টার কাছে সর্বদা কবিতার অর্থের কোন মূল্য নেই। কবিতা এমনই অনির্বচনীয় ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কেও এমন কথা প্রচলিত আছে, একজন পাঠক তাঁর একটি কবিতার মর্ম উদ্ধারের জন্য তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। রবীন্দ্রনাথ নিজের কবিতাটি কয়েকবার পড়ে তার মর্মার্থ খুঁজে পান না। শেষ পর্যন্ত পাঠকের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘যে পাখি আসিয়াছিল গান গাহিতে, সে পাখি উড়িয়া গিয়াছে, এক্ষণে তুমিও যাহা, আমিও তাহা।’ ব্রাউনিং এবং রবীন্দ্রনাথের উক্তির মধ্যে একটি সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া যায়। তবে এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরও স্পষ্ট করে বলেন, ‘কিছু একটা বুঝাইবার জন্য কেহ তো কবিতা লেখেন। এ জন্য কবিতা শুনিয়া কেহ যখন বলে ‘বুঝিলাম না’ তখন বিষম মুশকিলে পড়িতে হয়। কেহ যদি ফুলের গন্ধ শুকিয়া বলে কিছু বুঝিলাম না- তাহাকে এই কথা বলিতে হয়- ইহা বুঝিবার কিছু নাই এ যে কেবল গন্ধ।’ সাত্যিই তো কবিতার পংক্তি ধরে ধরে ব্যাখ্যা করা দুঃসাধ্য। একটি কবিতা পাঠ করলে এক ধরনের ভাললাগা, মুগ্ধতা যদি পাঠককে আবিষ্ট করে তবে যেটিই সার্থক কবিতা। কবিতার প্রকৃত পাঠক, যাকে বলা হয়েছে মেধাবী পাঠক, তিনিও বোধ হয় এর বেশি প্রত্যাশা করেন না কবিতার কাছ থেকে। সমগ্র কবিতা পাঠ করার পর একটা অর্থ পাঠকের চেতনায় দাঁড়িয়ে যায়, হোক তা ভাসা ভাসা, অষ্পষ্ট। তবে পাঠক যদি আনন্দ পান, আলোড়িত হন তা হলে সেটাই প্রকৃত কবিতা। যে কোন ভাবে পাঠককে নাড়া দিতে পারলেই কাবতার সার্থকতা। তবে কবিতার সম্পূর্ণ অর্র্থ করা সম্ভব নয়, কেউ যদি এই অজুহাতে অসংলগ্ন, ভুল শব্দ, ভুল কথা, অপ্রসাঙ্গিক উপমায়, চিত্রকল্পে কবিতা রচনা করে পাঠকের ঘাড়ে চাপিয়ে দেন। সেটাকেও কবিতা বলা যাবে না। অসংখ্য ভুল বাক্যে কবিতা লেখার দৃষ্টান্ত, এমনকি প্রতিষ্ঠিত (?) কবিদের ক্ষেত্রেও দেয়া সম্ভব। সে প্রসঙ্গ অন্য কোথাও, অন্য কোনদিন ।
শিল্প সমৃদ্ধ কবিতা সাধারণ পাঠক বুঝবেন না সেটি বুঝা গেল। কিন্তু কবিরা কি বুঝবেন না কবিদের কবিতা? এমন একটা কথা প্রচালিত আছে, যারা কবিতা লেখেন তারাই কবিতার পাঠক । রবার্ট গ্রেভস বলেছেন, ‘আমি কবিদের জন্যই কবিতা লিখি এবং ছন্দরচনা বা হাস্যেদ্দীপক কাহিনি লিখে থাকি বুদ্ধিজীবীদের জন্য, আর সাধারণ লোকদের জন্য আমি যা লিখি, তা হল গদ্য।’ কেউ কেউ গ্রেভস এর মন্তব্যে অহংকারের গন্ধ পেয়েছেন, তবে খুব ভুল বলেন নি তিনি। যদিও জটিল গদ্যও কখনও সাধারণ পাঠকের কাছে বোধগম্যহীন হয়ে ওঠে। তবে গ্রেভস এর কথায় আর একবার প্রমাণিত হল, কবিতা সাধারণ লোকদের জন্য কবিরা রচনা করেন না। তবে কবিরা যদি কবিতার পাঠক হন, সেখানে কি দুরূহতার প্রশ্ন ওঠে? সত্যি করে বলুন তো, আমরা যারা কবিতা লিখি, কজনই বা কজনের কবিতা বুঝি? আর পড়ি বা কজন? একজন মৃত্তিকালগ্ন কবি সমুদ্র গুপ্ত। যিনি প্রয়াত হয়েছেন। তাঁকে নিয়ে একটি স্মরণানুষ্ঠানে একজন কর্তা কবি (অনুষ্ঠানের) তাঁর বক্তব্যে নির্দ্বিধায় বললেন,‘আমি সমুদ্র গুপ্তের কবিতা পড়িনি।’ আমরা অনেকেই জানি তার অনেক লেখা একই পত্রিকার একই পাতায় অনেকবার ছাপা হয়েছে। আমি নামটি উচ্চারণ করলাম না। আমার বিশ্বাস এই পাঠ শ্রবণ বা পঠনে অংশগ্রহণ করা কোন কবি এ ঘটনার সাক্ষী। আসলেই কবিদের কবিতা শুধু নয়, কখনো কবিদেরকেও বুঝে ওঠা দুরূহ হয়ে যায়।
কবি শক্তি চট্টোপধ্যায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন-
‘কী হবে জীবনে লিখে? এই কাব্য, এই হাতছানি
এই মনোরম মগ্ন দিঘি
ফাঁস থেকে ছাড়া পেয়ে এই মৃত্যুময় বেঁচে থাকা?
কবিদের কবিতা কোন পাঠক পড়ুক না পড়–ক, এমনকি কবিরাও, তারপরও কবিতা লেখা হয়। মৃত্যুময় বেঁচে থাকাটা কখনও হয়ে ওঠে যোদ্ধার মত বেঁচে থাকা।
সাধারণ পাঠকের জন্য কবিতা নয়। তবে মেধাবী বা শিক্ষিত পাঠকও যদি কবিতা বিমুখ হয়ে ওঠেন, তখন কি অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াবে কবিতা? অসংখ্য কবিতা ছাপা হচ্ছে পত্র পত্রিকায় প্রায়শই, অনেকে লিখছেন। বলা যায়, কবিতাই সবচেয়ে বেশি লেখা হচ্ছে এ সময়ে। কিন্তুু মনে দাগ কাটবার মত কবিতা বা পংক্তি কোথায়? মনকে আচ্ছন্ন করে রাখার মত কবিতার সত্যিই বড় সংকট এখন।
বাংলাদেশের অভ্যুদয় কালে কবি ও সমালোচক হাসান হাফিজুর রহমান বলেছিলেন,‘গ্রীবা হারিয়ে ফেলেছে বাংলা কাব্য, পৌরুষ নেই।’ এতদিন পরেও সার্বিকভাবে উত্তরণ ঘটেনি আমাদের। মধুসূদন থেকে শুরু করে শূন্য দশক পর্যন্ত ইউরোপ মনস্কতা আমাদের টুটলো না। মধুসূদন ইউরোপ থেকে নিয়েছিলেন, বলা যায় তিনি পথ প্রদর্শক। কিন্তু তিনি কি বলেছিলেন এ প্রসংগে, তা জেনে নেয়া যায়। তিনি বলেছিলেন, ‘সাহিত্য সংক্রান্ত ব্যাপারে আমি বিদেশ থেকে ধার করা পোশাক পরে বিশ্বের সামনে দাঁড়িয়ে গৌরব বোধ করতে চাই নে। আমি একটা নেকটাই ধার নিতে পারি, এমনকি ওয়েস্ট কোটটাও, কিন্তুু সম্পূর্ণ পোশাকটা নয়।’ ত্রিশের কবিরা সম্পূর্ণ পোশাকটাই ধার করেছিলেন। সেই আবহ থেকে আমরা মুক্ত হতে পেরেছি বলে মনে হয় না। স্বদেশ, স্বদেশের মাটি থেকে বিচ্যুত, জীবন থেকে বিচ্যুত শব্দমালায় গ্রথিত অতি দর্শনে ভারাক্রান্ত কবিতাই আমাদের চোখে পড়ে বেশি। কবিতা শুধু কলম দিয়ে নয়, লিখতে হয় হৃদয় দিয়ে। কি লাভ হৃদয় বিচ্যুত কবিতা লিখে?
কবি বীরেন চট্টোপধ্যায়ের একটি কবিতার পংক্তি আওড়াতে ইচ্ছে করে। তিনি লিখেছেন-
‘ছত্রিশ হাজার কবিতা না লিখে
যদি আমি সমস্ত জীবন ধরে
একটি বীজ মাটিতে পুঁততাম
একটি গাছ জম্মাতে পারতাম!’
কবিতার শত্রু কবিরাই, এ কথাটি যেন সুপ্রতিষ্ঠিত না হয়, তার জন্য সৎ ও যোগ্য কবিদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন। তবে আমাদের সাহিত্যে জীবন ঘনিষ্ট, হৃদয় সংলগ্ন কবিতার যে কোন দৃষ্টান্ত নেই, তা বলব না। অহংকার করে বলার মত অনেক কবি ও কবিতার নাম উচ্চারণ করা সম্ভব। তবে নাম উচ্চারণ না করেই তাঁদের ওপর ভরসা করে বলি-তাঁদের নিরলয় প্রচেষ্ঠায় বাংলা কবিতা আজ অনেক সমৃদ্ধ। সাম্প্রতিক কবিতা আমাদেরকে প্রাণিত করুক, হৃদয়কে উদ্বেলিত করুক।
চমৎকার লেখা। ধন্যবাদ সাহিত্য বাজারকে। লেখকের ছবি থাকলে ভালো হত।