বরিশাল থেকে প্রকাশিত ৪২টি পত্রিকার বেশিরভাগ অংশেরই নেই কোনো বেতনভুক্ত সাংবাদিক বা রিপোর্টার। একজন মাত্র বার্তা সম্পাদক ও একজন কম্পিউটার পারদর্শী দিয়ে চলছে এখানের লোকাল দৈনিকগুলো।
১০টি উপজেলাসহ বরিশাল জেলার মোট সাংবাদিক সংখ্যা প্রায় ৪ শত জন। এদের বেশিরভাগই শুধু পরিচয়পত্র বা কার্ডধারী সাংবাদিক। বাকীরা সংগঠন নির্ভর হয়ে দান ছদকায় জীবন কাটান। বরিশালের সাংবাদিক ও সংবাদপত্র বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে এমন চিত্রই তুলে ধরলেন জেলার সাংস্কৃতিকজন, সুশীল সমাজ ও সাংবাদিক নেতারা।
সরজমিনে বরিশালের স্থানীয় সংবাদপত্র ও সাংবাদিক সংগঠন অফিসগুলো ঘুরে দেখা গেছে বেশিরভাগ সংবাদপত্র এখানে মূলত ব্যবসায়িক ঢাল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। আবাসিক হোটেল ব্যবসায়ী, ইলেকট্রনিকস ড্রিলার, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর মালিক ও গণপরিবহনের মালিকদের এই ঢালগুলোও আসলে বড়ো দূর্বল ঢাল। কেননা ডিক্লারেশন নীতিমালার সামান্যতম বিষয়গুলোর কোনোটাই অনুসরণ করছেন না এখানকার কোনো সংবাদপত্র মালিক। একই ব্যক্তির বিভিন্ন নামে চারপাঁচটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার চলছে। চলছে গণপরিবহন ও অন্যান্য বৈধ অবৈধ বিভিন্ন ব্যবসা। যা আড়াল করতে তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন সংবাদপত্রকে। প্রশাসনের চোখের সামনেই নিয়মহীনতার নিয়মে চলছে এসব পত্রিকা।
সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় অঙ্গিকার বদ্ধ হলেও এসব বিষয়ে সাংবাদিক সংগঠনগুলো এখানে অন্ধ হয়ে আছে।প্রতিটি সংগঠন এখানে দু তিনভাগে বিভক্ত। জেলায় প্রেসক্লাব আছে কয়েকটি, সাংবাদিক ইউনিয়নের রয়েছে দুটিভাগ। আরো কিছু সাংবাদিক সংগঠন ও পরিষদ রয়েছে, যাদের কাজ শুধু ফুল দেয়া আর সরকারি কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎ পাওয়া। শুধু মাত্র ঐতিহ্য ধরে রেখে গর্বিত পথচলার দাপট এখানে বরিশাল রিপোর্টাস ইউনিটির। তবে তারাও এখানে রাজনৈতিক প্রভাবিত। ক্ষমতাসীনদের তোয়াজ করে চলার নীতিতে ঘটেছে তাদেরও নৈতিক স্খলন। এগুণের আগুন ছড়িয়ে আছে বরিশালের প্রায় সব সাংবাদিক ও পত্রিকা গুলোতে।
এ জেলায় পদার্পণ মাত্রই শুভাকাঙ্ক্ষী জাতীয় পত্রিকার সাংবাদিক বন্ধু ও বড় ভাইয়েরা সতর্কতা জারী করে বলেন, সবকিছু নিয়ে লেখুন কিন্তু বরিশালের আওয়ামী লীগ ও সিটি করপোরেশন নিয়ে ভুলেও লিখতে যাবেন না।
তাদের সেই সতর্কতার প্রমাণ দেখা যায় তাদের কাজকর্মের ধারায়।অথচ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ স্পষ্টই বললেন, লিখুন, তবে শুধু মন্দটুকু নয়, ভালো যেটুকু চোখে পড়ে সেটুকুও লিখুন।
বরিশালের উল্লেখযোগ্য পত্রিকা কীর্তনখোলা সম্পাদক, জাতীয় দৈনিক মানবকন্ঠ এবং এসএটিভি প্রতিনিধি সালের টিটু, যুগান্তর ও এনটিভির প্রতিনিধি আক্তার ফারুক শাহীন, মানবজমিন এর জিয়া শাহীনসহ জাতীয় দৈনিকের জেলা প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে বোঝা গেল, এখানে এই জাতীয় দৈনিক প্রতিনিধি হতেও এখন টাকা দিতে হয় ঢাকা অফিসে। এমন প্রমাণও আছে বেশকিছু।বিশেষ করে ফেসবুকে নতুন পত্রিকার বিজ্ঞাপন এ চোখ রাখলেই মন্তব্য দেখা যায় – কার্ডের জন্য কত দিতে হবে? কেউ কেউ পরিষ্কার টাকার অংক বলেই দিচ্ছেন।
জাতীয় দৈনিক তার ঢাকার প্রতিনিধিকে নির্দিষ্ট বিষয়ে কাজ করিয়ে বেতন দেন। আর জেলা প্রতিনিধি সবরকম বিষয় নিয়ে কাজ করার পরও উল্টো টাকা বা বিজ্ঞাপন খুঁজে দেন। তারপরও একজন জেলা প্রতিনিধিকে ঠিকমতো সম্মানী দিতে না চাওয়াটা কি অপরাধ নয়? এটা কি প্রেস আইনের অধীনে নয়? তাহলে জাতীয় প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক সংগঠন এর কাজ কি শুধু পত্রিকা মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করে চলা? সাংবাদিক সংগঠনগুলোর উচিত এ বিষয়গুলো সামনে নিয়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
অন্যদিকে জেলা শহরের বেশিরভাগ পত্রিকা দুই পাতার কতগুলো চিরকুট যেন। দু একটি চারকালার হলেও বেশিরভাগ পত্রিকা সাদাকালো মানহীন প্রিন্ট। কেন এই মান-দায়হীন পত্রিকার প্রকাশনা তবে?
বরিশালের প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বহুল আলোচিত মাসিক আনন্দ লিখন ও দৈনিক পরিবর্তন পত্রিকার সাবেক প্রকাশক ও সম্পাদক সৈয়দ দুলাল বললেন, নীতিমালা অনুসরণ করে পত্রিকা চালানো খুবই কঠিন কাজ। একটি দৈনিকের জন্য সর্বনিম্ন বার্তা সম্পাদক ছাড়াও ৭ জন নিজস্ব প্রতিনিধি দরকার যাদের কম হলেও দশ হাজার টাকা বেতন দিতে হবে। ওয়েজবোর্ড অনুসরণতো দূরের কথা।
সৈয়দ দুলাল বলেন, এখানে বিজ্ঞাপন বলতে শুধু সরকারি কিছু বিজ্ঞাপন, তাও ক্রমশ কমছে। এ ছাড়া সংবাদপত্রের প্রধান কাঁচামাল নিউজপ্রিন্টের ওপর আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট মিলে ল্যান্ডেড কস্ট হিসেবে প্রায় ২৬% পরিশোধ করতে হচ্ছে। সম্ভবত সংবাদপত্রই একমাত্র পণ্য, যার উত্পাদন খরচ পণ্যের বিক্রয় মূল্যের থেকে ৩ গুণ বেশি। বিজ্ঞাপন আয় কমে যাওয়ায় এই ঘাটতি পূরণ করে প্রতিষ্ঠান চালানো অসম্ভব পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। বাঁচতে হলে বেতনবিহীন সাংবাদিক দিয়েই চালাতে হবে। পরিচয়পত্র পেলেই খুশি এমন সাংবাদিক তখন মাঠে কাজ করবে আর মানহানী ঘটবে সাংবাদিক পেশার।
যেটা আমি পারিনি বলেই ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি।
বরিশাল জেলা মেট্রোপলিটন প্রেসক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক শাহনামা পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, এখানের সাংবাদিকতা এখন শুধু কে প্রথম কে দ্বিতীয় এমব বিষযের প্রতিযোগীতায় সীমাবদ্ধ। ইতিহাস জ্ঞান অধিকাংশেরই নেই। লিখতে জানেনা অথচ সাংবাদিক দাবিদারের অভাব নেই এই শহরে।সাংবাদিকতা করতে হলে পড়তে হয এটাই এখন এরা মানতে রাজী নয়।
বরিশালের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অতি পরিচিত নাম অধ্যাপক তপংকর চক্রবর্তী। সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি প্রথমেই সরকারি ত্রাণ বা সহায়তাকে রেশনিং পদ্ধতি করে জেলা শহরের সাংবাদিকদের জন্যও বরাদ্দের প্রস্তাব তুলে বলেন, এটাকে শুধু সরকারি মহলে সীমাবদ্ধ না রেখে রেশনিং পদ্ধতিতে সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হোক।আমাদের দেশের কিছু আইন আছে যা সুন্দর কিন্তু বাস্তবায়ন নাই। বয়স্ক ও বিধবা ভাতার প্রচলন আছে। ৬৫ বছর বয়স হলেই সচ্ছল বা অসচ্ছল সবাইকে এই ভাতা দিতে হবে। কেউ যদি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করতে না চায় সেটা আলাদা কথা। কিন্তু রাষ্ট্র সবাইকে দেবে। একটি বিভাগীয় জেলা শহরের এই সব বিষয় নিয়ে সাধারণত বিভাগ বা জেলা উন্নয়ন সংস্থা বা কমিটি এগুলো ভাববে। কিন্তু গত ২৭ বছরে বরিশালে এসব কিছুই হয়নি। তাই এগুলো নিয়ে জেলা প্রশাসন কে ভাবতে হবে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এতোদিন বরিশালে হয়তো কর্মসংস্থান সৃষ্টির অন্তরায় ছিলো। আগামী পাঁচ বছরে এ চিত্র বদলে যাবে, অনেক উন্নত হবে বরিশালের এটা বলতে পারি।। নির্ভর করে আমাদের চিন্তা চেতনার উন্নয়ন কতটা তারউপর। নদীবেষ্টিত এই জেলায় ইস্পাত কারখানা, পাট, মৎসশিল্প, নারিকেল, পেয়ারা ইত্যাদি যেকোনো কারখানা তৈরি সম্ভব। যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করে দিয়েছেন, গ্যাসও হয়তো চলে আসবে শীঘ্রই।ভোলা থেকে পাইপলাইন দিয়ে গ্যাস আসাটা কেন হলোনা তা সাংবাদিক বন্ধুরা ভালো বলতে পারবেন।তবে বরিশালে সাংবাদিক পেশার প্রতি খুব একটা সমীহ কারো নেই। এখানে জেলায় প্রায় ৪০০ সাংবাদিক আছেন বটে। তবে মুলধারার সাংবাদিক কতজন তা নিয়ে বিতর্ক আছে। ৪০ /৪৫টি পত্রিকা এই জেলা থেকে ডিক্লেয়ারেশন।কয়টা নিয়মিত প্রকাশিত হয় প্রশাসনের তা নজরদারি প্রয়োজন।বেশিরভাগ সাংবাদিক এখানে হতদরিদ্র অবস্থায় আছেন।
তপংকর চক্রবর্তী আরো বলেন, বরিশাল প্রেসক্লাব, সাংবাদিক ইউনিয়ন, রিপোর্টাস ইউনিটি। এভাবে সংগঠন ভুক্ত যারা তারা কিছুটা ভালো থাকলেও অন্যদের অবস্থা এতোটাই শোচনীয় যে নিজেরাই নিজেদের কাউকে ঘরভাড়া বা টাকা ধার দেবেনা। অভাবে স্বভাব নষ্ট, ফলে না হয় ভালো সাংবাদিকতা না হয় ভাগ্যের উন্নয়ন। এই ক্ষেত্রে সরকারের ডিকলারেশন দেয়ার আগে ভাবা উচিত। এই আধুনিক ডিজিটাল যুগে এসে মফস্বল শব্দটা বেমানান। জেলার সাংবাদিকদের মানসম্পন্ন বেতন নিয়ে রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। সংগঠনগুলো কি এ নিয়ে কিছু করছে? তাহলে সংগঠন এর প্রয়োজন কি?
এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান প্রায় সব সাংবাদিক নেতা। তবে প্রবীণ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সাংবাদিকদের মতে, বরিশালে বেশিরভাগ সাংবাদিক এখন শুধু কার্ডধারী। টাকা দিয়ে পত্রিকার কার্ড কিনে ছাত্রনেতা, কন্ট্রাক্টর, হোটেল বয়, কেবিন বয় এরাও এখন নিজেকে সাংবাদিক দাবী করে।
প্রবীণ সিনিয়র সাংবাদিক আনিসুর রহমান স্বপন, নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান এখন।
বরিশালের রিপোর্টার্স ইউনিটির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সভাপতি ছিলেন তিনি। ঢাকা থেকে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য দৈনিকে সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা নিয়ে অসংখ্য সুযোগ হাতছাড়া করে ভালোবাসার টানে বরিশালেই পরে থাকলেন যে মানুষটি, আজ তিনিও ক্ষুব্ধ বরিশালের সংবাদপত্রের প্রতি। দীর্ঘ সময় আলোচিত দৈনিক ভোরের কাগজের প্রতিনিধি হবার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ঢাকায় একটি জাতীয় দৈনিকে বিভিন্ন বিট ভিত্তিক সাংবাদিক কাজ করেন। সেখানে জেলা শহরের একজন সাংবাদিক একাই সবধরনের বিট সামলাতে হয়। স্বাভাবিক কারণেই তাদের মর্যাদা আরো বেশি হওয়া উচিত ছিলো। অথচ হয়েছে উল্টোটা। অপসাংবাদিকতা আড়ালে হারিয়ে গেছে সাংবাদিকতা এখানে।
বর্তমানে ঢাকা ট্রিবিউন এ কর্মরত খ্যাতিমান সাংবাদিক আনিসুর রহমান স্বপন এর দৃষ্টিতে সব দোষ বরিশালের স্থানীয় সাংবাদিকদের। তিনি বলেন, নিজেদের দোষেই বরিশালের সাংবাদিকরা আজ মর্যাদাহীন। তারা বেতন বা সম্মানী ছাড়াই কাজ করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এখানে।হাতেগোনা দুই তিনটি বাদে কোনো পত্রিকায়ই এখানে নিজস্ব কোনো সংবাদদাতা বা সাংবাদিক নেই। তারপরও দুইপাতা বা চারপাতার পত্রিকা তো বের হচ্ছে।অনিয়মিত ভাবে হলেও বেরতো হচ্ছে। কীভাবে বের হচ্ছে? কারা সংবাদ প্রেরণ করছে? স্থানীয় সাংবাদিকদের যদি আত্মসম্মানবোধ থাকতো তাহলে একটি পত্রিকাও তাদের সংবাদ নিয়ে ছাপা হতোনা। সবটাই ঐ কম্পিউটারের লোক দিয়ে নিউজ টেনে নিয়ে প্রকাশ করতে হতো। যা বের হয় তাওতো অত্যন্ত নিম্নমানের পত্রিকা।
বরিশালের সাংবাদিকদের তাদের আত্মমর্যাদা রক্ষা করতে হলে সবার আগে পেশাদার হতে হবে। যাই ঘটুক পেশাদারিত্বের জায়গায় কোনো ছাড় দেয়া যাবেনা। বিশেষ করে, সাংবাদিক সংগঠনগুলোকে এ নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। শুধু ফুল দেয়া আর সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করাটাই সংগঠনের দায়িত্ব নয়।সাংবাদিকতার স্বার্থ রক্ষার জন্য উদ্যোগী হতে হবে। শুধু সংগঠনের সদস্যদের সরকারি অনুদান পাইয়ে দেয়ায় কোনো কৃতিত্ব নেই, সাংবাদিকতার মুল চরিত্রের সব চাহিদা আদায় করে দেয়াটাই সংগঠনের প্রধান কাজ হওয়া উচিত।
পত্রিকাগুলো বেতন দিচ্ছে কিনা, ওয়েজবোর্ড নীতিমালার অনুসরণ হচ্ছে কিনা, ডিক্লারেশন নীতি পালিত হচ্ছে কিনা এগুলোর জন্যই প্রেসক্লাব বা অন্যান্য সংগঠনের ভূমিকা হওয়া উচিত।এই জায়গায় তাদের দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটি ও সাংবাদিক ইউনিয়নের মর্যাদা বজায় রাখতে হলেও এ কাজগুলো করে দেখানো জরুরী বলে মনে করেন আনিসুর রহমান স্বপন।
বরিশালের খুব সাম্প্রতিক একটি সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখতে পাবেন – উজিরপুর থানার ঘটনা। রিমান্ডে নিয়ে নারীকে যৌন হয়রানীর অভিযোগ। এই সংবাদ টি ছাপার পরেরদিন পত্রিকাগুলো সংবাদ পরিবেশন করলো – মেডিকেল পরীক্ষায় যৌন হয়রানির কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। কেন এ নিউজ সাংবাদিকরা করলো, কিসের ভিত্তিতে করলো? এটাতো তখন আদালতের এক্তিয়ার। আদালত কিছু বলার আগেই তারা বলে দিল। এটা কি দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা? বরিশালের আজকের সাংবাদিকদের চরিত্র এটাই। তারা বেশিরভাগ রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক হাতেগোনা কয়েকজন আছেন হয়তো, চুপচাপ নির্বাক হয়ে।এভাবেই বরিশালের সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের চিত্র তুলে ধরেন দৈনিক অবজারভার পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক ও প্রেসব্লাব সভাপতি নেগবান মন্টু।
তিনি বলেন, বরিশালের ১৯৮৩ সালের আলোচিত সাপ্তাহিক লোকবাণী পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে যে সম্মান ও শ্রদ্ধা আমরা পেতাম। আজ জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিকদের তার কানাকড়ি সম্মান নেই।
আমরা বলতে তখন আমার বার্তা সম্পাদক ছিলেন আনিসুর রহমান স্বপন, তার দেয়া অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে কাজ করেই এই বরিশালে আজো আমার মতো অনেকে সাংবাদিকতা পেশাকে ধরে রেখেছেন। বর্তমান বরিশাল প্রেসক্লাবের সভাপতি ও বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মুঃ ইসমাইল হোসেন নেগাবান মন্টু
তিনি আরো বলেন, বর্তমান বরিশালের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের অবস্থা খুবই হতাশাজনক। মালিক ও সাংবাদিক কারো মধ্যেই নৈতিকতা নাই। বেশিরভাগ পত্রিকা এখানে অনলাইন থেকে নিউজ টেনে নিয়ে হুবহু বসিয়ে দেয়। একটু এডিটও হয়না। কে এডিট করবে? এডিট করার জন্যওতো একজন লোক থাকা চাই। সেটাও নাই। পত্রিকাগুলো এখানে অবৈধ ব্যবসার ঢাল হিসেবে ব্যবহার হয়। সেই ঢালটাও শক্তিশালী হওয়া দরকার সেটুকু বোধও এদের নাই।বরিশাল শহরের রাস্তায় কম হলেও দুইশত মোটরসাইকেল চলে সাংবাদিক স্টিকার লাগিয়ে। এটা নিয়ন্ত্রণের জন্য সাংবাদিকরা যেমন কোনো ভুমিকা নেয়না, পুলিশও কোনো কাজ করেনা। করবে কি করে অদক্ষ অপেশাদার ছাত্র নেতা, হকার, লঞ্চের কেবিন বয় এরা সবাই এখন সাংবাদিক কার্ডনিয়ে ঘোরে। শুধু বরিশালে নয়, ঢাকার কিছু পত্রিকা আছে যারা সাংবাদিক কার্ড বিক্রি করে পত্রিকা চালায়। এমন অবস্থায় পেশাদারিত্ব আসবে কি করে? এ বিষয়ে বরিশাল প্রেসক্লাব উদ্যোগ নিতে গেলেই কিছু সাংবাদিক আবার আমাকে নিয়েই প্রশ্ন তোলে, বলে আপনিতো উকিল। পেশাদার সাংবাদিক নন। অথচ একটু পড়াশুনা থাকলেই তারা বুঝতো, তাদের নিজেদের স্বার্থেই সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্ব আনা জরুরী। সংগঠনগুলোর উচিত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটা নিয়ে কাজ করা। তানা হলে তারাই হুমকীর মুখে পরবে সবার আগে।
বরিশাল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক আজকের পরিবর্তন পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক কাজী মিরাজ মাহমুদ মফস্বল সাংবাদিকতার সমস্যা তুলে ধরে বলেন, মুলধারার সাংবাদিকতার বাইরে এখন অনলাইন সাংবাদিকতা যুক্ত হয়েছে। এখানে অনেকে যেমন ভালো সাংবাদিকতা করছেন তেমনি খারাপ বা দুর্নীতির অভিযোগও কম নয়। এখন এই জায়গাটা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা খুব জরুরী হয়ে গেছে। সরকার মফস্বল সাংবাদিকদের একটা তালিকা প্রকাশ করার কথা, সেটা কতদূর কি হয়েছে জানা নেই। হলে সঠিক সাংবাদিকদের বাছাই করে তাদের জন্য অনুদান প্রদান সহজ হতো। প্রধানমন্ত্রী গত বছর বরিশালের সাংবাদিকদের একটা অনুদান দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। গত ঈদের আগেই সেটা পাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তা এখনো আসেনি। জেলা প্রশাসক থেকে জেলার কিছু দুঃস্থ সাংবাদিককে সহায়তা করার কথা রয়েছে। প্রেসক্লাবের জন্যও হয়তো একটা অনুদান তিনি দেবেন বলে আশা করছি। আমাদের প্রেসক্লাবে মোট কার্যকরী সদস্য ৮২ জন, এছাড়া সহয়ক সদস্য আছেন ৬০ জন।আর জেলায় মোট সাংবাদিক পরিসংখ্যান এখন আর বের করা সহজ নয়ঐ অনলাইন সাংবাদিকতার কারণে।
বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়ন (জেইউবি) সভাপতি স্বপন খন্দকার এর সাথে আমাদের কথা হয় – মফস্বল বা জেলা শহরের সাংবাদিকদের একটা পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি জানান,
বরিশাল সিটিতে জেইউবি, প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংস্থায় প্রায় ২০০/২৫০ জন সাংবাদিক কাজ করছেন। এছাড়া অনলাইন ও স্থানীয় পত্রিকায় ৫০/৭০ জন হবে হয়তো। গড়ে এটা ৩০০ এর বেশী নয়।আর দশটি উপজেলায় গড়ে দশজন করে ১০০ জন নিয়ে মোট ৪০০ সাংবাদিক বরিশাল জেলায় কাজ করছেন।বরিশাল জেলায় সর্বমোট ৪২ টা পত্রিকা আছে। অথচ রিপোর্টার আছে ২৫/৩০ জন। এদের অধিকাংশই নিয়মিত বেতন বা সম্মানী পান না। আমরা আমাদের সংস্থার সদস্যদের যেভাবে হোক যতটুকু হোক সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করি। গতবছর করোনাকালীন পরিস্থিতিতে সরকার থেকে সারাদেশে ৪০০০ এর মতো সাংবাদিককে অনুদান দেয়া হয়েছে। যার একটা অংশ বরিশালের ইউনিয়ন পেয়েছে।
চলতি বছর ইউনিয়নের বাইরেও কিছু সাংবাদিক কে সহায়তা প্রদানের জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলাম।যা সম্প্রতি বাস্তবায়ন হয়েছে।করোনাকালীন দুর্যোগ মোকাবেলায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে পরষ্পরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে। এর বিকল্প কিছু নেই বলে মনে করেন জেইউবি সভাপতি।
বরিশাল রিপোর্টারস ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক বৈশাখী টেলিভিশন এর বরিশাল প্রতিনিধি মিথুন সাহার সাথে মফস্বল সাংবাদিকদের অবস্থা নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বেতনহীন অসহায় অবস্থার বর্ণনা দিয়ে ভারতের রেশনিং পদ্ধতির উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, আমাদের এখানে সরকারি সহায়তা বা ত্রাণ শব্দটাকে রেশনিং এ বদলে দেয়ার বিনীত অনুরোধ জানাবো সরকারের কাছে। সেইসাথে রেশনিং ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে সব শ্রেণীর মানুষের জন্য । জাতীয় পরিচয়পত্র বা ভোটার আইডি বা জন্মনিবন্ধন পত্র হতে পারে রেশনিং বন্টনের উপায়। আমাদের সাংবাদিকদের জন্য এখন এই রেশনিং ব্যবস্থা খুব জরুরী বলে মনে করেন মিথুন সাহা।
তিনি বলেন, একটি বিভাগীয় শহর এই বরিশাল। গত ২৭ বছরের এ বিভাগীয় শহরের অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়ন আপনি খুঁজে পাবেন না। নেই কোনো উন্নয়ন কমিটি। নাগরিকদের সংগটিত হওয়ার কোনো সংগঠনও এখানে নেই।নেই কোনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন।অথচ সুযোগ আছে। নেই উদ্যোগ। তেমনি সাংবাদিকতা পেশাকে পেশাদারিত্বের জায়গায় দাঁড় করানোর সুযোগ আছে হয়তো। সেজন্য যে একতা দরকার তা কোথাও নেই।তবে মফস্বল সাংবাদিকরা বা আমরা আজীবন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো একটা দল বা গোষ্ঠী।এখনো আমাদের এভাবেই দেখে সবাই।উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বড় পত্রিকা ও মিডিয়া ছাড়া কেউই এখানে সঠিক মূল্যায়ন মূল্য পাননা। নতুন নতুন অনলাইন হচ্ছে। সঠিকদের মূল্যায়ন না হওয়ার কারণে সেখানে অযোগ্য লোক এসে ভরে যাচ্ছে। মূলধারার সাংবাদিকতা এখন বিলুপ্ত বলা যায়।
আমাদের সংগঠন রিপোর্টার্স ইউনিটির ৫২ জন সদস্যদের জীবনমান নিয়ে আমরা সেভাবে কিছু করতে এখনো পারিনি, তবে নিজেরা নিজেদের মতো করে পরষ্পরকে সাহায্য করার চেষ্টা করি, যা সাহায্য গ্রহণকারী নিজেও জানতে পারেন না। তাই সংগঠনের বাইরের সাংবাদিক বন্ধুদের জন্য তেমন ভাবতে পারিনা। আগে নিজের ঘর ঠিক রেখে তবেইতো বাইরের কথা ভাবতে হবে।