ছাত্র রাজনীতিঃ প্রাসঙ্গিক ভাবনা
শৈশবটা দেখেছি যুদ্ধরত এক দেশ। কঞ্চির মাথায় লাল সবুজের স্বপ্নিল পতাকা বেঁধে তেপান্তরে দৌড়ে বেরিয়েছি দিনমান। কিছুই বুঝিনি, অথচ বুকের মধ্যে অদম্য এক প্রেরণা উঁকিঝুঁকি দিতো সারাক্ষণ।
জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু এ শ্লোগানগুলো মুখস্ত করতে করতে পাঠশালার গণ্ডি পেরিয়ে স্কুলে এসেও রাজনীতিটা সঙ্গি হয়ে গেলো। অগ্রজরা শিখিয়েছেন, রাজনীতি মানে দেশকে ভালোবাসা, ছাত্র রাজনীতি মানে ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কথা বলা।
দশম শ্রেণি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শবাহী বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের ছাত্র সংগঠনের বিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছিলাম। তারপর সমাজ বিপ্লবের অমীয় সুধার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাম ছাত্র সংগঠনে যোগ দেই। ছাত্রত্বের বাকি জীবনটা সে আদর্শেই কেটেছে।
ছাত্র রাজনীতির গোড়াপত্তন কখন কোথা থেকে হয়েছে তা আমার ঠিক জানা নেই।
জানা যায়, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে উপমহাদেশে ছাত্ররাজনীতির প্রারম্ভিকতার কথা। বিশ শতকের প্রথম দিকে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনীতি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করতে শুরু করে। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা সঞ্চারের লক্ষ্যে একটি ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। একই সময়ে আনন্দমোহন বসু ছাত্রদের রাজনীতিতে যোগদানের আহবান জানান এবং ছাত্রদের রাজনীতি বিষয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদান শুরু করেন।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছাত্রদের সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণে প্রণোদনা জোগায়। জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ সত্ত্বেও ১৯২৮ সালে কংগ্রেসের উদ্যোগে নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতি গঠিত হওয়ার আগে বাঙালি ছাত্রদের কোনো নিজস্ব সংগঠনিক ভিত্তি ছিল না।
বিশ শতকের বিশের দশকের রাজনীতিতে মুসলিম ছাত্রদের অংশগ্রহণ প্রায় ছিলো না বললেই চলে। মুসলিম অভিভাবক ও নেতারা তাদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। তা সত্ত্বেও কংগ্রেসের উদ্যোগে গঠিত নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ঢাকা শহরের কয়েকজন মুসলিম বুদ্ধিজীবী নিজেদের একটি ছাত্রসংগঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। ফলত ১৯৩০ সালের ১২ জুলাই ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুসলিম ছাত্রদের একটি সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শহীদুল্লাহ্কে একটি মুসলিম ছাত্র সমিতি গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয় এবং ১৯৩২ সালে নিখিলবঙ্গ মুসলিম ছাত্র সমিতি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তবে জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকা ছিল এ ছাত্রসংগঠনের ঘোষিত নীতি। ইতঃপূর্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য লে. কর্নেল এইচ সোহরাওয়ার্দী মুসলিম ছাত্রদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকার আহবান জানিয়েছিলেন।
এরপর, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৩৭ সালে গঠন করেন অল ইন্ডিয়া মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশন এবং ওই বছরই কলকাতায় এর বঙ্গীয় শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের আগে খুব কমসংখ্যক মুসলিম ছাত্রই এসব রাজনৈতিক সংগঠনে আগ্রহী ছিলো।
কিন্তু ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর এবং জিন্নাহর নেতৃত্বে বাংলায় মুসলিম লীগের বিস্তার ঘটলে ছাত্ররা মুসলিম লীগ নেতাদের অনুগামী হয়ে ওঠে। কলকাতায় ইস্পাহানি ও ঢাকায় খাজাদের ভবনগুলি ছাত্রদের ওপর মুসলিম লীগের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৯৩৮ সালে বাংলায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের নতুন নামকরণ হয় অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ। পুনর্গঠিত এ সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে ঢাকার আবদুল ওয়াসেক ও যশোরের শামসুর রহমান। এ মুসলিম স্টুডেন্টস লীগই পূর্ববাংলার মুসলিম ছাত্রদের ব্যাপকভাবে রাজনীতিতে আকৃষ্ট করে তোলে। ঢাকার নবাব ছিলেন সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক। মুসলিম স্টুডেন্টস লীগই পাকিস্তান আন্দোলনে ছাত্রদের ব্যাপক যোগদান নিশ্চিত করেছিলো।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বিশেষত ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে জিন্নাহর ঘোষণার পর মুসলিম ছাত্রলীগের ওপর খাজা পরিবারের প্রভাব লোপ পায়।
এ বছরই জানুয়ারির ৪ তারিখে প্রতিষ্ঠা লাভ করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ যার মূল ভূমিকায় ছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। এখান থেকেই তিনি বাংলার অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন।
এবছরই শুরু হয় ভাষা আন্দোলন।
বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী নিয়ে প্রতিষ্ঠিত আন্দোলনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক তৎপরতা আরো সুদৃঢ় হয়।
ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় এ ছাত্রলীগ। এ জাতীয় আন্দোলনে ছাত্রদের অবদান সুজ্ঞাত ও সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু ভাষাসমস্যার সমাধান হলেও ছাত্র আন্দোলন থামেনি। বিভাগোত্তর রাজনীতিতে জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতিকদের যতগুলি উপদল গড়ে উঠেছিল ছাত্রসংগঠনও ছিল ঠিক ততগুলিই। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল ও উপদল নিজস্ব ছাত্রফ্রন্ট গড়ে তুলতে চাইত। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন অব্যবহিত ২৬ এপ্রিল পূর্ববাংলায় বাম রাজনীতির ধরায় ছাত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের লক্ষ্যে গড়ে ওঠে ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ইউনিয়ন। সাম্য ও স্বাধীনতাকামী সৃজনশীল মেধাবীদের একটি সাংগঠনিক স্রোতধারা ছিলো এটি।
পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে বিশেষ করে অনুন্নত ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাতিষ্ঠানিকতা দুর্বল, সেখানে ছাত্র রাজনীতি জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। যেহেতু ছাত্ররা সমাজের অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ সচেতন অংশ, সেহেতু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ছাত্র সমাজের বিশেষ ভূমিকা অনিবার্য হয়ে পড়ে।
১৯৪৮ সালে জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার বিপ্লবের মূলশক্তি ছিল ছাত্র সমাজ। ‘জার’ আমলে রাশিয়ায় ছাত্ররাই বিভিন্ন বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা ঘটায়। এমনকি ১৯৫৫ সালে আর্জেন্টিনায়, ১৯৫৮ সালে ভেনিজুয়েলায়, ১৯৬০ সালে কোরিয়ায় ছাত্র সমাজ পালন করে ঐতিহাসিক ভূমিকা। ১৯৬৪ সালে দ. ভিয়েতনাম ও বলিভিয়ার ক্ষেত্রেও জাতীয় সংকটে ছাত্র সমাজের অবদান ইতিহাসে ছাত্র রাজনীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবেই বিবেচিত।
বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গেও মিশে আছে ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। বিশেষ করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-র কুখ্যাত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ’৬৬-র ঐতিহাসিক ৬ দফা ও ১১ দফা, ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-র নির্বাচন, ’৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনসহ প্রতিটি ঐতিহাসিক বিজয়ের প্রেক্ষাপট তৈরি ও আন্দোলন সফল করার ভ্যানগার্ড হিসেবে তৎকালীন ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা ছিলো অপরিসীম। পরবর্তীতে ’৯০-র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও এদেশের ছাত্র রাজনীতির রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহাসিক ভূমিকা। আর এ কারণেই জনগণের কাছে ছাত্র রাজনীতির আলাদা একটা গ্রহণযোগ্যতা আমাদের দেশেও ছিলো।
স্বাধীনতা উত্তর ও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও ছাত্ররা রাজনীতির মাঠে ছিলো হিরক খণ্ড। কারন সর্বক্ষেত্রেই ছাত্রদের ভূমিকা ও আন্দোলন সংগ্রাম ছিলো জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। দেশের কোনো ক্রান্তিলগ্নে, দুর্যোগে, দুর্ভিক্ষে, দুর্দিনে প্রথমত ছাত্ররাই আর্তমানবতার সেবায় অগ্রণী ভূমিকা রাখতো, সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে। কিন্তু পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর ক্রমান্বয়ে সবকিছুরই যেনো পরিবর্তন হওয়া আবশ্যকীয় হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতার পালাবদলে ছাত্রদেরকে তৈরি করা হয় অঘোষিত বেসামরিক লাঠিয়াল বা আর্মড ফোর্সেস বাহিনী হিসেবে। জিয়াউর রহমানের ঘোষিত আইন অনুযায়ী ছাত্রদের স্বতন্ত্র সাংগঠনিক সত্ত্বা যখন হুমকির মুখে পড়ে তখনই বিদ্যমান ছাত্রসংগঠনগুলো টিকে থাকার জন্যে রাজনৈতিক দলগুলোর ধ্বজাবাহী তল্পীবাহক সংগঠনে পরিনত হতে থাকে। তবুও ৯০ এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত ছাত্রদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিলো কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুরবৃত্তিক সংগঠনে পরিনত হতে হতে ছাত্র সংগঠনগুলো ক্রমেক্রমে তাদের স্বকীয় সত্ত্বা হারাতে থাকে এবং দলীয় এজেণ্ডা বাস্তবায়ন ব্যতিরেকে ছাত্রদের সামগ্রিক স্বার্থ ও জাতীয় কোনো ইস্যু নিয়ে ভূমিকা গ্রহণ হ্রাস পায়।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে দেশের একজন ত্যাগী আদর্শবাদী ছাত্রনেতা ছিলেন। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনগুলোয় যে ছাত্রদের গৌরবময় ভূমিকা ছিলো সর্বমহলে প্রশংসিত, আজ লেজুরবৃত্তিক ও ভোগবাদী রাজনীতির ধ্বজাবহণকারী ছাত্রসংগঠনগুলো সাধারণের হৃদয়ের মণিকোঠা থেকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত।
যেখানে ছাত্ররাজনীতির ফ্রন্টপেজে থাকতো মেধাবীরা, সেখানে আস্তে আস্তে অবেধাবীদের অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে পুঁজিতান্ত্রিক, লেজুরবৃত্তিয় ভোগবাদী রাজনীতির ধারায়। লেখাপড়া, বইখাতা, কাগজ-কলম যেখানে ছিলো ছাত্রদের মূল শক্তি সেখানে স্থান গেঁড়েছে মদ-গাঁজা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, শক্তি প্রদর্শন, মাদক বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, হলে সিট বাণিজ্য, ইভটিজিং, নারী নির্যাতন, কাটা রাইফেল, রিভলবার ইত্যাদি ইত্যাদি। এরশাদ কি ভেবে একবার ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার উদ্যোগে নিয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে তিনিও থুক্কু দিয়ে ডুবো নায়ে জোড়াতালি দিতে লেগে গেলেন।
এমন একটি মু্হূর্ত ছিলো যখন একজন ছাত্রনেতার হাতে থাকতো লাল মলাটের কিংবা অধিকার ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের বই, সেখানে তাদের হাতে শোভিত হচ্ছে ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র। একজন ডাকসাইটে ছাত্রনেতাকেও পড়াশুনা কালীন জীবন নির্বাহের জন্যে টিউশনি করে বেরাতে হতো, সেস্থলে আজ সে ছাত্রনেতাদের মূল বিজনেস দলীয় পদ পদবী- তারপর টেণ্ডার, খুন, মাদক প্রভৃতি অনৈতিক ব্যবসায় তারা এখন রাতারাতি টাকার পাহাড় গড়ে তোলায় ব্যস্ত। সব ছাত্রসংগঠনগুলোই এখন ছাত্র রাজনীতি করে দলীয় পদ পদবী, ক্ষমতা প্রয়োগ আর টাকা রোজগারের ধান্ধায়।
এমন একটি সময় ছিলো যখন কোনো অসহায় মানু্ষ তার চরম বিপদের সময়ে কোনো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা ছাত্রনেতাকে সামনে পেতো, তখন তার বুক জুড়িয়ে যেতো, মনে করতো একটা ভরসার জায়গা অন্তত সে পেয়েছে। অথচ আজকাল? কোনো ছাত্রনেতার নাম শুনলেই সে নাভিস্বাস দৌড়াবো। কারন কি?
কারন একটাই, ভোগবাদী মানসিকতায় মানবিক চেতনা থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং ছাত্রসংগঠনগুলোর উপর রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা ও লাগামহীন পুঁজিরতান্ত্রিক অর্থনীতি।
ছাত্রদের হাতে প্রথম অস্ত্র তুলে দেয় ক্যান্টনমেন্ট থেকে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল আর স্বাধীনতার বিরোধীতাকারী একটি বিতর্কিত ইসলামী দল। এরাই প্রথমত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হাত-কাটা পা কাটা, রগ কাটা সহ খুন, গুম হত্যা আর দখলদারিত্বের রাজনীতি শুরু করে। তখনকার সময়ে ছাত্রলীগ ছিলো চরমভাবে নিগৃহীত। কিন্তু কালের পরিক্রমায় ক্ষমতার মদমন্তে চিরসংগ্রামের ঐতিহ্যে মণ্ডিত বঙ্গবন্ধুর লালিত ছাত্রসংগঠন তার অপরিসীম সত্য ন্যায়ের সংগ্রামী গৌরবকে হারিয়ে ফেলে ক্ষণে ক্ষণে রচনা করছে সর্বকালের সর্বশ্রষ্ঠ কলঙ্কিত অধ্যায় সমূহ। যা কারোরই কাম্য হবার কথা নয়। কিন্তু কেনো?
শুনেছি একেকটি পদ পদবীর জন্যে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়। এই টাকা খরচা করে যারা আসে তারা আবার টাকা সুদে আসলে ইনকামের জন্যে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। টাকা প্রদান করে যে পদলাভ করে, সে পদপ্রদানকারীদের উপর তাদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ আর থাকেনা। উঁচু পর্যায়ে একবার টাকার লেনদেন হলে তার রেশ বা প্রভাব একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে কর্মী সাধারণের উপরে গিয়ে পড়ে। অর্থাৎ লেনদেনের একটি অঘোষিত নেটোয়ার্ক তৈরি হয়ে যায়। বিষয়টা চেইন বাই চেইন অলিখিত সিস্টেম হয়ে ওঠে। তখন টাকা আর ত্রাস, লেহন এটাই হয়ে ওঠে চেইন অব কমাণ্ড।
বর্তমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা বলেছেন- ছাত্র রাজনীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বদানে নিজেকে গড়ে তোলা। কিন্তু তারই ইপ্সিত লক্ষ্যকে পদদলিত করে ছাত্রলীগ ক্রমান্বয়ে একটি অতাত্ত্বিক অসাংগঠনিক সংগঠনে পরিনত হচ্ছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু ছাত্রলীগের যেখানে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পরিগ্রহ করা দরকার সেখানে তারা তাদের হৃত গৌরব হারিয়ে সাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত এখান থেকে উত্তরণ ঘটাতে না পারলে সামনে সমূহ বিপদ।
যে ছাত্ররা একসময় রাজনীতি করতো না, সে ছাত্ররা একদিন জাতীয় প্রশ্নে সংগঠিত হলো। আবার, যে ছাত্রসংগঠনগুলো একসময় কোনো রাজনৈতিক দলের দলীয় ছত্রছায়ায় ছিলোনা, কালে তারাই হলো দলভিত্তিক সন্ত্রাসী বাহিনী।
কোনো হত্যাই কোনোভাবেই কারো কাম্য নয়। তবু স্বাধীনতা উত্তর পঁচাত্তর পরবর্তী বিগত সরকার গুলোর সময়েও ছাত্র কর্তৃক ছাত্র হত্যার নজির রয়েছে অনেক। সামাজিক যোগাযোগ মিডিয়ার বদৌলতে ব্যপক প্রচার প্রচারণায়
সম্প্রতি বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা ঘটনায় নড়েচড়ে উঠেছে দেশ। দাবী উঠেছে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দেয়ার। বুয়েট প্রশাসন ইতোমধ্যেই নাকি ক্যাম্পাসে সকল ছাত্রসংগঠন নিষিদ্ধ করেছে।
তাহলে কোথায় যাচ্ছি আমরা? আমরা কি পিছিয়ে যাচ্ছি? সেই পেছনের দিকে? তাহলে তো সেদিনকার এক স্বৈরশাসকের আহুত চাওয়ারই বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে আজ, এই একবিংশ শতাব্দিতে এসে!!!
দেশ মাতৃকা ও জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে চির সংগ্রামী ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তে গড়া এ ছাত্রলীগ। আর সেই সোনার ছেলেদের উপর বিতশ্রদ্ধ হয়ে এ সংগঠনের সাংগঠনিক পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী প্রধান।
এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের যৌক্তিক স্বার্থ রক্ষার আন্দোলনে সামিল হবার অপরাধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব হারিয়েছিলেন। যে বহিষ্কারাদেশ বাতিল করা হয় ২০১০ সালের ১৪ আগস্ট।
আর তারই লালিত স্বপ্ন সংগঠনের বিকৃত মেধাবীদের ছাত্রত্ব হারাতে হলো আরেক সহপাঠীর জীবন সংহারের অপরাধে। বিষয়টা খুবই কষ্টকর।
আসছে বছর বাঙালির জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতর্ষ পালন করবে দেশ। এমন একটি মাহেন্দ্রক্ষণকে সামনে রেখে দেশের সর্ববৃহৎ তারুণ্যশক্তি ছাত্রদের ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবী হতাশাব্যঞ্জক ও বিব্রতকর।
সুতরাং হুজুগে বাঙালির কথায় ছাত্ররাজনীতি বন্ধের ভাবনাকে জিরো টলারেন্স করে ছাত্রদেরকে আদর্শিক ভাবধারায় গড়ে তুলে নিয়মতান্ত্রিক ও স্বাতন্ত্র্যবোধ সম্পন্ন মানবিক রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধকরণ সময়ের সবচেয়ে বেশি জরুরি ভাবনা। না হলে আমাদের সকল অর্জনই ব্যর্থ হবে, দুঃসময়ের এই ব্যর্থ অহংকারে।
# মাসুদ আলম বাবুল।
১৪.১০.১৯ ঢাকা।