ভাত দে হারামজাদা
ভীষণ ক্ষুধার্ত আছি: উদরে, শরীরবৃত্ত ব্যেপে
অনুভূত হতে থাকে- প্রতিপলে- সর্বগ্রাসী ক্ষুধা
অনাবৃষ্টি- যেমন চৈত্রের শষ্যক্ষেত্রে- জ্বেলে দ্যায়
প্রভুত দাহন- তেমনি ক্ষুধার জ্বালা, জ্বলে দেহ
দু’বেলা দু’মুঠো পেলে মোটে নেই অন্য কোন দাবী
অনেকে অনেক কিছু চেয়ে নিচ্ছে, সকলেই চায়ঃ
বাড়ি, গাড়ি, টাকা কড়ি- কারো বা খ্যাতির লোভ আছে
আমার সামান্য দাবী পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর-
ভাত চাই- এই চাওয়া সরাসরি- ঠান্ডা বা গরম
সরু বা দারুণ মোটা রেশনের লাল চাল হ’লে
কোনো ক্ষতি নেই- মাটির শানকি ভর্তি ভাত চাইঃ
দু’বেলা দু’মুঠো পেলে ছেড়ে দেবো অন্য-সব দাবী;
অযৌক্তিক লোভ নেই, এমনকি নেই যৌন ক্ষুধা
চাইনিতোঃ নাভি নিম্নে পরা শাড়ি, শাড়ির মালিক;
যে চায় সে নিয়ে যাক- যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়ে দাও
জেনে রাখোঃ আমার ওসবের কোনো প্রয়োজন নেই।
যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য এই দাবী
তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘ’টে যাবে
ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, আইন কানুন-
সম্মুখে যা কিছু পাবো খেয়ে যাবো অবলীলাক্রমেঃ
থাকবে না কিছু বাকি- চলে যাবে হা ভাতের গ্রাসে।
যদি বা দৈবাৎ সম্মুখে তোমাকে ধরো পেয়ে যাই-
রাক্ষুসে ক্ষুধার কাছে উপাদেয় উপাচার হবে।
সর্বপরিবেশগ্রাসী হ’লে সামান্য ভাতের ক্ষুধা
ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসে নিমন্ত্রণ করে।
দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অব্দি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে
অবশেষে যথাক্রমে খাবো : গাছপালা, নদী-নালা
গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাত, নর্দমার জলের প্রপাত
চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব প্রধান নারী
উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ী
আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ
ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ সাহিত্য বাজারকে জানান, জোটের উদ্যোগে অয়োজন করা হবে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠান। পরে বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী জানান, তার দুই ছেলে অভিন্ন আজাদ ও অব্যয় আজাদ কানাডায় থাকেন। তাঁরা বাবাকে দেখতে দেশে এসেছিলেন। অভিন্ন আজাদ বাবাকে দেখে ১০ মার্চ কানাডা চলে যান। আজ তিনি বাবার মৃত্যু খবর শুনেছেন। দেশের উদ্দেশে তিনি আবার রওনা দিয়েছেন, সোমবার ঢাকায় পৌঁছানোর কথা। এরপরই রফিক আজাদের দাফন সম্পন্ন করা হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) রফিক আজাদ ৫৮ দিন যাবত লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। গত শুক্রবার সকাল থেকে তাঁর রক্তচাপ পাওয়া যাচ্ছিল না। এতে ক্রমান্বয়ে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। শনিবার দুপুরে তীব্র রক্ত সংক্রমণজনিত কারণে ২টা ১০ মিনিটে তাঁর মৃত্যু হয়। জানা গেছে, কবি দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুস ও কিডনিসহ নানা দূরারোগ্য ব্যধিতে ভুগছিলেন। তার মরদেহ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউ থেকে হীমঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, গত ১৫ জানুয়ারি কবি মস্তিস্কে রক্তক্ষরণজনিত রোগে আক্রান্ত হলে প্রথমে তাকে বারডেম হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে বিএসএমএমইউতে তাকে ভর্তি করা হয়। বেশ কিছুদিন চিকিৎসার পর গত ১৩ ফেব্রুয়ারি কবির অবস্থার আরও অবনতি হলে তাঁকে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। দিনে দিনে তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। বহুমুখী শারীরিক জটিলতাও দেখা দেয়। বিএসএমএমইউ’তে কবি আইসিইউ ইনচার্জ দেবব্রত বণিক ও কামরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তিনি স্ত্রী, পাঁচ সন্তান, আত্মীয়-স্বজনসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদ রাজধানীতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। তাকে এক নজর দেখার জন্য শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গণের ব্যক্তিত্বরা ছাড়াও সর্বস্তরের মানুষ হাসপাতালে ছুটে যান।
কবি রফিক আজাদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পীকার ও সিপিএ নির্বাহী কমিটির চেয়ারপার্সন ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পীকার মো: ফজলে রাব্বী মিয়া, চীফ হুইপ আ.স.ম ফিরোজ, সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নেতৃবৃন্দ, বাংলাদেশ আম জনতা পরিষদ (বাপ) নেতৃবৃন্দ, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকসহ বিভিন্ন সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠন গভীর শোক প্রকাশ ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
রফিক আজাদ ১৯৪১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার গুণী গ্রামের জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সলিম উদ্দিন খান একজন সমাজসেবক এবং মা রাবেয়া খান ছিলেন আদর্শ গৃহিণী। তিন ভাই-দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তার জন্মের আগে মারা যায় সর্বজ্যেষ্ঠ ভাই মাওলা ও তৎপরবর্তী বোন খুকি। রফিক আজাদ যখন মায়ের গর্ভে তখন তার অকাল প্রয়াত বড় বোন খুকি অনাগত ছোট ভাইয়ের নাম ‘জীবন’ রেখেছিলেন। ‘জীবন’ রফিক আজাদেরই আরেক নাম।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি অভিভাবকদের শাসন উপেক্ষা করে তিনি ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রভাতফেরীতে অংশগ্রহণ করেন। চিরদিনই প্রতিবাদী এ কবি তার দ্রোহকে শুধু কবিতার লেখনীতে আবদ্ধ না রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন লড়াইয়ে, জাতির চরম ক্রান্তিকালে, ১৯৭১ এ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণের সৈনিক হিসেবে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছেন।
রফিক আজাদ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ থেকে স্নাকত্তোর ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি টাঙ্গাইলের মওলানা মুহম্মদ আলী কলেজের বাংলার লেকচারার ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে কাদের সিদ্দিকীর সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমিতে ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ জুট মিল কর্পোরেশন, বিরিশিরি উপজাতীয় কালচালার একাডেমি এবং জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সাপ্তাহিক রোববারে সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেছেন।
কবি রফিক আজাদ ভাষা ও সাহিত্য কর্মে অবদানের জন্য ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০১৩ সালে রাষ্ট্রীয় একুশে পদক অর্জন করেন। এছাড়া হুমায়ুন কবীর স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৭), কবিতালাপ পুরস্কার (১৯৭৯), আলাওল পুরস্কার (১৯৮১), ব্যাংক পুরস্কার (১৯৮২), সুহৃদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৯), কবি আহসান হাবীব পুরস্কার (১৯৯১), কবি হাসান হাফিজুর রহমান পুরস্কার (১৯৯৬) এবং ১৯৯৭ সালে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা লাভ করেন।
রফিক আজাদের প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে আছে- অসম্ভবের পায়ে (১৯৭৩), সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে (১৯৭৪), নির্বাচিত কবিতা (১৯৭৫), চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া (১৯৭৭) প্রভৃতি। রফিক আজাদের প্রেমের কবিতার মধ্যে নারীপ্রেমের একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়।