‘সমুদ্র বিলিয়েছে উদারতা তার
পাহাড় বিছিয়েছে স্নেহ ছায়াতল
প্রকৃতির বিশালতায় বেড়ে ওঠা মন
এখানে ভালবাসা কবিতার ভুবন ॥’
বৃহত্তর চট্টলা বা চট্টগ্রাম নিয়ে কবির এই ভাবনা কোনোভাবেই মিথ্যে নয়। চট্টগ্রাম বিভাগের প্রতিটি জেলাতেই ছড়িয়ে আছে প্রকৃতির বিশাল উদারতা। যেখানের সবুজের ছায়ায় ছায়ায় খেলা করে কবিতারা। সাহিত্যের উপকরণ ঘুরে বেড়ায় এখানে আলো, জল, বাতাসে। দূর পাহাড়ের হাতছানি আকাশ ছুঁয়ে দেখার আহ্বান। এই সব, সবকিছুতেই কবিতার প্রতিফলন জাগে। শুধু তাই নয়, প্রাচ্যের প্রবেশদ্বার বলে খ্যাত এই বীরচট্টলা ছিল ধর্ম, বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের সহাবস্থানের অনন্য উদাহরণ। ‘বারো আউলিয়ার দেশ’ বলে খ্যাত এই অঞ্চলের সাহিত্যে তাই সুফিবাদের প্রভাবও লক্ষনীয়।
আর তাইতো মহাকবি আলাওল তাঁর পদ্মাবতী কাব্যেগ্রন্থে চট্টলার পরিচয় দিতে লিখেছেন-
নানা দেশী নানা লোক শুনিয়া রোসাঙ্গ ভোগ
আইসন্ত নৃপ-ছায়াতল।
আরবী মিশরী শামী তুরকী হাবশী রূমী
খোরাসানী উজ্বেগী সকল ॥
…………………………………….
আরমানী ওলন্দাজ দিনেমার ইঙগরাজ
কান্টিলান আর ফরাসিস
হিসপানী আলমানী চোলদার নাসরানী
নানা জাতি আর পর্তূগীস ॥
তবে চট্টলার সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন কবি হিসেবে যাকে উল্লেখ করা হচ্ছে, তিনি পঞ্চদশ শতকের কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর। ইউসুফ জোলেখা-র কাব্য তাঁর বিখ্যাত রচনা। এরপরই উল্লেখ রয়েছে নসিহৎনামা ও সিয়োৎনামা কাব্যের কবি মুযাম্মিল-এর নাম। বিখ্যাত আরব্য কাহিনী লায়লী-মজনু এবং জঙ্গনামার কবি দৌলত উজির বাহরাম খানকেও আমরা খুঁজে পাই এই চট্টগামের মাটিতে। সৈয়দ সুলতান ও তাঁর নবীবংশ কাব্যনামা, দৌলত কাজী ও তাঁর সতী-ময়না কাব্য, কবি আব্দুল হাকিম ও তাঁর নূর নামা ইত্যাদী মধ্যযুগীয় কবি ও তাদেও তথ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক বিস্তারিত জানিয়েছেন তাঁর অন্বেষার আলোয় চট্টগ্রাম নামক গ্রন্থে। অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক আরো জানান, ঐ গ্রন্থে আধুনিককালের বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান বিষয়েও বিস্তারিত রয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম মহাকাব্যকার নবীনচন্দ্র সেন, কবি সমালোচক শশাঙ্কমোহন সেন সামগ্রিকভাবে সুপরিচিত। চট্টগ্রামের সাহিত্য সাধনার ইতিহাসে এরপরই উঠে আসে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ-এর নাম। প্রাচীন পুথি সংগ্রহে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের পাশাপাশি আর একজন পুথি সংগ্রাহক হচ্ছেন শ্রী আশুতোষ চৌধুরী। তাছাড়া আধুনিক কথা সাহিত্যে অবদানের জন্য চট্টলাবাসী যাঁদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন তাঁরা হচ্ছেন- সাহিত্য শিল্পী আবুল ফজল, সাংবাদিক মাহবুবুল আলম এবং কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-ও তাঁর অমর সৃষ্টি লালুসালু, কাঁদো নদী কাঁদো ও চাঁদের অমাবস্যা এখন পর্যন্ত গবেষণার দাবীদার। এরকম আরো অনেকের কথাই অন্বেষার আলো গ্রন্থে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে।
চট্টগ্রামের সাহিত্য সাংস্কৃতির বর্তমান অবস্থা বিষয়ে প্রতিবেদন করতে এসে ইতিহাস ঐতিহ্যের পথে কিছুটা হাঁটা শেষে আমরা প্রবেশ করি বর্তমান আঙ্গিনায়। সাহিত্য বাজার পত্রিকার উপদেষ্টা উপমহাদেশের প্রখ্যাত নাট্য নির্দেশক নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, নাট্যজন সারা যাকের এবং আবৃত্তিশিল্পী প্রকৌশলী কাজী আরিফ-এর পরামর্শ অনুযায়ী আমরা ঘুরে বেড়াই পর্যায়ক্রমে আবুল মোমেন, স্থানীয় সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক মহিউদ্দিন শাহ আলম নিপু, নাট্যাঙ্গনের আহমেদ ইকবাল হায়দার, আবৃত্তি অঙ্গনের বিষয়ে অঞ্চল চৌধুরী এবং সঙ্গীত অঙ্গনের তরুণ শিল্পী মুক্তা মজুমদারসহ আরো অনেকের কাছে। দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, প্রবীণ-তরুণ কবি লেখিয়েদের অনেকেই এখানে খ- বিখ- হয়ে সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরা রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে সাহিত্যের বিচার করতে এখনো ব্যর্থ। অতীতের ঐতিহ্যে গর্বিত এখানের সাহিত্য প্রেমীরা, তবে বর্তমান অর্জন শুন্যই বলা যায়। তাই তাদের অনেকেই কোনো রকম সম্মান দেখাননি আমাদের এই উদ্যোগকে। ‘আমি যে আপনাকে সময় দেব, আমার সম্পর্কে কি জানেন, কতটুকু জানেন, আমার কোনো লেখা কি পড়েছেন? এ জাতীয় প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে আমাদের বিভ্রান্তিতে ফেলে দেন কেউ কেউ। ভুলে যান এই চরম সত্যকে যে, আমরা তো জানতেই এসেছি এতোটা পথ ছুটে। জানতে দিলে তবেই না জানতে পারবো।’ যদিও এই প্রতিবেদনটি যখন লিপিবদ্ধ হচ্ছিল ঠিক তখন সব চিকিৎসার উর্ধ্বে উঠে লাশ হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন বাংলাদেশের কথা সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ হুমায়ুন আহমেদ (ইন্নালিল্লাহি…রাজেউন)। ২৩ জুলাই সকাল ১১টা থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে হুমায়ুন আহমেদ-এর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসা জনমানুষের জোয়ার, আর একবার প্রমাণ করে দিল সাহিত্য-সংস্কৃতির মানুষেরা কখনোই দলমতে আবদ্ধ নয়।
যাইহোক, আমরা প্রথমেই কথা বলি সাহিত্য-শিল্পী আবুল ফজল-এর পরিবারের কণিষ্ঠজন দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান আবুল মোমেন-এর সাথে।
আবুল মোমেন
সবকিছু এখন ঢাকা কেন্দ্রিক। বর্তমানের অবস্থাটা অনেকটা ঝিমিেিয় পরা। রাজনৈতিক মৌলবাদ, অসহিষ্ণুতায় গতি হারিয়ে ফেলেছে বর্তমান চট্টলার সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গন। সাহিত্যে তবুও কিছু যেমন, মনসুরুল করিম, অশক রায়, কবিতায় স্বপন দত্ত, ময়ূখ চৌধুরী, ওমর কায়সার, বিশ্বজিৎ, শাহিদ আনোয়ার, সেলিনা শেলী ফেরদৌস আরা আলীম প্রমূখ, গল্পে হরিশংকর, মহিবুল আজিজ, মাহবুবুল হক, ভুইয়া ইকবাল, শান্তনু বিশ্বাস প্রমূখ এখানের সাহিত্যকে টিকিয়ে রেখেছেন বলা যায়। নৃত্যাঙ্গনের অবস্থা খুবই খারাপ বলা যায়। সংগীত ও নৃত্য বিষয়ে স্থানীয় আর্য সমিতি ভালো বলতে পারবে। থিয়েটারের সংগঠন অনেক তবে নিয়মিত ৩/৪টা সংগঠন কাজ করছে।
(বিস্তারিত আবুল মোমেনের রচনায়)
কালধারা পত্রিকার সম্পাদক মহিউদ্দিন শাহ আলম নিপু বলেন,
চট্টগ্রামের সাহিত্য অঙ্গন অনেক সমৃদ্ধ ও সুগঠিত। প্রচুর বই বের হচ্ছে। ২০০৮ সাল থেকে এখানে সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা গঠন করে নিয়মিত বই মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। সাহিত্যিক রফিক আনোয়ারের তিনমাসে ৫টি উপন্যাস ও ১টি উপন্যাস সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে। নাটক ও প্রবন্ধ রচনায় তিনি সমান দক্ষ। জামালউদ্দিন ঐতিহাসিক লেখক। ময়ুখ চেধুরী খুবই ভালো ও উচুমানের কবি, কিন্তু কবিতা লেখেন কম। আলমগীর শিপন, মাজহারুল ইসলাম তিতুমীর, জেসমিন খান, অরুন দাস গুপ্ত, ফাইজুল কবীর, স্বপন দত্ত, এজাজ ইউসুফী প্রমূখ সাহিত্যচর্চা করছেন। তরুণদের মধ্যে মুস্তাফিজুর রহমান, ফারুক হাসান, পারভীন বাশার, আজাদ বুলবুল, আসমা বিথি প্রমূখ ভালো লিখছে।
তবে নাট্যচর্চাটা শিল্পকলা কেন্দ্রিক এখন। ষ্টুডিও থিয়েটার কার্যক্রমটাই নাটককে বাঁচিয়ে রেখেছে বলা যায়। এই বিষয়ে ইকবাল হায়দার ভালো বলতে পারবে। আবৃত্তি অঙ্গনের অবস্থা খুবই ভালো। বোধন ও প্রমা এখানে আবৃত্তির প্রধান সংগঠন। রণজিৎ রক্ষিতের সাথে এই বিষয়ে কথা বলতে পারলে খুব ভালো হবে।
আহমেদ ইকবাল হায়দার
দলীয় প্রধান, তীর্যক নাট্যদল, চট্টগ্রাম
২৫০ আসনের দুটি মঞ্চ এখানে। একটি শিল্পকলা মঞ্চ অন্যটি টিআইসি অর্থাৎ থিয়েটার ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম মঞ্চ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত বর্ষ উদযাপন উপলক্ষে এখন এখানে রবীন্দ্র নাটকের চর্চাটাই বেশি। তাছাড়া পুরোনো কয়েকটি প্রযোজনার নিয়মিত প্রদর্শনী চলছে। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী, বিসর্জন, রথযাত্রা এবং নজরুলের মধুমালা। তির্যক অবশ্য নতুন এবং সৃজনশীল মঞ্চ-কর্মী খুঁজছে। যোগ্যতরদের সমাবেশ ঘটাতে পারলেই নতুন নাটকের মহড়া শুরু করব।
মোট ২৩টি নাট্য সংগঠন এখানে। প্রত্যেকেই বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটারের সদস্য। এদের মধ্যে ১২টি সক্রিয় আছে। অন্যরা অনিয়মিত হলে চর্চা ধরে রেখেছে। তবে সংকট এখানেও তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে, এখনকার তরুণরাও কম্পিউটারের মতই আবেগহীন হয়ে বেড়ে উঠছে। মিডিয়া কেন্দ্রিকতার প্রভাবে দুষ্ট তারা। অন্যদিকে এখানের সাহিত্যজনরা অজ্ঞাত কারণে নাটকের আঙ্গিনায় খুব একটা আসেন না। তারা নাটক দেখেন না বলেই নাটকের উপযোগি ভালো পা-ুলিপি সংকট প্রকট।
তীর্যকের কথা যদি বলি, ১৯৭৪ সালের ১৬ মে থেকে আমাদের নাট্যচর্চার শুরু। তখন মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, চৌধুরী জহিরুল হক, সদরুল পাশা ছিলেন নিজস্ব নাট্যকার। এখন আর নিজস্ব নাট্যকার নেই বললেই চলে। তখন পথনাটক ছিল খুবই জনপ্রিয়। আমাদের অভিজ্ঞতায় বলছে দেশের নানা ক্রান্তিকালীন সময়ে পথনাটকের প্রযোজনা সবচেয়ে বেশি হয়েছে যেমন Ñ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের কথা ভাবুন। তবে এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ প্রযোজনা কেবল সময়ের দাবি মিটিয়েছে, শিল্পোত্তীর্ণ হবার দায়বদ্ধতা ততটুকু ছিল না। কিন্তু আমার বিশ্বাস পথনাটক বা মুক্তনাটক একজন অভিনেতার প্রস্তুতি পর্বে দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই সব দলেরই পথনাটক নিয়ে সুযোগ পেলেই দর্শকের মুখোমুখি হওয়া উচিত। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময়ে আমরা সফদর হাশমির মেশিন নাটকটির শতাধিক প্রদর্শনী করেছিলাম। আরো ছিল গিরগিটি, জোট বাঁধো এবং স্মৃতি ’৭১। শেষ নাটকটির প্রদর্শনী হয়েছিল একশত ত্রিশটি।
আবৃত্তিশিল্পী অঞ্চল চৌধুরী
রণজিৎ রক্ষিত এই সময় চট্টগ্রামে উপস্থিত না থাকায় আমরা কথা বলি আবৃত্তিশিল্পী অঞ্চল চৌধুরীর সাথে। তিনি জানালেন, এখানের আবৃত্তির অঙ্গন অনেকটাই ঢাকা কেন্দ্রিক আবৃত্তিচর্চার সাথে ঐক্যতা ধরে রেখেছে। বোধন এর সভাপতি রণজিৎ রক্ষিত, আমি প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। প্রমা, নোঙর, শব্দ নামের আরো কিছু সক্রিয় আবৃত্তির সংগঠন রয়েছে। জাগাও প্রাণে সুপ্ত শক্তি- এই শ্লোগানে বোধন নবীনদের নিয়ে কাজ করছে। নিয়মিত একক ও দ্বৈত আবৃত্তি চর্চায় এখানের কবিদের সহযোগিতা অবশ্য স্বীকার্য। চট্টগ্রামের কবি কামরুল হাসান বাদন, ওমর কায়সার, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, রাশেদ রউফ, আনন্দ মোহন রক্ষিত, স্বপন দত্ত প্রমূখ আমাদের আবৃত্তির অঙ্গনকে নিয়মিত সহযোগিতা করছেন। আবৃত্তি শিল্পী হিসেবে মিলি চৌধুরী, রাশেদ হাসান, ফারুক তাহের, ইন্দিরা চৌধুরী, আয়েশা হক সিমু, কঙ্কন দাস, শুভ্রা বিশ্বাস, হাসান জাহাঙ্গির প্রমূখ নাম উল্লেখযোগ্য। তবে সমস্যা হচ্ছে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে সাথে সাংস্কৃতিক অঙ্গনেরও পট পরিবর্তন হয়ে যায়। এতে কওে অনেক প্রতিভা অকালেই সমাপ্তিতে ডুবে যায়। এখানে তরুনদের মাঝে সাংগঠনিক নিষ্ঠা এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না।