গল্প সুখের নক্সিকাঁথা : আত্মকথন
২৫ ডিসেম্বর সহধর্মিনী সুলতানা নাজকে সাথে নিয়ে শাকুরা পরিবহনের একটি বাসে চেপে বসলাম সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে। গন্তব্য বরিশাল সদর। কাটায় কাটায় যাত্রা শুরু হলেও দুর্ভাগ্য আমাদের, তাই ফেরীঘাটে দীর্ঘ যানজটে নাজেহাল হলাম। তিনঘণ্টা পর যখন ফেরীতে উঠল বাসটি তখন মেজাজ আরো খিঁচড়ে গেল সরকারী কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার নমূনা দেখে। ফেরীতে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত পরিবহন লোড হয়ে সামান্যতম একটু ফাঁকা জায়গা রাখা হলনা যাতে যাত্রীরা টয়লেটে বা ২য় তলার খাবার ঘরে যেতে পারে। এভাবে বিরক্তি নিয়ে যখন বরিশাল সদরের নতুল্লাবাজ নামক স্থানে বাস থেকে নামলাম তখন রাত আটটা।
দীর্ঘসময় পর নিজের জন্মস্থানের মাটিতে পা রাখতেই অদ্ভুত এক ভালোলাগা অনুভব করলাম। মূহুর্তে একঝাক হিমেল বাতাস এসে আমার দেহ মনের সব ক্লান্তি, বিরক্তি ধুয়ে মুছে দিল। একটা অটোরিক্সা ভাড়া করে ছুটলাম শ্বশুরবাড়ি পদ্মাবতী নামক স্থানে। শ্বশুর শাশুড়ি কেউ-ই আর বেঁচে নেই। আছেন নাজের বড় ও মেঝ দুই ভাই। পদ্মাবতীতে আজ রাতটা কাটিয়ে পরদিন সকালে যাবো আমার গ্রামের বাড়ি তালুকদার হাটে।
বরিশালে পা রেখেই আমি সাধারণত তিনটি স্থানে ছুটে যাবো-ই। প্রথম বন্ধু গৌতম দাসের কম্পিউটারের দোকানে, ২য়ত নাট্যমের রিহার্সাল কক্ষে ও সর্বশেষ কৃর্তোণখোলার পারে। পদ্মাবতীর শ্বশুরবাড়ীতে ব্যাগটা রেখেই তাই ছুটে এলাম কালীবাড়ী রোডের জয় কম্পিউটারে। ওখানে আমার অপেক্ষায় গৌতম আগেই বসে ছিল। ওকে সাথে নিয়ে ছুটে গেলাম নাট্যমের রিহার্সাল কক্ষে হাসপাতাল রোডের জেলখানা সংলগ্ন একটি ভবনের ৩য় তলায়। কিন্তু সেখানে দেখি মস্ত তালা। নাট্যমের বাসুদেব বা রিপন গুহ কারো ফোন নাম্বারই সাথে নেই।
গৌতম জানালো – আমার কম্পিউটারে ফোন নাম্বার আছে, কাল সকালে ফোন দিস।
কি আর করা দু’জনে বের হলাম কীর্তোণখোলা দর্শনে। তীব্র শীতের চোখ রাঙানী উপক্ষো করে আমরা এসে দাঁড়ালাম কাউয়ারচরের খেযাঘাট সংলগ্ন নদীর পারে। দূরে নদীর ওপারে আধো অন্ধকারে কাউয়াচর ঘাট দেখা যাচ্ছে। কীর্তোণখোলার মুক্ত বাতাসে দুই বন্ধু প্রায় তিনটি বছর পর একসাথে হাঁটছি। হঠাৎ কবিতা এসে বাসা বাঁধলো মনে, আমি আঁওড়ালাম …
আমি তো কখনোই যাইনি – তোমাকে ছেড়ে
এখানেই আছি অনাদিকাল – তোমারই অপেক্ষায়
তোমার হাতে তুলে দিয়ে – এই দায় ভার
এখানেই নেব – শেষ আশ্রয়।
আমাকে শুইয়ে দিও অতি যতনে
এখানে; এই মাটির বিষানায়।
গৌতম বাহবা দিল কবিতা শুনে। বলল তুই সব কবিতা দিয়ে বই করসিছ না কেন?
উত্তরে বললাম, কবি হতে চাইনা তাই। সাংবাদিক হতে চাই, প্রকৃত সাংবাদিক। যে সত্য বলবে ও সৎ কাজটি করবে এমন একজন সাংবাদিক হতে চাই।
তা আর পারলি কই? নিজের পত্রিকাটিও ঠিকমতো চালাতে পারলিনা। গৌতমের দীর্ঘশ্বাস যেন কীর্তোণখোলার বুকে আছড়ে পরলো। আচমকা ঢেউ এসে বাড়ি খেল জেটিতে। একরাশ ভালো লাগা নিয়ে দু’জনে আকাশে তারাদের দেখলাম, আধখানা চাঁদটার সাথে দুষ্টমী শেষে রাত ১১টায় যে যার ঘরে ফিরে গেলাম।
২৬ ডিসেম্বর। শুক্রবার সকালেই নাজকে সাথে নিয়ে কীর্তোণখোলা পাড়ি জমালাম। দূরে কুয়াশার হাতছানীতে ডাকছে কাউয়াচর। গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপনের বদৌলতে কাউয়াচর এখন দেশখ্যাত, হয়ত বিশ্বখ্যাত। নদীর জলে হাত ডুবিয়ে খেলা করার সেই ছোট্টবেলার অভ্যাসটি আজো মনের ভিতর ডালপালা বিস্তার করে আছে। কিন্তু ট্রলার থেকে কিছুতেই পানি ছুঁতে পারলাম না। ২০ জন যাত্রী নিয়ে ট্রলারটির নদী পার হতে মাত্র ১০মিনিট সময় লাগলো। মাত্র ২টাকা মাথা পিছু ভাড়া গুনে আমরা যখন কাউয়াচর পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে ৯টা ১০ মিনিট। আমার গ্রামের বাড়ি তালুকদার হাট। এখান থেকে মাত্রই তিন মাইল পথ। বাস আছে, আছে আটো রিক্সা ও মটর সাইকেল। বাসগুলোর সহকারীরা নিয়ামতগঞ্জ, গোমা ও কাটাদিয়া স্থানের নাম ধরে যাত্রীদের ডাকছে। গোমা ও কাটাদিয়া লাইনের বাস তালুকদার হাট হয়ে যাবে। ভাড়া ১৫ টাকা জনপ্রতি।
আজ আমার বাসে চড়তে মন সায দিচ্ছেনা। তাই একটা অটোরিক্সায় চেপে বসলাম দু ‘জনে। নাজের মনে কিছুটা শংকা। বিয়ের পর গত ১১ বছরে এই ২য়বার ও আমার বাড়িতে যাচ্ছে। এর আগে একবার মাত্র গিয়েছে বটে তবে থাকেনি। ঘণ্টা দুয়েক থেকেই চলে এসেছে। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন, রাতেও থাকার ইচ্ছে আমাদের। তাই ওর অনেক জিজ্ঞাসা? সবকিছুর উত্তর দিচ্ছি আর চারিদিকের দৃশ্যপটে মুগ্ধতা জড়াচ্ছি। সবুজ প্রকৃতি, শর্ষে ফুলে ঢেকে থাকা হলুদ বিছানা দেখতে দেখতে কখন যে তালুকদার বাড়িতে এসে গেলাম টেরই পেলাম না।
তালুকদার বাড়ি। এটা এখন চাচাত বড়ভাই জাহাঙ্গীর তালুকদার বা টুনু তালুকদারের নামে পরিচিত। যদিও এই বাড়িটির আদি পরিচয় আহঞ্জী বাড়ি। আহঞ্জী যার অপর নাম আকন বা আহন। যার অর্থ ধর্ম প্রচারকারী। আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রথম এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রচার করতে এসে এখানে বসত গড়েছিলেন। সরাসরি আরব অঞ্চল থেকে তিনভাই এসে এখানে বসতভিটা তৈরি করেন বলে কথিত আছে। সেই তিন ভাইয়ের বংশবিস্তারের ১৫তম পৌরুষ ছেফের আলী আমার পরদাদা। ছেফের আলীর তিন ভাইয়ের পরিবার নিয়েই বর্তমানের এই তালুকদার বাড়ি।
সে যাকগে, বাড়ির দরজায় এসে রিক্সা থামতেই চাচাত চাচা, ভাই, ফুফু, দাদিরা ছুটে এলেন, খবর পেয়ে ছুটে এলেন আমার এক মামাও। তিনিই এখানে আমাদের ঘরে থাকেন স্বপরিবারে। চাচাত দুইভাই বিদেশে ব্রুনাইতে কাজ করে। ওদের একজন গ্রামে এসেছে। নাম আল আমীন। ও ছুটে এসে ভাইয়া বলে জড়িয়ে ধরল। নিজের বাড়িতে, নিজের ছেলেবেলার মাটিতে সে যে কি আনন্দ বলে বুঝানো যাবেনা।
আপ্যায়নের প্রাথমিক ধাপ শেষ হতেই আমি ছুটলাম সারাবাড়ি। অর্থাৎ আমাদের জঙ্গল ভরা খেতখামার ও জঙ্গলবাড়ি দেখতে। যেখানে নাজ আর আমি বিয়ের তিনমাসের মাথায় এসে কিছু গাছ লাগিয়েছিলাম। সেই গাছেরও যে আগামি ২০১৫ সালের মে মাসে একযুগ পূর্তি হবে। বাড়ি থেকে শহরের হিসেবে প্রায় এক কিলোমিটার দুরত্ব হবে আমাদের জঙ্গলবাড়ির। এখানে ছোট্ট ছোট্ট পুকুর, ধান খেত, সবজীখেত ও নানান রকমের ফলফুলারী গাছের বাগান রয়েছে। বাদশাবাড়ির জঙ্গল নামে রয়েছে পৃথক একটি বড় পুকুরপাড় এলাকা। এই পুকুর পার থেকে আরো প্রায় ২ কি.মি. পথ হাটলে গজনীর দিঘি । বরিশাল ও আশেপাশের শহরের মানুষেরা যেখানে পিকনিক করতে আসেন এই শীতকালে।
মেহগনী আর চামরুল গাছগুলো যেন আমাদের দুজনকে দেখে হেসে উঠলো। আমাদের পথপ্রদর্শক চাচাত দাদু মা। তিনি জানালেন, অনেক অতীত গল্প। তাকে নিয়ে ছবি তুললাম আমরা। যেহেতু আজ জুম্মা বার। আমাদের নিজস্ব মসজিদে জুম্মার নামাজের আয়োজন হয়। তাই বাড়ি থেকে বের হাবার আগেই সে বিষয়ে আগাম সতর্ক করেছেন মামা লুৎফর রহমান ছবুর। তিনিই এখন আমাদের বাড়ির মসজিদের মোয়াজ্জেম।
বাড়িতে ফিরে পুকুরে সাঁতার কেটে চাপকলে গোসল ছেড়ে মসজিদে প্রবেশ করতেই চমকে উঠলাম। দেখি গ্রামের প্রায় সবাই চলে এসেছেন। এসেছেন বরিশাল শহরে অবস্থান করা তালুকদার উপাধী গ্রহণকারী চাচাত বড় ভাইয়েরাও। সকলের সাথে কুশল বিনিময়ের একপর্যায়ে জানতে পারলাম, আজ ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪ আমাদের আরেক চাচাত বড়ভাই, যার নামের উচ্চারণ মাত্র শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় মাথা নত হয়ে আসে। সেই গোলাম ছরোয়ার আলম মন্টু ভাইয়ের আজ মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। তাই মসজিদে মিলাদ ও ভোজের আয়োজন করেছে গ্রামের বাসিন্দারা। নামাজ শেষে দ্রুত বের হয়ে এসে বাড়ির ভিতর মন্টু ভাইয়ের বউ বা ভাবীকে খুঁজলাম, খুঁজলাম তার ছেলে মেয়ে সানী আর জেসিনকে। না কেউ আসেনি, হয়তো তারা জানেনও না। অবাক হলাম। তাদের কাউকে না ডেকে এই ভোজ আর মিলাদের আয়োজন কতটা আন্তরিকতার প্রমাণ।
এটা চাঁনপুরা ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের প্রায় অর্ধেক মানুষ রেলওয়েতে চাকুরী করেন। তাদের প্রায় সাবই কৃতজ্ঞ গোলাম ছারোয়ার আলম মন্টু ভাইয়ের কাছে। আল্লাহর অসীম রহমত ছিল তার উপর। তাইতো তারই উছিলায় এখানে স্বাবলম্বি অনেকে। মন্টু ভাইয়া কোনো শিশুকে কোলে নিতেন না, শিশুরাও সবাই তাকে একটু ভয় পেত। কিন্তু আমাকে কোলে না নিয়ে পারেননি তিনি ও ভাবী। আজো মনে আছে সেই দিনের কথা। কাদা মাখা গায়ে ছুটে যেয়ে নতুন বরবধূ মন্টু ভাইয়া ও নাদিরা ভাবীর কোলে উঠে বসেছিলাম আমি আর বড়ভাইয়ের মেয়ে শারমিন।বলা জরুরী যে, নাদিরা ভাবীও কিন্তু আমাদের চাচাত বোন।পরদাদা ছেফের আলীর তিন ভাইয়ের একজন কালু আখন (ডাক নাম) এর দুইছেলে। সেই ছেলেদের একজনের ঘরে ইসরাইল ও ইসমাইলের বংশধর এই তালুকদারকুল।ইসরাইল তালুকদারের দুইছেলে নাসির ও বাবু এবং একমেয়ে নাদিরা। ইসমাইল তালুকদারের আট ছেলে ও দুইমেয়ে।সবার বড় আনিস, মেঝ শামসুল আলম ও সেজ ছরোয়ার আলম আর জীবীত নেই। এই বাড়ি ও বাজারসহ কাউয়াচর এলাকার উন্নয়নে শামসুল আলম তালুকদার এতোটাই নিজেকে বিলিয়ে গেছেন যে তাকেও সবাই শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করেন।এখানে উল্লেখ্য যে মুলত ইসরাইল ও ইসমাইল আখন বা আহঞ্জী তালুকদারি ক্রয় করে তালুকদার উপাধী গ্রহণ করেন ও আহঞ্জীবাড়িটির পরিচয় বদলে যায়। শামসুল আলম তালুকদার ও ছারোয়ার আলম মন্টুর পরপোকার নীতির কারণে এ বাড়িটি হয়ে ওঠে এ অঞ্চলের প্রধান নীতি নির্ধারক।
বাড়ির ভিতর উঠোনে চাটি বিছিয়ে গ্রামবাসীর খাওয়ার আয়োজন করেছেন চাচাত চাচারা। চাচাত ভাইয়েরা ও চাচারা মিলে খাবার পরিবেশন করছেন। এ এক ভিন্ন আনন্দ। পুরুষরা সকলের খাওযা হয়ে গেলে মহিলারা খেতে বসেছে। এমন সময় চাচাদের একজন এসে বলল : আরিফ তোকে বড় ঘরের ভিতরে ডাকছে।
বড়ঘর মানে তালুকদারদের ঘর। নিয়ম ভেঙ্গে, অনেকটা গায়ের ও অর্থের জোরে গড়ে তোলা একটি অভিশপ্ত ঘর। যে ঘরের দিকে তাকালে অহংকার ফণা তোলে। বিনা কারণে, পিছনে অনেক জায়গা থাকার পরও ঘরটি উঠোন দখল করে তুলেছেন আমার সম্মানীত বড় ভাইয়েরা। চাচা কিম্বা মন্টুভাই বা বড় ভাই আনিস তালুকদার বেঁচে থাকলে এটা কখনোই সম্ভব হতোনা। আনিস ভাইয়া মারা যাবার পর এই ঘরে কখনো আসা পড়েনি। একটা জড়তা নিয়েই ঘরটিতে প্রবেশ করলাম। বেশ বড় একটি বৈঠকখানা সম্বলিত তিন কক্ষের একটি ঘর। সেখানে বসে আছেন চাচাত বড় বোনের ছেলে এবং বড় ভাইয়ের মেয়ে শারমীনের স্বামী মোহন। বিএনপি থেকে নির্বাচিত সাবেক এমপি জহিরুদ্দিন স্বপনের ছোটভাই মোহন আমাকে দেখে উৎফুল্ল চিত্তে জড়িয়ে ধরলেন। তাকে দেখে আমিও ভীষণ খুশি। ঢাকায় কখনো কখনো মোহন মামার সাথে দেখা হয়, ফোনে কথা হয় স্বপন মামার সাথেও। ভালো লাগে তাদের আন্তরিকতা। এ মূহুর্তে লাল তালুকদার ও বাদশা তালুকদার এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন। বাদশা ভাই সেই ছোট্টবেলা থেকেই আমাকে খুব ভালোবাসেন। তার বাসায় যাতায়াতও আছে আমাদের। কিন্তু লাল ভাই বা জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সাথে আমাদের অনেক দুরত্ব। কেন তা জানিনা। তবে এই গ্রামের হর্তাকর্তা তারা, এটাই হয়তো কারণ। জাহাঙ্গীর ভাই আবার তালুকদার হাট উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ্, একইসাথে আওয়ামী লীগের বড় নেতাও। আর নেতাদের এড়িয়ে চলাই আমার প্রথম নীতি।লাল ভাই কি করেন তা জানিনা, বাদশা ভাইয়ের ছোট কবীর ভাই ও তাদের সবার ছোট সমীর ভাই আমার খুব প্রিয়। সমীর ভাই বিদেশে থাকেন, অনেকবছর গত হয়েছে তাকে দেখিনি।
মোহনসহ ভাইয়েরা খেতে বসবেন। আমি আস্তে বের হয়ে যেতে উদ্যত হতেই জাহাঙ্গীর ভাই ডাকলেন – যাসনে, খেতে বস।
কিন্তু কোথায় বসবো? জায়গা যে একটা টেবিল সেখানে পাঁচটি চেয়ারে তারা পাঁচজন বসে পড়েছেন আগেই। আমি পাশেই সোফায় বসে পড়লাম। টুনু ভাই, টুনু তালুকদার খাবার পরিবেশন করছেন, সবশেষে তিনি আমাকেও দয়া করে দিলেন। অনিচ্ছা স্পষ্ট, তবুও দিলেন, কারণ চক্ষু লজ্জা বলে একটা কথা আছে, আমিও সেই লজ্জায় বসে খেলাম। কিন্তু আমার বউটা কি করবে। সে যে এই গণপাটিতে বসতে পারবে না। এই প্রথম এ বাড়িতে খাবে সে। ভাবনার জট দূর করে মামা ছবুর একটা পেলেট নিয়ে ছুটে এলেন, চাচা মজিবর সেই পেলেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বললেন, বাড়ির বউ, সবার সাথে বসেই খাওয়া উচিত। সে কি ভিআইপি নাকি?
আমি বললাম – আপনার ময়েদের উচিত ছিল ওদের ভাবীকে ডেকে এনে পাশে বসিয়ে নিজেরা খেতে বসা, সেটা তারা কেউ কেন করল না?
এ কথায় চাচা চুপ হয়ে গেলেন। তার তিন মেয়ে, কোনো ছেলে নেই। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলেও তারা এখানেই থাকে। আমার বউকে তারা আগে থেকে চেনেও।
খাবারের উঠোনেই বাল্যবন্ধু দর্জি বাড়ির মনিরের সাথে দেখা হলো। কুশল বিনিময়ের পরে জানতে পারলাম ও সিভিলি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে এই গ্রামে বসেই মানুষের সেবা করার চেষ্টা করছে। শুনে খুবই ভালো লাগলো। ওর আমন্ত্রণে বিকেলে তালুকদার হাটে চলে এলাম।
বাজারের মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করে দীর্ঘদিন পর দুইবন্ধুর আড্ডায় যুক্ত হলেন এলাকার দু’জন মুরব্বি। তারা কেউ আমাকে চেনেন না, আমিও তাদের চিনিনা। কিন্তু আমার বাবা আলাউদ্দিন আহমেদকে তারা চেনেন।
তাদের একজন জানালেন, এই বাজারে তোমাদেরও জমি ছিল। তোমার বাবা এই বাজারের জমির বিনিময়ে নীচু ধানখেত নিয়েছে তালুকদারদের থেকে। এখন তোমার চাচারা কি বাড়ির জমিটাও তালুকদারদের দিয়ে দেবে? নাকি বাড়িঘর কিছু করবে তোমরা?
উত্তরে বললাম, আমার চাচা জাকির আহঞ্জী যা করবেন, তা-ই হবে। তার উপরে আমরা কেউ কথা বলবো না। তিনি কলেজের অধ্যাপক। সুশিক্ষিত ও ধার্মিক। তাই তার সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য উত্তম হবে।
আমার কথা শুনে বন্ধু মনির যেন খুব আহত হলো। মনির এখন এলাকার যুবকদের নেতা। আমি ওকে আমাদের বাড়ির জন্য একটা নক্সা তৈরির প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আমার কথা শেষ হলে মনির বলল, জাকির ভাই আমাকে পছন্দ করেন না, তুই আগে তার অনুমতি নিয়ে আয়, তাহলে আমি তোদের বাড়িতে যাব ও নক্সা করে দেব।
আড্ডা শেষে দু’বন্ধু একটি মটরবাইক ধার করে ছুটলাম দূরের একগ্রামে, সেখানে মনিরের পরিচিত কেউ একজন মারা গেছেন। তার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে এই রাতের আধারে কন কনে শীতে কাঁপতে কাঁপতে আমরা দোয়া পড়লাম ও দু’মুঠো মাটি ছিটিয়ে দিলাম।
একরাশ বেদনা একটা ভিন্ন অনুভূতি নিয়ে বাড়ি ফিরতেই মসজিদে কয়েকজন মুরব্বি ও পেশইমাম সাহেবকে দেখলাম কিছু একটা বিষয়ে আলোচনা করছেন। তাদের সালাম দিয়ে আমি এশার নামাজ আদায় করতে দাঁড়ালাম। মূহুর্তে তাদের কথোপকথন বন্ধ হয়ে গেল। আমি নামাজ শেষ করে তাদের পাশে বসলাম, জানতে চাইলাম, একদম চুপ হয়ে গেলেন কেন, আপনারাতো আস্তে আস্তে কথা বলতে পারতেন।
উত্তরে ঈমাম সাহেব বললেন, আপনার নামাজে ব্যাঘাত ঘটলে আল্লাহ আমাদের শাস্তি দিতেন যে। মসজিদে কেউ নামাজরত থাকলে তখন কথা বলা সম্পূর্ণ নিষেধ আছে।
আমি তাদের আলোচনার বিষয় জানতে চাইলে তিনি বললেন, আমরা দাড়ি রাখা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। গ্রামের অনেকেই আপনাকে নামাজে দেখছেন কিন্তু আপনার দাড়ি নেই, আপনাকে দাড়ি রাখার অনুরোধ তাদের। এ বিষয়ে আমি কিছু বলার চেষ্টা করছি মাত্র, এখন আপনিই ভালো বলতে পারেন বলে আমার দিকে তাকালেন ঈমাম সাহেব।
আমি একটু লজ্জিত হাসি দিয়ে বললাম, আসলে দাড়ি নবীজীর সুন্নত, এই সুন্নত পালন করতে গেলে আগে যেটা নবীজীর ফরজ সেটাকে ভালোভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে। সবার আগে নবীজীর মতোই সত্যবাদী ও বিশ্বাসী হতে হবে, মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। কিশোর বয়সেই নবীজী আল আমিন উপাধী পেয়েছেন, হিলফুলফুজুল নামের সংগঠন তৈরি করে মানুষের সেবা করেছেন। এটা যখন তিনি করেছেন তখন তাঁর দাড়ি ছিলনা। নবীজীর মতো দাড়ি রাখার আগে আমাদের কি সত্যবাদী হওয়া উচিত না? আপনি কি বলেন হুজুর? যেখানে নবীজী তিনবার কসম কেটে বলেছেন, কসম আল্লাহর, কসম আল্লাহর, কসম আল্লাহর ঐ ব্যক্তি মুসলমান নয়, যার হাত, জিহবা ও চোখ হতে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয় এবং যার ঘরে খাবার থাকতেও প্রতিবেশী অভূক্ত থাকে। তাহলে কোনটা আগে হুজুর, মুসলমান হওয়া নাকি দাড়ি রাখা? কি বাবারা বলেন, কোনটা আগে ।
আমার কথা শুনে ঈমাম সাহেব ও মুরব্বীরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন, তারা একযোগে বলে উঠলেন, আলাউদ্দিনের পোলায়তো ঠিক কথা কিইছে। আগেতো মুসলমান হইতে হইবো, সাচ্চা মুসলমান?
মসজিদ থেকে বের হবার সময় ঈমাম সাহেব হাত বাড়ালেন, আমি তার হাত চেপে ধরে অনুরোধ জানালাম, গ্রামের প্রতিটি মানুষের কাছে তিনি পবিত্র কোরআনের বাংলা অনুবাদ পড়ে শোনাবেন। প্রতি ফজর ও আছরের পরে।
হুজুর আমাকে কথা দিলেন, তিনি জুম্মার খুতবায় ও যেকোনো অবসরে পবিত্র কোরআনের বাংলা পাঠ করবেন।
আমি একটা আনন্দ, একটা তৃপ্তি নিয়ে ঘরে ফিরলাম, মনে মনে আউড়ালাম —-
বেদন বিভূর কালোরাত্রির হাতছানী
আজো শুধু ইতিহাস তুলে ধরে…
অতীতের নোংরা জলের ছিটে
এখনো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয় দেহ মন
টেনে নেয় খরস্রোতার তীব্রতায়
মনের বিহনে মন আনচান
ক্ষণিকের অস্ফুট আকাঙ্খায়…।
হিসেব মেলেনা কিছুতেই আর
পথ ছাড়েনা বিবর্ণ অতীত।
মনের গ্লানি চুষে খায় দৃষ্টির জড়তায়
ভালোবাসা ফেরি করা দূরন্ত সৈনিক
মুখথুবড়ে পরে জলন্ত দুপুরে
আবারো নতুন সূর্যের প্রত্যাশায়।
পরদিন ২৭ ডিসেম্বর শুক্রবার সকালেই নাজকে সাথে নিয়ে বরিশাল শহরে যাত্রা। এ দিনটি বড় উল্লেখযোগ্য দিন। কেননা একদিকে আমার ঘনিষ্ট বন্ধু সালাম খোকনের বিয়ে। অন্যদিকে ঢাকায় আমার অবিভাবক বড়বোন সারা যাকেরর মেয়ে শ্রিয়া সর্বজয়ার বিয়ে। সালামেরটা বগুড়ায়, শ্রিয়ারটা ঢাকাতেই। পৃথক দুটি বিয়ের নিমন্ত্রণ উপক্ষো করে আমরা বরিশালে। কারণ আজ ছোটচাচা আমাদের বাড়ি তৈরির সিদ্ধান্ত জানাবেন। ছোটচাচা জাকির হোসেন আহঞ্জী ঢাকার হাবিবুল্লাহ বাহার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ইংরাজী বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন, পরে সরকারী জিল্লুর রহমান কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। বর্তমানে তিনি অবসরে আছেন বলেই শুনেছি। তার সবচেয়ে বড়গুন হচ্ছে আমার দাদীমা, ও তার মা হাজেরা খাতুন (১০৮ বছর বয়সে) এখনও বেঁচে আছেন এবং বহাল তবিয়তে ছোট ছেলে জাকিরের সেবা গ্রহণ করছেন।ছেফের আলীর তিন ছেলের একজন আমার দাদা আব্দুল মালেক আহঞ্জী যখন মারা গেছেন, তখন আমার বয়স মাত্রই তিন-চার মাস। দাদার প্রথম পক্ষের সন্তান আমার বাবা, একচাচা ও এক ফুফু। যারা আমার জন্মের পূর্বেই মারা গেছেন।আমার বাবার মা মারা যাওয়ার পর দাদা ২য় বিয়ে করেন আমার বর্তমান দাদু হাজেরা খাতুনকে। যিনি আবার আমার মায়ের আপন ফুফু। ২য় ঘরে দাদার দুইছেলে ও একমেয়ে। অর্থাৎ আলাউদ্দিন, সালাউদ্দিন, পরী ও খলিল, জাকির এবং পারুলকে নিয়ে মালেক বংশের বিস্তার।পরী ফুফুর বিয়ে হযেছিল বরিশালের ফকিরবাড়িতে। সেখানে তার ছেলেমেয়ে তসলিম ভাই, নার্গিস ও শীলা আপারা রয়েছেন যে যার মতন। ফুফু পারুলকে বিয়ে দেয়া হয়েছে কবিরাজ নামক স্থানে। সেখানে ফুপাত ভাইবোন ফারুক, বশার, ছালমা, আখি ও আসমা।
বর্তমানে মেজচাচা খলিল, ছোটচাচা জাকির আর ফুফু পারুল জীবীত আছেন ও ভালো আছেন।তাদের অনুপ্রেরণাতেই এবার বাড়িতে জরুরী বৈঠক ডেকেছেন ছোটচাচা। তিন ২৭ ডিসেম্বর দুপুরে এই বৈঠক নির্ধারণ করেছেন। খুব ভোরে ফজরের নামাজ পরেই তিনি ঢাকা থেকে বরিশালের পথে যাত্রা শুরু করেছেন বলে ফোনে জানিয়েছেন। মাওয়া হয়ে ভাঙ্গা পথে বরিশাল পৌঁছতে তার ৪ ঘণ্টার মত সময় লাগবে। নাজকে তার বড়ভাইয়ের বাসা লাইন রোডে পৌঁছে দিয়ে আমি এসে বসলাম কাউয়াচর ঘাটে। এখানে বেশকিছুটা এলাকা কীর্তোনকোলার ভাঙ্গানের শিকার। নদীর পার ধরে হাঁটছি আর চাচার জন্য অপেক্ষা করছি।
ঢাকায় আমার ছেলেবেলা থেকে বেড়ে ওঠার পিছনে বাবা-মায়ের পরেই অভিনেত্রী নির্দেশক সারা যাকেরের অবদান অনেক। তারই একমাত্র মেয়ে শ্রিয়ার আজ বিয়ে। আমার বিয়েতে তিনি উপস্থিত ছিলেন, অথচ … একই অভিযোগ করতে পারে বন্ধু সালাম খোকন। সাহিত্য বাজার পত্রিকার যেকোনো প্রয়োজনে ছুটে এসেছে খোকন। সেই এখন এই পত্রিকার প্রকাশক। আর তার বিয়েতেই আমি নেই।
ভাবনার বিষণ্নতায় কীর্তোনখোলার দুষ্ট চাহনী টের পেলাম। কবিতা এসে জমা হলো মনে। আমি তাদের উদ্দেশ্যে লিখলাম…
ও এসএমএস পাঠালাম…
(সদ্য (২৭/১২/২০১৪ইং) পৃথক দুটি স্থানে (একজন ঢাকাতে অন্যজন বগুড়ায়) বিবাহ বন্দনে আবদ্ধ আমার প্রিয় দুজন মানুষ – ভাগিনী শ্রিয়া সর্বজয়া ও তার স্বামী রাব্বি এবং বন্ধু সালাম খোকন ও তার সহধর্মিনী ইভা’র জন্য উৎসর্গিত এই কাব্যচরণ)
এই যে তোমাদের
জোড়াখানা পূর্ণ হলো আজ।
স্মরনে রেখ তারে; আজ থেকে
যুক্ত হলো; আদম হাওয়ার আশির্বাদ।
তোমাদের সাথে; সয়ং ঈশ্বর,
তার অনাদিকালের আকাঙ্খার
পূর্ণতা চেয়ে
এখানেই বেঁধেছেন ঘর।
তোমাদের জীবন হোক নির্বিঘ্ন
সারাটাই সত্য আর সুন্দর…।
আরিফ আহমেদ ও সুলতানা আরিফ
কাউয়ারচর
বরিশাল
চাচা এলেন বেলা ২টায়। তাকে সাথে নিয়ে পুনরায় তালুকদার বা আহঞ্জীবাড়ীতে প্রবেশ করলাম। দুপুরের খাবারের পরই সভা আরম্ব হলো। সিদ্ধান্ত হলো, যৌথভাবে একটি ঘর তৈরি হবে এবার বাড়িতে। মজগুনি (সবারভাগের)গাছ বিক্রি করে ঐ টাকায় বাড়ির প্রথম গাঁথনী হবে। গাছের ক্রেতা পাওয়া গেছে। সব গাছ সাড়ে তিনলাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শুনে প্রাণে শক্তি এলো যেন। এতোদিন আমরা বাড়িতে এসে চাচাত চাচাদের ঘরে অবস্থান করতাম। আমাদের ভাঙ্গা একটি ঘর আছে বটে তবে সেটা বসবাসের উপযোগী করেছেন মাত্র দুমাস আগে মামা ছবুর এসে। এতোদিন এটা বসবাসের অনুপোযোগী ছিল।চাচার সিদ্ধান্তকে সাদুবাদ জানিয়ে আমি ফিরে এলাম বরিশাল শহরে।
সেখানে নাজ আমার অপেক্ষায় অস্থির সময় কাটাচ্ছে। সবশুনে ও খুব খুশি। তবে বাড়িতে এসে কে থাকবে? এটাই ওর প্রশ্ন।
সন্ধ্যায় আবার বের হলাম। গৌতমের কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে ফোন করলাম নাট্যমের রিপন গুহ কে। জানলাম ওরা শিক্ষাভবনের ৩য় তলায় রিহার্সালে ব্যস্ত।পরদিন লঞ্চের কেবিন পাওয়া গেছে। অর্থাৎ ২৮ ডিসেম্বর রবিবার আমরা ফিরছি ঢাকা অভিমুখে। তাই আজ দেখা করাটা জরুরী। তা না হলে আর কবে বন্ধুদের সাথে দেখা হবে কে বলতে পারে? বরিশাল শহরের রূপ দেখতে দেখতে আমি হাঁটছি শিক্ষাভবনের দিকে…।এখানের অন্যতম আরো নাটকের সংগঠন শব্দবলী, খেয়ালী ও বরিশাল থিয়েটার।নাজ শব্দাবলীতে কাজ করতো একসময়। সেখানেই আমার সাথে প্রথম আলাপ হয়েছিল ১৯৯৮ সালে।আমি তখন ঢাকাতে দৈনিক জনকণ্ঠের সাংস্কৃতিক প্রতিবেদক।
৩১ ডিসেম্বর। ভোলা সদরের মিলনায়তনে নাটকের প্রদর্শনী করবে বরিশালের অন্যতম নাট্য সংগঠন নাট্যম। ২৮ ডিসেম্বর বিকাল থেকেই নাট্যমের রিহার্সাল কক্ষে তাই জোর মহড়া চলছিল। নাটকের নাম ত্রিকাল। রচনা ও নির্দেশনা ঢাকার নাট্যজন আসিফ সুমন। মুক্তযুদ্ধের সময়ের একজন বাঙ্গালী সৈনিকের চেষ্টা ও সাহসীকতার পরিচয় বহনকারী আত্মত্যাগের কাহিনী নিয়ে এই ত্রিকাল যাত্রা। তিনটি সময়কে ধারণের চেষ্টা এ নাটকে। যুদ্ধপূর্ব ও যুদ্ধাপরবর্তী অবস্থাকেও প্রাধান্য দেয়া হয়েছে এতে।
কিছুটা সময় রিপন ও বাসুদার পাশে বসে রিহার্সাল দেখলাম।নাজ মিশকল দিচ্ছে বারবার। তাই ওদের থেকে বিদায় নিয়ে পুনরায় গৌতমের কাছে গেলাম।এদিকে কীর্তোনখোলা হাতছানী দিয়ে ডাকছে। আজ শীতের তীব্রতা যেন অনেক বেশি। কিন্তু আমার ভয়াল দর্শন জ্যাকেটটি ভেদ করে শীতেরা হানা দিতে ব্যর্থ হয়ে গৌতমকে ঝাঁপটে ধরেছে। ও শীতে কাঁপছে ঠক্ ঠক্ করে। কাল দুপুরে আমার ঘরে খাবি তোরা। বলেই আদেশ জারি করল গৌতম। ওর দুইছেলে ও এক মেয়ে বর্তমান। আরেকজন আগত। এমন সময় ওর ঘরে যেয়ে বৌদিকে কিছুতই বিরক্ত করতে রাজী নয় নাজ।কিন্তু কে শোনে কার ভাষ্য। ওর মেয়ে পিয়ন্তী মাত্রই আট বছর বয়সেই নাচ রপ্ত করে এটিএন বাংলায় অংশ নিয়েছে।ছেলে জয়দিগন্ত পিএসসিতে গোল্ডেন প্লাস হয়েছে। দুজনেই নাজের খুব ভক্ত। ওরা নাজকে বড় মা বলে ডাকে। ওদের ডাক এড়িয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে অসাধ্য।
তাইতো পরদিন সকাল হতেই পিয়ন্তী আর দিগন্ত ফোনের পর ফোন – তোমরা আস না কেন? তারাতারি আস।
দুপুরে গৌতমের বাসায় খাওয়া ছেড়ে বিদায় নিতে বিকেল ঘনিয়ে এলো। নাজের বড়ভাইয়ের বাসা থেকে বিদায় নিয়ে মেজভাইয়ের বাসা পদ্মবতী হয়ে পারাবত ১০ লঞ্চের ৭৭ নম্বর কেবিনে যখন পৌঁছলাম তখন রাত আটট ত্রিশ।নদীর পাশেই কেবিন তারউপর শুধু আমাদের কেবিনটার সামনেই একটি চেয়ার ভালো ও অক্ষত দেখে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানালাম। কারণ কেবিনের বাইরে চেয়ারে বসে লঞ্চের পানি কেটে ছুটে চলা না দেখে যে আমি থাকতে পারি না।
আর তাইতো মাঝরাতে এই চেয়ারে বসেই লিখলাম ….
ও তারা আকাশে মিটিমিটি হাসছে
নদীতে ঝিকিমিকি কুয়াশা ভাসছে।
মন আমার দেয় সাঁতার
ঢেউয়ের দোলায় দুলছে।।
আজ উচাটন
আনমনা হবে মন
জোসনা জলে
ভালবাসা হবে বিতরণ।।
আজ সীমানা ছাড়িয়ে
যাব গো হারিয়ে
আমরা দু’জন
হারাবো আপন ভুবন।।
যেখানে নদীতে
সাগরের মিতালী চলছে।
মন আমার দেয় সাঁতার
ঢেউয়ের দোলায় দুলছে।ঐ
আজ এই আধারে
ঢেউয়ের তালে তালে
জেলে নাও যেখানে নাচছে
জোনাকী খেলাতে
পিদিমটা যেখানে
জ্বলছে আর নিভছে।।
কুয়াশা চাদরে
আহা কি আদরে ডাকছে।
মন আমার দেয় সাঁতার
ঢেউয়ের দোলায় দুলছে।ঐ