“এই নদীতে সাতার কাইটা বড় হইছি আমি
এই নদীতে আমার মায় কলসীতে নেছে পানি
আমার দিদিমা আইসা প্রতিদিন ভোরে
থাল বাটি ধুইয়া গেছে এই নদীর কিনারে
দশ বছর পর বিদেশ গোনে ফিরা আইসা দেহি
হগলি বদলাইয়া গেছে
নদী আমার যেমন ছিলো তেমনি আছে
ও নদী তেমনি আছে।।”
বিখ্যাত এ গানের উৎস নদীর নাম জানেনা বাংলাদেশে এমন মানুষ খুবই কম। বাংলা ছাড়িয়ে ভারত, লন্ডন আমেরিকায়ও বেজে চলে কীর্তনখোলার জয় গান।
আর এই নদীর জল যেমন হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান পার্থক্য বোঝেনা, তেমনি এই নদী পাড়ের মানুষেরাও বোঝেনা সাম্প্রদায়িকতা কি জিনিস?
চারদিকে নদী বেষ্টিত বরিশালের গর্ব কীর্তনখোলা। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বরিশাল এবং ঝালকাঠি জেলারও উল্লেখযোগ্য নদী এই কীর্তনখোলার দৈর্ঘ্য ১৬০ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৪৯৭ মিটার। অনেকটা সাপের মতোই এঁকে বেঁকে চলে গেছে শাখা নদ সমুহে। বিষখালী ও সন্ধ্যা হয়ে চলে গেছে সাগরের সাক্ষাৎ পেতে। সুগন্ধা, আড়িয়াল খাঁ যার আদি আবাসস্থল। এই নদী পাড়ের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী কিন্তু হিন্দু ও খ্রিস্টান। বিশেষ করে ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও ভোলা জেলার বেশিরভাগ মানুষ হিন্দু ধর্মের অনুসারী।
ইতিহাস ও বাংলাপিডিয়া ঘেটে জানা যায়, কীর্তনখোলা নদী বরিশাল জেলার শায়েস্তাবাদ থেকে যাত্রা শুরু করে গাবখান খালের কাছে এসে গজালিয়া নদীতে পড়েছে। অতি প্রাচীনকালে গঙ্গার তিন প্রবাহের (নলিনী, হলদিনী ও পাবনী) অন্যতম একটি প্রবাহ পাবনী। এটি প্রাচীন পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয়। যাট মিলিত ধারা সুগন্ধা নদীটি আন্দার খাল বা আড়িয়াল খাঁ নামে ফরিদপুরের দক্ষিণে মাদারীপুর হয়ে কয়েকটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে। এরপর এটি বরিশালের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। পথে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে পরিচিত নিয়ে হরিণঘাটা হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। উক্ত আন্দার খাল বা আড়িয়াল খাঁ নদী মাদারীপুরের দক্ষিণে সুগন্ধা নামে পরিচিত ছিল এবং একসময় বাকলা চন্দ্রদ্বীপ বা বর্তমান দক্ষিণ বাংলার সর্ববৃহৎ নদী ছিল।কালের আবর্তে নদীপ্রবাহের পরিবর্তন হয়ে সুগন্ধার বদ্বীপের শাখা নদীগুলো ক্ষীণ হয়ে ভরে যায় ও ধীরে ধীরে বৃহত্তর বরিশাল জেলার বিভিন্ন এলাকায় চর সৃষ্টি করে এবং কালক্রমে সুগন্ধা নাম বিলীন হয়ে আড়িয়াল খাঁর নামটি প্রাধান্য পায়। ব্রিটিশ আমলে নদীটি খুব প্রশস্ত, গভীর ও খরস্রোতা ছিল। সে সময় বরিশাল শহরকে বলা হতে বরিশল্ট। কারণ, তখন এ নদীর পানির লবণাক্ততা ছিলো তীব্র। এই লবণাক্ততা এবং বন্যার পানি থেকে রক্ষার জন্য যে বাঁধ দেওয়া হয় (যা বর্তমানে বাঁধ রোড নামে পরিচিত) তাতে দেখা যায় যে, কীর্তনখোলা নদী প্রায় এক কিমি প্রশস্ত ছিল। প্রায় এক শতকের মধ্যে চর পড়ে নদীর প্রশস্ততা অর্ধেকে নেমে এসেছে। গভীরতা, প্রবাহ এবং স্রোতও অনেক কমে গিয়েছে। নদীটি ভাঙন প্রবণ এবং প্রচুর পলি বহন করে। বরিশাল ঘেঁষে কীর্তনখোলা নদী পশ্চিমে এগিয়ে নলছিটি থানার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। সেই সাথে পরিচিতি পেয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নাম।
একটি অংশ ধানসিঁড়ি নাম নিয়ে কচা নদীতে গিয়ে মিশেছে। অপর অংশ মিলেছে বিষখালী নদীতে।
স্থানীয়ভাবে নদীর নামকরণ নিয়ে দু-তিনটি বক্তব্য শোনা যায়। নদীর পার ঘেঁষেই শহরের সবচেয়ে পুরনো হাট রয়েছে। প্রচলিত রয়েছে, সেখানে কীর্তনের উৎসব হতো। সেই থেকে এই নদীর নাম হয়েছে কীর্তনখোলা। কেউ কেউ হাটখোলায় স্থায়ীভাবে কীর্তনের দল বসবাস করার কারণে এর নাম কীর্তনখোলা হয়েছে বলে মনে করেন। তবে নদীর নামকরণের সাথে কীর্তনের কিংবা কীর্তনীয়দের যে একটা সম্পর্ক রয়েছে তা নিশ্চিত। কৃষ্ণলীলার কাহিনী নিয়ে কীর্তনীয়রা গানে মেতে থাকতেন। কৃষ্ণ রাধাকে নিয়ে যমুনা নদীতে লীলায় মেতে উঠতেন। বরিশালে যমুনা না থাকলেও কীর্তনখোলা নদীই যেন রাধা-কৃষ্ণের অমর প্রেমের গাঁথা হয়ে আছে।
আর লোকগাথায় লুকিয়ে আছে হিন্দু ধর্মের রামায়ন, মহাভারতের ঐশ্বর্য। যা থেকে এটা পরিস্কার যে হিন্দু রাজত্বে ছিলো এ অঞ্চল।
বর্ষায় কীর্তনখোলার দুই কূল ছাপিয়ে বাণ ডাকে। তখনই দেখা যায় এর ভরা যৌবন। জলে ভাসিয়ে-ডুবিয়ে সব একাকার করে দেয় যেন। বর্ষায় ওর এমন সংহার মূর্তি কেন? শহরের কংক্রিটের শরীরে আঘাত করে ভাঙতে পারছে না বলে সব আক্রোশ ওপাড়ে! চরকাউয়া, বিনয়কাঠী, পশুরীকাঠী ভেঙে ভেঙে কীর্তনখোলা ওর অবয়ব প্রসারিত করেই চলেছে। উত্তরের শহরতলির চর আবদানী, চর উলালঘুনী, চরবাড়িয়া, লামচরির অগ্রভাগ প্রতি বর্ষায় গ্রাস করে নিচ্ছে। ভিটেমাটি, গাছগাছালি, ফসলি জমি থেকে ঘুমন্ত মানুষও তলিয়ে নিখোঁজ হচ্ছে ওর ভাঙনের তোরে। কত পরিবার যে গৃহহারা, ভিটেছাড়া বর্ষায় ও ফুঁসে ওঠে ক্রোধে, আক্রোশে। বর্ষায় কীর্তনখোলার সর্বগ্রাসী রূপ দেখলে মনেই হবে না ও মায়াবী, আনন্দদায়ী!
আর ঠিক ঐ সময়টায় মানুষের সাথে মানুষের সৌহার্দ্য টের পাওয়া যায় বৃহত্তর বরিশালের প্রত্যন্ত গ্রামেও।
আর শীতের কীর্তনখোলা অপরূপ সৌন্দর্য্যের প্রতিমা যেন। কোথাও ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস নেই, নেই ভাঙনের গর্জন। আসে শুধু ভালোবাসা আর উদারতার আহ্বান। আর
কীর্তনখোলা বরিশাল বাসীদের গর্ব। আর ধর্মীয় সম্প্রতি বরিশালবাসীর অহংকার।
এখানকার বাজার ব্যবসা সব কিছুর সাথেই আছে এই কীর্তনখোলা। দূর দূরান্তের নানানরকম সবজী, মাছের নৌকা এসে এখনো ভীড় করে এই নদী বন্দরে। রাত ১১ টার পর বদলে যায় সিটি বহুমুখী কাঁচাবাজারের চিত্র। যেন ঘুম নবরীতে জেগে ওঠা নতুন কোনো শহর। পাইকারী ব্যবসায়ীদের ভীড়। ট্রাক অটো গাড়ির ঠেলাঠেলি। ইঞ্জিন চালিত বোটের শব্দ। সে এক অন্যরকম দৃশ্য।
এই কীর্তনখোলা নদীতেই দাবড়ে বেড়ায়, সুরভী, কীর্তনখোলা, সুন্দরবন, এডভেঞ্চার নামের অসংখ্য যাত্রীবাহী জলযান। একইসাথে এখানের মানুষগুলো বুঝিয়ে দেয় তার সবাই এক আদমের সন্তান।।