সদানন্দ সরকার, ভ্রাম্যমান প্রতিবেদক : খুলনা অঞ্চল তথা খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিবেদন করতে গিয়ে এ কথা স্পষ্ট বলা যায় যে, এ অঞ্চলে যতটা না সাহিত্যের সৃজনশীল ধারার চর্চা হচ্ছে, তার তুলনায় অনেক বেশি চলছে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলে একে-অপরের মধ্যে সাংগঠনিক দক্ষতা দেখানোর প্রতিযোগি চর্চা। এতে করে সাহিত্য বা সাংস্কৃতিক কিছু সাংগঠনিক কার্যক্রম বৃদ্ধি পেলেও সৃজনশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিকচর্চা প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম বলেই জানালেন খুলনা অঞ্চলের প্রবীণ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শ্রী তারাপদ দাস ও কবি ও গল্পকার অচিন্ত কুমার ভৌমিক।
এখানে প্রতিটি জেলার পাড়ায় পাড়ায় রয়েছে অসংখ্য সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। খুলনার দৌলতপুর ও ফুলতলাতেই প্রায় ৫০টির মত সংগঠন রয়েছে।সদরে সংগঠন ও এর শাখা-প্রশাখা নিয়ে শ’দেড়েক ছাড়িয়ে যাবে। সে তুলনায় যশোরে সংগঠন সংখ্যা যদিও অনেক কম। তবে এখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও ফোরাম-এর দুটি ধারায় সংগঠন সংখ্যা প্রায় ২০টি। কিন্তু ব্যতিক্রম দেখা যায় সাতক্ষীরা জেলার সাংগঠনিক চিত্রে। এখানের প্রায় একশত সংগঠন রয়েছে এবং প্রতিটি সংগঠনেরই রয়েছে থানা-উপজেলা পর্যায়ে অসংখ্য শাখা-প্রশাখা। সাংগঠনিকভাবে এরা খুলনাকেও ছাড়িয়ে যাবে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, সুন্দরবনের আগাছার মতই এখানে গজিয়ে উঠছে অসংখ্য সাহিত্য ও সাস্কৃতিক সংগঠন। প্রতিটি সংগঠনই তৈরি হচ্ছে কর্তৃত্ব পরায়ণতার দ্বন্ধ থেকে। যে কারণে একে অপরের মধ্যে ঐক্যের যেমন অভাব তেমনি একে অপরের নিন্দায় পঞ্চমুখ প্রতিটি সংগঠনেরই কর্ণধাররা। আর এ কারণেই সৃজনশীলতা এ অঞ্চল থেকে বিলুপ্ত প্রায়। কেননা, যেখানে সুন্দরের বসবাস, সেখানে আর যাই থাক দ্বন্ধ ও নিন্দা থাকে না। আর এ দুটো না থাকলে এত সংগঠন তৈরির প্রয়োজনই পড়ে না। তবে হ্যাঁ! প্রতিটি সংগঠনই কিন্তু উৎসব পার্বণে ব্যস্ত হয়ে ওঠে একে-অপরের তুলনায় বড় উৎসব করার জন্য। বইমেলা, সাহিত্য আসর, সংগীত, নৃত্য ও নাটকের পরিবেশনা রয়েছে প্রতিটি সংগঠনেরই। রুটিন মাফিক এ সব উৎসব আয়োজনের মান নিয়ে সংশয় থাকলেও ঝাঁকজমকতা নিয়ে সংশয় প্রকাশের কোন সুযোগ নেই। দর্শক যে হচ্ছে না তা কিন্তু নয়, তবে রুচীশীল দর্শকের বড় অভাব বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সাংস্কৃতিকজনরাই।
অন্যদিকে সাহিত্য সংগঠনগুলো যে শুধু উৎসব পার্বণে কাজ করছে তা কিন্তু নয়। বেশিরভাগ সাহিত্য সংগঠনই প্রতিমাসে সাহিত্য আসর করছে, কেউ কেউ প্রতি সপ্তাহে বসাচ্ছে জমজমাট আড্ডা। উৎসব পার্বণে, কেউ কেউ মাসে, তিনমাসে নিয়মিত সাহিত্য পতিকা প্রকাশ ও বইমেলার আয়োজনও করছেন বেশ উৎসাহ নিয়ে। প্রতিটি সংগঠনই আবার তাদের সদস্যদের কবিতা বা গল্প নিয়ে বইয়ের প্রকাশনাও করেছেন। যদিও এ সব প্রকাশনার মান নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। নিয়মিত লিটলম্যাগও প্রকাশ হচ্ছে এখানে। লিটলম্যাগ বা সাহিত্যের ক্ষুদ্র পত্রিকার অংকন ও মুদ্রণ মান বেশ প্রশংসনীয় হলেও কবিতা বা গল্পের মান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংগঠক নিজেরাই।
এ অঞ্চলের অন্যতম গুনীজন, সাহিত্যিক ও গবেষক শ্রী তারাপদ দাস বলেন, এ অঞ্চলে সাহিত্যচর্চাটা মূলত সংগঠন কেন্দ্রিক। সংগঠন কেন্দ্রিক হবার সুফল যেমন আছে, তেমনি কিছু ক্ষতিকর দিক আছে। সুফল হচ্ছে একসাথে অনেকজন বসে আলোচনা করে একটা লেখাকে মানসম্পন্ন করে তোলা যায়। আমাদের এখানে থানা উপজেলা পর্যায়ে সাহিত্য সংগঠন আছে, সেখানে নিয়মিত সাহিত্য আসর হয়। সে সব আসরে নতুনদের লেখা পাঠ হয়, আলোচনা হয়। এতে তারা তাদের লেখার মান সংশোধন করতে পারেন। সংশোধিত এ সব লেখা নিয়ে সাহিত্য পত্রিকাও প্রকাশ করা হয়। কিন্তু এর কুফল হচ্ছে, এককভাবে সাহিত্যচর্চাটা এতে বিঘ্নিত হয় এবং সাহিত্যচর্চার যে একটা দায়বদ্ধতা থাকে সেটা তাদের সাহিত্যকর্মে অনুপস্থিত থাকে। আর একটা সমস্যা হল, প্রগতিশীল ধারার সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা বিরোধী আর স্বপক্ষ একটা দন্দ্ব রয়েছে। এটা কেন আমি ঠিক বুঝিনা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে সাহিত্য মান বিচারই প্রধান বিষয় হওয়া উচিৎ। সামাজিক দায়বদ্ধতা স্বীকার করেন, এমন সব লেখকই প্রগতিশীলতার দাবিদার। আমি অন্তত সেটাই মনে করি। এ অঞ্চলে ডাঃ ফজল মোবারক, অচিন্ত্য কুমার ভৌমিক, আসাদী, জিএম মুছা, পদ্মনাভ অধিকারী, কাসেদুজ্জামান সেলিম, তৌহিদ মনি আরও বেশ ক’জন আছেন ভালো লেখেন, মেয়েদের মধ্যেও আছেন নাম মনে নেই, পৃথা পল্লবী, লিলি প্রমূখ। (২০০৮ এর প্রদত্ত সাক্ষাতকারের অংশবিশেষ)
কবি ও গল্পকার অচিন্ত্য কুমার ভৌমিক জানান, খুলনা অঞ্চলে প্রথম বড় সংগঠন ছিল ষাটের দশকে সন্দীপন। পরে হল প্রতিনিধি গ্রুপ। এ সময় এ অঞ্চলের সাহিত্যে গল্পকার আবুল হাসেম, নাজিম মাহমুদ (গান লিখতেন), ডাঃ মান্নাফ, বেদুইন সামাদ, এ্যাডভোকেট আব্দুল জলিল(ইতিহাস লিখতেন), ডাঃ আবুল কাসেম, যশোরের নওয়া পাড়ায় ছায়াপথের নাসিরুদ্দিন ছিলেন, ইজাজ হোসেন ছিলেন, আবু ইসহাক ছিলেন এখানে, গল্প লিখতেন। ইন্ডিয়া থেকে উনি এসেছিলেন জামান মনির, ঐ সময়ই তার চার-পাঁচটি বই বের হয়ে গিয়েছিল। তারপর নওয়াপাড়ায় একটা নাম করা পত্রিকা ছিল, সারা বাংলাদেশে চলত, মাসিক মুকুল। সেই পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন নাসিরুদ্দিন আহমেদ। এঁরা সাহিত্যচর্চার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং খুবই ভাল লিখতেন। এঁদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। এরপরতো দেশ স্বাধীন হল। একে একে অনেক নতুন লেখক এলেন। যশোরের কথা এখন আর আমি বলতে পারবো না। তবে খুলনা অঞ্চলে বর্তমানে অসংখ্য নতুন লেখক আছেন এবং বেশিরভাগই তারা কবি। আমি বই ধরে যদি হিসেব করি তাহলে প্রায় শ’তিনেক কবির নাম বলতে পারবো। সবার নামতো জানিনা। বই ধরেই বলতে হবে। গোলাম মোস্তফা সিনদানী হয়ত এটা বলতে পারবেন। তিনি ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন। খুলনায় কবি বিষ্ণুপদ সিংহ প্রচুর লেখেন, ভাল লেখেন কিন্তু গভীরতা নেই। এদের মধ্যে মোটামুটি ভাল, লেখায় গভীরতা আছে এমন কয়েকজনের মধ্যে অসিত বরণ ঘোষ, আজিজ খান এঁরা আছেন। মহিলাদের মধ্যে বেগম মাজেদা আলী আছেন, নাসরীন হায়দার, শামীমা শীলু এঁরা ভালো লেখেন। আগেই বলেছি কবির সংখ্যা বেশি। প্রবন্ধকার খুবই কম। গল্পকার তো নেই বললেই চলে। সেলিম আলতাফ, আলী হোসেন মনি এঁরা কয়েকজন গল্প লেখেন। বাগেরহাটের সুশান্ত মজুমদারও ভাল গল্পকার। আর একজন আছেন শক্তিশালী গল্প লেখেন আবুবকর সিদ্দীকী। এ রকম গল্পকার বা প্রবন্ধকারদের হাতে গোণা যাবে কিন্তু কবিদের গুনে শেষ করা যাবে না। আসলে সাংগঠনিক কার্যক্রম নিয়েই এঁরা বেশি ব্যস্ত। সংগঠনে আসেন, কবিতা আনতে হবে, তাই নিয়ে আসেন। সকলের মধ্যে বসে কবিতা পড়েনও কিন্তু অপরের কবিতা আর শোনেন না। চলে যান। কবিতায়ও যে একটা সামাজিক দায়বোধ আছে-এটা যেন কেউ মানতেই চান না। এ কারণেই কবিতার মান আর মানের হয় না। আর একটা বিষয় হচ্ছে স্বাধীনতা বিরোধী ও স্বপক্ষ শক্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব। সাহিত্য-সাংস্কৃতির চর্চা যারা করেন তারাতো সুন্দরের চর্চা করেন। তাদের মধ্যে কেন এ দ্বন্দ্ব আসবে। যারা স্বাধীনতা বিরোধী তারাতো সাহিত্য-সাংস্কৃতিরও বিরোধী হবে, এটাই স্বাভাবিক। (২০০৮ এর প্রদত্ত সাক্ষাতকারের অংশবিশেষ)
সংগঠন নির্ভর খুলনা : সুন্দরবনের পাতায় পাতায় কবিতা
এখানে সুন্দরবনের পাতায় পাতায় কবিতার ছড়াছড়ি। গল্প, উপন্যাস কিম্বা প্রবন্ধের অবস্থা অনেকটাই দুষ্প্রাপ্য রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মত। অথচ এই খুলনা শহরের ফুলতলাতেই দক্ষিণদিঘি নামক স্থানে আমাদের বর্তমান সময়ের ‘গল্পরাজ’ হিসেবে খ্যাত এবং অতি সম্প্রতী ‘আনন্দবাজার’ পুরস্কার প্রাপ্ত কথা সহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের বাড়ি। যৌবনের অনেকটা সময়ই তার কেটেছে এই খুলনা শহরে। অনেকেই বলেন যে, খুলনা বিএল কলেজের প্রথম সাহিত্য পত্রিকাটিও প্রকাশ পেয়েছে হাসান আজিজুল হকের হাতে। প্রায়শই তিনি রাজশাহী থেকে ছুটে আসেন এখানে, অধ্যাপক কায়কোবাদ সাহেবের বাসায়, নিজের বাড়িতে ঘোরাঘুরি করেন। দিনকয়েক কাটিয়ে আবার ফিরে যান রাজশাহীতে। কোন কোন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন তখন তাকে নিমন্ত্রণও করেন বলে জানান সংগঠকরা। তবে অনেকেরই অভিযোগ তিনি সংগঠনগুলোতে যেতে পছন্দ করেন না বা যান না। যদিও এ প্রসঙ্গে হাসান আজিজুল হক বলেন, এটা অভিযোগ করতে হয় তাই তারা করেছে। আমি কিন্তু কখনো তাদের থেকে কোন অনানুষ্ঠানিক আমন্ত্রণও পাইনি। আমাকে মৌখিকভাবে বললেও আমি যেতাম। অল্প সময়ের জন্য খুলনায় যাই। ভাইয়েরা আছেন, কায়কোবাদ সাহেব আছেন, বেশিরভাগ সময়টা তাদের মাঝেই কাটে। কিন্তু কেউ সাহিত্যের কোন আড্ডায় আমাকে ডেকে পায়নি-এ অভিযোগ করতে পারবে না।
জেলা শহরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটভূক্ত ২২টি সংগঠন ছাড়াও এর বাহিরে অসংখ্য সংগঠন রয়েছে বলে জানিয়েছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের অন্যতম সদস্য ও জাতীয় কবিতা পরিষদের খুলনা শাখার সাধারণ সম্পাদক (২০০৯ সালে) কবি ও সম্পাদক আইফা রহমান। শুধু দৌলতপুর ও ফুলতলা থানাতেই প্রায় ৫০টি সংগঠন রয়েছে বলে জানিয়েছেন দৌলতপুর থানা উদীচীর সভাপতি এস এম মন্টু। তিনি আরও জানান, এ সব সংগঠনের মধ্যে বর্তমানে ২২টি সংগঠন নিয়মিত কার্যক্রম ধরে রেখেছে। জুটমিলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতাও প্রায় বন্ধ। তারপরও এখানে সাহিত্য-সাংস্কৃতির চর্চা থেমে নেই। দৌলতপুর উদীচীর সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে সবগুলো সংগঠনকে একত্রিত করে আন্দোলনের মাধ্যমে এখানে একটি শহীদ মিণার স্থাপন ও ২০০৭ এর ডিসেম্বরে দূর্নীতি বিরোধী র্যালী নিয়ে খুলনা থেকে হেঁটে ঢাকা শহীদ মিণারে গিয়ে সমাবেশ করা।
খুলনার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব শাহীন জামান পন বলেন, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে খুলনা জেলার অবস্থান অন্যসব জেলার তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী ও সম্মৃদ্ধ। আমাদের মত সাংগঠনিক ঐতিহ্য খুব কম জেলাতেই আছে। এখানে ১৯৬৩ সনে প্রথম সন্দীপন পরে প্রতিনিধি গ্রুপ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম শুরু করে। সন্দীপনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অধ্যাপক খালিদ রশীদ গুরু। ওনাকে ৭১ সালে হানাদাররা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। আর প্রথম প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক ছিলেন সাধন সরকার। তারা প্রথম গণ আন্দোলন শুরু করেন। এরপর নাট্যনিকেতন ছিল। সোসাইটি সিনেমা হলে তখন নাটক হত। এনামূল হক মিলু ছিলেন। পরবর্তীতে খুলনায় সংগঠন সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং জাতীয় রাজনীতিতে এখানের সংগঠনগুলোর ভূমিকা প্রচণ্ডভাবেই প্রশংসনীয়। ৯০-এর গণআন্দোলন বলেন, দূর্নীতি দমন আন্দোলনসহ সব আন্দোলনেই আমরা সক্রিয়।
প্রায় একই কথা বলেন কবি আইফা রহমান, আমরা এখানে সাংগঠনিকভাবে অনেক শক্তিশালী ভূমিকা রাখছি। ষাটের দশকে সন্দীপন নামের যে সাহিত্য সংগঠন তোলপাড় তুলেছিল পরবর্তীকালে সাহিত্য মজলিস, সাহিত্য পরিষদ একই ভূমিকা পালন করে। যদিও সাহিত্য মজলিসের কর্মকাণ্ড বর্তমানে প্রায় বন্ধ। ৮০-এর দশকে ঢাকায় যখন জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠন হয় একই সময়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে খুলনাতেও জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠন করা হয় এবং সে সময়ের আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখি আমরা। খুলনার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জাতীয় কবিতা পরিষদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এখানে ‘গর্জে উঠুক বাংলাদেশ’ নামের সাহিত্য পত্রিকা করে সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে চলেছি। সবাই এখানে পৃথক পৃথকভাবেই কাজ করে। সাহিত্য সংসদ আছে এখানে, প্রতিষ্ঠাতা হারুন অর রশীদ বাচ্চু। জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি বিমল কৃষ্ণ রায়। সাহিত্য মজলিশে আছেন রুহুল আমিন সিদ্দিকী। সাহিত্য পরিষদে আছেন সাধারণ সম্পাদক নিজামউদ্দিন। রাইটার্স ওয়ার্ল্ড আছে, সভাপতি মনির হাসান, সাধারণ সম্পাদক মেহরাব চপল, রাইটার্স ক্লাব আছে প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ডি কে মণ্ডল। এটি নিয়মিত সাপ্তাহিক সাহিত্য আসর করে। আমরাও নিয়মিত মাসিক সাহিত্য আসর করি। দৌলতপুরে আছে মোহনা সাহিত্য সংগঠন। প্রকাশনাও আছে এখানে। গাঙচিল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ, কেন্দ্রিয় কমিটি। দক্ষিণাঞ্চলের সব জেলাতেই এদের শাখা আছে। এদের প্রকাশনা রয়েছে। শুধু খুলনা জেলার কবি সাহিত্যিকদেরই প্রায় ৫২টি বই প্রকাশ করেছেন এ সংগঠনের কর্ণধার খান আক্তার। আবার অনেকগুলো পদকও তিনি দিয়েছেন।
আইফা রহমান আরও বলেন, খুলনার কবি সাহিত্যিকদের লেখা জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত না হলেও আমি বলবো সাহিত্য মানের দিক দিয়ে আমাদের অবস্থান মোটমুটি উচ্চমানের। ঢাকার সাহিত্য সম্পাদকরা মফস্বলের কবিদের কবি মনে করেন না, তাই তারা আমাদের কবিতা বা গল্প ছাপেন না। কিন্তু আমাদের এখানে প্রায় প্রতিটি সাহিত্য সংগঠনেরই নিজস্ব সাহিত্য পত্রিকা রয়েছে, সেখানে আমাদের লেখা নিয়মিত ছাপা হয়। জাতীয় পত্রিকায় আমাদের লেখা ছাপা হয় না বলেই আমাদের মধ্যে থেকে নতুন কাউকে সেভাবে উল্লেখযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা যাচ্ছেনা। সবাইতো আর হাসান আজিজুল হক নন যে, মফস্বলে বসে খ্যাতি অর্জন করবে। আর একটা বিষয় হচ্ছে আমাদের এখানের সাহিত্যচর্চায়ও দুটি ধারা আছে। একটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্যটি বিপক্ষের। আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যারা আছি তারা বিপক্ষ ধারার কাউকে নিয়ে কাজ করতে রাজি নই।
খুলনা জেলা লেখিকা সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামীমা সুলতানা শীলু বলেন, পাকিস্তানের শেষ সময়ে, বাংলাদেশ হওয়ার আগে এখানে এই খুলনা থেকে কিছু কিছু মহিলারা বেগম পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মুন্নু জাহান হোসেন, তিনি ছোট গল্প লিখতেন। মাজেদা আলীও লিখতেন। তখন আশির দশকের গোড়ার দিকে খুলনায় বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের একটি শাখা খোলা হয় ও কার্যক্রম শুরু হয়। দেখা যায়, খুলনায় এ সংগঠনের আবেদন অনেক বেশি। এটি তৈরি হওয়ার ফলে খুলনায় মহিলাদের আড্ডা দেওয়ার একটা জায়গা হয়। নিয়মিত এখানে সাহিত্য আসর বসা শুরু হয়। এখানে সাহিত্যের চর্চাটা শুধু সাহিত্য আসরে সীমাবদ্ধ থাকেনা। রীতিমত ঢাকার বিশিষ্টজনদের এনে এখানে কর্মশালার আয়োজন করা হয়। কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন আপা নিজে থেকেই এখানে এসেছেন। কবি আসাদ চৌধুরীসহ অনেক বড় বড় লেখক এখানে এসেছেন। ২০০০ সাল থেকে এ সংঘের কার্যক্রম আরও ব্যপকতা লাভ করে। এখন সাধারণ সদস্যই প্রায় দেড়’শ-এর মত। আমাদের মেয়েরাই কিন্তু আবার এখানের অন্যান্য সাহিত্য সংগঠনগুলোর সাথে জড়িত। যেমন সাহিত্য মজলিস, সাহিত্য পরিষদ এ সব সংগঠনেরও সদস্য তারা। সাহিত্য পরিষদের কর্ণধার হচ্ছেন অধ্যক্ষ মাযহারুল হান্নান। ওনার কার্যক্রম অবশ্য কম কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ অনুষ্ঠান করে তিনি সবাইকে চমকে দেন। গাঙচিল নামের একটি সংগঠন আছে। বেশিরভাগই প্রকাশনার কাজ করে এই সংগঠনটি। ঢাকার পরে গ্রন্থ প্রকাশের দিকে খুলনার যে সুনাম হয়েছে সেটা এই গাঙচিলের অবদান। তবে সত্যি বলতে কি এখানে লেখার মান খুব একটা ভালো নয়। কিছু কিছু ভালো। এই কিছু কিছু ভালোর মধ্যে যারা আছেন তাদের আসলে গোনা যায়। যেমন কামাল মাহমুদ, চঞ্চল শাহরিয়ার নামে দু’জন ছিলেন, ভালো লিখতেন। এখন ঢাকায় চলে গেছেন। এ রকম অনেকেই যারা ভালো লিখতেন ঢাকায় চলে গেলেন। এরা থাকলে আমাদের সাহিত্য সম্মৃদ্ধ হত। এখন যেটা হয়েছে, এই আমার মত কিছু, সাহিত্য কিছুই হয়না কিন্তু মনের টানে চর্চাটা চালিয়ে যাচ্ছি। দেদারছে বই বের করছি। কেউ পড়ুক আর না পড়ুক তৃপ্তিতো পাচ্ছি। তবে ইদানিং শিশু সাহিত্যে একটা ঝোঁক এখানে লক্ষ্য করা গেছে। এখানে একজন ভাষা সৈনিক আছেন সমীর আহমেদ, তিনি ছোটদের নিয়ে লিখছেন। লেখিকা সংঘের সভানেত্রী মাজেদা আলী শিশুদের নিয়ে লিখছেন। গাঙচিলের আশরাফ হোসেনও শিশু সাহিত্যে ভালো। আমাদের নাসরীন হায়দার ও লেখেন। তবে নাসরীন কবিতায় ভালো, প্রবন্ধও লেখে। লেখিকা সংঘ থেকে নিয়মিত লিটলম্যাগও প্রকাশ করা হয়।
এদিকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চা নিয়ে সদরের কেউ কোন কথা না বললেও বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক সংগঠনগুলোর উপদেষ্টা ও এগ্রো টেকনোলজী বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল ইসলাম (২০০৯ সালে) বলেন, এখানে বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘীরে মোট ১৬টি সংগঠন, তবে ১২টি সংগঠন নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন আরও কিছু সংগঠন তৈরি হচ্ছে। বেশিরভাগ সংগঠনই সাহিত্য নির্ভর। বপাট, সুত্রপাত, রিডার্স ফোরাম ইত্যাদি। এ সব সংগঠন থেকে নিয়মিত লিটলম্যাগ প্রকাশ করে। নোয়াই, সুত্রপাত, ছায়াবৃত্ত ইত্যাদি নামে বেশ কিছু পত্রিকা বের হচ্ছে। শহরে উদীচী থেকে আমরা বের করছি অরিত্র নামের সাহিত্যপত্র। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চায় তরুণদের মধ্যে রতন, জুবায়ের, আলিফ, কিরণ, হাফিজ, মিঠুন এদের মধ্যে প্রতিভা আছে। তবে ওভারঅল সাহিত্য বা সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুলনা অন্যসব জেলার তুলনায় অনেক পিছিয়ে। এখানে অসংখ্য সংগঠন আছে কিন্তু একে-অপরের মধ্যে সদ্ভাব নেই। পরস্পর সমঝোতার অভাবটাও প্রকট। খুলনার সাহিত্য নিয়ে যদি কেউ সত্যিকারই কাজ করেন তাদের মধ্যে অচিন্ত্য কুমার ভৌমিক, অসিত বরণ ঘোষ, উদীচীর সাবেক সভাপতি বিরেন্দ্রনাথ রায়, শরীফ আতিকুজ্জামান পিন্টু আর বিষ্ণুপদ সিংহ এ নামগুলোই আগে উঠে আসবে।
(এরপর পুড়ুন সাতক্ষীরার সাহিত্য নিয়ে প্রতিবেদন)