কবি শোয়েব শাদাব সম্মাননা ও ‘লোক’ কবিতাভ্রমণ বৃত্তান্তঃ অনিকেত শামীম

অতিথি লেখক

Sharing is caring!

কবি শোয়েব শাদাব সম্মাননা ও ‘লোক’ কবিতাভ্রমণ বৃত্তান্ত
…………………………

অনিকেত শামীম 

কবিতার ইতিহাসে পৃথিবীর কোনো কবিকে তার নিজ বাড়িতে গিয়ে পুরস্কৃত/সম্মাননা জ্ঞাপন করার কথা আমাদের জানা নেই। আমাদের সৌভাগ্য যে, বাংলা ভাষার একজন কবি তথা শোয়েব শাদাবকে আমরা তার নিজ বাড়িতে গিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত চিত্তে সম্মাননা জ্ঞাপনের সুযোগ পেয়েছি।
উল্লেখ্য, কবি বিনয় মজুমদারকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’টি প্রদান করা হয়েছিল তার বাড়িতে গিয়ে।

১.
২৯ অক্টোবর, শীতের আমেজ ভরা সাতসকাল।আমরা প্রায় ১২৫ জন কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক ‘লোক’ আয়োজিত কবিতাভ্রমণে অংশগ্রহণ করি (ঢাকা-ত্রিশাল-সাখুয়া) শাহবাগ জাদুঘরের সামনে থেকে ২টি রিজার্ভ বাস যোগে। প্রথম বাসটি যথাসময়ে অর্থাৎ সকাল সাড়ে সাতটায় উপস্থিতিদের নিয়ে ছেড়ে যায়। দ্বিতীয় বাসটি আটটায়। কেউ কেউ নিজস্ব গাড়িতে করে রওনা দেন। তাছাড়া বগুড়া, ময়মনসিংহ, মুক্তাগাছা, তারাকান্দা, নেত্রকোনা, জামালপুর ও আরো নানা জায়গা থেকে অনেকেই অংশগ্রহণ করেন। বাস উত্তরা অতিক্রমের পর সকালের নাস্তা হিসেবে ভুনা খিচুড়ি দেয়া হয়।

পরে অংশগ্রহণকারী সবাইকে একটি নান্দনিক ব্যাগ উপহার দেয়া হয়। ব্যাগের মধ্যে সদ্য প্রকাশিত ‘লোক’-এর শোয়েব শাদাব সংখ্যা, ‘লোক’ নামাঙ্কিত কলম ও প্যাড সরবরাহ করা হয়।
যদিও পরবর্তীতে অংশগ্রহণকারী ময়মনসিংহের কয়েকজনকে শেষমেশ দিতে পারিনি, এজন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।

শাদাব একই দিনে তিনটি সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন :
১) জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক।
২) বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি লিটল ম্যাগাজিন ‘শব্দমঙ্গল’ থেকে আমাকেসহ এবং
৩) তার নিজ বাড়িতে ‘লোক’-এর পক্ষ থেকে।

‘শব্দমঙ্গল’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের একটি লিটলম্যাগ ও সংগঠন। তাদের পক্ষ থেকে শাদাব ও আমাকে ক্রেস্ট, উত্তরীয় এবং তাদের প্রকাশিত কয়েকটি সংখ্যা দেয়া হয়। খুবই নান্দনিক এবং রুচিশীল তাদের পত্রিকা। বুঝতে পারি এর নেপথ্যে আছে তাদের শিক্ষক, চিত্রশিল্পী, সাহিত্য-সংগঠক ও কবি দ্রাবিড় সৈকত। তাদের আন্তরিকতা আমাদের অভিভূত করেছে।

মনে পড়ে যায়, লোক-এর সহযোগী পাল্টা-প্রতিষ্ঠান ‘লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণ’-এর পক্ষ থেকে ২০১২ সালে দ্রাবিড় সৈকত সম্পাদিত লিটলম্যাগ ‘অর্বাক’কে পুরস্কৃত করা হয়েছিল এবং সেটিই ছিল লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণের শেষ পুরস্কার, যার আর্থিক মূল্য ছিল দশ হাজার টাকা।

শব্দমঙ্গলের উত্তরীয় দেখে কবি নাসির আহমেদ কৌতূহলী হয়ে বলেন, আহা, এত সুন্দর একটা উত্তরীয় আমাকে দিলো না (কৌতুক করে)। আমি নিজের গলা থেকে তাকে তা দিয়ে দিতে চাইলে কে একজন বললেন, শামীম ভাই, এতে আপনার নাম লেখা আছে তো। প্রথমে আমি খেয়াল করিনি। তাই তাকে আর দেয়া হলো না।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়া হয়।
প্রাণবন্ত অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কন্ফারেন্স হলটি যেন কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের আন্তরিক মিলনমেলায় রূপ নেয়। অনুষ্ঠানের শেষদিকে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ও মজিদ মাহমুদ উপস্থিত হন। তাদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠান আরো উদ্ভাসিত হয়ে উঠে এবং অনুষ্ঠান শেষ হতে জুমার নামাজের সময়ও পার হয়ে যায়।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মাননীয় উপাচার্য মহোদয় অসাধারণ হৃদয়স্পর্শী ও কাব্যিক ভাষায় তার বক্তব্য প্রদান করেন এবং শোয়েব শাদাবের হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন। মাননীয় উপাচার্য তাঁর বক্তব্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ৪ বছরের সময়ে আজকের মতো এত বিদ্বৎজন সংবলিত এমন তরতাজা প্রফুল্ল দুপুর আর আসেনি।
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জানান, আজ থেকে ১০৭ বছর আগে ঠিক এই এলাকায়, দরিরামপুরে, আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের আনাগোনা ছিল। আর এখন শোয়েব শাদাবের।
কবি নাসির আহমেদ তার প্রতিক্রিয়ায় জানান, শোয়েব শাদাবের কবিতা পড়লে প্রথমত মনে হবে খাপছাড়া। কিন্ত গভীর মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করলে যেকোনো পাঠক উপলব্ধি করবেন, বাংলা কবিতার ঐতিহ্যের সঙ্গে তার লেখা ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট এবং ভিন্নধর্মী।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সভাপতি কবি ফরিদ আহমদ দুলাল, প্রধান অতিথি এবং কবি শোয়েব শাদাবকে ‘লোক’-এর পক্ষ থেকে উপহার প্রদান করা হয়। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আমি মাননীয় উপাচার্য মহোদয়কে কবি শোয়েব শাদাবকে সম্মাননা প্রদান করায় ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি।

তাছাড়া মাননীয় উপাচার্যকে ‘অনিন্দ্য’ সম্পাদক হাবিব ওয়াহিদ শিবলী খদ্দরের পাঞ্জাবি কাপড় উপহার দিয়ে তাঁর বক্তব্য প্রদান করেন। কবি সরকার মাসুদ, কথাসাহিত্যিক পারভেজ হোসেন, কবি শোয়াইব জিবরান, কবি শাবিহ মাহমুদ-সহ কয়েকজন আলোচনা করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রছাত্রী ও ভ্রমণে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন শাদাবের কবিতা থেকে আবৃত্তি করেন। অনুষ্ঠান চলাকালে কিছুক্ষণ পর পরই শোয়েব শাদাব টেবিলের উপর রাখা তাকে দেয়া গোলাপের তোড়া হাতে নিয়ে (কবিসুলভ ভঙ্গিতে) বারবার ঘ্রাণ শুঁকছিলেন।

শোয়েব শাদাবের বক্তব্যের পালা এলে তিনি দাঁড়িয়ে বলেন : ‘কবি শোয়েব শাদাবকে নিয়ে আমি আর কী কইতাম, তারচেয়ে কবি শোয়েব শাদাবের কবিতা পড়ি, আফনেরা মনযুগ দিয়ে শুনুইনযে’ বলেই তিনি তার ‘আবহমান’ কবিতাটি পড়লেন, মুখস্থ। তার পর চারিদিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে শাদাব সবাইকে তার বাড়িতে দুপুরের খাবারের আমন্ত্রণ জানান।

২.
দুপুর আড়াইটার দিকে আমরা বাংলার একটি চিরায়ত গ্রাম, সুতিয়া নদীর তীরে শোয়েব শাদাবের গ্রামের বাড়ি সাখুয়ায় পৌঁছি। সেখানে গিয়ে দেখি, সে এক বিশাল এলাহি আয়োজন! তাদের বাড়ির আঙিনায় বিরাট প্যান্ডেল ও মঞ্চ। প্যান্ডেলে প্রথমে খাবারের আয়োজন। আমাদের কয়েকজনকে (হুদা ভাই, নাসির ভাইসহ) আমাদের আপত্তি সত্ত্বেও বাড়ির ভেতরের রুমে নিয়ে গিয়ে আপ্যায়িত করা হলো। খাওয়া-দাওয়া শেষে টেবিল সরিয়ে ঐ প্যান্ডেলেই দর্শক-শ্রোতার উপযোগী করে অনুষ্ঠান শুরু হলো প্রায় চারটার দিকে।
অনুষ্ঠানের সভাপতি শোয়েব শাদাবের ছোটভাই, সাখুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ মো. গোলাম ইয়াহিয়া, প্রধান অতিথি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, বিশেষ অতিথি কবি নাসির আহমেদ।
শুরুতেই মঞ্চে উপবিষ্ট আমাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়ার পর লোক-এর পক্ষ থেকে কবি শোয়েব শাদাবকে কাঙ্ক্ষিত সম্মাননা জ্ঞাপন করা হয়।

তার পর চিত্রশিল্পী আমানউল্লাহ তার আঁকা শাদাবের পোর্ট্রেট ফ্রেমবাঁধাই করে উপহার দেন শাদাবকে, বাহার রহমান তার প্রতিষ্ঠান ‘নিত্য উপহার’ থেকে নজরুলের পঙক্তি খচিত চাদর উপহার দেন তার বন্ধুকে। আরও অনেকেই তাদের বই আর লিটলম্যাগ উপহার দেন। কবি শামসুল ফয়েজ, কবি ও সাংবাদিক রওশন ঝুনুসহ তার পরিবারের অনেকেই খুবই আবেগস্পর্শী বক্তব্য দেন। কবি আহমেদ শিপলু, নূরুননবী শান্ত, মাশরুরা লাকী, রাজিয়া সুলতানা, জেবুন্নেসা রিনা, রুহুল আমিন বাদল-সহ (যাদের নাম এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না, তাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী) অনেকেই শাদাবের কবিতা থেকে আবৃত্তি করেন।

প্রধান অতিথি হুদা ভাইয়ের অন্য একটি প্রোগ্রাম থাকায় তিনি আগে বক্তব্য দিতে চাইলেন। সভাপতি ইয়াহিয়া হুদা ভাইয়ের আগেই তার বক্তব্যে হুদা ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত একটি হলের নাম ‘শোয়েব শাদাব’-এর নামে করা হোক।’ পরে হুদা ভাই তার বক্তব্যে জানান, ‘হলের নামকরণের বিষয়টি তো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা ইউজিসি নির্ধারণ করেন। তবে আমি আমার সাধ্য অনুযায়ী সুপারিশ করবো। তবে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে যদি ‘শোয়েব শাদাব কবিকেন্দ্র’ করার উদ্যোগ নেয়া হয়, সেটিই হবে যথোপযুক্ত। এবং সে ব্যাপারে আমি সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো।’
আমার বক্তব্যের শেষদিকে (তখন হুদা ভাই তার বক্তব্য দিয়ে চলে গেছেন) আমি বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে কবি শোয়েব শাদাব-এর কবিতাসংগ্রহ প্রকাশ করার জোর দাবি জানাই। এবং এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের সঙ্গে আলাপ করে বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে মর্মে ঘোষণা দিই।

অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার কথা ছিল সন্ধ্যা ৬টায়। কিন্তু বক্তব্য ও কবিতাপাঠ শেষ হতেই সাড়ে ৭টা বেজে যায়। ঢাকায় যারা ফিরবেন তাদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা শুরু হয়। পরবর্তী আয়োজন ছিল নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের গানের দলের সংগীত অনুষ্ঠান। সংগীত অনুষ্ঠানের শুরুতেই ঢাকা থেকে আগত কবি-সাহিত্যিকগণ রিজার্ভ বাসে উঠে পড়েন। তার পরেও প্যান্ডেল স্থানীয় দর্শক-শ্রোতায় ভরপুর থাকে। অনেকেই বিভিন্ন গানের অনুরোধ করতে থাকেন। শোয়েব শাদাবও ‘ওরে নীল দরিয়া…’ গানটি গাওয়ার অনুরোধ করেন। মনোজ্ঞ সংগীত অনুষ্ঠানটি চলে রাত প্রায় ৯টা পর্যন্ত।

সবমিলিয়ে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ঐকান্তিক উষ্ণতা ও কবি শোয়েব শাদাবের পরিবারের আথিতেয়তা আমাদের দীর্ঘপথের সকল ভ্রমণক্লান্তি মুছে দেয়। কবি শোয়েব শাদাবকে কেন্দ্র করে ‘লোক’ আয়োজিত এই কবিতাভ্রমণ ও আনন্দ সম্মিলনীতে সত্যিই আমরা উজ্জীবিত সবাই।

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!