তুমি যাও বন্ধু, আমরাও আসিতেছি
অনাদী পথের সাথী হতে
তোমার পিছু পিছু
আজ নয়তো কাল আসতেই হবে, হতেই হবে এ পথের যাত্রী।
এখানে তুমি সাথীহীন হলেও ওখানে পাবে তার দেখা
খুঁজেছিলে যাকে আর ডেকেছিলে বারেবার
লেখনী তোমার বুঝেনি যে কৌশলী বাঁকে
তাকে যায়নি কখনো ডাকা।
এখানে আমি তোমাকে দেখালাম চরম অবহেলা
ওখানে তোমার পাওনা রহিল আজন্ম বরণডালা।
নিউইয়র্কে বসবাসরত বাংলা ভাষায় বর্তমান সময়ের অন্যতম প্রধান কবি, একুশে পদকপ্রাপ্ত শহীদ কাদরীর আর নেই। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নাইলাইহি… রাজিউন। নিউইয়র্কের রোববার স্থানীয় সময় সকাল ৭ টায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন বলে জানিয়েছেন কবি পত্নী নীরা কাদরী। সোমবার উচ্চ রক্তচাপ এবং তাপমাত্রা জনিত কারণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে ৭৪ বছর বয়সী এই কবিকে নিউইয়র্কের নর্থ শোর ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শুক্রবার কবির শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা। কিন্তু শনিবার বিকেলে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে এবং আই সিইওতে থাকা কবি সকালে সবাইকে কাঁদিয়ে পরপারে চলে যান। কবির মৃত্যুর খবরে নিউইয়র্কে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। অনেকই ছুটছেন হাসপাতালের পানে। নিউইয়র্ক কনসাল জেনারেল শামীম আহসান জানিয়েছেন, তিনি মৃত্যুর খবর শোনে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ছুটছেন। পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তিনি বিস্তারিত জানাবেন বলে জানান।
বাংলা কবিতার অন্যতম জীবিত কিংবদন্তি কবি শহীদ কাদরী গত ১৪ আগস্ট ৭১ বছরে পা রাখেন। ১৯৪২ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন কলকাতার পার্ক সার্কাসে। ১০ বছর বয়সে চলে আসেন ঢাকায়। ১৯৫৩ সালে, মাত্র এগারো বছর বয়সেই, ‘পরিক্রমা’ শিরোনাম দিয়ে তিনি একটি কবিতা লিখে ফেলেন, যেটি ছাপা হয় মহিউদ্দিন আহমদ সম্পাদিত ‘স্পন্দন’পত্রিকায়। এরপর লিখেন, ‘জলকন্যার জন্য। সেটিও স্পন্দনেই ছাপা হয়। এভাবেই শুরু। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার বের হয় ১৯৬৭ সালে। তখন তাঁর বয়স ২৫ বছর। এই গ্রন্থে অবশ্য প্রথম রচিত কবিতা দুটি সন্নিবেশিত হয়নি। ‘উত্তরাধিকার’এ সংকলিত কবিতাগুলো কৈশোর এবং প্রথম যৌবনে রচিত হলেও ম্যাচিউরিটির কোনো অভাব নেই তাতে। একজন কবির বয়স যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ কবি শহীদ কাদরী। কবি শহীদ কাদরীর কবিতায় শরতের উপস্থিতি শরৎ ঋতু-বৈশিষ্ট্যের আবহে অবস্থান করেই তা কখনো বিপ্লবী, কখনো মানবিক আবার কখনো স্বপ্নচারী।’নশ্বর জ্যোৎস্নায় কবিতায় তিনি একটি সময়ের কথা বলেছেন যে সময় এখনো আসেনি। কবিতাটিতে তিনি যে চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন তা বাংলার শরৎ ঋতুরই ছবি।
‘জ্যোৎস্নায় বিব্রত বাগানের ফুলগুলি, অফুরন্ত/হাওয়ার আশ্চর্য আবিষ্কার করে নিয়ে/চোখের বিষাদ আমি বদলে নি’আর হতাশারে/নিঃশব্দে বিছিয়ে রাখি বকুলতলায়/সেখানে একাকী রাত্রে, বারান্দার পাশে/সোনালি জরির মতো জোনাকীরা নক্সা জ্বেলে দেবে’।
তিনি ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা শহরে জন্ম এবং সেখানেই কেটেছে প্রাক-কৈশোরের কিছুটা সময়। দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা শহরে অভিবাসন, তিন দশক এই শহরে অবস্থান, অতঃপর বার্লিন, লন্ডন, বোস্টন হয়ে নিউইয়র্কে বসবাস। তিনি একজন পরিপূর্ণ নাগরিক কবি । প্রকৃতপক্ষে গ্রামীণ জীবনের স্বাদ গ্রহণ বা অভিজ্ঞতা অর্জনের কোনো সুযোগই তিনি পাননি। যে কারণে তার কাব্যভাষাটিও হয়ে উঠেছে শহুরে। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘কাব্যভাষা তৈরির জন্য অভিজ্ঞতা লাগে, বই পড়ে নিজস্ব কাব্যভাষা তৈরি হয় না।’ তাই তার কবিতায় শরৎ এসেছে নাগরিক দ্যোতনা নিয়ে।
এ যাবৎ প্রকাশিত শহীদ কাদরীর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা চারটি: ‘উত্তরাধিকার’, ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা , ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ এবং ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও। নিউইয়র্কে অবস্থানকালীন সময়ে প্রবাসে রচিত কবিতাগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’। অন্য তিনটি গ্রন্থের কবিতাগুলো তিনি রচনা করেন দেশছাড়ার আগেই অর্থাৎ ১৯৭৮ সালের মধ্যেই। এই চারটি গ্রন্থে সন্নিবেশিত কবিতার সংখ্যা ১২২টি। এর পরে তিনি আরও চারটি কবিতা লিখেন। এর তিনটি ছাপা হয় ‘কালি ও কলম’-এ, অন্যটি প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায়। সব মিলিয়ে তার কবিতার সংখ্যা ১২৬টি। শালিক নাচে টেলিগ্রাফের তারে,/কাঁঠালগাছের হাতের মাপের পাতা/পুকুর পাড়ে ঝোপের ওপর আলোর হেলাফেলা/ এই এলো আশ্বিন,/আমার শূন্য হলো দিন/কেন শূন্য হলো দিন?/মহাশ্বেতা মেঘের ধারে-ধারে/আকাশ আপন ইন্দ্রনীলে ঝলক পাঠায় কাকে?/ছাদে-ছাদে বাতাস ভাঙে রাঙা বৌ-এর খোঁপা/এই এলো আশ্বিন,/আমার শূন্য হলো দিন/কেন শূন্য হলো দিন?/শিউলি কবে ঝরেছিল কাদের আঙিনায়/নওল-কিশোর ছেলেবেলার গন্ধ মনে আছে?/তরুণ হাতের বিলি করা নিষিদ্ধ সব ইস্তেহারের মতো/ব্যতিব্যস্ত মস্তো শহর জুড়ে/এই এলো আশ্বিন,/আমার শূন্য হলো দিন/কেন শূন্য হলো দিন?’ এই কবিতায় কবি শহীদ কাদরী দিন শূন্য হওয়ার কথা বলেছেন, দিন ফুরানোর ঘণ্টাধ্বনি তিনি শুনতে পাচ্ছেন, যেমনি করে শরৎ পাতা ঝরিয়ে দিয়ে বৃক্ষকে শূন্য করে ফেলে। উল্লেখ করার মতো হচ্ছে, ‘আমার শূন্য হলো দিন’ এই পঙ্ক্তিটির পরে প্রতিবারই তিনি আরও একটি প্রশ্নবোধক পঙ্ক্তি লিখেছেন, ‘কেন শূন্য হলো দিন?’
এই প্রশ্নের মধ্যে রয়েছে খেদ, ক্ষোভ, হতাশা। ‘দিন ফুরানো’ তিনি মেনে নিতে পারছেন না। কবিতো তখন যুবক ছিলেন। তাহলে ‘দিন ফুরানো নিয়ে তার এত আক্ষেপ কেন? প্রকৃতপক্ষে কবি অন্য এক ভবিতব্যের ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলেন। দেশছাড়ার ঘণ্টাধ্বনি। তিনি এ-ও আঁচ করতে পেরেছিলেন যে তাঁর কবি জীবনের প্রায় যবনিকাপাত ঘটতে যাচ্ছে।
এরপর দীর্ঘ দীর্ঘ বিরতি। প্রায় তিন দশক পরে মাত্র ৩৬টি কবিতা নিয়ে ২০০৯ এ প্রকাশিত হয় ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’। সেইদিক থেকে শুধু দেশ ছেড়ে যাওয়াই নয়, যেন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তার কবি জীবনের দিনও শূন্য হতে চলেছে।কোনো এক ঘন বর্ষণের দিনে কবি ‘বৃষ্টি, বৃষ্টি’ কবিতাটি লিখেছেন।
যে অবিরাম বর্ষণের কথা এই কবিতায় এসেছে তা কালবোশেখির বৃষ্টি নয়, এই বৃষ্টি বর্ষার শেষে বা শরতের শুরুতেই দেখা যায়, যার গ্রোতধারায় ‘ভেসে যায় ঘুঙুরের মতো বেজে সিগারেট-টিন/ভাঙা কাঁচ, সন্ধ্যার পত্রিকা আর রঙিন বেলুন/মসৃণ সিল্কের স্কার্ফ, ছেঁড়া তার, খাম, নীল চিঠি/লন্ড্রির হলুদ বিল, প্রেসক্রিপশন, সাদা বাক্স ওষুধের/শৌখিন শার্টের ছিন্ন বোতাম ইত্যাদি সভ্যতার/ভবিতব্যহীন নানা স্মৃতি আর রংবেরঙের দিনগুলি’।
(লেখাটি দৈনিক প্রথম আলো থেকে নেয়া)