যতোদূর বাংলা ভাষা ততোদূর এই বাংলাদেশ
অসামান্য সুন্দর ব্যাঞ্জনাময় এই পঙক্তি । ষাট দশক থেকে শুরু করে আজও অবধি যে ক’জন মেধাবী কবি বাংলা কাব্য-ভূবন কাঁপিয়ে কবিতা নির্মাণে মেধার সাক্ষর রেখে আসছেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা তাদের মধ্যের অন্যতম প্রধান কবি। লিখে চলেছেন যে কোন তরুণের চেয়ে অনেক বেশী । বহু-মাত্রিক এই কবি কেবল মাত্র কবিতা রচনাই নয় বাংলা কাব্যে স-চেতন কাব্য-আন্দোলনের প্রধান সংগঠক । কথা সাহিত্য, প্রবন্ধ. ছোটগল্প লেখক এবং নতুন কাব্য আন্দোলনের একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তিনি যেমন সমাদৃত হয়েছেন নিজ দেশে তেমনি আন্তর্র্জাতিক পর্যায়ে তাঁর কাব্য-কৃতি স্বীকৃতি পেয়েছে। তার লেখা দেশ-বিদেশে নানা ভাষায় অনুদিত হয়েছে । বাংলাদেশে কপি রাইট আন্দোলন তাঁর চেষ্টায় আন্তর্জাতিক রূপ পেয়েছে এবং তিনি তার সাথে সক্রিয় ভাবে যুক্ত রয়েছেন ।
এঙ্গেলস-এর মতে ‘ইতিহাসের গতি এমনই যে শেষতক যা ঘটে তা বহু ব্যক্তির সঙ্কল্পের সংঘর্ষের ফল আর এই সংকল্প আবার প্রত্যেকটি জীবনের বহু বিশেষ অবস্থার দ্বারা গঠিত সুতরাং বহু শক্তির প্রতিচ্ছেদ আছে, বহু সামান্তরিক শক্তি আছে যার ফল হচ্ছে কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা..’ কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা কবিতা নির্মাণের নানা পর্যায় অতিক্রম করে বর্তমানে বাস্তবতার কবিতায় তার মেধা-মনন শক্তিকে নিয়োজিত করেছেন কাব্য নির্মাণের এমন এক জিজ্ঞাসায়, যেখানে বহুর আকাঙ্খা আছে। তিনি বহুর আকাঙ্খা ও স্বপ্নকে সচেতন কাব্য-নির্মাণের মধ্য দিয়ে শিল্প-সত্তা মানবমুখি করে তোলার চেষ্টা করছেন যা ইতিহাসের দাবীর সংগে সম্পৃক্ত। এ’দিক দিক থেকে তিনি প্রান্তিকতার কবিতায় বিশ্বাসী নন, কবিতার বহু মাত্রিকতা-প্রিয়তার অনুগামী। কোন হৈ চৈ নেই, আছে স্বপ্নগুলো সচেতন ভাবে পাঠকের মনে জাগরিত করে চিন্তা-কর্ম-ভাবনায় নতুন জিজ্ঞাসার উদ্রেক ঘটানো। নতুন হৃদ-স্পন্দনে মানুষকে সম্পৃক্ত করা। কবি যেমন তাঁর জাতিসত্তার কবিতায় ( ,৯২ সালে প্রকাশিত) সচেতন ভাবেই একটি জাতির নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষনের মধ্যদিয়ে তাঁর আদি পর্বের ইতিহাস, ইতিহাসে তার বিস্তার, তার সংগ্রাম, জয়-পরাজয়, নির্মাণ এবং বিবর্তন ইত্যাদিকে কাল পঞ্জির মতো বিশ্লেষিত করে কাব্য-রসায়ন নির্মাণ ও পূনর-নির্মাণ করছেন এবং শিল্প-মানকে অটুট রেখে কবিতা কে নতুন স্বপ্ন-ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিতে কর্ম-মুখর রয়েছেন । ১৯৯২ থেকে ২০১৩ দীর্ঘ সময়ে তাঁর আরো ২২/২৩ টি কাব্য প্রকাশিত হয়েছে । আলোচ্য ২ টি কাব্য তারই ধারাবাহিকতা ।
১. বুনতে বুনতে বেড়ে উঠি, বুনতে বুনতে বুড়ো হয়ে যাই;
আমার অস্তিত্ব জুড়ে অসংখ্য সুতোর দাগ
বুকের গভীরে ঘোরে জন্মস্মর সুতো-কাটা কল
শিরায় শোণিত-স্রোতে
সুতোর মতোন কত শ্বেত শুভ্র নদী
পলিহীন প্লাবনবিহীন
সে নদীতে ভেসে ওঠে নাওয়ের বহর,বুকে তার
হাসন-লালন আর এক তারে বাঁধা লক্ষ সাঁই;
পুনর্বার
এই ডাঙা ছেড়ে যাই শ’খণ্ড স্বদেশ ছেড়ে অখণ্ড স্বদেশে
যাই মূল স্বপ্নে যাই ।
২. বৃক্ষ তুমি জমজ ভ্রাতা
পাখি তুমি বোন
মা গঙ্গা ভগীরথী
শেকড়-কথা চারিয়ে দিলাম
তামাটে এক দ্রাবিড় গ্রিয়ট
গল্পগুলো চারিয়ে দিলাম
৩. ‘তোমাদের হাড়গুলো বাংলার হৃদপিণ্ডে অবিনাশী ঝড়
বাঙালীর জন্মতিথি,রক্তে লেখা ষোলো ডিসেম্বর.’।
{জাতী সত্তার কবিতা, কাব্য]
অর্থাৎ ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত বিশাল বয়নে তাঁর এই কাব্য-নান্দনিকতা কাব্য-পিপাসু মানুষকে প্রাশান্তি দেয় এবং তিনি জাতিসত্তার কবি বলে সকলের আন্তরিক স্বীকৃতি পেয়ে যান ।
‘ভালোবেসে জীবনকে আনগ্ন চেয়েছি
আমরা তামাটে জাতি, আমরা এসেছি
রাজধর্ম পিছে ফেলে পিছে ফেলে গোত্রের আরতি
লোকধর্মে লোকসংঘে সুদীক্ষা নিয়েছি
আমরা তামাটে জাতি, আমরা এসেছি ।’
[জাতি সত্তার কবিতা. কাব্য]
ঘোষণা পত্রের মতো ‘আমরা তামাটে জাতি’ শিরোনামের কবিতাটি। বাঙালী জাতিসত্তার নানা স্তর অতিক্রমণ– তার অস্তিত্ব স্বাধীন ভাবে ঘোষণার মধ্যদিয়ে শেষ হয়েছে ‘জাতিসত্তার কবিতা’। অর্থৎ শুরুর পর্যায় থেকে নানা ধাপ নির্মাণে একটি জাতির অস্তিত্ব ঘোষণার পর্যায়গুলো কে অতিক্রম করেছেন কাব্যিক শৈলীতে। নির্মাণে উত্তরাধিকারিত্ব রয়েছে বাংলা কাব্য-ধারাবাহিকতায় আধুনিক পর্বের বুননে,ভাব-ভাষা-উপমা-উৎপ্রেক্ষার মিশেলে। ফলে কবিতাগুলো খণ্ড-আকারে পাঠকের সামনে এলেও অখণ্ডের জমিনে পড়ে নিতে অসন্তুুষ্টি থাকে না । হেগেলের মতে ‘শ্রেষ্ঠ শিল্প ও দর্শন অভিন্ন’ এই কাব্যে শেষতক বিধৃত হয়েছে এক দর্শন যা ‘লোক ধর্মে লোকসংঘে সুদীক্ষা নিয়েছি’-র মধ্যদিয়ে উপমহাদেশের ঐতিহ্যকেও ধারণ করে যুক্ত করে বিশ্ব-মানব সংস্কৃতির মৌলিকের সংগে যা সবসময়ই গণমুখি এবং গণ-মানুষের এবং যা নানা সময়ে সার্থ-অন্বেষী নিপীড়ক শাক্তি দ্বারা রুদ্ধ হয়েছে, লুন্ঠিত হয়েছে. কুক্ষিগত হয়ে আছে। তবু দেশে দেশে মানুষ সংগ্রাম করেছে, তার ভাষার জন্যে, তার সংস্কৃতির জন্যে, তার জীবন বদলানোর জন্যে এবং চূড়ান্ত ধাপে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার জন্যে ।
প্রতিভাধর কবি, সাহিত্যিক,শিল্পী কখনোই জীবন বিমুখ হন না। সৃষ্টিতে নানা ব্যতিক্রম থাকলেও তাঁদের প্রতিভার প্রকাশ শেষমেষ মানুষের পক্ষে থেকে যায় এটা-ই সত্য । তারপরেও নানা বিমুখতা আমরা লক্ষ্য করি, এবং ভাব-বিলাসের যাত্রায় অনেক কে জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেও দেখি– আখেরে তাঁরা ইতিহাসের করুণা ছাড়া আর কিছুই পায় না । দা’ ভিঞ্চি বলেছিলেন ‘একজন শিল্পী তখনই শিল্পী যখন অন্য মানুষের চকিতে অনুভবকরা সত্যকে সৃষ্টিযোগ্য বিষয় রূপে দেখেন’ ।
‘নন্দনতত্ত্বের বিতর্কিত প্রশ্ন শিল্পের বিষয় ও রূপ অর্থাৎ শিল্প বিষয এবং রূপের সমন্বয়ই শিল্পের নান্দনিক প্রকাশ’ । শেলীর কাব্যের বিশেষ গুণ যেমন গতিশীলতা, প্রচন্ড অন্তর আবেগে, মূর্তবাণী বিশাল মানব সমুদ্রে মিলিত হয় তেমনি কবি নুরুল হুদার কাব্য-আবেগ শেষতক মানব প্রেমেরই অনুষঙ্গ হয়ে থাকে এবং ছড়িয়ে পড়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো তটভূমির দিকে। ‘জাতিসত্তার কবিতায়’ কবিতার গঠন এবং পঙক্তির নির্মাণ-বি¯তার-বিন্যাস-এর স্বতন্ত্রতা এখানে । যেমন–
‘তোমার স্মৃতিতে আজ লেখা হয় জীবনের লাল ইতিহাস
তোমার হাড়ের বহ্নি তাপ দেয় গৃহে গৃহে শীতার্ত নিশীথ’ ।
[ জাতি সত্তার কবিতা, কাব্য]
নির্মাণের গুণে উপমা-উৎপ্রেক্ষা এবং মিথ সম-পুষ্টিতে মিশে গেছে প্রতিটি পঙক্তিতে শব্দের ওজন মাপা গাণিতিক নিয়ম ব্যবহারের কারণে । ফলে রূপ-রস-আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে কাব্য-শরীরে এবং অখণ্ড হয়ে উঠেছে ।
‘যতোদূর বাংলাভাষা ততোদূর এই বাংলাদেশ’
এই পঙক্তি যতোদূর বাংলাভাষা ততোদূর এই বাংলাদেশ কাব্য ভুক্ত কবিতা । আমরা তামাটে জাতি আমরা এসেছি জাতিসত্তার কবিতা কাব্যের শেষ পঙক্তির ধারাবাহিকতাই প্রমাণ করে। পঙক্তিটি যেনো অনিবার্যভাবে মানুষের শ্রম-ঘাম-কল্পনা-স্বপ্নের সাথে মিলে-মিশে ধীরে ধীরে বড় হয়েছে এবং ২০১৩ সালের যাত্রা আরম্ভের নির্দেশক হয়েছে । ‘দার্শনিক কিয়ের্কেগার্দ’ প্রসংগে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত প্রবন্ধ সংকলনে কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এরিশ ফ্রীড-এর তাঁর অনুবাদ একটি কবিতার উল্লেখ করেছেন
‘যে নাকি
একটি কবিতার কাছ থেকে
মুক্তির হদিশ চায়
সে বরং কবিতা পড়তে শিখুক
আর যে একটি কবিতার কাছ থেকে
মুক্তির হদিশ চায় না
সে বরং কবিতা পড়তে শিখুক।
আমি বলবো কবিতার কাছে মুক্তির হদিশ আছে । শুধু হাসিটুকু, শুধু কান্নাটুকু, পাতার লাল নীল রং টুকু আর নারীর শরীর বাঁকের নানা উপমা ভাঁজে ভাঁজে বসিয়ে দেয়ার বিভ্রম, কারণে অকারণে পুরাণ আর মিথের ব্যবহার কবিতাকে নৈতিকতার মানদণ্ডে কবিতা করে তোলে না। কবিতায় থাকতে হয় বেশী কিছু–ভাব আর প্রকাশের সামঞ্জস্যতা, গণমানুষের ভাব-ভাবনার সাথের ঐক্যবদ্ধতা এবং ইতিহাস চেতনা যা মুহম্মদ নূরুলহুদার কবিতা পাঠে সংশয়হীন ভাবে মিলে যায়।
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতায় অতিস্তত্ববাদী ভাব ধারা বহমান। তাঁর অন্তর্জগতের ভাব-ভাবনাগুলোই বহির্জগতে আদর্শ-মূল্যবোধ-সৌন্দর্য বোধ প্রকাশ মাত্রায় অখণ্ড হয়ে উঠেছে ।
‘যতোদূর বাংলা ভাষা ততোদূর এই বাংলাদেশ’
পঙক্তিটি নির্মাণে কোনো আড়াল-আবডাল বা বিভ্রান্তি নেই । আবেগের সরলতম প্রকাশ বলে তাৎক্ষণিক মনে হতে পারে। তা’ হলে কী অসামান্য পঙক্তি নয় ? প্রশ্নটা উঠতেই পারে । মহাত্মা মার্কস ‘প্রকৃতি বলতে হিউম্যানাইজড ন্যাচারের উল্লেখ করেছেন যার সংগে মানবিক সম্পর্ক উদ্ভাসিত, নব রূপে রূপায়িত, সে ক্ষেত্রে কল্পনার স্থান আছে সৃষ্টিতে’। কল্পনা ছাড়াও শিল্পের জগতে ইন্ট্যুশন শব্দটির অস্তিত্ব রয়েছে যার সংগে কল্পনার কোন বিরোধ নেই । ‘ ইন্ট্যিুশন’ হচ্ছে একদৃষ্টিপ্রসূত বিকল্প-বিহীন অখন্ড উদ্ভাস’ । গোর্কির মতে ‘কল্পনা ছাড়া মানুষের চিন্তা অনুর্বর, যেমন বাস্তবতা ছাড়া কল্পনা’ । সুতরাং কবি প্রতিভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ‘সৃজনধর্মী কল্পনা শক্তি’ ‘যতোদূর বাংলা ভাষা ততোদূর এই বাংলাদেশ’ ভাষণের মাত্রিকতা দূরাশ্রয়ী অন্তর-উদ্ভাস উষালোকের মতো, আর কল্পনা– অখণ্ডতার বিস্তার– যা ধাপে ধাপে এগিয়ে বাঙালী জাতির আইডেন্টিটি পূর্ণতার দিকে নিয়ে যাবে এবং ভাষার ভিত্তিতে দেশ, দেশের পরিচয়, জাতির পরিচয়. ব্যক্তির বিকাশ, এগুবে গণতান্তি্রুক মনোবিশ্লেষণে । কবির এই কল্পনা একই ভাষা-ভাষী মানুষের অখণ্ডতা, তার নির্মাণে, তার পথ চলায় ।
‘যতোদূর বাংলাভাষা ততোদূর এই বাংলাদেশ’
এই পঙক্তিটি নিছক একটি কাব্য-পঙক্তি যে নয় তা’ উপরে বলেছি– একটা ‘ডিসকোর্স’ । ‘যতোদূর বাংলাভাষা ততোদূর এই বাংলাদেশ’ নামের কাব্যে ৩০ পৃষ্ঠায় ১৬ ক্রমিকের কবিতা হলেও পঙক্তিটি আরো তিন-চারটি কবিতায় সংযোজক পঙক্তি রূপে ব্যবহৃত হয়ে ভাব যোজনার জ্যাঁ হয়েছে । পুরো কাব্যে ৪৬ টি ছোট-বড় কবিতা সংকলিত হলেও এবং নানা বিষয়ের ভাব উদ্দামতা পেলেও সবগুলোর অন্তর-সুর এক দিকে মুখ করে আছে। এবং অন্তর-আবেগের উদ্ভব ঘটিয়ে তার চৈতন্য-শরীর নির্মাণ অখণ্ড ও মানবিক করে তুলেছে। আধুনিকতা মানে ঔপনিবেশ, নতুন ঔপনিবেশ চিন্তা নয় । হতাশা, ক্লান্তি থেকে জন্ম নেয়া আধিপত্যবাদের উগ্র-সহযোগী চিন্তা ও তত্ত্ব নয়, উগ্র-সংস্কৃতি বোধ নয়, পুরানো সংস্কৃতিয়ো নয় বা পুরানো সং¯কৃতির বিকৃত উপস্থাপনাও না , আধুনিকতা হচ্ছে নতুন সমাজের উপযুক্ত সংস্কৃতি যা দুনিয়ার প্রত্যেকটি জাতিকে সম-মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করবে ধর্ম-গোত্র-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে সমর্থন ও সাহস জোগাবে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার সড়কে সমান তালে পৌঁছার জন্য। এ’যুগ মহাকাব্যের নয়, বীর একিলিসের আবির্ভাব ও সম্ভব নয়। সমাজ খুব দ্রুত বদলাচ্ছে, শত শত বছরের ব্যাবধান কমে যাচ্ছে. টেকনোলোজির ব্যাপক প্রভাবে । প্রতিক্রিয়ায় মানুষের মনে যে ব্যাপকতর পরিবর্তন ঘটে চলেছে তার প্রেক্ষাপটে চেতনা-জগতের দেয়ালগুলোতে নানা রকম ছাপ পড়ছে কোনটা বিকৃতির কোনটা নতুনের । একজন সচেতন কবির তাই সবসময় নতুনে হয়ে থাকতে হয়, বদলাতে হয় তার প্রকাশ কাঠামো। অন্তরে রাখতে হয় মানুষের রুচি. অভ্যেস, বোধের বিবেচনা । পাঠকের সংগে সংযোগের মুল বিষয়টি হলো তাই । যদিও এ কথাটি বেশ চালু আছে যে শিল্পের দাবী দূরবর্তি, খানিকটা সত্য, তবে কৈবল্যবাদিরা যেমন করে বলেন আসলে তা’ নয়। শিল্প সমকালীন ও দূরবর্তি । সমকালীন এই অর্থে, শিল্প ও তার প্রকাশ যদি মানব কল্যাণের জন্য নিবেদিত হয় তার প্রভাব যেমন দূরবর্তি এবং একই সংগে সমকালীন। সমকালকে অতিক্রম করে যেতে হয় দূর কালে, যেমন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ-এর ‘ ওরা কাজ করে
১ …ওরা চিরকাল টানে দাঁড়
ধরে থাকে হাল;
ওরা মাঠে মাঠে বীজ বোনে
পাকা ধান কাটে–ওরা কাজ করে
নগরে প্রান্তরে ’
২. কবি কাজী নজরুল ইসলামে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা
‘যবে উৎপীড়িতের ক্রনন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারির খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না–
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হবো শান্ত..’
৩. পোল-আমেরিকান কবি চেসোয়াভ মিউশ-এর কবিতা- (অনুবাদ মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়)
‘এই-তো পোল্যাণ্ডের সব অগভীর নদী-ধোয়া উপত্যকা। আর বিশাল সেতু
শাদা কুয়াশায় চলে যাচ্ছে । এই-যে ভাঙাচোরা শহর আর হাওয়া ছিটিয়ে দেয়
তোমার কবরের ওপর গাং চিলের চীৎকার.
যখন আমি তোমার সঙ্গে কথা বলি
কাকে বলে কবিতা,যদি তা না বাঁচায় দেশ কিংবা মানুষ?’
৪. আমেরিকার কবি গীন্সবার্গের কবিতা-অনুবাদ: [কবি মুনির সিরাজ]
আমেরিকা আমি তোমাকে সব দিয়েছি
এখন আমি নিঃস্ব
জানুয়ারী ১৭,১৯৫৬-আমার কাছে মাত্র দু’ডলার সাতাশ সেন্ট
আমার নিজের মনকেই আমি সহ্য-করতে পারছিনা
আমেরিকা . কবে আমরা মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ করবো।
৫.. বা জার্মান কবি গুন্টাগ্রাসের কবিতা [অনুবাদ: সলিমুল্লা খান ]
‘যে কথা না বললেই নয়’
এতদিন কেন চুপ মেরে আছি ,কেন মুখ খুলিনি এত দীর্ঘ দিন
একটা খেলা চলছে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা
মহড়া চলছে প্রকাশ্যে দিবালোকে
এ খেলার শেষে আমরা বেঁচে যাই তো হবো পাদটীকা’
কবিতাগুলো সমকালে এবং দূর-কালে সবসময়ই থেকে যাবে প্রাসঙ্গীক । উল্লেখিত কবিতাগুলোর গঠন, শব্দ প্রয়োগ রীতি, বাক-বিন্যাস, বিষয় এবং রূপ নির্মান একই রকম কেবল প্রকাশের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা আমরা লক্ষ্য করি। যদিও তাঁদের মধ্যে দেশ কালের ব্যাবধান আছে. তবুও ঐক্য একই সুর-মুখি । অর্থাৎ সময়, সামাজিক অবস্থা ও অবস্থানের দিক থেকে ভিন্নতা থাকলেও বিষয় ও রূপ-কল্পনার ঐক্য এক হয়ে আছে।
১. ‘মানুষের ভাষা হোক পাখিদের ভাষা
পাখিদের ভাষা হোক মানুষের ভাষা’
কিংবা
২. ‘তুমি আমি জন্মে জন্মে ভাষা-নাগরিক
ভাষা বাংলা বিশ্বজোড়া, নাই দিগি¦দিক’
‘যতোদূর বাংলা ভাষা ততোদূর এই বাংলাদেশ’
পঙক্তিটির নির্মাণ ৫২-র ভাষা আন্দোলনের পট ভূমি থেকে উদ্ভুত যা কেবল মাত্র একটি আন্দোলন নয়. বা যারা বলে বেড়ান ২১- চেতনা, অথচ চেতনার স্বরূপ কেবল মাত্র চেতনা শব্দের মধ্যে লীন হয়ে থাকে। ফলে ২১, বলতে এখন একাডেমি চত্তরে বই মেলার ব্যাবসা. দেখা-সাক্ষাৎ, আড্ডা এসব একুশের চেতনায় রূপ হয়ে যাচ্ছে আগামী প্রজন্মের কাছে, অথচ চেতনা ছিলো দৃঢ়তার, সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার। কবি তার বাংলা ভাষা রাষ্ট্র চাই-এর মধ্য দিয়ে ভাব চেতনা নয় চেতনার পূর্ণাঙ্গ রূপ কাঠামো পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন । ‘মানুষের ভাষা হোক পাখিদের ভাষা’ ঠিক বৈপরীত্য এনেছেন ‘পাখিদের ভাষা হোক মানুষের ভাষা’ বয়ানের প্রকৃতি ও মানুষ, মানুষ ও প্রকৃতির অচ্ছেদ্য সম্পর্ক, নিটোলতা, ভালোবাসাকে জারিত করে নতুন কালের ধ্বনি করে তুলেছেন । এবং সংযোজক হিসেবে পরবর্তি দুই পঙক্তিতে ‘মানুষ ও রাষ্ট্র ’,‘রাষ্ট্র ও মানুষ’ খন্ড ও অখন্ডের মধ্যদিয়ে পরিচিতি নাগরিকত্বের বন্ধন ভাষার দূর পরিক্রমায় স্থির ও স্থিত করেছেন । ‘ভাষা বাংলা রাষ্ট্র চাই’ গতানুগতিক ভাবে নয় একধরণের জাদুময়তা ছড়িয়ে দিয়ে পরিচিত শব্দটি ‘রাষ্টভাষা বংলা চাই’- না বলে ‘ভাষা বাংলা রাষ্ট্র চাই’ -এর লক্ষ্য বিলসিত করে চিন্তার ক্ষেত্রটি প্রসারিত করেছেন। চিত্রকল্পে আগামী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নাগরিকের পরিচিতি বিস্তার উদ্ভাষণ যোগ্য হয়ে উঠেছে। কক্ষিতাটির বিষয় বাস্তবতার সাথে ভাব বাস্তবতার সংযুক্তি বোধগম্য উপস্থাপনা দূর-কালের নির্দেশক । অনেক রাষ্ট্রে এমন কী মহা-চীনের বিশাল জনগোষ্ঠির রয়েছে একটি ভাষা, যা রাষ্ট শক্তিকে সবল রাখার ক্ষেত্রে শক্ত ভূমিকা পালন করছে। ভাষা-শক্তির জোরেই দেশে দেশে প্রবল হয়ে উঠছে পারষ্পরিক সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্য ।
ডাকছে সেই অণুকোকিল
কোকিল ডাকছে
বিগ ব্যাং খেকে বিগ ব্যাং পর্যন্ত
সীমিত মানবজীবনে তুমি-আমি হঠাৎ হঠাৎ শুনতে পাচ্ছি সেই কুহু’
লাখনৌর কুহু কবিতাটি ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্ব-এর মিশেলে একটি পরাবাস্তব কবিতা হলেও এরকম নয় যে এর রস-আস্বাদন দুরূহ হয়ে আছে, কারণ প্রয়োগকৃত বাংলা কাব্য-নীতিমালার কাঠামোটি অটুট রেখে তিনি তাঁর অন্তর আর বাহিরকে পরিপার্শ্বে দৃশ্যমান, অদৃশ্যমানকে চলমান ও ফ্রিজ করে ইন্দ্রিয়ের অনুভব কে সুরের মাধ্যমে ধরতে চেষ্টা করেছেন, যা ধীরে ধীরে নানা স্থানচ্যুতি ও সংযোজনের মাধ্যমে ঘুরে-ফিরে চেতনা-মহলে প্রবেশ করে। পাঠকের অনুভুতিতে সেই কোকিলের ডাক অনুরণনিত হয় যা চেতনার অংশ হযে যায় এবং এর গঠন যে ভাবে কবি শুনতে পান একজন মুনূহুর শ্রবনে –লাখনৌর কোকিল ডাকছে– । ‘ফ্রয়েডের আবিষ্কার অনুসারে– আমি কে? আমি আমি নই, অন্য কেউ.. আমি ও আমার অপর মিলে আমি একটা অন্য কিছু.’। কবি অনন্তকাল ধরে বিরামহীন সেই ডাক শুনে যাচ্ছেন একজন মুনূহু; মানে ‘মুহম্মদ নূরুল হুদা’ আর তখন অগণিত পাঠক যারা পাঠ করলেন নিবিষ্ট হলেন তারাও তেমনি এক অনুভবের দরোজায় পৌঁছালেন। এই রহস্যময়তা আবহমান বাংলার, বাউল কবিদের প্রকাশে ‘আমি’-র উপস্থিতি মানুষের অন্তরের অনন্ততর ‘আমি’ পরম। এখানে কোকিল সুন্দর, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য থেকে অন্দরে ফিরে আসা আনন্দরূপ- যা ‘স্থান-কাল-বদলরত বস্তু-অবস্তুর আলোকডানায় ডাকছে অণু-কোকিল’ পরাবাস্তবতার রূপ মেশানো এবং পরবর্তিতে ‘কোকিল ডাকছে’ চেতনায় বদল হওয়া ।
‘বাঙালি’ কবিতাটি তার ‘যতোদূর ক্ষাংলা ভাষা ততোদূর এই বাংলাদেশ’-কাব্যের শেষ কবিতা । কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা সুদীর্ঘ সময় ধরে একটা বিশ্বাস বা মতধারার বুনন করে চলেছেন শীতল পাটি বুননের কারিগরদের মতো। কারিগরগণ পাটির বেতিগুলো অত্যন্ত যতেœর সংগে চাঁছেন, শুকান এবং বুননের জন্য প্রস্তুত করেন । তাঁর সৌন্দর্য নির্মাণ এরকমই যেমন পোষা বিড়ালটি শুয়ে আছে সোফায় তার পাশে বসতেই বিড়ালটি উঠে এলো কোলে, তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে হাল্কা মিহিন সুরে ডাকলো মি-য়া-ও– সে সুর তীক্ষè নয়. তীব্র নয়, সে সুরে জ্বালা নেই, হিংস্রতা নেই. সে সুর চেনাও না অচেনাও নয় –স্পষ্টতই তার আওয়াজ । পরক্ষণে লেজ উঁচিয়ে দিলো এবং ঠেকালো থুতনিতে তারপর কোল থেকে নেমে লঘু পায়ে হেঁটে গেলো ‘হেথায় নয় অন্যকোথাও’ সেই এক অনুভুতির আনন্দ মুভির দৃশ্যে বার বার রি-উইন্ডে দেখতে থাকলো কেউ ।
কবি মুহম্মদ নুরুল হুদার কাব্য প্রসংগে কবি ফরিদ আহমদ দুলালের ‘মুহম্মদ নূরুল হুদার-নতুন অধ্যায় শিরোনামে বিডি নিউজ ২৪-এ প্রকাশি প্রবন্ধের জিজ্ঞাসা এরকম ১৯৮১-তে প্রকাশিত তাঁর পঞ্চম কাব্য আমরা তামাটে জাতি কবিকে জাতিসত্তার কবি অভিধায় পরিচিত করে তুললেও একই বিষয়ের কবিতা কবির পূর্বে প্রকাশিত কাব্যেও লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু এ কাব্যের “রোদ্দুরে নেয়েছি আর বৃষ্টিতে বেড়েছি/সহস্র শতাব্দী দিয়ে নিজেকে গড়েছি/আমরা তামাটে জাতি, আমরা এসেছি।’ যে ভাবে বাংলার কাব্যানুরাগীদের অন্তর ছুঁয়ে গেছে তেমনটি যেন পূর্ববর্তীদের ভাগ্যে জোটেনি।‘ আমরা তামাটে জাতি’ প্রকাশিত হয়েছে একত্রিশ বছর আগ; কিন্তু আজো সবাই তাঁকে ‘জাতিসত্তার কবি’ নামে পরিচিত করাতে চান। তা’হলে কি ধরে নেবো এই একত্রিশ বছরেও মুহম্মদ নূরুল হুদা নতুন কোনো প্রবল বাঁক সৃষ্টি করতে পারেন নি?’ প্রশ্নটরি উত্তর তার পরবর্তি ‘যতোদূর বাংলা ভাষা ততোদূর এই বাংলাদেশ’ প্রকাশ ২০১৩ ফেব্রুয়ারী-তে আছে। প্রত্যেক প্রতিভাবান কবির একটা গুঢ় আদর্শ থাকে যার প্রকাশ সর্বত্র ছড়িয়ে যায়। জোড়া দিতে পারলে উত্তর পাওয়া দু:সাধ্য হয় না। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার সৃষ্টির মধ্যে নানা রকম মুখ আছে, আছে তার সমগ্র কাব্যের মধ্যে তার প্রকাশ-এর একটা
সংযোজক দন্ড আছে ‘নির্দেশক দণ্ড’ যা বিশ্বাস এবং যা নানা ভাবে ছড়িয়ে গেছে তাঁর কাব্য-ভাষণে। ফরিদ আহমদ দুলালের প্রশ্নটি তাকে ধরিয়ে দেয়ার।
যেমন-
‘তুমি উড়ে যাচ্ছো স্বপ্ন থেকে বাস্তবতায়
উচ্চতম গিরিশৃঙ্গ থেকে গভীরতম সমুদ্রদেশ
বিবর্তনের স্রোতে সিদ্ধ, মনে রেখো
এই সত্য ভবিষ্যে অশেষ
যতোদূর বাংলা ভাষা ততদূর এই বাংলাদেশ
‘পরিশেষে সমতালে বদ্ধ হতে না পারার জন্যে যে তত্ত্বকে একমাত্র সত্য রূপে একদল শিল্পী আঁকড়ে ধরতে চাইছেন তার পরিণতি. গোর্কির ভাষায় অলস মস্তিষ্কের শস্তা আমোদের খোরাক’। এর কবল থেকে উদ্ধারের জন্যে শিল্পী সাহিত্যিকদের কিছু নির্দেশ তর্জনী সংকেতের মতো তুলে ধরেছিলেন ব্রেশট। তিনি মনে করে শিল্পী যিনি তার কাজ হবে–
১. জনসাধারণের অহিতকারী শক্তির বিরোধিতা করা
২. ঐতিহাসিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ করে বাস্তবের রূপায়ণ
৩. অন্তরে প্রগতি-চিন্তার লালন
৪. মানুষে মানুষে বৈষম্যের কারণ সম্পর্কে সচেতন
৫. জনগণের চাহিদা প্রসংগে বাস্তব জ্ঞানার্জন
৬. জনগণের সাংস্কৃতিক জীবনের মান উন্নয়নে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির ভঙ্গি গ্রহণ ।
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা তার দীর্ঘ কাব্য-সাধন জীবনে লিখেছেন প্রচুর যা সকল পাঠে আনতে এবং তার সমগ্র কবিতার আলোচনা করতে দীর্ঘ গবেষণা ও গভীর-পাঠ প্রয়োজন । তার পরেও আমার স্বল্প পাঠে মনে হয়েছে এই কবি অনাবি®কৃত মহাদেশের মতোÑÑএ’আলোচনায় খানিকটা দিক-পাতের চেষ্টা । ‘আনন্দ’ হলো এই যে নূরুল হুদা পশ্চিমের নানা কাব্য আন্দোলন, তত্ত্বের অন্ধ ধারক হন নি, তিনি নিয়েছেন বহু নিজের সংস্কৃতির ঐতিহ্যে আত্মিকরণের মধ্যমে সমৃদ্ধ করার জন্যে ।
তিনি বাংলা কাব্যের ধারাবাহিকতায় সাঁতার কেটে কেটে আধুনিকতাকে গ্রহণ করেছেন । মিশেয়ে দিয়েছেন আধুনিক সকল মনোভঙি তার কবিতার শরীরে, যার জন্য প্রতিভার দরকার। সংগত কারণেই তাঁর কাব্য-প্রতিভা ও গ্রহণযোগ্যতা ঈর্ষণীয়।
সহায়ক রচনা:
১. শিল্প সংস্কৃতি ও সমাজ, বিনয় ঘোষ,
২. সবার জন্য নন্দন তত্ত্ব , হাসানাত আবদুল হাই
৩. কিয়ের্কেগার্দ,এবং মুশায়েরা,
৪. মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্ব, বিমলকুমার মুখোপাধ্যায়,
৫. সঞ্চয়িতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,
সঞ্চিতা,কাজী নজরুল ইসলাম,
৬. চেসোয়াভ মিউশ: শ্রেষ্ঠ কবিতা, অনুবাদ মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়
৭. অ্যালেন গীন্সবার্গের কবিতা,
‘কবিতা এবং সমাজ চেতনা’ অনুবাদ কবি মুনির সিরাজ,
৮. গুন্টাগ্রাসের কবিতা, অনুবাদ সলিমুল্লা খান( বিডি নিউজ২৪-এর সৌজন্যে,
৯. আমি তুমি সে, সলিমুল্লাহ খান।
কবি ফরিদ আহমদ দুলাল-এর প্রবন্ধ, বিডি নিউজ ২৪.কম।
দরিয়া পাড়ের ভূমিপুত্র
ঐতিহ্যকে অবলম্বন করে কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তাড়িত কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা শুরু থেকেই তার কাব্য সুষমায় যোগ করেছিলেন ভিন্নমাত্রা। মাটি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে ঐতিহ্যকে তুলে নিয়েছিলেন কাঁধে। তার শিল্পচিন্তা কিংম্বা কাব্যকলার শব্দ নির্মাণ কাঠামোর বিন্যাসি আয়োজন সবখানেই তিনি এগিয়েছেন বাঙালি জাতিসত্তার ইতিহাসকে ধরে। যে কারণে দেখি, কবির জন্মস্থানের প্রতি তার যে টান কিংম্বা মৃত্তিকা সংলগ্নতা তাকে তাড়িত করেছে কাব্যকলার মধ্যেও তার জন্মদাগকে তুলে ধরার নিরন্তন প্রয়াস। যে কারণে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘শোণিতে সমুদ্রপাত’, দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আমরা সশস্ত্র শব্দবাহিনী’ এবং তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘শোভাযাত্রা দ্রাবিড়ার প্রতি’-এই তিনটি কাব্যগ্রন্থের কবিতারগুলোর দিকে তাকালেই আমরা দেখি জাতিসত্তার বিষয়টি সর্বাগ্রে উঠে এসেছে। তার কবিতার অনন্য বিষয় বাঙালির জাতিসত্তা বিনির্মাণে তার ত্যাগ, তার সংগ্রাম, তার নিরন্তর যুদ্ধ। যে যুদ্ধের মধ্যে বসে তিনি সৈনিক কবি-কবিতার বরপুত্র লিখে চলেন দেশপ্রেমের ইশতেহার।
বাঙালির গণসংগ্রামের ইতিহাসে তেভাগা, টংক, নানকার, ভাওয়াল, সাঁওতাল কৈবর্ত বিদ্রোহের অগ্নিপথ পার হয়ে একুশ, বাষট্টি, ছেষট্টি ও পরিবর্তীতে উন্সত্তরের রক্তরাঙা ঝাণ্ডা উড়িয়ে একাত্তরে পদার্পন করে। এর মধ্যে যে সময়টা মধ্যবর্তী ভূমিকা পালন করে সেটি আমার অহংকার, আমার ভাষার অধিকার। একুশকে তাই ভিন্নভাবে দেখেন কবি নূরুল হুদা এবং লেখেন-‘মায়ের ভাষার মান রাখতে/ জীবন দিলো যারা,/ বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম শহীদ তারা।’ (ভাষার শহীদ : সুর সমুদ্র)
ভাষা শহীদদের নিয়ে এই কাব্যভাষা নির্মাণের অগ্রপথিক কবি নূরুল হুদা। তিনি ‘বৈশাখী ভাষা’ শিরোনাম দিয়ে সন্মানিত করেছেন বাংলা ভাষাকে। শুধু তাই নয় বাঙালির ঐতিহ্যের অন্যতম উৎসব বৈশাখের সঙ্গে একুশের যে মিথষ্ক্রিয়া তিনি ঘটিয়েছেন, তা কাব্যভাষায় নতুন সংযোজন। ভাষা শহীদদের এই ভাষা যখন বৈশাখী ভাষায় রূপ নেয়, ঝরা কৃষ্ণচূড়া-পলাশের আগুনলাগা সৌন্দর্যে ও নববিকাশের ধারায় কবিতা পার হয় নবঐতিহ্যের পারাবারে। আর তাই কবি বলেন, ‘ও মাঝি ভাই, মানি না, মানি না, দাও ডাক/ ডুবো বাঙলার ভাষা বদলাক এ বৈশাখ’ (ভাষা বদলাক এ বৈশাখ : আমার সাহস নেই সুন্দরকে টোকা মেরে উড়িয়ে দেবার)।
ভাষার ইতিহাস, ভাষার বীজমন্ত্র খুঁজতে হলে আবারও ফিরে যেতে হবে উৎপত্তি রেখার কাছাকাছি কোনো ভাষা বিনির্মাণের কৌশলীর কাছে। কিংম্বা রাতের দ্বিপ্রহরে গহীন গ্রামে হ্যাজাক লাইটের আলো জ্বালিয়ে একদল শ্রমজীবী কর্মক্লান্ত মানুষ, ঘাম-শ্রম বিলিয়ে যখন বিনোদনের জন্য খড়কুটোর উপর এলিয়ে দেয় দেহ, শোনে বিজয় কবিয়ালের গান, ভাষার আঁতুড়ঘর সেখানেই। এই সত্যতা বুঝেছেন যিনি, তিনিই আহরণ করেছেন মৃত্তিকার সংলাপ আর দেহতত্ত্বের আঠারো মোকামের খবর। কবি নূরুল হুদা মাটিবর্তী মণীষা, দার্শনিক ও ইতিহাস সচেতনতা তাকে করেছে স্বতঃপ্রকাশমান। তার বিশ্বাসবোধ ও চেতনায় সঞ্চারিত চেতনভাষা আমাদের ভাষারাষ্ট্রের পরিচয়কে কবিতার মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন। আর তাই লিখেছেন,‘ভাষাই শক্তি ভাষাই মুক্তি-অস্ত্র/ ভাষাই অন্ন ভাষাই মান্য বস্ত্র’ (ভাষামন্ত্র)।
সংস্কৃত মহাকবি কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ পড়ে জার্মান মহাকবি গ্যাটে শকুন্তলাকে নিয়ে যে লেখাটি লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গ্যাটের সেই লেখাটির মূল্যায়ন করতে গিয়ে, শকুন্তলার বাণী প্রসঙ্গে বলেছিলেন,“উক্তিটি আনন্দের অত্যুক্তি। ইহা রসজ্ঞের বিচার। এর বিশেষত্ব আছে। শকুন্তলার মধ্যে একটি গভীর পরিনতির ভাব আছে। সে পরিণতি ফুল হইতে ফলে রূপান্তরিত হইতে পারে। মর্ত্য হইতে স্বর্গের পরিণতি, শকুন্তলার একটি পূর্ব মিলন ও একটি উত্তর মিলন আছে। প্রথম অংকবর্তী সেই মর্ত্যরে চঞ্চল সৌন্দর্যময় বিচিত্র পূর্ব মিলন হইতে সর্বতপবনে শাশ্বত আনন্দময় উত্তর মিলন যাত্রাই মূলত ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ নাটক। ইহা কেবল বিশেষ কোনো ভাবের অবতারনা নহে। বিশেষ কোনো চরিত্রের বিকাশ নহে। ইহা সমস্ত কাব্যকে একলোক হইতে অন্যলোকে লয়ে যাওয়া প্রেমকে স্বভাব সৌন্দর্যের দেশ হইতে মঙ্গল সৌন্দর্যের অক্ষয় স্বর্গধামে উত্তীর্ণ করিয়ে দেয়া।” কবি নূরুল হুদা ভারতের প্রাচীন সৌন্দর্যের সঙ্গে আধুনিক সম্ভাবনার স্বর্গধাম ও চলমান সৌন্দর্যের মানবিক বিস্তার ঘটাতে শকুন্তলাকে পুর্নবার ফিরিয়ে এনেছেন তার কাব্য। ঐতিহ্যের প্রতি তার এই টান ও মহোমুগ্ধতা তাকে করে তুলেছে বহুমাত্রিক এক শিল্প ¯্রষ্টা ও জাতিসত্তার কবি। ‘শুক্লপক্ষে জন্ম যার সেই শকুন্তলা/ শোনে মেয়ে বুঝি নাতো কুসুমের দাম/ তপবনে ক্ষিপ্র হলো যে মাতঙ্গ কাম/ কেশ-পাশে বেঁধেছিলে রহস্যকুন্তলা’ (শুক্লা শকুন্তলা)।
কাব্যের প্রচল ধারার বাঁক বদলের এই সাহিত্য নির্মাণের স্বর্ণ কারিগর রচনা করেছেন তার কাব্য কাঠামো উপমা উৎপ্রেক্ষা নিজের মতো করে। তাই প্রাচীন ভারতীয় নারীর সৌন্দর্যের এই যে বিচ্ছুরণ তা বাদ পড়েনি মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা থেকে। তার কবিতায় তিনি দ্রাবিড়া নামক নারীকে একটি প্রতীকে পরিণত করেছেন। তামাটে দ্রাবিড় জাতির কাছে কোনো এক দ্রাবিড়াই নবতর পর্যায়ের সূচনা ঘটাতে পারে। বাঙালির পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্যকে সাহিত্যের ঐতিহ্যের প্রাণবন্ত মিলন উৎসারে তিনি কাব্য উৎসের প্রান্তর হিসেবে বেছে নিয়েছেন। দেশ, জাতি, রাষ্ট্র, ইতিহাস, সভ্যতা তার কবিতায় মানবিক সমাজবোধের এক বিশাল ক্যানভাস হিসেবে দেখা দিয়েছে। যেখানে তিনি হয়ে উঠেছেন ঐতিহ্যের প্রতীক। দরিয়ার উচ্ছ্বাস ভরা জীবনে পৌরাণিক ও নবতর কাব্যশৈলীর নতুনমাত্রা সৃষ্টিতে তিনি একলব্যের তীর হাতে নিয়ে কাব্যের রণক্ষেত্রে যেভাবে আগমন করেছিলেন তার তিনি আজো বিচ্যুত হননি। ফলে মুহম্মদ নূরুল হুদা একজন কবি, একজন হুদা ভাই, একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছেন। গত ৩০ সেপ্টেম্বর ছিল কবি মুহম্মদ নূুরুল হুদা ৬৬তম জন্মদিন। জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
তথ্যসূত্র : ১. জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, ৬৫তম জন্মবার্ষিকী স্মারক সংখ্যা, সম্পাদক : কামরুল ইসলাম