কবি মানস বিশ্বাস ও তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘কাচপাত্র’
শিউলী সরকার
কতটুকু ভিজালে দেহ
ঘাসবে মরু দেখবো ছায়ায়
কতটুকু পোড়ালে মন
যাবে মরু সাগর ছায়ায়। (কবিতা ছায়া প্রণাম, পৃষ্ঠা ২০)
শব্দ নীড়ে চলে স্বপ্নের সংসার। ঋজু দেবদারুর বুকে সুস্মিত অপরাহ্ন। মেরুন ছায়াপথে দাঁড়িয়ে ছায়াশরীর। এটা কি প্রাগঐতিহাসিক পদচিহ্ন অথবা মায়াময় আলোক বর্ষের কোনো আলোক বর্তিকা? নাকি বিভ্রান্তি? না এটা বিভ্রান্তি নয়, মহাবিশ্বে সঞ্চারিত নত্রের সমাবেশে সত্যিই আলোর শরীর অথবা মহাবিশ্বে গড়ে উঠা শব্দশরীরে মহাকবিতা। সমগ্র পৃথিবীটাই একটা কবিতার মত। শব্দের শৈলশীরায় সঞ্চারিত বোধ আর ভাবনার প্রগাঢ়তায় গড়ে উঠেছে হাইকু সনেটের অন্তরীনে প্রানবন্ত কবিতা।
দক্ষিণে স্মৃতির সাগর
উত্তওে চেনামুখ খানখান
ঐখানে ধূসর তুমি
এইখানে আমি বর্তমান। (কবিতা ধূসর, পৃষ্ঠা ১৮)
কাব্য বা কবিতা বিশ্লেষণে দশক, সময়, সমাজ, রাষ্ট্র ঐতিহাসিক প্রগাঢ়তায় কোনো বিশেষ গুরুত্ব নেই। কারণ কবিতার কোনো ধর্ম নেই, বর্ণ নেই, রাষ্ট্র নেই, কবিতার কোন সময়কাল নেই। প্রাচীন গুহামানব যখন প্রথম পাথরে পাথর ঠুকে আগুন জ্বালাল এর চেয়ে বড় কবিতা আর কে কিভাবে লিখেছে।
ত্রিকোণ অন্ধকারে কোন আমি?
বিশুদ্ধ রক্তের সিম্ফনি বাজে বাতাসের উপাদানে
কে ডাকে
অনন্ত শূণ্যতা নাকি মোহজাল? (কবিতা গ্রীল, পৃষ্ঠা ১৫)
অপরাহ্নের আলো নিভে আসে, দূরে সন্ধ্যারতির শব্দে গাঢ় হয় অন্ধকার, সেইখানে ধীরে বহে ধলেশ্বরী, তীরে তমালের ঘন ছায়া তারই পথ ধরে অথবা ধূসর সন্ধ্যায় মেহগনি, জারুল, আমলকির বনে কিংবা শাহবাগের জনারন্যে অনন্তকাল ধরে শব্দ খুঁজে চলেছেন শ্বাশত সুন্দরের অন্বেষনে কালিদাস, কাহলিন জীবরাল, রবীন্দ্রনাথ, নাজিম হিকমত, জীবননান্দ দাশ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী কিংবা একজন মানস বিশ্বাসও।
কবি মানস বিশ্বাস যখন কবিতা লেখা শুরু করেন, তখন পৃথিবীতে এসেছে বড় পরিবর্তন। রাষ্ট্র ভেঙ্গে গড়েছে রাষ্ট্র, মানুষ সরে গেছে মানুষের কাছ থেকে অনেক দূরে। সামাজিক মালিকানার পরিবর্তে এসেছে ব্যক্তিগত মালিকানা, অঙ্গীকার ভেঙ্গেছে অহংকারের কাছে, জীবিকার প্রগাঢ়তা কেড়ে নিয়েছে জীবন, শ্বাশত প্রেমিক একই জীবনের মোহনা খুঁজতে গিয়ে গড়েছে আরেক সংসার, বদলে গেছে মুন্ডমালা গ্রাস, বহ্মপুত্র পাল্টেছে গতিপথ। বদলে যাওয়া এই ছন্দহীন পৃথিবীতে বিশুদ্ধ চেতনা আর শ্বাশত সুন্দরে অন্যতম প্রতিধ্বনি কবি মানস বিশ্বাস।
তার কবিতায় প্রেম ভালবাসার আচ্ছন্নতা যত বেশি ততটাই ভেসে ওঠে মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক আকাঙ্খার কথাও। প্রেম ও অপ্রেমের দ্বান্দিকতায় যখন কবিদের যাবতীয় চিন্তা, শব্দকোষ বিন্যস্ত হয়ে উঠে তখন মানস বিশ্বাসের কবিতায় সুস্পষ্ট হয খেটে খাওয়া বঞ্চিত মানুষের তীব্র জীবনবোধ।
জীবীকার গন্ধ থেকে প্রতিদিন তীর ছুটে আসে
ঊুকের কান্ত গভীরে
ঘুমন্ত শরীর নেচে উঠে ঘুমে
গ্লাস ভর্তি চুমু, বিমূর্ত বাগানের মতো।
করীর পথে শ্রমিক মন
ক্ষুধা ক্ষুধাই করে সবল শাবল যেন। (শ্রমিকের রাত ঘুম)
সমসাময়িক কবিদের বিশেষ করে জীবনানন্দ আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর কবিতার প্রভাব থেকে বের হয়ে আসতে পারিনি মানস বিশ্বাস। এছাড়া এই কংক্রীট সময়ে কবিতা ও কঠিন হতে হতে হয়েছে যেন এক একটি প্রস্তরখন্ড। বর্তমান কবিদের লেখায় শুধু বর্ণের বর্ণাঢ্যতায় সাজানো কবিতার অবয়ব। যেখানে কাব্যের স্বচ্ছলতা নেই, মনের মুক্তি নেই, নেই কোনো গভীরতম জীবন বোধ। কঠিন কঠোর শব্দের বুনোটে ঘেরা ফাঁকা পান্ডিত্য ঠিক যেনো ইট, কংক্রীটে মেশানো প্রানহীন সুদৃশ্য ইমারত। ভাষার কাঠিন্যে চাপা পড়েছে কবিতার সাবলীল সৌন্দর্য।
কিন্তু মানস বিশ্বাসের কবিতায় সরল সাধারণ শব্দের বিন্যাসে অসাধারণ জীবনবোধ, স্বচ্ছ চিন্তা, বিশুদ্ধ উপমার ব্যবহার আর মায়ময় পরিমিত ছন্দের স্পর্শে একটি ব্যতিক্রমী ধারার জন্ম দিয়েছে যা তার কবিতার দুঃখবোধ আর নিবিড় একাকিত্ব Keats এর Melancholic Mood কে ছুঁয়ে যায়। কিন্তু কিট্স এর দুঃখগুলো একান্ত ব্যক্তিগত। কিন্তু মানস বিশ্বাস তার ব্যক্তিগত যন্ত্রনাগুলো বা দুঃখগুলোকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সর্বজনের সাথে, তিনি নিজেকে চিনেছেন গন মানুষের মাঝে। তাই তার খন্ডিত জীবন দর্শন বি¯তৃত হয়েছে মহাকালের দর্শনে।
যেমন তাঁর ‘রেখে দিও’ কবিতায় আমরা দেখতে পাই-
যে যুবক ঘর থেকে বেরিয়ে আসে
অজানা পথের সন্ধানে, পথের আড়ালে
রেখে দিও এই একাকী ল্যাম্প পোষ্টের আলোতে
যে কৃষক হেসে ওঠে ভরা ফসলের মাঠে
রেখে দিও তার কষ্টের হালে চৈত্রের বিদীর্ন দুপুরে
আমাকে রেখে দিও আজম অযতেœ বেড়ে ওঠা
শিশুর কান্নায় এতিমের পাঠশালায়
রেখে দিও, তোমরা রেখে দিও,
তোমাদের সব না বলা কষ্টের নীড়ে।
এই কবিতায় কবি নিজেকে অবহেলিত বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের মাঝে থাকতে চেয়েছেন। থাকতে চেয়েছেন প্রতিটি মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে, সুখ দুঃখের ভিন্ন ভিন্ন অনুভবে।
সংকুচিত হয়ে আসছে পৃথিবী, খন্ডিত হয়ে আসছে মানুষের মন, এরই মাঝে বিশুদ্ধ মনা এই কবি অনাগত সুন্দর আর শ্রেণীহীন এক সুষম সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছেন প্রতিনিয়ত।
দুখিনী পৃথিবী দুঃখ করোনা
বকুলের গন্ধে ফুটবে গোলাপ জেনো।
মানুষের সাথে থাকবে মানুষ।
মাটির বৈভবে, বাঁশির সুরে
আমাদের গল্প হবে
আমাদের মতো করে। (প্রিয়তমা গল্প হবে)
কবি মানস বিশ্বাসের বাবুলালের তিন সঙ্গী কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে এই অবহেলিত মানুষের জীবন জীবীকা ও স্বচ্ছ জীবনবোধ। ফোঁটা ফোঁটা লাল শাড়ী পরা নিষিদ্ধ পাড়ার মেয়ে জোনাকী যার শরীরে যৌবনের গন্ধ ফুরিয়ে এসেছ বলে বাবুলালেরা আর তার ঘরে আসে না। হাড় হাড় বুকের রঘুপতি দুইখান চামড়া মহাজনের কাছে চেয়েছিলো বলে লাথি খেতে হয়েছিলো আর বুকের পাঁজরে জমানো নীরব কষ্ট প্রতিদিন মরা পোড়ার যে বীরেন শূন্য চিতায় মাথা রেখে লাশদের সাথে কথা বলতে বলতে নিজেই যখন জীবন্ত লাশের খাতায় নাম লিখিয়েছে। তাদের বেদনাদগ্ধ হৃদয় থেকে নিঃসারিত শব্দ- ‘এই যদি ভালো হয়। তবে তো এই ভালো আছি’- প্রহসনের মতো ভাসতে থাকে বায়ুস্তরের ইথারে ইথারে।
জীবনবোধের প্রাচুর্য্যে ঐশ্বর্য্যবান এই কবি বাস্তবতার ব্যবচ্ছেদে হয়ে উঠেছে ভীষন নিঃসঙ্গ। তাই কখনও নিভৃতে একান্তে করেছেন মুক্তির সন্ধান, কখনও প্রিয়তমাকে কাছে পাবার আকাংখা করেছেন। কখনও আবার হাজারো বঞ্চিত মানুষের বিমূর্ত বেদনার সমুদ্রে ফেলেছেন ব্যক্তিগত ক’ফোটা শিশিরবিন্দু। তার সকল কবিতাই তার আলোকিত অর্ন্তলোক থেকে উৎসারিত হয়েছে নিজেরই অজান্তে- সেই উষ্ণতার দ্যোতিটুকু ছড়িয়ে পড়েছে দিগি¦দিক, অন্তর থেকে অরন্যে, গৃহকোন থেকে বিশ্বলোকে, কাল থেকে কালান্তরে।
মহাবিশ্বের সুস্মিত ছায়াপথে আধুনিক নিঃসঙ্গতায় শাহবাগের জনারন্যে আজো হেঁটে চলেছেন কবি মানস বিশ্বাস শ্বাশত সুন্দরের অন্বেষনে-
ভালোবাসা দূর কান্ত সময়ে
শুধু খুঁজে ফিরি জীর্নমনে
অমৃত তোমাকে।