এক
- চিন্তনবিভা এবং নতুনতর বাস্তবতার উদ্ভাবন বা উদ্ঘাটন ছাড়া কবিতা আর কিছুই নয়; আর এর ভাষা যতটা হৃদয়গ্রাহি হয় বা সহজবোধ্যতা পায়, ততই ভালো। কবিতাভাষার নান্দনিকতা ভাষাতাত্ত্বিক উৎকর্ষের ভেতরে নয়; বরং উদ্ঘাটিত উপলব্ধি, প্রতিসত্য এবং প্রতিবাস্তবতার আকস্মিক হোঁচটের মধ্যেই নিহিত; অর্থাৎ চিন্তার সৌন্দর্যই কবিতার সৌন্দর্য।
কবিমাত্রেই ইশারাভাষি গল্পকথক (storyteller), যিনি শুধু সূত্র ও ইঙ্গিত তুলে ধরেন, গল্পটা বানিয়ে নিতে হয় রসগ্রাহী পাঠককেই।
কবিতা একটি ইশারাভাষা, যা উদ্ভাবিত কল্পনা ও নান্দনিক মিথ্যার ভেতর দিয়ে যাত্রা শুরু করে এবং নবতর উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার উদ্ঘাটনের মাধ্যমে পৌঁছে যায়: সত্যের সবচে’ নিকটতম বিন্দুতে।
তা সত্ত্বেও, যে কোনও কবিতাকে, তিনটি মানদণ্ডের সমন্বয়ে মাপা যায়; তিনটির প্রতিটি নিক্তিতে যখন কোনও একটি প্রস্তাবিত সত্য বা অভিজ্ঞতার উদ্ভাসঋদ্ধ সৃজনীরচনাকে ওজনদার হিসেবে পাওয়া যায়, তখনই বলা যাবে, এটি কবিতা; নিক্তি তিনটি হলো:
১. জীবন সম্পর্কে এর কি কোনও নতুন বা উদ্ভাবনি দৃষ্টিভঙ্গি আছে?
২. শিল্প সম্পর্কে এর কি কোনও নতুন বা উদ্ভাবনি দৃষ্টিভঙ্গি আছে?
৩. সত্য বা উপলব্ধি কিংবা অভিজ্ঞতার জগতে এটি কি কোনও নতুনত্ব বা উদ্ভাবন অথবা পুনরাবিষ্কার যুক্ত করছে?
একটি কবিতার ক্ষেত্রে সবকটি অথবা অন্তত দুটি জবাব হ্যাঁ-বোধক হওয়া চাই।
অলিখিত ও অব্যক্ত বক্তব্যের প্রস্তাবনাঋদ্ধ প্রাথমিক ও রূপকাশ্রিত এক প্রকার উপস্থাপনই কবিতা, যা এর পাঠকের সামনে কিছু প্রস্তাবিত সত্য হাজির করার উদ্দেশ্যে চূড়ান্ত ও অভীষ্ট টেক্সটি পাঠ ও উদ্ধারে প্ররোচনা জোগায়। লিখিত টেক্সটি, আসলে, কবিতার অভীষ্ট টেক্সটে পৌঁছাবার একটি মাধ্যম ব্যতিত আর কিছু নয়। এ কারণেই কবিতা তাত্ত্বিক ও সাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিকগণ বলে থাকেন: কবিতার প্রথমত দুটি অর্থ থাকে। প্রথমটি হলো উপস্থাপিত শব্দ সমবায়ে সৃজিত চরণগুলোর প্রতীয়মান বা আক্ষরিক অর্থ এবং এ থেকে খুঁজে পাওয়া ব্যঞ্জনার্থ। একই কারণে, বলা হয়ে থাকে, কবিতা যতটা বুঝবার বিষয়, তারও চে বেশি উপলব্ধি ও অনুভব করবার জিনিস।
কোনও একটি কবিতা যত বেশি ভিন্ন ভিন্ন ব্যঞ্জনার্থ নিয়ে রসগ্রাহী পাঠকের অনুভব ও উপলব্ধিতে ধরা দেয়, সে কবিতা ততবেশি বহুরৈখিক। বাঙলায় ও বিশ্বসাহিত্যে এমন কবিতা বিরল নয়, যার ব্যঞ্জনার্থ যুগের পর যুগ পরিবর্তিত হতে হতে নিত্য নতুন আলোয় তার পাঠকবর্গের কাছে হাজির হচ্ছে।
সর্বত্র অসহায় হয়ে পড়া নিরাশ্রয় মনের কাছে যে কবিতা শেষ আশ্রয় হয়ে উঠতে পারে, সেটাই ধ্রুপদী ও কালজয়ী কবিতা।
কবিতা বিষয়ে এসকল ভাবনার পক্ষে আমার ঐকমত্য ও সায় রয়েছে। তবে, কবিতাকে অবশ্যই সমকালীন বিশ্বপ্রবণতার অনুগামী হয়ে, মহাকালে উড়াল দিতে হয়; আর নিজের কবিতা বিষয়ক বিশ্বাস-অবিশ্বাস, আমি, ব্যক্তিগতভাবে, কবিতার প্রাথমিক টেক্সটেও গুঁজে রাখি।
আরেকটু চিত্রিত করা যাক কবিতাকুমারিকে: কবিতা আমার মতে, নিভৃত-রতন। তাকে কোলাহলমুক্ত রাখাই শিল্পের সততা। কবিতা নিয়ে কোনও প্রভাষণা, ধারাভাষ্য, হৈহৈ-কোলাহল পছন্দ নয় আমার। তবে গুঞ্জন চলতে পারে; কবিতা নিয়ে গুঞ্জন চলবেই। চলাই উচিত। তাকে দেখলেই মনে হবে, আহা, এই রূপসী কাদের কূলবধু গো? তারপর আবার দেখতে মন চাইবে তাকে। আবার এবং আবার। কিছুতেই তৃষ্ণা মিটবে না। ছিমছাম, নির্মেদ, ময়াবী; অতিসাধারণ অথচ মনপোড়ানো রূপ তার। সেটাই কবিতা। প্রথম দর্শনেই মনে হবে সামগ্রিক উন্মোচনে ধরা পড়লো। কিন্তু যতবার দেখা, ততবারই নতুন তার আচরণ। কোনও জটিলতা নেই, সারল্যের স্বচ্ছতায় উদ্ভাসিত সেই সুন্দর। চিরচেনা, চিরজানা এবং সেই সুপরিচয়ের কারণেই চিরদিন অচেনা থেকে যাবার সকল সম্ভাবনা জারি থাকে কবিতায়। নিরীহ। সরলে উপস্থাপিত এক জটিলতম সুন্দরই কবিতা। তাকে নিয়ে অভিসন্দর্ভ যে লেখে লিখুক। কবি লিখবে না। সেটা তার কাজ নয়। কবির কাজ তার প্রিয়তমা কবিতাকে রূপসী থেকে রূপসীতম করে তোলা। জীবনের দিকে, জীবনের মৌন আঙিনার কাছাকাছি তাকে টেনে আনা। যতই সে জীবনের সন্নিকট হবে, গুঞ্জন বাড়বে ততই। কিন্তু কোলাহল আমি অনুমোদন করি না। এতেই কবিতার জয়। এভাবেই জয়ী হন প্রকৃত কবি।
দুই
জাতিগোষ্ঠীসমূহের আক্ষরিক ভাষায় রচিত হবার ফলে প্রতীয়মান অর্থের বিভিন্নতা সত্বেও সমগ্র মানবজাতির হৃদয়-সংবেদের অনুকূলে সৃজিত অন্তর্নিহিত তাৎপর্যে অভিন্ন আন্তর্জাতিক চিন্তাসংকেতই কবিতা।
মনোসংবেদনের এই প্রক্রিয়ায় হৃদয়শাসিত মস্তিষ্কই এর সৃজনি-সৌকর্যের বাহন, স্থপতি বা কারিগর। স্ব-স্ব আক্ষরিক ভাষার শব্দাবলি সহিত্যে উপস্থাপনীয় এই সংবেদনী ভাবনা-সংকেত মননে ও শ্রবণে সম্মোহনের রঙিন আলো ফেলে রসাস্বাদনকারীর প্রাণে এক অনির্বচনীয় এবং অনাস্বাদিত অনুভূতি সঞ্চার করে।
এমনকি , অন্য যে-কোনও ভাষায় রূপান্তরিত হলেও, আদি-আক্ষরিক ভাষার রূপ ও ঘ্রাণ সম্পূর্ণ বিলুপ্তির পক্ষে তার সায় থাকে না। মনোসংবেদনের এই আশ্চর্যচিন্তারাশি সুসংহত ভাবনার, এমনকি, বিক্ষিপ্ত ভাবনা-ইঙ্গিতেরও প্ররোচনা দিতে পারে। সে যা-ই হোক না কেন, আমি মনে করি, আক্ষরিক-ভাষা নির্বিশেষে হৃদয়ানুভূতির এই যে অভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রকাশ মাধ্যম অর্থাৎ অন্তর্নিহিত ভাষা, এরই নাম কবিতা।
মানুষের প্রতিকাশ্রয়ী মাতৃভাষায় সৃজিত হয়েও এই ভাষা আসলে হৃদয়সংবেদনের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা।
কবিতা, শুনে আসছি, অনেক রকমের হয়। বিশ্বাসও করি। তবে, এই বিশ্বাসের অন্য এক তাৎপর্যগত অর্থ, আমি , আমার মতো করে বুঝে নিয়েছি। এর অর্থ হলো, এই যে, আমি বিশ্বাস করি, যে-কোনও জাতিগোষ্ঠী বা ভাষাগোষ্ঠীর কবিতার রকম তার নিজস্ব স্বাদে ও সৃজনশৈলীতে স্বকীয় ; যদিও তার অন্তর্নিহিত অনুভূতিমালার উপস্থাপনায় রয়েছে এক ধরনের আন্তর্জাতিক মৌলিক আদল, সাজুয্য ও প্রায়-অভিন্নতা। এই বিবেচনার বাইরে, কবিতা মূখ্যত, এক রকমেরই হয়ে থাকে, কবিতা রকমের।
কবিতার যে আন্তর্জাতিক চেহারা, তার বাইরেও, আমাদের কবিতার , নিশ্চিতভাবেই থাকবে এক লোকাল কালার। আমি বাঙলাকবিতার কথা বলছি। বাঙলাকবিতার সৃজনশৈলী প্রাচ্যীয় শিল্পবোধ ও রূপ-সৌকর্য দিয়ে গড়া। এই প্রশ্নে কোনও কাব্য-আন্দোলন-প্রণোদনার সাথে আমি কোনও রকমের আপোষ-রফায় যেতে নারাজ। প্রতীকিভাষার শব্দসমূহ সহিত্যবোধের অনুশাসনে, পরস্পরের পাশাপাশি বসে, পরস্পরের ওপর অন্তর্নিহিত অর্থের আলো ফেলে, সৃষ্টি করে যে-তৃতীয় আলোকপুঞ্জ, প্রাচ্যে তারই নাম___ ব্যঞ্জনা। এই বিশিষ্টতাই বক্তব্যের প্রতীয়মান অর্থকে নিহিতার্থে উত্তীর্ন করে, সৃষ্টি করে বক্রোক্তি। বক্রোক্তিই বাঙলাকবিতার অমোচনীয় লোকাল কালার বা স্থানীয় রঞ্জক। এক বা একাধিক বক্তব্য পরিস্ফুটন নয়, বরং প্রযুক্ত শব্দের সংকেতায়ন ঘটিয়ে এক বা অজস্র ভাবনার ইঙ্গিত উপস্থাপনই কবিতার প্রধানতম লক্ষ ও করণকৌশল; কৌশল শব্দটিকেও এখানে শৈলী অর্থে বিবেচনা করতে হবে।
বাঙলাকবিতাকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানে উত্তীর্ণ হতে হবে। তার অর্থ এই নয় যে, আমাদের ওইসব কবিতার আদল ও উপস্থাপন ভঙ্গিমা বিদেশি ভাষার কোনও কবিতার অনুবাদ পড়ছি এমন ধারনা পাঠকের সামনে তুলে ধরবে। আমাদের কবিতার একটি সুচারূ আদল ও উপস্থাপন ভঙ্গিমার অজস্র অথচ স্থানীয় ধরন আমি সব সময়ই প্রত্যাশা করি। কেননা, আমার দৃঢ় বিশ্বাস,
জগতের জাতিগোষ্ঠীসমূহের সাহিত্যের একটি জাতীয় চারিত্র্য থাকা প্রয়োজন, যা সংশ্লিষ্ট জাতিসত্বার সামষ্টিক আবেগানুভূতি, সমস্যা-সম্ভাবনা ও স্বপ্ন-কাঙ্ক্ষার অনুকূলে দানাবদ্ধ হতে থাকবে। একের ভাবনাবিশ্বে প্রতিফলিত হবে সমষ্টির আশা-আকাঙ্ক্ষা।
ব্যক্তিগতভাবে, আমি, নিজের কবিতায় সব সময়ই যে কাজটি করে থাকি, সেটি হলো, চিন্তাসূত্রের সংকেতায়ন। কবিতা, আমার কাছে আক্ষরিক ভাষার শব্দসমবায়ে গড়ে তোলা ভাবনা ও বক্তব্যের কিংবা এসবের ইঙ্গিতময়তার কোডিফিকেশান। সংকেতায়নের এই প্রক্রিয়ায়, আমি, সাধারনত, কোনও একটি চাবি শব্দ , পঙক্তিতে প্রয়োগের জন্য যেটি আমার টার্গেট ওয়ার্ড, সেটিকে সরিয়ে, বিকল্প অন্য একটি শব্দ বসিয়ে দিই। কবিতায় পাঠকের জন্য খুলে রাখি বেশ কিছু দরোজা-জানালা; ওইসব পথে প্রবেশ করে যিনি টার্গেট ওয়ার্ডটি খুঁজে এনে পুনস্থাপন করবেন, তিনিই জেনে ও দেখে ফেলবেন, প্রকৃত চিন্তা বা চিন্তা-সংকেতটির স্বরূপ । এই করণকৌশল অন্যান্য কবিগণ আরও অনেক প্রকারে প্রয়োগ করতে পারেন। আমি নিজের নির্মাণশৈলীর একটি গোপনীয়তা, এখানে, উন্মোচন করলাম।
কবিতায় ভাবনাসূত্রের বহুমুখিনতা, অজস্রতা এবং উন্মুক্ততা আমার লক্ষ। ইতিহাসের স্মৃতি আর স্মৃতির ইতিহাস আমার ভাবনায় শুধু একাকারই নয়, অভেদও। কবিতায় আমি শুধু কিছু ভাবনার উস্কানিদাতা, চিন্তা-সংকেতের পথ বেয়ে বক্তব্যের মূলে ও অজস্রতায় পৌঁছে যাবার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও ভার পাঠকের। আমার মতে, কবিতা শুধুই জো তুলে দেবে, জাল বুনবেন রসাস্বাদনকারী পাঠক। এ কাজে তার সামনে অসংখ্য পথ অবারিত, উন্মুক্ত; এমনকি, হয়তো বিভ্রান্ত হয়ে, ভুল পথে এগিয়ে যাওয়ার পথও কম খোলা নয় !
বিশ্ব কবিতার কালানুক্রমিক অধ্যয়ন, সর্বশেষ অগ্রগতি আমার পাঠ্য___ আরাধ্য নয়।
আমার আরাধ্য বাঙালি জাতিসত্তার সামষ্টিক স্বপ্নানুভূতির আত্মপরিচয়বাহী বাঙলাকবিতা। প্রাচ্যীয় নন্দনতত্ত্বই আমার কবিতার হিরন্ময় হাতিয়ার।