এডগার অ্যালেন পো : জীবন ও লিখন – মুনীর সিরাজ
১৮০৯ সালের ১৯শে জানুয়ারী আমেরিকার বোস্টন শহরে এডগার অ্যালেন পো’র জন্ম। পিতা ডেভিড পো জুনিয়র এবং মা এলিজাবেথ আরনল্ড পো। ১৮০৩ সালে চার্লেস্টন থিয়েটারে নাটকের অভিনয় দিয়ে ডেভিড পো’র পেশাগত জীবনের যাত্রা শুরু। সুদর্শন ডেভিড পো ছিলেন মদ্যপায়ী, অস্থিরচিত্ত খিটখিটে মেজাজের মানুষ। অভিনয় কুশলী হিসেবে সাধারণ। অন্যদিকে মা এলিজাবেথ পো ছিলেন পরিশ্রমী এবং অভিনয়ে মানুষকে অভিভূত করার এক ঐতিহ্য রেখে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। অভিনেত্রী মায়ের সাথে ১৯৭৬ সালে আমেরিকা আসার পর তিনি বাকী জীবন আমেরিকার নাট্য জগতের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তখনও আমেরিকা, বিশেষ করে নিউ ইংল্যান্ডের অভিজাত শ্রেণীর কাছে নাটক ছিল এক অসম্মানজনক পেশা। তবুও বোস্টন থেকে চার্লেস্টন পর্যন্ত এলিজাবেথ নাটকের অভিনয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তাঁর প্রথম স্বামী চার্লস হপকিন্স্-এর মৃত্যুর পর তিনি ডেভিড পো জুনিয়রের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে পো ছিলেন দ্বিতীয়। পরে তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে এবং এলিজাবেথ ১৮১১ সালের ৮ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। ফলে রিচমন্ডের সম্ভ্রান্ত পরিবারের দুই মহিলা, মিসেস জন অ্যালেন এবং মিসেস উইলিয়াম মেকেঞ্জি এডগার পো এবং তাঁর বোন রোজালিনকে পোষ্য সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেন। এলিজাবেথ তাঁর সন্তানদের জন্য সাহস, যথাকর্তব্য এবং মানুষকে ব্যক্তিত্বের প্রকাশে বিমুগ্ধ করার উদাহরণ রেখে গিয়েছিলেন।
নিঃসন্তান মিসেস জন অ্যালেনের প্রতি এডগার পো এক ধরণের আকর্ষণ অনুভব করতেন এবং তিনি সারা জীবন এই অনুভূতি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। মিঃ জন অ্যালেন ছিলেন একজন সফল স্কটিশ ব্যবসায়ী এবং আমেরিকার রিচমন্ডে সুপ্রতিষ্ঠিত। ভাল পরিবেশেই বেড়ে উঠছিলেন এডগার পো। আইনসঙ্গত ভাবে দত্তক পুত্রের স্বীকৃতি না দিলেও এডগার পো’কে তিনি ভাল স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। তাই এডগার পো’কে ঐ পরিবারের সন্তান হিসেবেই স্বীকার করে নিয়েছিল রিচমন্ডের লোকজন। ব্যবসায়িক কারণে জন অ্যালেন ১৮১৫ সালে ইংল্যান্ড যান। যখন এডগার পো স্কটল্যান্ড ঘুরে দেখার সুযোগ পান। পাঁচ বছর জন অ্যালেন পরিবার নিয়ে ইংল্যান্ডে বসবাস করেন। সে সময় এডগার পো দুটি স্কুলে অধ্যয়ন করেন। দ্বিতীয়টি ছিল ম্যানর হাইস্কুল যার সভাপতি ছিলেন ড. জন ব্রান্সবি। এখানেই পো পরিচিত হন এডগার অ্যালেন নামে। এখানে তিনি ল্যাটিন, ফ্রেঞ্চ, ইতিহাস এবং সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। পরবর্তী সময় তিনি তাঁর উইলিয়াম উইলসন চরিত্রে ব্রান্সবিকে চিত্রায়িত করেন।
অর্থনৈতিক কারণে জন অ্যালেন ১৮২০ সালে রিচমন্ডে ফিরে যেতে বাধ্য হন। এডগার পো’কে স্কুলে পাঠাতে থাকেন জন অ্যালেন। কয়েক বছর পর স্কুলের প্রধান শিক্ষক জোসেফ এইচ কার্ক, এডগার পো সম্বন্ধে এই মন্তব্য করেন যে, তাঁর ছাত্রটি খুব অধ্যবসায়ী না হলেও কাশে তাঁর ফলাফল ভাল। তাঁর আত্মসম্মানবোধ প্রখর এবং কল্পনাশক্তি অতি উচ্চমানের। কার্কের স্কুলে পো হোরেস, সিসেরো এবং হোমার অধ্যয়ন করেন। ১৮২৩ সালে উইলিয়াম বার্ক একাডেমিতে প্রবেশ করার পরও তিনি ধ্রুপদী সাহিত্য এবং অংকশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে থাকেন। পিতা মাতা অভিনয়ের সাথে যুক্ত থাকার কারণে রিচমন্ডের স্কুলে অধ্যয়নের সময় অ্যালেন পোকে নানা ধরণের বিড়ম্বনা এবং তাচ্ছিল্য সহ্য করতে হতো। তবে একজন ভাল সাঁতারু হওয়ার কারণে তিনি প্রশংসাও অর্জন করেছিলেন। স্কুলের একজন সহপাঠি রবার্ট স্ট্যানার্ড-এর মাধ্যমে এডগার পো সম্ভ্রান্ত এক মহিলা মিসেস জেইন ক্রেইগ স্ট্যানান্ডর্-এর সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। এই মহিলার সহানুভূতিশীল ব্যবহারই ছিল অ্যালেন পোর কবিতার প্রথম আবেগের প্রকাশ, যার জন্য তিনি ‘হেলেন-এর জন্যে’ শিরোনামে একটি অনবদ্য গীতি কবিতা রচনা করেন।
জন অ্যালেন ক্রমশ এডগার পো’র জন্য সহানুভূতি হারাতে থাকেন। সারা এলমিরা রয়স্টারের সাথে বাল্য প্রেমের মতো একটি সাধারণ ব্যাপারে অ্যালান পো জড়িয়ে পড়লে জন অ্যালেন তাঁদের এই প্রেমের সম্পর্কে বাঁধা প্রদান করেন। এ ব্যাপারে এলমিরার পিতাও সহযোগীতা করেন। রিচমন্ড থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার জন্য জন অ্যালেন শার্লসভিলে, ভার্জিনিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এডগার পোকে পাঠিয়ে দেন।
একটি জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে থমাস জেফারসন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষাদান এবং শৃঙ্খলা গতানুগতিক হলেও এই ইনষ্টিটিউটের প্রাচীন এবং আধুনিক ভাষা শিক্ষার মান ছিল অতি উচ্চস্তরের। ১৮২৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে অধ্যয়নের জন্য অ্যালেন পো উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানে পোর সামগ্রিক খরচ বহনের জন্য অ্যালেন অপরাগতা প্রকাশ করলে অ্যালেন পো অর্থ সংগ্রহের জন্য জুয়া খেলে ২০০০ ডলার হেরে বসেন। জন অ্যালেন এই অর্থ প্রদানে অস্বীকৃতি জানালে ঐ বছরই অ্যালেন পো’র নিয়মিত শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটে। তবে তিনি অনার্স নিয়ে ল্যাটিন, ফ্রেঞ্চ অধ্যয়ন করেন এবং ইটালিয়ান এবং স্প্যানিশ ভাষাও অধ্যয়ন করেন। তিনি মার্শালের লেখা ওয়াশিংটনের জীবনসহ ইতিহাস সম্বন্ধে ধারণা লাভে সচেষ্ট হন। অতি মাত্রায় মদ্যপান এবং উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্রে তাঁর উচ্ছৃঙ্খলতা বা অশোভন আচরণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
অ্যালেন পো রিচমন্ডে ফিরে আসার পর জন অ্যালেন-এর সাথে তাঁর মানসিক দ্বন্দ বেড়ে যায়। এডগার পো এবং তাঁর পরিবারের প্রতি জন অ্যালেন-এর অবিশ্বস্ততা এবং ঘৃণার কথা পো জেনে ফেলেছিলেন এবং সম্ভবত সেই কারণেই জন অ্যালেন, পো’কে দূরে সরিয়ে রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। ১৮২৭ সালে পো বোস্টনে পালিয়ে যান। এখানে পো ছিলেন নিজের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল এবং জন অ্যালেন-এর সাথে সম্পর্কের বিচ্যুতির কারণে বেদনাবিদ্ধ ছিল তাঁর মন। বোস্টনে তিনি একজন অতি অপরিচিত মুদ্রকের সাহায্যে তাঁর প্রথম কবিতার বই Tamarlane and Other Poems প্রকাশ করেন। লেখক হিসেবে নিজের নাম উল্লেখ না করে লেখেন by a Bohemian। এতে তাঁর অর্থোপার্জন হয়নি, কোনো প্রশংসাও তিনি অর্জন করেননি। অথচ প্রথম সংস্করণের এই কাব্যগ্রন্থটির এক কপির মূল্য ১৯৯২ সালে ধার্য হয়েছিল ১৫০০০ ডলার। এই বইটির প্রথম সংস্করণ এতই দুষ্প্রাপ্য যে এর একটি কপি (২,০০,০০০/-) দুই লক্ষ ডলারে বিক্রয় হয়েছে। এমন নাজুক অবস্থায় পো ১৮২৪ সালে আমেরিকার সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করেন।
অ্যালেন পো তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনায় কখনোই দুই বছরকাল সামরিক বাহিনীতে কাজ করার কোনো বর্ণনা দেননি। সম্ভবত আত্মসম্মান হানিকর মনে করেই তিনি সামরিক বাহিনীতে কাজ করার কথা উল্লেখ করেন নি। তিনি এই সময়ে ইউরোপ ভ্রমণের এক কল্পকাহিনী রচনা করেন। সামরিক বাহিনীতে তিনি প্রশংসনীয় কাজের জন্য সার্জেন্ট মেজর পদে উন্নীত হয়েছিলেন। জন অ্যালেন এক পর্যায়ে পো’কে সামরিক বাহিনী থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেন। ১৮২৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারী মিসেস জন অ্যালেন মৃত্যুবরণ করেন। শেষ পর্যন্ত অ্যালেন পো তাঁকে আর জীবিত অবস্থায় দেখার সুযোগ করতে পারেন নি, যদিও তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় তিনি উপস্থিত থাকতে পেরেছিলেন।
Al Arraf, Tamarlane and Minor Poems নামক তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থটি ১৮২৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেই জন নীল তাঁর সম্পাদিত ‘ইয়াংকি’ নামক সাময়িকীতে গ্রন্থটির কবিতা সম্বন্ধে আলোচনা করেন। জন নীলের পর্যালোচনা থেকে এ কথাই বোঝা যায় যে, এডগার অ্যালেন পো এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন যে শত বিঘ্ন সত্ত্বেও কবিতা রচনাই ছিল তাঁর জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত মূল লক্ষ্য। সামরিক বাহিনী থেকে অব্যাহতি নেয়ার সময় প্রথা অনুযায়ী তাঁর বদলি হিসেবে কাজ করার জন্য সার্জেন্ট গ্রেভ্সকে তিনি দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছিলেন এবং এ জন্য তিনি গ্রেভ্স -এর কাছে ঋণী ছিলেন। ১৮৩০ সালের মে মাসে অ্যালেন পো তাঁর কাছে চিঠি লিখে জানান যে, জন অ্যালেন সব সময় ভদ্রজনোচিত ব্যবহার না করার ফলে গ্রেভ্স-এর ঋণ তিনি পরিশোধ করতে পারছেন না। গ্রেভ্স পো’র এই চিঠি জন অ্যালেন-এর কাছে পাঠিয়ে দেন। এর পরিণতি এডগার পোর জন্য শুভ ছিল না। ১৮৩০-এর জুনে পো পুনরায় সামরিক একাডেমিতে ক্যাডেট হিসাবে প্রবেশ করেন। ১৮৩১-এর জানুয়ারির ৩ তারিখে এডগার পো, জন অ্যালেনের কাছে গ্রেভ্স-এর ঋণ শোধ করতে না পারার সমুদয় কারণ ব্যাখ্যা করে এক দীর্ঘ চিঠি লিখেন। জন অ্যালেন সামরিক একাডেমিতে পোর খরচ বহন করতে অপারগ হওয়ায় আবার তার পক্ষে একাডেমি থেকে বের হওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে ইচ্ছাকৃত ভাবে তিনি একাডেমির শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন। ১৮৩১ এর ৬ মার্চ পো’কে বরখাস্ত করা হয় এবং তিনি সামরিক একাডেমি ছেড়ে নিউইয়র্ক গমন করেন। নিউইয়র্কে তিনি তাঁর কাব্যগ্রন্থ Poems of 1831 প্রকাশ করতে সমর্থ হন। এই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করার জন্য সামরিক বাহিনীর বন্ধুরা তাঁকে অর্থ সাহায্য করেন। এই কাব্যগ্রন্থে তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাব্যগুলোর মধ্যে To Helen, Israfel Ges The City in the Sea -এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত অ্যালেন পো জুন ১৮৩১ সালে ঘোষিত Philadelphia Saturday Courier পত্রিকা ঘোষিত সাহিত্য পুরস্কারের জন্য পাঁচটি গল্প পাঠান। এডগার পো বাল্টিমোরে তাঁর আন্ট মিসেস কেমের সাথে থাকার সময় ১৮৩২ সালে এই গল্পগুলি অজ্ঞাত নামে প্রকাশিত হয়। এর জন্য তিনি কোনো অর্থ পেয়েছিলেন কিনা সন্দেহ। অন্যান্য ম্যাগাজিনে তাঁর পাঠানো গল্পগুলি অমনোনীত হয়ে ফিরে আসতে থাকায় অ্যালেন পো দুঃখজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। ১৮৩৩ সালে পো দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জন অ্যালেন-এর সাহায্য প্রার্থনা করে একটি চিঠি লিখেন, যার মর্মার্থ ছিল – বন্ধু, অর্থ, বিত্ত ছাড়া তিনি ধ্বংসের মুখোমুখি। নিরলস পরিশ্রম করে এবং সমাজের প্রতি কোনো অন্যায় না করে এবং কোনো পাপ কাজের সাথে সম্পৃক্ত না হয়েও তিনি দুর্দশাগ্রস্থ। এমতাবস্থায় তিনি জন অ্যালেন-এর সাহায্য প্রার্থনা করেন, যাতে তিনি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারেন। জন অ্যালেনের কাছে এটাই ছিল তাঁর শেষ আবেদন। জন অ্যালেন ১৮৩৪ সালে ২৭ মার্চ ইহলোক ত্যাগ করেন। মরণোত্তর উইলে তিনি অ্যালেন পো’কে কিছুই দিয়ে যাননি।
১৮৩৩ সালে অ্যালেন পো Baltimore Sunday Visitor পত্রিকার ছোট গল্প প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হয়ে ৫০ ডলার পুরস্কার লাভ করেন। গল্পটির নাম ছিল The Manuscript Founded in a Bottle। পুরস্কার দেয়ার জন্য বিচারক মন্ডলীর একজন সদস্য জন পেন্ডলেইন কেনেডি, যিনি ছিলেন একাধারে একজন ঔপন্যাসিক এবং উকিল, পো’কে আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন, তাঁর গল্প প্রকাশে সাহায্য করেন এবং রিচমন্ডের Southern Literary Messenger পত্রিকার সম্পাদকের পদ পাইয়ে দেন। রিচমন্ডে বাসস্থানের ব্যবস্থা করে ১৯৩৫ সালের গ্রীষ্মে অ্যালেন পো তাঁর আন্ট মিসেস কেম এবং কন্যা ভার্জিনিয়াকে নিয়ে আসেন। ভার্জিনিয়াকে অ্যালেন পো ভালবাসতেন। ঐ বছর সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখে পো ভার্জিনিয়াকে বিয়ে করেন।
অ্যালেন পো অত্যন্ত দক্ষতার সাথে Messenger পত্রিকাটিকে দক্ষিণের একটি অগ্রজ সাহিত্য জার্নালে পরিণত করেন। তাঁর গল্পগুলি জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি লাভ করে এবং বৃটিশ সমালোচনার ধাচ এবং ভন্ডামিপূর্ণ অযৌক্তিক সমালোচনার প্রতি কটাক্ষপূর্ণ ইঙ্গিতবহনকারী এক স্বাধীন সমালোচকের ভূমিকায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। অল্প সময়ে পত্রিকা প্রকাশের সংখ্যা ৫০০ থেকে ৩৫০০-তে উন্নীত হয়। কিন্তু শ্রমসাধ্য কাজ এবং অল্প বেতনের কারণে তিনি জানুয়ারী ১৮৩৭ সালে ঐ পত্রিকার সম্পাদকের কাজ ছেড়ে দেন।
এ সময় তাঁর রচিত Narrative of Arthur Gordon Pym যন্ত্রস্থ অবস্থায় হারপার প্রকাশনী ১৮৩৮ সাল পর্যন্ত মুদ্রণ বন্ধ করে রাখে। এন্টার্কটিকা মহাসাগর ভ্রমণের এই কল্পকাহিনীটি এতটাই বাস্তবসম্মত ছিল যে ইংল্যান্ডের পাঠকেরা এই গল্পটি অবধারিত সত্য ঘটনা বলে বিশ্বাস করেছিল। বরফের চেয়ে সাদা বর্ণের বর্বরের আক্রমণে কিভাবে পিম -এর নৌকা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, সেই গল্পটি পাঠকের সত্য বলে গ্রহণ করা অ্যালেন পো’র অসাধারণ কাল্পনিক শক্তিরই প্রমাণ দেয়। কিন্তু তিনি Barlesque Tales এবং Tales of Folio Club গ্রন্থ দুটি প্রকাশ করতে ব্যর্থ হন।
নিউইয়র্কের অভিজ্ঞতায় অতৃপ্ত অ্যালেন পো’র ১৮৩৮ সালে ফিলাডেলফিয়াতে সবচেয়ে কৃতকর্মের সময় শুরু। ফিলাডেলফিয়ার প্রকাশনা জগৎ তখন উজ্জীবিত। ফিলাডেলফিয়াতে তিনি ছয় বছর অবস্থান করেন, এখানে তিনি তাঁর শামুক বিষয়ক গ্রন্থ Concholist’s First Book প্রকাশ করেন। তাঁর বিখ্যাত ছোটগল্পগুলির একটি Ligia এবং শ্রেষ্ঠ কবিতার একটি The Haunted Palace প্রকাশিত হয় ১৯৩৮ সালেই। জুলাই ১৯৩৯-এ উইলিয়াম ই. বার্টনের সাথে যৌথভাবে The Gentlemen’s Magazine সম্পাদনা শুরু করেন। এই ম্যাগাজিনে তাঁর আরও একটি বিখ্যাত ছোট গল্প The House of Usher প্রকাশিত হয়। ব্যক্তিগতভাবে একটি উচ্চমানের সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের জন্য তিনি বার্টনের সাহচার্য ত্যাগ করেন। জুন ১৮৪০-এ The Gentleman’s Magazine -এর সম্পাদনা ছেড়ে দেন এবং The Penn Magazine নামে একটি পত্রিকা প্রকাশে আগ্রহী হন। ১৯৩৯ সালে Lea & Blanchard প্রকাশনী তাঁর পঁচিশটি ছোট গল্পের সংস্করণ Tales of Grotesque and Arabseque প্রকাশ করেন। প্রকাশকের কাছ থেকে তিনি শুধু প্রকাশনা সত্ত্ব এবং সম্মানী হিসাবে বিশ কপি বই ছাড়া আর কোনো আর্থিক সুবিধা পান নি। অতএব এই ধারণা বশবর্তী হয়ে ব্যক্তিগতভাবে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠায় উদ্দ্যোগী হয়ে ওঠেন যে তিনি তখন নিজের গল্পগুলি বিভিন্ন সাময়িকীর কাছে বিক্রি করে অর্থোপার্জনে সক্ষম হবেন। সদা সচেষ্ট অ্যালেন পো’র কাজের মূল্যায়ন করতে পেরেছিলেন জর্জ আর. গ্রাহাম এবং তিনি এডগার পোকে Graham’s Maganize -এ যোগদান করতে সম্মত করেন। পো এবং গ্রাহাম এই ম্যাগাজিনটিকে আমেরিকার একটি শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পত্রিকায় পরিণত করেন। তাঁরা লেখকদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেয়ার ফলে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ লেখকেরা এই ম্যাগাজিনে লিখতে আগ্রহী হন। ১৮৪১ সালে অ্যালেন পো এই পত্রিকার সম্পাদনা ছেড়ে দেয়ার সময় এর প্রকাশনা সংখ্যা পাঁচ হাজার থেকে পঁয়ত্রিশ হাজারে উন্নীত হয়েছিল। এই ম্যাগাজিনেই তাঁর বিখ্যাত গল্প The Murders in the Rue Morgue প্রকাশিত হয়। পো গ্রাহামের সাথে যোগ দিতে রাজি হয়েছিলেন এই কারণে যে তাহলে গ্রাহাম তাঁর Penn Magazine এ যোগদান করবেন। তখন উভয়ে সাধারণ পাঠকের জন্য একটি পত্রিকা এবং অপেক্ষাকৃত চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবিদের জন্য অন্য একটি পত্রিকা প্রকাশ করতে পারবেন। Graham’s Magazine -এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে তিনি Longfellow’s Ballads সম্বন্ধে আলোচনার সূত্রে কবিতার সঙ্গা নির্ণয়ের চেষ্টা করেন এবং কবিতাকে Rythmical Creation of Beauty বলে উল্লেখ করেন। হথ্রোন-এর Twice Told Tales আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ছোট গল্পের যে সংঙ্গা নির্ণয় করেন তা পরবর্তী সকল আলোচনাতেই স্বীকৃত এবং অপরিবর্তিত থেকেছে।
লিখেছেন : মুনীর সিরাজ