‘এই যে, শুনুন’ – এই একটি মাত্র বাক্য আমার সমস্ত অস্তিত্বকে যেমন নাড়িয়ে দিয়েছিল। আবার আমার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সব, সবকিছু এই একটি বাক্যই তছনছ করে দিয়ে গেছে। সেদিন বেশ মেঘ ছিল আকাশে। আকাশে মেঘ দেখেই আমার ভিতরে কোথাও একটা ঝড় শুরু হয়ে গিয়েছিল। কারণ মেঘ মানেই বিষন্ন প্রকৃতি। বিষন্ন ভালবাসা। মেঘ কেটে গিয়ে যতণ না বৃষ্টি শুরু হত, ততণ স্বস্তি পেতাম না। মনে হত, এই বুঝি ও আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছে। এই বুঝি ও খুব যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ও বৃষ্টিকে খুব পছন্দ করে। বৃষ্টি মানেই ওর কাছে আমার ছোঁয়া। প্রায়ই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে পথ চলত আর আমাকে ফোন করে বলত – এই, আর একটু জোরে জড়িয়ে ধর না।
আমি ওকে ধমকাতাম – বৃষ্টিতে ভিজ না, ঠাণ্ডা লাগবে।
উত্তরে ও বলত – লাগতে দাও, তাহলেই তো ডাক্তারের কাছে যাওয়ার একটা রাস্তা হবে।
হ্যাঃ পেশায় আমি একজন ডাক্তার। মোটামুটিভাবে আমার পেশায় আমি সুনামের সাথেই কাজ করছিলাম। আর এখানেই হচ্ছে যত সমস্যা। ঘর সামলানো, বাচ্চাকে সময় দেয়া, ওকে সময় দেয়া, সবার উপরে আমার পেশাগত দায়িত্ব। শুক্রবার বাদে সপ্তাহের ছয়দিনই আমাকে প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকতে হয়। কখনো কখনো শুক্রবারটাতেও ফুরসত পাই না। গরীব-অসহায় কোন মা তাঁর সন্তানকে নিয়ে আমার কাছে আসলে তাকে আর নিরাস করতে পারিনা। বেশিরভাগ সময় গরীব রোগীদের ফ্রী চিকিৎসা দিতে হয়। এটা ওর বিশেষ অনুরোধ। ওর কথা হচ্ছে – অর্থাভাবে তোমার কাছ থেকে কোন রোগী যেন ফিরে না যায়। চেষ্টা করবে দিনের শুরুটা বিনামূল্যের চিকিৎসা দিয়েই শুরু করতে। তাতে কিছু না হোক আমার আত্মা শান্তি পাবে, কথাটা মনে রেখ।
এমনিতেও কোন রোগীকেই আমি অবহেলা করতে পারি না। ও নিজেও সেটা পছন্দ করে না। ওর কথা হচ্ছে – যদি দেখ রোগীরা বসে আছেন কিন্তু তোমার প্রার্থনার সময় পার হয়ে যাচ্ছে, খবরদার রোগীদের বসিয়ে রেখে কখনো প্রার্থনা করতে যাবে না। তোমার কাজই তোমার প্রথম ধর্ম কথাটা মনে রেখ।
ওর এ রকম বেশ কিছু কথা আছে, যা আমার খুব ভালো লাগে। আর এই একটি জায়গায় এসে আমি ওকে প্রচণ্ড ভালবাসি, প্রচণ্ড।
আকাশে কালোমেঘ দেখেই বুকের ভিতর ছাৎ করে উঠল। আমাদের দেড় বছরের সম্পর্কে আমি এটুকু উপলব্দি করতে পেরেছি যে, কালোমেঘ মানেই আমাদের দুটি মনের দুরত্ব বেড়ে যাওয়া। কালোমেঘ মানেই অস্থির প্রকৃতির অস্থিরতার প্রভাবে আমাদের দুটি মনের কষ্ট বেড়ে যাওয়া। প্রকৃতির বিষন্নতায় মানুষের মনের উপর এতোটা নিবিড় প্রভাব ফেলতে পারে আগে কখনো বিশ্বাস হত না। ওর সাথে জড়িয়ে, এখন আর বিশ্বাস না করে উপায় নেই।
প্রথমদিকে অবশ্য গুরুত্ব দিতাম না। ভাবতাম এটা ওর মনগড়া। কিন্তু সেদিন আকাশে মেঘ দেখেই ও বলে উঠল, সূর্য তাড়াতাড়ি শক্ত করে আমায় জড়িয়ে ধর। আমি তখন লজ্জায় ধরতে পারছিলাম না। মাত্র ৩ দিনের পরিচয়, এর মধ্যেই ঘরের বাহিরে এসেছি, এখন বলে জড়িয়ে ধর। আমি ধরছি না দেখে ও নিজেই আমার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আঁকড়ে রাখল, আর বলল – কখনো এটা করনা। এই যে প্রকৃতি দেখছো, ওরা আমার তোমার এই সম্পর্কটা তৈরি করে দিয়েছে। আকাশে কালোমেঘ মানেই প্রকৃতি বিষন্ন বা রুষ্ট। প্রকৃতি বিষন্ন দেখলেই আমাকে জড়িয়ে থেক, তা না হলে আমরা সিটকে যাব। আমাদের সম্পর্ক টিকবে না।
আমি তখন ওকে বাঁধা দিয়ে বলেছিলাম – যাও প্রকৃতি চলবে তার নিয়মে, মানুষের সাথে কি তার তুলনা চলে। মানুষ আর প্রকৃতিতো এক নয়।
উত্তরে ও বলল – সবাই নয়, এটা ঠিক। কিন্তু সবসময় মনে রেখ, দু’একজন মানুষ, তাদের স্বভাব-চরিত্র সবটাই প্রকৃতির সাথে বেশ মিলে যায়। আর আমার তোমার কথা বলছো? আমাদের সবটাই প্রকৃতির হাতে মনা। আদর করে ও আমায় কখনো সূর্য আবার কখনো মনা বলতো। ওর মনা ডাকটাই আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দ, যদিও এ কথা ওকে কখনো বলা হয়নি।
ও বলতো – তুমি সূর্য আর আমি পৃথিবী, হিসাবটা বোঝ? পৃথিবীতে যদি ঝড় হয়, আকাশে বিদ্যুত চমকাবেই। আর স্বাভাবিক নিয়মেই তখন সূর্য হারিয়ে যাবে মেঘের আড়ালে।
না তখন ঠিক বুঝিনি হিসাবটা, তবে ধীরে ধীরে ল্য করেছি যে আকাশে কালোমেঘ মানেই আমার আকাশে বিদ্যুতের ঝলক, আর পৃথিবীতে ঝড়ের তাণ্ডব। কোন না কোন অজুহাতে আমাদের মধ্যে তখন মনমালিন্য দেখা দেবেই। কোন না কোন আঘাতে আমরা দু’জন সেদিন কাঁদবোই। মেঘ কেটে গেলেই আবার সব সুন্দর, ফকফকা। আবার আমরা আমাদের ভুলগুলো শুধরে নিয়ে আনন্দে মেতে উঠি। ছেলে আলাওলকে কাঁধে বসিয়ে ও তখন খেলা করে বেড়ায়। খেলার ফাঁকেই আলাওলকে চুমু খাওয়ার ছলে আমাকেও চুমু খেয়ে যায় সকলের অজান্তে। এমন গভীরভাবে কেউ কাউকে ভালবেসেছে কিনা আমার সন্দেহ আছে। তাই সেদিনও আকাশে কালোমেঘ দেখেই আৎকে উঠেছিলাম।
হঠাৎ ঝড়ের মতই ও এল, বলল – ‘এই যে, শুনুন, অনেক কেঁদেছি আপনার জন্য, আর কাঁদতে চাই না’। বলেই আমার কপালে ও ললাটে চুমু খেয়ে বলল – ‘আল্লাহ হাফেজ’।
আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্কুটারে চেপে চলে গেল ও। পিছন থেকে আমার ডাক ওর কানে পৌঁছলো কিনা জানি না। স্তম্ভিত আমি, মন্ত্রমুগ্ধের মত অনেকটা সময় দাঁড়িয়েছিলাম, তারপর কি ঘটেছে যখন বুঝতে পারলাম, তখনই ওর এসএমএস এল।
তাতে লেখা – “স্যরি ম্যাডাম, আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করেছিল, তাই হঠাৎ এসে দেখে গেলাম। আপনি এভাবে অপমান করবেন জানতাম না। করলেন, হলাম। তারপরও আপনাকেই ‘ভালবাসি’ বলে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলাম। আই লাভ ইউ।”
মাথাটা ঘুরে উঠল। কোথায়, কীভাবে ওকে অপমান করলাম বুঝতে পারলাম না। কোনভাবে অফিস থেকে বের হয়ে গাড়িতে চেপে বসেই জ্ঞান হারিয়েছিলাম হয়ত। কারণ গাড়ি বাসায় পৌঁছলে আমার মা-ভাইয়েরা আমাকে ধরাধরি করে নামাল এটা টের পেলাম শুধু।
আমি একজন ডাক্তার, সেই আমাকেই ডাক্তারের চিকিৎসাধীন থাকতে হল প্রায় এক সপ্তাহ। প্রেসার বেড়ে গিয়েছিল। আর একটু দেরী হলে ঘাড়ের রগ ছিঁড়ে চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যেতাম হয়ত। একটা পঙ্গু মেয়েকে নিয়ে কি করে কাটাতে বাকীটা জীবন?
ধূৎ কাকে বলছি। যাকে বলছি সেতো কোনদিন আর ফিরে এলো না। একবারও বুঝতে চাইল না তার সূর্য শুধু তারই আছে। অন্য কারো নয়। কতটা মানসিক দকল সহ্য করে এখনো বেঁচে আছি, এখনো তোমার জন্য পথ চেয়ে ছেলেকে নিয়ে সেই গাছটির গোড়ায় গিয়ে অপো করি। আমাকে লেখা তোমার সেই কবিতাটি একটু ঘুরিয়ে এখন আমিই পড়ি প্রতিদিন। তুমি লিখেছিলে –
গাঁও গ্রামের সরল সোজা মূর্খ ছেলে,
সুযোগ পেলেই কবিতা লেখে ছন্দ ভুলে।
সেই ছেলেকে ভালবাসার স্বপ্ন দিয়ে
যেই মেয়েটি ছেড়ে গেল কষ্ট দিয়ে
“আল্লাহ তাকে সুখে রাখুন”-এই দোয়াতে,
সেই ছেলেটি কান্দে এখন পার্কে বসে।
আমার একদিন একটু আসতে দেরী হওয়ায় তুমি এরকম ভয়ংকর একটি কবিতা এসএমএস করে পাঠিয়েছো আমাকে? কবিতাটি পড়ে কাঁদতে কাঁদতে আমি আমাদের গাছটির কাছে ছুটে এসে তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। আজ আমি তোমার ঐ কবিতাটি একটু ঘুরিয়ে পড়ছি –
শহরবাসী সরল সোজা মূর্খ মেয়ে,
কাজের মাঝে ব্যস্ত হয়ে কষ্টগুলো থাকছে ভুলে।
সেই মেয়েকে ভালবাসার স্বপ্ন দিয়ে
যেই ছেলেটি ছেড়ে গেল কষ্ট দিয়ে
“আল্লাহ তাকে সুখে রাখুন”-এই দোয়াতে
সেই মেয়েটি কান্দে এখন পার্কে বসে।
কত শতবার, অসংখ্যবার আমি এই কবিতাটি পড়ি, আর এদিক ওদিক তোমাকে খুঁিজ, কই আমার বুকে এসেতো তুমি ঝাঁপিয়ে পড়লে না সাধন। তুমি কি জান? তোমার যুদ্ধজয়ী ছেলেটা আজ কত বড় হয়েছে? আর কখনো কোন অসুখ-বিসুখ ওকে স্পর্শ করেনি। খোদা তোমার প্রার্থনা কবুল করেছেন হয়ত। তাই আমরা মা ও ছেলে শারীরিকভাবে সুস্থই আছি। ও এখন কলেজে পড়ছে। প্রায়ই ও প্রশ্ন করে – মা, আমরা এই গাছটার কাছে কেন আসি? কি উত্তর দেব ওকে? বলে যাও।
লেকের পাড়ের এই গাছটি আমাদের ভালবাসার সাী। ওকে কি তা বলে দেব। ওর ভাবনায় তোমার কোন অবস্থান এখনো আছে কিনা জানিনা। তবে এখনো ও স্বপ্নে বাব্বা বাব্বা বলে কেঁদে ওঠে। আমায় প্রশ্ন করে – মা বাব্বাটা কে? আমি কেন ঘুমের মধ্যে বাব্বা, বাব্বা বলি?
ওটা দুঃস্বপ্ন বলে এড়িয়ে যাই ওকে। নিজে বাথরুমে গিয়ে, দরজা বন্ধ করে কাঁদি। সে কান্না কি শুনতে পাও না?
তুমি প্রকৃতির কান্না বোঝ!
মানুষের কান্না বোঝ না?
তুমি যখন ছিলে তখন বাবুর বয়স মাত্র একবছর তিনমাস। আজ সেই বাবু ১৬ বছরের যুবক। কত দীর্ঘ সময় আমাদের দেখা নেই। কি অপরাধে আমাকে ছেড়ে গেলে? কী অপমান আমি তোমাকে করেছিলাম? শুধু এই একটা প্রশ্ন তোমাকে করবো বলে এখনো বেঁচে আছি। কোথায় তুমি? কেমন আছ? আজ খুব জানতে ইচ্ছে করছে। আল্লার কসম, ভালবাসার কসম লাগে ফিরে এসে শুধু একবার বলে যাও আমার কি অপরাধ ছিল? আমি যে এখনো তোমার বুকে মাথা রেখেই মরতে চাই।
দুই
ডাঃ সূর্যমূখী যখন এভাবে একের পর এক প্রশ্নবাণে নিজের ডায়রীর পাতা ভরছেন, ঠিক তখন কুয়াকাটার সমুদ্রের পাড়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের ডায়রীর পাতা উল্টাচ্ছেন সাংবাদিক সাধন তালুকদার।
সূর্যমূখী। জানিনা কেমন আছ, তবে দোয়া করি আল্লাহ যেন সব সময় তোমাকে আর তোমার ছেলেকে ভালো রাখেন। আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও আল্লাহ তোমাদের ভাল রাখবেন ইনশাহ্আল্লাহ। তোমার হয়ত অনেক প্রশ্ন আমার কাছে। জানি অসংখ্য ‘কেন’ জমে আছে তোমার মনে? বিশ্বাস কর! সব ‘কেন’র উত্তর তোমার কাছেই আছে। একটু ভাবলে পেয়েও যাবে। কিন্তু তুমি ভাববে না, আসলে ভাবার মত অবসরই তো তোমার নেই। এখনো কি তুমি আগের মতই মহাব্যস্ত? বাবাকে দেয়ার মত সময় টুকুও নেই হাতে।
জানি না। শুধু জানি সূর্যের আলো ছাড়া পৃথিবী ক্রমশ ধ্বংসের দিকেই যাচ্ছে। তোমার পৃথিবীতে আজ আর কোন আবাদ নেই, কোন সৃজনশীলতা নেই। সাংবাদিকতা ছেড়ে সেই যে চলে এলাম আর কখনো কোন কিছু সৃষ্টি করতে পারিনি।
তুমি হয়ত জানতে চাও আমি কেন ওভাবে তোমাকে ফেলে চলে এলাম? না এসে যে উপায় ছিলনা সূর্যমূখী। আমি তো বারবার তোমাকে বলেছি – তুমি সূর্যমূখী ফুল নও যে, তোমাকে দেখেই তৃপ্তি পাব। তুমি সূর্যমূখী চাঁদ। চাঁদ যেমন সূর্য থেকে আলো নিয়ে পৃথিবীকে জোৎস্না দেয়, তেমনি তুমিও আমার বুকে জোৎস্না ঢাল। তোমার স্পর্শেই আমার সজীবতা সূর্য।
আমাদের সম্পর্ক তৈরির সেই প্রথমদিনটির কথা মনে আছে সূর্য? ঐদিনটি ছিল শুক্রবার। তোমার বাবার জন্মদিনে তোমরা বিশাল বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলে। আমি অনুষ্ঠানে পৌঁছলাম বেশ দেরী করে। তুমি তখন চলে যাবার জন্য গাড়িতে চড়ছিলে। ‘এই যে, শুনুন’, বলে আমি তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখেই তোমার গালে টোল পড়ল।
বললে – এতো দেরী করলেন? অনুষ্ঠানতো প্রায় শেষ। আমি চলে যাচ্ছিলাম, চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়েই না হয় যাব।
এ কথা বলে তুমি আমার সাথে চলতে শুরু করলে। আমি একটু অবাক হলাম, কারণ তোমার সাথে আমার পরিচয় প্রায় ৫ মাস হয়ে গেছে। কখনো এতটা আন্তরিকতা আগে দেখাও নি। আমার সাথেই তুমি লিফটে চড়লে। আমাদের গন্তব্য সাত তলার অডিটোরিয়ামে। কিন্তু হঠাৎই যেন নার্ভাস হয়ে পড়লে তুমি। ২য় তলায় লিফট থামতেই তুমি অনেকটা তাড়াহুড়ো করে ২য় তলায় নামতে নামতে আমাকে বললে- আপনি যান। আমি একটা রোগী দেখে আসছি।
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নেমে গেলে তুমি। বিশ্বাস কর ঐ দিনটির আগমূহূর্ত পর্যন্ত তোমার প্রতি কোন আগ্রহ ছিল না আমার। কারণ আমি জানি তুমি স্বামী-সন্তান নিয়ে বেশ সুখে আছ। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আমার মনটা বিষন্ন হয়ে গেল। আমি আর অনুষ্ঠানে গেলাম না। ঐ লিফটে চড়েই নীচে নেমে এলাম। আমার মনটা তখন এমনিতেই খারাপ ছিল। ঘরে আমার স্ত্রীর সাথে আমার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। যে কারণে অফিসে কাজের তি হচ্ছিল এবং তোমার বাবা এ নিয়ে তোমার সাথে আলাপও করেছিলেন। তোমার বাবার কাছে তুমি যে আমার সম্পর্কে সব আগেই জেনে বসে আছ তা কিন্তু আমি জানতাম না। তোমার বাবার কাজ করতে বেশ ভালোই লাগছিল। কিন্তু তখনো তোমার প্রতি কোন আগ্রহ আমার ছিল না। তুমি পাগলামীটা না করলে হয়ত কোনদিন হতও না। কারণ আমি মানসিকভাবে প্রচণ্ড সৎ একজন মানুষ। যার নিজের কাছে নিজেকে কখনো জবাবদিহিতে পড়তে হয় না। তুমি হঠাৎ ওভাবে লিফট থেকে নেমে যাওয়ায় আমি খুব অপমান বোধ করলাম। নিজেকে খুব ছোট ও হীন মনে হল। একেতো ঘরে স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না। তার উপর তোমার এ আচরণটায় মনে হল এ সমাজে মানুষ হিসেবে আমি বড় অযোগ্য।
একদিন কাজের অবসরে তুমি বলছিলে – বাঃ সাধন সাহেব। বাবা এমনিতে সাংবাদিকদের পছন্দ করেন না। কিন্তু আপনাকে দেখি রীতিমত ভালোবাসেন।
তখন আমি তোমাকে বলেছিলাম – জানেন ম্যাডাম, আমি না কোথাও বেশিদিন টিকতে পারি না। এই যে আপনার বাবা বা আপনি যে প্রশ্রয়টা দিচ্ছেন এর বয়স বড় জোর ৪ মাস। এরপর আপনারাই আমাকে তাড়িয়ে দেবেন।
তুমি হেসে বলেছিলে – তাই নাকি? আচ্ছা দেখা যাক।
তোমার বাবার কাজে গিয়ে কোথাও কোন পরামর্শ দরকার হলে, সেটা তোমার কাছে এসএমএস এর মাধ্যমে মেসেজ দিতাম। আমার মেসেজ পেলেই তুমি ফোন করে পরামর্শ দিতে। মাঝে মধ্যে বিরক্ত হতে তাও বুঝতাম। কিন্তু লিফট থেকে নেমে যাওয়ার পিছনে কি বিরক্তির আচরণ করেছিলাম তা মনে করতে পারিনি। আমার খুব কষ্ট লেগেছিল। প্রচণ্ড কষ্ট।
আমি তাই তোমাকে একটা এসএমএস লিখলাম- ‘স্যরি ম্যাম, চার মাস না আজ থেকেই আমাদের যোগাযোগ শেষ হল। না আমি আর আপনাকে বিরক্ত করবো, না আপনি আর আমাকে ফোন করবেন। আপনি ফোন করলেও আমি তা আর রিসিভ করবো না। স্যরি এন্ড থ্যাঙ্কস ফর ইউর অল কাইন্ডনেস।’
মেসেজটি পাঠিয়েই আমি আমার ফোন বন্ধ করে দিলাম। বাসায় ফিরে আবার সেই একই ঝামেলা। আমার স্ত্রী’র মধ্যেকার অবিশ্বাস, আমাকে নিয়ে তার সন্দেহ রোগ। যা আমি কোনদিন করিনি সেই সব সন্দেহ অভিযোগ তুলে ঝগড়া এবং রাগ করে বোনের বাড়িতে তার চলে যাওয়া। এ সব কারণে বিপ্তি মন আমার। আমিও দূরে কোথাও চলে যাওয়ার জন্য বাসে চড়ে বসলাম।
তিন
দূরের এক জেলা শহরে নদীর তীরে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল সাধন তালুকদার। পাশ থেকে হঠাৎই বন্ধু গালিব অভিযোগ করে বসল – কিরে তোর কি হয়েছে বলতো? দু’দিন যাবৎ তোর ফোন বন্ধ। ঢাকা থেকে তোকে খুঁজতে অস্টিন, দুর্জয়, সেলিম, মানস, স্বীকৃতি সবাই আমাকে ফোন করছে। তোর অফিস থেকে নাকি ওদের কাছে বারবার ফোন আসছে। তোর কোন ট্রেস চাচ্ছে তারা। তুই কোন অঘটন ঘটিয়ে আসিছ নাই তো?
বন্ধুর এ প্রশ্নে হেসে ফেলে সাধন – নারে ভয় নেই। কারো কোন তি করে আসি নাই যে তুই বিপদে পড়বি।
গালিব উত্তর দেয় – সে ভয় তোকে নিয়ে কখনো করি না। তবে তোর স্ত্রীর সাথে তোর সম্পর্ক ভালো না থাকায়, তোর মনের অবস্থা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। এত বিষন্ন থাকিস নাতো। ফোন খোল, সকলের সাথে কথা বল। দেখবি মন ভালো হয়ে যাবে।
ঐ সময় ফোনটা বাসায় রেখে আসায় আর খোলা হয় না। আড্ডা শেষে ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত্র একটা। ঘরে ফিরেই প্রথম ফোন খুলল সাধন। মিনিট পাঁচেক যেতে না যেতেই সূর্যমূখীর ফোন। রিসিভ করবে কি করবে না ভাবতে ভাবতেই বেশ ক’বার রিং হয়ে থেমে গেল। এরপর কল এল একটি টিএনটি নাম্বার থেকে। ধরতেই ও প্রান্তে সূর্যমূখীর করুণ কণ্ঠ ভেসে এল – প্লিজ আমার ফোনটা একটু রিসিভ করুন। আপনার সঙ্গে কথা আছে।
উত্তরে সাধন বলল – স্যরি ম্যাম আমি খুব বিষন্ন, এখন কারো সাথেই কথা বলতে পারবো না। আমি আমার আচরণের ব্যাখ্যাটা এসএমএস করে দিচ্ছি। বলেই লাইন কেটে দিল সাধন।
মিনিট পাঁচেক পর ও লিখল- ‘স্যরি এটা আপনার সমস্যা না আমার একান্তই ব্যক্তিগত সমস্যা। সম্ভবত আমি আপনাকে পছন্দ করি (সধু ন রষঁ)। তাই দয়া করে আর ফোন করবেন না’।
মেসেজটি পাঠিয়েই আবার ফোন বন্ধ করে দিল ও। পরদিন আর খুলল না। তারও পরদিন মাঝরাতে ফোন খুলতেই একটি নতুন নম্বর থেকে অসংখ্য এসএমএস এসে ভরে গেল। একটা মেসেজ মাত্র পড়েছে, এর মধ্যেই ঐ নম্বরটি থেকে ফোন এল। এতরাতে কার ফোন। প্রথমে ভেবেছিল হয়ত ওর স্ত্রী ওকে পরীা করতে এটা করছে। কিন্তু কণ্ঠ শুনে বুঝল যে, এটা সূর্যমূখী। ফোন রিসিভ হতেই ওপ্রান্তে হাউ মাউ করে কান্না শুরু হল। কান্নার শব্দে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সাধন। সূর্যমূখী নিজেই তার ভুলটা ধরতে পেরেছে, কাঁদতে কাঁদতে তাই সে বলল যে, সে নিজেও জানেনা কেন সে হঠাৎ ওভাবে লিফট থেকে নেমে এসেছে।
সূর্যমূখীর জবাব শুনে স্তম্ভিত সাধন আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করে বসল – ম্যাম, আর ইউ স্যূয়র, আপনি কোন কারণ ছাড়াই নেমে গেছেন?
ও প্রান্ত থেকে উত্তর এল – হ্যাঃ। কোন কারণ ছিল না।
সাধন জানতে চাইল – নাউ ইউ থিংক ইট প্লিজ। আর ইউ ই্ন লাভ উইথ মি।
সূর্যমূখী – আই ডনট নো, বাট মে বি আই ফিল উইকনেস টু ইউ। বাট ইন নাউ আই লাভ ইউ। প্লিজ কাম ব্যাক ইন টুমোরো।
সাধন- ইয়া, আই উইল ডু ইট। বাট, ইউ হ্যাব
সূর্যমূখী- প্লীজ কাম ব্যাক, আমরা সামনাসামনি কথা বলবো।
সাধন- ওকে, আই অ্যাম কামিং।
চার
পরদিন সকালের ট্রেনেই ঢাকায় চলে এসেছিল সাধন। পথে আসতে আসতে আমার সাথে ওর অনেক কথা হয়েছিল। বাবার অফিসে চুক্তিভিত্তিক একটি গবেষণার কাজ করছিল ও। একই অফিসে আমি হাফবেলা কাজ করতাম। তাই সকালে এসে যখন ও আমার রুমে উঁকি দিল, মনে হল আমি আমার জীবনটা মাত্রই হাতে পেলাম। এর আগে এ উপলব্দি আমার কখনো হয়নি। জীবনটাকে ভালোভাবে বুঝে ওঠার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলাম। যাকে বিয়ে করেছি তার সাথে কোন প্রেম ছিলনা তবে আমিই তাকে পছন্দ করেছিলাম। তখন অবশ্য ভালবাসা কি তা বোঝার বয়স আমার হয়নি। ঐ মূহুর্তে সাধনকে দেখেই নিজের মধ্যে প্রাণ ফিরে পেলাম যেন। মুখোমুখি বসে আমরা কথা বললাম। ওর লেখা একটি কবিতা সেদিনের পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। ও সেটি পড়ে শোনাল –
দেহ তাঁর শ্যামলিমার মনমুগ্ধ হাসি
চোখে দাঁড় বেয়ে যায় পদ্মার মাঝি
চুল ছুঁয়ে উড়ে যায় পাখিরা নীড়ে
সৌম্য মুখে তাঁর বেদনা ঘোরে।
আমার পায়ে চলা প্রতিটা বাঁকে
তারই হাতছানি দেখি, সে-ই আমায় ডাকে।
আমি জানতে চাইলাম ‘সৌম্য মুখে বেদনা ঘোরে’ কথার মানে কি?
উত্তরে ও বলল – যেমন আপনি। সব সময় হাসি খুশি একজন ডাক্তার। অথচ হাসির আড়ালে লুকানো কষ্টের পাহাড়।
বললাম – যান, আমার কোন কষ্ট নেই।
ও একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল – প্রার্থনা করি যেন না থাকে কখনো।
এ কথায় আমি চুপসে গেলাম। অনেক সময় নিয়ে রোগী দেখলাম আর ফাঁকে ফাঁকে ওর সাথে কথা বললাম। কিন্তু কেউই কারো মনের কথা বলতে পারলাম না। সব কথাই হল কাজ আর ঘরের পরিস্থিতি নিয়ে। আমি ওর বউয়ের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলাম। ও অবাক হল দেখে মজা পেলাম। বললাম বাবা আমাকে সব বলেছেন। দেখলাম বউয়ের প্রতি ওর যথেষ্ট সম্মানবোধ। খুব বেশি ভাল না বাসলে এটা হয় না। ও তার কোন দোষই বলল না, বরং প্রশংসাই করল। শুধু এটুকু বলল যে, বেচারী আমাকে নিয়ে খুব কষ্টে ছিল।
কিন্তু ও আমার স্বামী প্রসঙ্গে কোন কথা বলল না। তবে ছেলের কথা জানতে চাইল। আমাকে বোঝাল যে, আমি আসলে রাগের মাথায় একটা অন্যায় করতে যাচ্ছি। এটা ভালবাসা না জেদ। আমিও ভেবে দেখলাম, হয়ত সাধন ঠিক বলেছে। যাই হোক, সেদিন আমরা দু’জন দু’জনকেই অনেকটা সময় নিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম, তারপর দু’জনই দু’জনকে সৎ পরামর্শ দিয়ে ঘরে পাঠালাম। সকালে কথা হবে বলে বিদায় নিলাম আমরা।
পরদিন অফিস বন্ধ। সকালে ওকে ফোন করলাম, দেখি ওর ফোন বন্ধ। ভাবলাম হয়ত বউ ফিরে এসেছে তাই ইচ্ছে করে ফোন অফ করে রেখেছে। ভাবনাটা মাথায় আসতেই আমি কেমন পোটে হয়ে উঠলাম। বার বার ফোন করছি আর এসএমএস করছি। তারপর টিকতে না পেরে একসাথে অনেকগুলো ঘুমের ঔষধ খেয়ে ফেললাম। মনে হচ্ছিল আমি মরে যাচ্ছি। ওকে বুঝি আর শেষ দেখাটাও দেখতে পাব না। আমার ঘরের লোকজন দ্রুত আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। হাসপাতালে আমার পেট ওয়াস করাল। দুপুরের পর সুস্থ হয়ে ঘরে এসে দেখি ওর ফোন খুলেছে। আমার এসএমএসগুলো সব ডেলিভার হয়েছে। একটু পরেই দেখি ওর ফোন। ও প্রান্তে ওর ভীত-অথচ উত্তেজিত কণ্ঠস্বর আমার খুব ভালো লাগছিল। আমার কণ্ঠশুনেই ও কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে। প্রায় পাগলের মতই ছুটে এসেছে ও। আমি বাধা না দিলে হয়ত ঘরেই চলে আসত। আমার বাসার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে শুনে স্বস্তি পেলাম। সাধারণত আমি চেম্বার করি বিকাল ৫টা থেকে। ঐদিন একটু আগেই গেলাম। বাসা থেকে বের হবার আগে আমি অনেকদিনপর নিজেকে একটু সাজালাম। ওর পছন্দের নীল রং শাড়ি পরলাম। বাহিরে তখন কড়কড়ে রোদ, তার উপর বৃষ্টি পড়ছে। বেশ একটা অন্যরকম দিনের স্বাদ পাচ্ছিলাম। এ রকম রোদ্রঝরা বৃষ্টি অনেকদিন দেখিনি। আমি চেম্বারে ঢুকে বসতে না বসতেই অনেকটা পাগলের মতই ও ঢুকল। ঢুকেই চেম্বারের দরজা বন্ধ করে উম্মাদের মত আমার গালে, কপালে, ঠোঁটে চুম্বন শুরু করে দিল। তারপর শান্ত হয়ে বসে জানতে চাইল কেন এ পাগলামী করেছি।
আমি উত্তর দিলাম – জানিনা। তুমি কখনো ফোন বন্ধ করলে আমাকে বলে বন্ধ করবে কথা দাও। কখনো সকালে ফোন খুলতে দেরী করবে না, কথা দাও প্লিজ।
ও আমাকে কথা দিল। সে সঙ্গে আমার ব্যাগ হাতিয়ে যে কটা ঘুমের ঔষুধ পেল সব নিয়ে ফেলে দিল। আমি জানিনা আমি কেন এটা করেছিলাম। শুধু বুঝতে পারলাম, বিশাল একটা পাপের পথ আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমার স্বামী আছে, ১০ বছর ধরে সাজানো সংসার আছে, আর আছে প্রাণের চেয়ে প্রিয় আমার সন্তান আলাওল। আলাওলের জন্য আমি হাসি মুখে ওকেও ছাড়তে পারি। সবচেয়ে বড় কথা আমার বাবা এ সমাজের প্রতিষ্ঠিত ও সম্মানীত একজন বড় মাপের মানুষ। সারা দেশের মানুুষ তাকে এক নামে চেনে। আর তার মেয়ে হয়ে আমি কিনা ছিঃ। তার উপর আবার আমি বাবা-মায়ের অমতেই আমার স্বামীকে বিয়ে করেছিলাম। সে নিয়ে সমস্যা এখনো যায় নি। যে কারণে এখনো আমাকে স্বামী-সন্তানসহ বাবার বাড়িতেই থাকতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে সাধনের প্রতি আমার আকর্ষণ সমাজের চোখেই শুধু নয়, আমার নিজের কাছেও এটা পাপ ছাড়া আর কিছু নয়। বিষয়টা হয়ত বুঝতে পেরেই সাধন আমার কাছে এই প্রথম আমার স্বামীর কথা জানতে চাইল। আমি এড়িয়ে গেলাম। আমার মন ভালো করতে ও তৎণাৎ একটি কবিতা লিখে আমাকে পড়ে শোনাল –
আর কোন কথা নয় মেয়ে
নিশ্চুপ দর্শন ছেড়ে চলে এসো
বাহুবন্ধে আমার।
এখনো স্বপ্নজুড়ে তোমার চুলের বাঁধন;
ছুঁয়ে নেমে যাওয়া নীল শাড়িটির মতন,
আমার চোখে জড়িয়ে আছে
তোমার সুন্দরম।
তোমাকে ভাবতে ভাবতে
কেটে যাক সময়, আমিও না হয়।
সুন্দরের সান্নিধ্যে এসে হয়ে উঠব
সুন্দরম একজন,
তোমার উজালা চোখের ছোঁয়ায়।।
আমার প্রতিটা দিন
কেটে যাক তোমার প্রতীায়।।
আর কোন কথা নয় মেয়ে
নিশ্চুপ দর্শন ছেড়ে এসো চলে
বাহুবন্ধে আমার,
তা-না হলে এই যে, রোদ্র ঝরা
প্রকৃতির কান্না দেখছো
ও কিন্তু থামবে না আর।
কবিতাটি পড়া শেষে হঠাৎ চুপ হয়ে গেল সাধন। কিছুণ পর ও স্পষ্ট বলল – দেখ ডাক্তার আমি মনে প্রাণে একজন সৎ মানুষ। অবৈধ কোন সম্পর্কে আমি বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করতেও চাইনা। যদিও এ কথা আমি আমার বউকে বুঝাতে পারিনি কিন্তু তুমি বুঝবে। আমার আচরণেই বুঝবে। তুমি যদি সত্যি আমায় ভালবাস, আর তোমার স্বামীর প্রতি তোমার যদি কোন টান না থাকে শুধু তাহলেই আমরা এগিয়ে যাব এবং বিয়ে করবো। বল আমার এ প্রস্তাব তোমার পছন্দ কিনা। অন্যথায় প্লিজ আর এগিয়ো না।
আমি ওকে তখনও বুঝাতে চাইলাম – আমরা বন্ধু হয়ে তো থাকতে পারি।
ওর সেই একই উত্তর – ছেলে-মেয়ের বন্ধুত্বে আমি বিশ্বাসী না। আমায় মা কর। ছেলে-মেয়েতে কখনো বন্ধুত্ব হয় না। আগুন আর মোম কখনো পাশাপাশি রেখ না। মোম গলে যাবেই।
আমি বলতাম – এটা আধুনিক যুগ। এ যুগে ছেলে আর মেয়ে একই সাথে সব কাজ করছে? তবে কেন বন্ধুত্ব হবে না।
ও যুক্তি দিত – এ জন্যইতো এ যুগে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ আর এসিড নিেেপর মত জঘন্য ঘটনাগুলো ঘটছে।
আমি বলতাম – ওটা সব যুগেই ছিল। প্রচার ছিল না বলে জানা যেত না।
উত্তরে ও যা বলল তা শুনে ওর যুক্তিকেই মেনে নিতে হল। ও বলল – দেখ সূর্যমুখী, তুমি যা দেখনি, তা তুমি কল্পনা করতে পার না, সে যুগেতো সবাই খুব পর্দা মেনে চলত। এখনকার মত অর্ধদেহ দেখিয়ে ঘুরে বেড়াত না। পর্দার আড়ালের মেয়েটি কালো না ধলা, তার ফিগার কেমন? এ সব বোঝার উপায় ছিল না। তাই নির্যাতনটা খুব কম ছিল। তোমাদের এ যুগ মানে স্যাটেলাইট কালচার, তোমাদের পোশাক যত খুলছে, মানুষের রুচি ও চিন্তার ততই বিকৃতি ঘটছে। এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা মেয়েদের নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করতে ‘নারী স্বাধীনতার যুগ’ বলে শ্লোগান তুলছে আর একটু একটু করে তাদের আব্র“ খুলে নিচ্ছে। বিনিময়ে দু[হাতে টাকা কামাচ্ছে তারা।
একটু ভেবে দেখ, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত! যিনি নারী স্বাধীনতার অগ্রপথিক! তিনি কি এটা চেয়েছেন? তিনি কি কখনো তার স্বামীর অবাধ্য হয়েছেন? না তার কাপড় কেটে অর্ধেক করেছেন কখনো? বরং তার স্বামী তাকে সাহায্য করেছেন তাঁর প্রতিটি কাজে। তিনি কোথাও ছেলে-মেয়ের বন্ধুত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে যান নি। ওটা পশ্চিমা ফ্রী সেক্স কালচার। বাংলাদেশে ওটা ব্যবহারের চেষ্টা কর না প্লিজ।
কী আর করা অগত্যা ওর প্রস্তাব সমর্থন না করে আমার উপায় ছিলনা। কারণ কোন কিছুর বিনিময়ে আমি ওকে হারাতে রাজী ছিলাম না। আমি ভাবলাম – কিছুদিন যাক। ও যখন আমাকে গভীরভাবে ভালবাসবে তখন আমার প্রস্তাবেই ও ফিরে আসবে। একটা বিষয় আমি পরিস্কার বুঝতে পারলাম, আর যাইহোক আমার শরীরের প্রতি নোংরা কোন আকর্ষণ ওর নেই। ও চাইলে আমি ওকে সবই দিতে রাজী। কিন্তু জানি ও বিয়ে না করে কোনদিন আমার সাথে সেক্স করার কথা চিন্তাও করে না।
ও বলে – সেক্স খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায়। ভালবাসার শেষ পরিণতি হয়ত ওটাই। কিন্তু সেটা বিয়ের পরে। আগে না। যে মেয়ে বিয়ের আগেই ওটা দিতে চাইবে, আমি বলবো তার মধ্যে কোন ভালবাসা নেই। সে কোন ভদ্র মেয়ে নয়। তাই বলে আবার এটাতেও আমি বিশ্বাসী না যে, সারা জীবন একে-অপরকে ভালই বেসে যাব, বিয়ে করবো না। না বাবা তাহলে আমায় মাপ করে দাও।
আমার ভালবাসাকে নিয়ে আমার একটা স্বপ্ন আছে – তুমি আবার পড়াশুনায় মনোযোগ দেবে, বড় ডাক্তার হবে। আমি তোমাকে ও আলাওলকে নিয়ে চলে যাব দূর অজপাড়া গাঁয়। যেখানে এখনো বিনা চিকিৎসায় মারা যায় অসংখ্য শিশু ও তাদের মায়েরা। তুমি ঐ সব অসহায় শিশু ও তাদের মায়েদের কম খরচে চিকিৎসা দেবে। আমাদের ঐ সেবাদান প্রতিষ্ঠানের একটা নাম থাকবে – ‘আলাওল-সুজানা মা ও শিশু স্বাস্থ্য কিনিক’। আমাদের মেয়ে সুজানা ওখানেই জন্ম নেবে। ও বেড়ে উঠবে বড়ভাই আলাওলের সাথে খেলা করতে করতে। এই স্বপ্নের ভুবনটায় যে আমাকে বিচরণ করতেই হবে সূর্য। তানা হলে এখানেই শেষ কর সব, আর এগিয়ো না প্লিজ।
ওর আর একটা কথা আমার খুবই ভালো লাগে। ও বলে – ডাক্তার তুমি ‘ইউসুফ-জুলেখা’র গল্পটা জানো। সেখানে জুলেখা একজন বাদশার স্ত্রী ছিলেন। তার কোন সন্তান ছিল কিনা জানিনা। তবে তিনি ‘ইউসুফ’কে ভালবেসে ছিলেন এবং প্রার্থনা করে আল্লাহর কাছ থেকে ‘ইউসুফ’কে বিয়ে করার অনুমতি পেয়েছিলেন। সত্যিকারের ভালোবাসা থাকলে আল্লাহ যে মেনে নেন তার প্রমাণ এই ‘ইউসুফ-জুলেখা’। আমার কি মনে হয় জানো ডাক্তার? যুগ যুগ ধরে ‘ইউসুফ-জুলেখা’দের জন্ম হয়। সবযুগেই তারা থাকেন, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে। তাই বুঝা যায় না। এই একবিংশ শতাব্দীতেও তারা এসেছেন, তোমার আর আমার রূপ ধরে। তাই প্রভু নিজেই আমাদের মিলন ঘটিয়ে দেবেন। প্রকৃতি আমাদের ভালবাসার সাী হবে। দেখ! প্রকৃতির সাথে আবার যুদ্ধ করতে যেও না। স্বাভাবিক নিয়মে যা ঘটবে তা ঘটতে দিও। তুমি বুদ্ধি খাটিয়ে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ কর না। তাহলে ফল ভাল হবে না।
ওর মধ্যে এ জাতীয় বেশ কিছু পাগলামী আছে। ওকে যে না বুঝবে তার জন্যে ওর সাথে তাল মিলিয়ে চলা খুবই কঠিন। এখন আমি বুঝি ওর সাথে তাল মিলিয়ে ওর বউ কেন চলতে পারেনা। ওর পোমীটা, ওর পাগলপনাকে আমি বুঝি আমার ডাক্তারী বিদ্যার গুণে। যে কারণে আমি ওকে যতটা বুঝতে পারি আর কেউ ওকে সেভাবে বুঝতে পারেনা। ওর মধ্যে কোন কপটতা নেই, খুব স্পস্টবাদী। মনের গভীরে আসা একটা খারাপ চিন্তাকেও প্রকাশ করে দেয়। সবসময় সত্যটা বলাই স্বভাব। অবশ্য ওর সত্য বলার ভঙ্গিটা বিরক্তিকর। মনে হয় যেন মিথ্যে বলছে। আসলে ও কখনোই মিথ্যে বলে না। ওর বলার ধরণটাই এমন যেন গাল-গপ্প করছে। হুট করে রেগে যাওয়া ওর স্বভাবের সবচেয়ে খারাপ দিক। রাগ হলে যা তা বলে বসে। নিজে যা বিশ্বাস করে না তাও বলে ফেলে। আবার খুব বেশি মন খারাপ হলে ফোন বন্ধ করে দেয়। কারো সাথে কথা বলতে চায় না। সোজা বাংলায় বলা যায়, সব রকম পরিবর্তনটাই ওর চেহারায় ফুটে ওঠে, যা ও লুকাতে পারে না। এটাই ওর স্বভাব। হুটহাট দূরে কোথাও চলে যেতে পারলে খুব আনন্দ পায়। এমন লোকের সংসার ধর্ম না করাই ভাল। অথচ ওকেই আমি ভালবাসি। প্রচণ্ড ভালবাসি।
পাঁচ
অতীতের সব স্মৃতি গাঁথা,
শোক গাঁথা; বন্ধুদের অসংখ্য ফোন,
প্রেম নিবেদন,
যদি পার আজ থেকে ভুলে যাও সব।
নতুন জীবনে,
এসো দু’জনে,
হাতে রেখে হাত যাত্রা করি শুরু।
তানা হলে আমাকেও ভুলে যাও।।
সূর্যমুখীকে আমি বার বার এই একটা কথাই বলে এসেছি যে, তোমার স্বামী আছে সংসার আছে, এসব সত্ত্বেও আমার দিকে আকর্ষণ থাকাটা অন্যায় হবে। আমি কোন অন্যায়ের সঙ্গ দেব না। তুমি যদি সবাইকে সত্য বলে, তোমার স্বামীর কাছ থেকে ডিভোর্স আনতে পার, তাহলে আমি তোমাকে গ্রহণ করতে পারবো। আমি তোমাকে ভালবাসি এটা সত্যি, তাই বলে একটা অন্যায়কে আমি প্রশ্রয় দেব না।
ও খুব যুক্তি দিত। বলত, বন্ধুত্বের কথা। পরে যখন ও বুঝতে পারল – আমি বন্ধুত্ব শব্দটাকে সত্যি অপছন্দ করি, তখন আমাকে খুশি করতেই বলত – আজ হোক, কাল হোক, বছর পরে হোক বিয়ে আমি তোমাকে করবোই।
এ কথা শুনে আমি তখনকার মত খুশি হয়ে উঠতাম। যদিও একা হলেই আবার একটা পাপবোধ আমাকে পেয়ে বসত। বিষয়টা শেষ করা উচিৎ আর এগোতে দেয়া যায় না। আমার জীবনটা তো গেছে, এই সুন্দর মনের মেয়েটির জীবন আমি কেন নষ্ট করছি। বিষয়টি নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করলাম, আমার সব বন্ধুগুলোই খুব ভালো মনের। ওরাও বিষয়টা বুঝতে পারলো, আমাকে বাধা দিল। এটা ঠিক না, তুই ওনার কাছ থেকে সরে যা।
একজন বুদ্ধি দিল – এক কাজ কর, টাকা ধার চেয়ে দেখ। দেখবি আপনা আপনি কেটে পড়বে। যেহেতু সে ডাক্তার, অবশ্যই বুদ্ধিমতী। এত অল্পদিনের পরিচয়ে কখনোই সে তোকে টাকা ধার দিতে পারবে না। বরং তুই লোভী ভেবে সরে পড়বে। আর যদি টাকাটা ধার দেয় তাহলেতো বুঝতে হবে সত্যি তোকে ভালবাসে। তখন সোজা বিয়ে করে ফেলবি।
বন্ধুদের এই পরামর্শ আমার মনঃপুত হয়নি। বিষয়টি নিয়ে একা একা আবার ভাবনায় পড়লাম। যদি ও আমাকে সত্যি ভালবাসে? তাহলে ও তো টাকাটা আমাকে দেবে। যদি দেয়, তাহলে কি হবে? অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম – একহাতে টাকাটা নেব, অন্যহাতে ওকে একটা চিঠি দিয়ে আসবো। চিঠিটি এমন ভাবে লেখা থাকবে পড়ে মনে হবে আমি ওর সাথে চিটিং করছি। ও আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করবে। আর আমি ওর মায়ের হাতে টাকাটা দিয়ে চলে আসবো। হ্যাঃ অনেকটা বাংলা সীনেমার কাহিনীর মতই। আমি দ্রুত হাতে চিঠি লিখে ফেললাম। লিখলাম-
‘প্রিয় সুর্যমুখী, সত্য হচ্ছে আগুন, যা কখনো চাঁপা থাকে না। আজ হোক, কাল হোক তোমার আমার এ সম্পর্ক প্রকাশ পাবেই। তাছাড়া আমাদের পরিণতি কি বলতে পারো? সারাজীবনতো এভাবে চলতে পারে না। একদিকে বলছো, স্বামীর প্রতি তোমার কোন টান নেই। অন্যদিকে বলছো, ঐ বেচারারতো কোন দোষ নেই যে, তাকে সন্তান ছাড়া করবে। আবার বলছো তোমার সন্তানকে বাবা ছাড়া করতে পারবে না। এ অনুরোধ যেন আমি না করি। তাহলে তুমিই বল, আমি কি করবো? তোমার সন্তানের এখন যে বয়স তাতে বাবার পরিবর্তনটা ও এখন বুঝতে পারবে না। কিন্তু বছর-দুই পরে ও সবই বুঝতে শিখবে। তখন ওর কাছে তোমার সম্মান কোথায় থাকবে বলতে পার? তাই আমিই সরে যাচ্ছি। চলে যাচ্ছি দূরে, বহুদূরে। আর একটা বিষয় হচ্ছে, আমি ল্য করেছি, তোমার স্বামীর প্রতিও তোমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা রয়েছে। তাকে দেখেছি, তার সাথে আমার কথা হয়েছে। মনে হয়েছে যথেষ্ট উদার ও মহান মনের একজন মানুষ তিনি। তাহলে এই ভালমানুষটিকে কেন ঠকাচ্ছ? আমার প্রতি তোমার যে ভালবাসা তার কিছুটা তাঁকে দিয়ে দেখ, তোমাদের মধ্যে যদি কোন সমস্যা থেকেও থাকে তা দূর হয়ে যাবে। আমাকে আর খুঁজো না। প্লিজ।’
চিঠিটা পকেটে নিয়ে যেখানে আমাদের সন্ধ্যার পর দেখা করার কথা সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমি বরাবরই আধাঘন্টা আগেই চলে আসি। হঠাৎ কি হল জানিনা, রাস্তায় লোকজন ছুটাছুটি শুরু করে দিল। গুলি-বোমার শব্দ। একটু পরই পুরো ঢাকা শহরে কার্ফু জারীর ঘোষণা এল। রাত আটটা থেকে কার্ফু। বাধ্য হয়ে ওকে ফোন করে দেখাটা বাতিল করতে হল। রাত আটটার পর ফোনের যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গেল।
পরদিন, বেলা বারটার পর ওর সাথে কথা হল ফোনে, আমি ফোনেই ওকে বললাম, আমার খুব জরুরী বিশ হাজার টাকার দরকার। তুমি কি দিতে পারবে?
আমার তখনও দৃঢ় বিশ্বাস এতো সামান্য টাকা, এটা ওর জন্য কোন বিষয়ই না। যথেষ্ট সম্ভ্রান্ত ও ধনী একটা পরিবারের মেয়ে ও। তার উপর ডাক্তার। চাকুরীর পাশাপাশি প্রাইভেট প্রাকটিসও করে। চাওয়া মাত্রই টাকাটা পাওয়া যাবে। আমি একহাতে টাকাটা নেব, অন্যহাতে চিঠিটা দিয়ে চলে যাব ওর ঘরে, ওর মায়ের হাতে টাকাটা দিয়ে, তাকে সব ঘটনা জানিয়ে হারিয়ে যাব দূরে, অনেক দূরে। ওর মাকে সব সত্য বলে যাব কারণ – যদি সূর্যমুখী আবার কোন দূর্ঘটনার জন্ম দেয়, আবার সুইসাইড করতে চেষ্টা করে তাহলে তিনি ওকে সত্যটা বলে দেবেন এবং আমাকে ডেকে পাঠাবেন। আমি তাকে আমার ঠিকানাটা দিয়ে যাব।
ছয়
সব মিলিয়ে আমাদের প্রেমের বয়স মাত্র ছয়দিন। এর মধ্যেই ও আমার কাছে টাকা চাইতে পারল। তাও এক দু-হাজার নয়, একসাথে বিশ হাজার। আমি কোথায় পাব এত টাকা। আমার হাতে যে কখনোই কোন টাকা থাকে না, এ কথা আমি ওকে কি করে বোঝাবো? আমাদের দশ বছরের বিবাহিত জীবনে আমি চাকুরী করে যা আয় করি সবই আমার স্বামীর হাতে তুলে দেই। নিজের খরচ যা লাগে সব স্বামী বা মায়ের কাছে চেয়ে নেই। এ কথা ওকে বলতেই, ও অবিশ্বাস করল। আমাকে যা তা বলে গালাগালি শুরু করল। বলল জাতে মাতাল তালে ঠিক। ঘুমের ওষুধ খেয়ে আমার জন্য মরতে পার, আর টাকা চাইলে তখন অজুহাত দেখাও। তোমরা ধনীরা সব এ রকমই। জাতে মাতাল, তালে ঠিক। আর কখনো আমায় ফোন করবে না, বলেই লাইন কেটে দিল।
ওর কথা শুনে আমার সারা শরীর কেঁপে উঠল। রাগে প্রায় অন্ধ হবার দশা। অফিস শেষে কোনভাবে ঘরে গেলাম। ঘরে গিয়ে সামনে যা পেলাম ভাংচুর করলাম। চিৎকার করে কাদঁতে শুরু করেছি। আমার অবস্থা দেখে আমার বড় ভাবি ছুটে এলেন। জানতে চাইলেন কি হয়েছে? আমার স্বামী ও ভাবীকে ঘটনাটি খুলে বললাম। রাগ হলে আমার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। কি করছি বা কি বলছি তার কোন খেয়াল নেই। ভাবী আমাকে সান্তনা দিলেন, বললেন – সাংবাদিকদের থেকে দূরে থাক, ওরা খুব খারাপ হয়। আর এই ছেলেটিকে তো আমার একদম পছন্দ হয়নি। খুব সাবধান।
এতকিছুর পরও আমি কেন জানিনা ওর মোবাইলে আবার ফোন করলাম। দেখি বন্ধ। আবার করলাম, আবার, যতবার বন্ধ পাচ্ছি, ততবারই আমার জেদ চেঁপে যাচ্ছিল। রাগে অন্ধ হয়ে সারা ঘর, ব্যাগ খুঁজে পাঁচটি ঘুমের টেবলেট পেলাম। একসঙ্গে সবকটা খেয়ে ফেললাম। তারপর ওর ফোনে একটা এসএমএস ছেড়ে দিলাম- “মরলে লাশটা একবার দেখে যেও।”
আমার বুকের ভিতর খুব কষ্ট হচ্ছিল, আমি বিছানায় শুয়ে ছটফট করছি, এতগুলো ঔষধ আমার চোখে ঘুম নামাতে পারছিল না। চিৎকার করে আবার কাঁদতে যাব, ঠিক তখনই ওর ফোন এল।
আমি রিসিভ করতেই ও প্রান্তে ওর উত্তেজিত গলা – কি করেছ তুমি, কয়টা টেবলেট খেয়েছো? আমি তোমার ঘরের সামনে দশ মিনিটের মধ্যে আমার কাছে না আসলে আমি ঘরে ঢুকে যাবো।
আমি জড়ো জড়ো কণ্ঠে কোনমতে বললাম – এখুনি আসছি, তুমি বাসায় এস না, সবাই তোমার উপর েেপ আছে।
দশ মিনিটের মাথায় কোনমতে একটু মাথাটা আচঁড়ে নিয়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ও একটা সিএনজি স্কুটার ভাড়া করে আমাকে নিয়ে সেটায় চেপে বসল। আমি স্কুটারে চড়তেই ও পাগলের মত আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলল। ওর বুকে মাথা রেখে আমিও যেন স্বস্তি পেলাম। জানতে চাইলাম টাকাটা ওর কেন দরকার?
ও বলল – দূর পাগলী! টাকা দিয়ে আমি কি করবো? আমিতো তোমাকে তাড়াতে টাকাটা চেয়েছিলাম।
বললাম – পেরেছো তাড়াতে? আর কখনো এমন কাজ কর না। বলেই আমি ওর কাঁধে মাথা রেখে কাদঁতে শুরু করলাম। ঘরে যা যা করেছি, ভাবী ও স্বামীকে যা যা বলেছি সব বলে দিলাম। বললাম – আমার বেতন, রোগীদের দেয়া ফি সব কীভাবে কি করি।
ও শুনতে চাইলো না। পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে আমার হাতে দিল, মুখে বলল – এখন পড় না। ঘরে গিয়ে পড়, তবে এটার আর কোন মূল্য নেই এখন।
চিঠিটা পড়ে আমি বুঝেছিলাম, ও সত্যি টাকাটা আমাকে তাড়াতেই চেয়েছিল। যদিও পরদিনই আবার ওর ফোন খুলতে দেরী হওয়ায় আমি পাগলের মত হয়েগিয়েছিলাম। ওর পরিচিত এলাকাগুলোতে ওকে খুঁজে বেরিয়েছি। না পেয়ে আবার আমি অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে মরতে গিয়েছিলাম। ও ছাড়া জীবনটাকে অর্থহীন মনে হয়েছিল। কেন এ রকম হয়েছিল আজ তা বলতে পারবো না। কিন্তু আজো তুমি ছাড়া আমার জীবনটাকে অর্থহীনই মনে হয়।
সাত
টাকা চেয়ে না পাওয়ার পরও সুর্যমূখীর প্রতি আমার কোন বিদ্বেষ জন্মালো না, বরং ওর প্রতি অদ্ভুত এক আকর্ষণ বোধ করতে শুরু করলাম। এই প্রথম আমার উপলব্দি এল যে জীবনে আমাকেও কারো প্রয়োজন আছে। আমার জন্যও কেউ স্বামী-সন্তান ফেলে মরতে চাইতে পারে। যদিও মনের মধ্যে একটা দ্বিধা রয়েই গেল। অবচেতনে কেউ বলছিল, দূর বোকা! ও একজন ডাক্তার, কি পরিমাণ ঘুমের ঔষধ খেলে কি হবে তা ও ভালোই জানে। ও শুধু তোমাকে ভয় দেখিয়েছে।
আমি বলি – সে ভয় দেখাক, আর ভণিতা করুক। আমার জন্যইতো করেছে। অবশেষে আমাকে বিয়ে করতে রাজীতো হয়েছে। তাহলে আর অবৈধ সম্পর্কতো হল না। এখন বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা। দেখি তিনি নিশ্চয়ই আমার ও তার মনের কথা জানেন। তিনিই সব সুন্দর করে দেবেন।
আজ প্রায় এক সপ্তাহ পর আমাদের দেখা হবে। আজই প্রথম ও ওর সন্তানকে আমার কাছে নিয়ে আসবে। যদিও ওর সাবধান বাণী – খবরদার তুমি কিন্তু বাবুকে ধরতে যেও না, তাহলে ও কান্না শুরু করে দেবে। আর থামানো যাবে না। শুনে আমি শুধু হাসলাম। ওদের আসার জন্য অপো করছি আর মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করছি – হে আল্লাহ! ওর সন্তান যেন আমার কোলে কান্না না করে, বরং আমাকে পেলে খুশি হয়ে ওঠে।
অপোর সময় যেন কিছুতেই কাটতে চায় না। মনের মধ্যে নানান রকম ভয় কাজ করতে শুরু করল। যদি না আসে, যদি কেউ বাধা দেয়। এ সব ভাবনা তাড়াতে বসে বসে একটা কবিতা লিখে ফেললাম –
তোমার একটু ছোঁয়া চেয়ে
প্রাণ মন কেঁদে যায়
কী ভীষণ যন্ত্রণায়
বুকের ভিতর মুচড়ে যায়
অদৃশ্য বাতাস।
নির্ঘুম চোখে অন্ধকারে চেযে চেয়ে
আঁকা স্বপ্নের বুনন ভেঙে যায়
মূহূর্মুহু দীর্ঘশ্বাস।
আগামী সুন্দরের প্রত্যাশায়
এভাবেই স্বপ্ন এঁকে যাব
অনাদিকাল।।
একটু পরই ওরা এল। ওকে নয় আমি বাবুকে ছোঁয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলাম। প্রথমবার হাত বাড়াতেই ফিরিয়ে দিল, একটু মোড়ামুড়ি করল, আসবে না। ওর মা বলল – যাও মাম্মা, মামার কাছে যাও। আমি অনেকটা জোর করেই বাবুকে কোলে নিলাম। সূর্যকে ধমকে বললাম – খবরদার! মামা বলাবে না। ও আমাকে বাব্বা বলবে।
অদ্ভুত ঘটনা হল, আমি যে জোর করে ওকে কোলে নিলাম, ও কাঁদল না। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আমাদের চমৎকার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আমার পিঠে চড়ে সে ঘোড়া চালাতে শুরু করল। অদ্ভুত এক মায়ার বাঁধন আমাকে কানে কানে বলে দিল ওর নাম আলাওল। দেখ তোমার আর ওর নামের অর্থ কেমন একই। তারমানে আল্লাহ নিজেই ওকে তোমারই সন্তান বানিয়ে রেখেছেন।
ওরা মা-ছেলে যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন আমার ভিতরটা কষ্টে কেঁপে উঠছিল বার বার। ইচ্ছে হচ্ছিল চিৎকার করে বলি, সূর্যমুখী! তুমিতো এখন চেম্বার করবে, রোগী দেখবে, বাবুকে আমার কাছে রেখে যাও না, আমি ওকে নিয়ে খেলা করি। আলাওল খুব কান্না করছিল, ও যাবে না। কিন্তু উপায় নেই। সূর্যর চেম্বারে রোগীদের ভিড় জমে গেছে। বার বার ফোন আসছিল। বাবুকে আমার কাছে রাখা সম্ভব ছিল না, কারণ এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠবে। এমনিতেই সূর্য’র মা তার মেয়ের আচরণের পরিবর্তন নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করেছেন।
এদিকে আমার ঘরে আমার স্ত্রী ফিরে এসেছেন। এসেই তিনি আমাকে একটা সিদ্ধান্তে আসার জন্য কান্নাকাটি শুরু করেছেন। এতদিন তার সন্দেহ ছিল – আমি অফিসের কাজে ঢাকার বাহিরে গিয়ে মেয়েদের সাথে সম্পর্ক করে বেড়াই। হোটেলে মেয়ে নিয়ে রাত্রী যাপন করি। এ নিয়ে তার সাথে প্রায়ই তর্ক হত। সম্প্রতি তার লেখা একটা ডায়রী পড়ে আমি বুঝতে পেরেছি, আমার প্রতি তার বিন্দু মাত্র শ্রদ্ধা বা বিশ্বাস নেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা আমি তার তুলনায় অনেক কম শিতি। তার দৃষ্টিতে আমি মেরুদ্বন্ডহীন একটা প্রাণী মাত্র। এমতাবস্থায় আমি সিদ্ধান্তে নিলাম, যাই ঘটুক। তার সাথে আর একত্রে থাকা সম্ভব নয়। সামনে আমাদের একটি ধর্মিয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাত্র ছিল। শবেবরাতের রাত্র। এ রাতে নাকি আল্লাহ কাউকে খালি হতে ফেরান না। চাওয়ার মত চাইতে জানলে তিনি সকলের মনের কষ্ট দূর করে দেন। সকলকে তিনি মা করেন। আমি ঐ রাতেই সিদ্ধান্ত নেব বলে তাকে জানালাম। শবেবরাতের রাতে সারারাত প্রার্থনায় কাটালাম।
আমার প্রার্থনা ছিল স্রষ্টার কাছে – “হে স্রষ্টা – আপনি আমায় মা করুন। আমাকে সত্য ও সুন্দর পথে চালিত করুন। আমার প্রতিটি পদপে আপনি নিয়ন্ত্রণ করে দিন। আমি যেন কোন পাপ না করি। সূর্যমুখী যদি আমার পাপ হয়, ওর সাথে সম্পর্ক এখানেই শেষ করে দিন, অন্যথায় ওকে আমার সারা জীবনের সাথী করে দিন, আমায় সঠিক পথ দেখিয়ে দিন।”
রাতে বেশিরভাগ সময়ই ফোন বন্ধ ছিল। শেষরাতে দু’বার ফোন খুলেছি। দু’বারই সূর্যমুখী ফোন করে আমার খোঁজ নিল, কিন্তু আমার স্ত্রী নিল না। ভোরবেলা প্রার্থনা শেষে প্রথমেই সূর্যমুখীর কপালে ও ললাটে চুমু খাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। ওকে ফোনে সে কথা জানাতেই ও অফিসে যাওয়ার জন্য একঘন্টা আগে ঘর থেকে বের হয়ে এল। এই প্রথম নিজের হাতে তৈরি নিয়ম ভাঙলো মেয়েটি।
‘এত সকালে কোথায় যাচ্ছ’? মা ও ভাবি ওকে প্রশ্ন করে বিব্রত করল।
তারপরও ও আমার কাছে চলে এল। সাত সকালে দু’জনে সিএনজি নিয়ে ঘুরলাম সংসদ ভবন এলাকায়। ওর কপালে ও ঠোঁটে মৃদু চুম্বন শেষে ওকে ওর অফিসের কাছে নামিয়ে দিলাম। নিজে ফিরে চললাম ঘরে।
ঘরে প্রবেশ মাত্রই স্ত্রীর কটুক্তি কানে এল। খাবার চাইতেই সে খুব নোংরা ভাষায় বলল – সারারাত যার কাছে মারিয়ে আসলে সে খেতে দেয় নাই।
হেসে এড়িয়ে গেলাম। না খেয়েই বের হয়ে গেলাম বন্ধুদের আড্ডায়। ফিরলাম রাতে। ঘরে ফিরতেই ভয়ঙ্কর এক দুর্ঘটনা জীবনের দর্শন পাল্টে দিল। স্ত্রী-মা-ছোটভাই তিনজন একসাথে জন্মদিল এই ঘটনার। তারা সবাই আমার স্ত্রীর প নিয়ে আমার সাথে দূর্ব্যবহার করল। পরদিনই আমি ঘর ছেড়ে চলে এলাম এক বন্ধুর বাসায়। আর আমার স্ত্রী সে চলে গেল তার বোনের বাসায়। আর আমি পুরো ঘটনাটির জন্য স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানালাম এই ভেবে যে, নিশ্চয়ই এর পিছনে তার মহৎ কোন উদ্দেশ্য রয়েছে।
আট
শবেবরাতের রাতের পরদিন সকালে ওর সাথে দেখা করে অফিসে এসেই শুনি আমার মা ফোন করে ইতোমধ্যে দু’বার জানতে চেয়েছেন আমি পৌঁছেছি কিনা? আমি অফিসে পৌঁছতেই আবার মায়ের ফোন এল। তাঁর কণ্ঠ শুনেই বুঝলাম তিনি খুব চিন্তিত ছিলেন। আসলে আমার অফিস টাইম ন’টায়। আমি সাধারণত ঘর থেকে বের হই পৌনে ন’টায়। বাসার কাছেই অফিস হওয়ায় গত ৫ বছরে কোনদিন এর অন্যথা হয়নি। তার উপর এটি আমারই বাবার প্রতিষ্ঠান। স্বাভাবিকভাবেই আমার কোন আর্জেন্ট কাজ থাকলে তা বাবার জানার কথা। সেখানে একঘন্টা আগে ঘর থেকে বের হওয়া ও পৌনে একঘন্টার মধ্যে অফিসে না পৌঁছাটা সন্দেহজনকই বটে। যাই হোক একটা রোগী দেখতে গিয়েছিলাম বলে কাটিয়ে দিলেও অফিস শেষে ঘরে ফিরে অনেক জেরার মুখে পড়তে হল।
এদিকে ছেলেকে নিয়ে হয়েছে আরেক জ্বালা। সাধন যে ওকে কি জাদু করেছে। ও এখন রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে আর সাধনের মত কাউকে দেখলেই বাব্বা, বাব্বা বলে চিৎকার শুরু করে। ওর বাবার পিঠে চড়ে ঘোড়া দৌড়াতে চায়। আমি বুঝলেও বিষয়টা ওর বাবাতো বুঝে না। ছেলেকে শান্ত করতেই ওকে নিয়ে বিকেলটা ঘুরে কাটালাম। সন্ধ্যায় চেম্বারে গেলাম। হঠাৎ করেই আমার কি যেন হল। প্রচণ্ডভাবে সাধনকে দেখতে, ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল। দুপুরে কথা বলেছি, বিকালেও অল্প কথা হয়েছে। ও ঘরে থাকবে তাই ওকে ফোন করা ঠিক হবে না। অথচ ওকে ফোন করার জন্য খুব অস্থির লাগছে। আমি জানি সাধন আমার কপালে, ললাটে যতই চুমু খাক না কেন, এখন পর্যন্ত ওর মনে আমি কোন দাগ কাটতে পারিনি। আমার চোখের পানি, আমার মরে যাবার চেষ্টা, এ সবের কারণে ও কিছুটা দূর্বল হয়েছে মাত্র। তবে শবেবরাতের রাতে নামাজ শেষে সকালে প্রথমেই আমার মুখ দেখতে চাওয়ায় আমি এতোটা আনন্দ পেয়েছি যে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। রাতে আমিও প্রার্থনায় বসেছিলাম। ওর মত সারারাত জাগতে পারিনি, তবে যতণ প্রার্থনায় ছিলাম, আমার চোখের সামনে ওর মুখটাই ভেসেছিল বার বার। তারপরও ওর মাঝে যে আমি এখনো পুরোপুরি স্থান করে নিতে পারিনি এ কথাটা আমি যে জানি বা বুঝি তা হয়তো সাধন জানে না বা বোঝেনা।
ক্রমশ যত রাত হচ্ছিল, আমার ভিতরের অস্থিরতা ততই বাড়ছিল। অজানা এক শঙ্কায় বুকের ভিতরটা কাঁপছিল। বার বার মনে হচ্ছিল সাধনের কোন বিপদ হচ্ছে। আমি আর সইতে না পেরে ওকে ফোন দিলাম। দেখি ফোন বন্ধ। পরপর তিনটা এসএমএস পাঠিয়ে ঘুমাতে গেলাম। কিন্তু ঘুম এল না। ঘুমের ওষুধ আর খাব না। সাধনকে কথা দিয়েছি। সারারাত ছটফট করে কাটালাম। রাতে উঠে প্রার্থনায় বসলাম। কোরান শরীফ পড়লাম, আর বারবার প্রার্থনা করলাম – আল্লাহ ওকে ভাল রেখ।
সকাল আটটায় ওর ফোন খুলেছে। আমার এসএমএস ডেলিভার হতেই ওর ফোন এল। বসে যাওয়া কণ্ঠে ও আমাকে শান্তনা দিতে চাইলো কিছু হয়নি, ও ভাল আছে বলে। কিন্তু ওর কণ্ঠই আমাকে বলে দিল ও ভাল নেই। জানতে চাইলাম – কি হয়েছে, সত্যি করে বল। আমাকে নিয়ে কোন সমস্যা হয়নিতো?
উত্তরে ও যা জানাল শুনে আমি স্তব্দ হয়ে গেলাম। ওর সিদ্ধান্ত শুনে স্বস্তিও পেলাম। বললাম ঐ ঘরে তুমি সেদিন যাবে, যেদিন ছোটভাইটা এসে তোমার কাছে মা চাইবে। আর তোমার স্ত্রী’ সে হয়ত তার ভুল বুঝতে পারবে। তাকে মা করে দিও। কথাটা উদারতার সাথে বললেও মনের মধ্যে একটা খুশীর ভাব মনে হয় লুকাতে পারিনি। সাধন কিছুটা বোকাটে ধরণের তাই ও তা টের পেল না।
এই বোকাটে, সরল সোজা ছেলেটাকে নিয়ে যে মেয়েটা শান্তিতে ঘর করতে পারলো না, তার কপালে অনেক দুঃখ আছে। কথাটা মাথায় আসতেই আমার মধ্যে একটা পাপবোধ জেগে উঠল। আমি কি করছি? আমি কি তাহলে ওকে বিয়ে করবো? সাথে সাথে ওর সামাজিক অবস্থান, ওর আয় রোজগার এবং আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থানগুলোর বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাবনা চলে এল মাথায়। আমি মানলেও আমার বাবা-মা ওকে কখনো মানবে না। সবচেয়ে বড় কথা আমি সাধনকে যতই ভালবাসি না কেন, আমি কখনোই আমার ছেলেকে ফেলে ওর কাছে যেতে পারবো না। এককথায় ছেলেটার ভবিষ্যত চিন্তা করেই আমি আমার ভালবাসার মানুষটাকে ধরে রাখতে পারবো না। কথাটা আমি স্পষ্টই বুঝে গেলাম। তাহলে কেন আর সাধনকে ধরে রাখা। চিন্তা করলাম, এ মূহূর্তে ওর মানসিক সাপোর্ট দরকার। ওকে আমি সেই সাপোর্টটা দিয়ে যাব। পরে ওকে বুঝিয়ে বলবো সব। ও যদি আমার বন্ধু হয়ে থাকে থাকবে, তানা হলে – এই আর কি! ওকে বিদায় দিতেই হবে।
আমার এইসব ভাবনার মাঝেই দিন পেরোচ্ছে। ও একবাসায় সাবলেট হিসেবে একটি রুম ভাড়া নিয়ে একা থাকছে। সে বাসার মহিলাকে আবার আমার সাথে ফোনে ফোনেই পরিচয় করিয়ে দিল। মহিলা আমাকে ওর স্ত্রী হিসেবেই চিনল। ভাবী সম্বোধন করল। ও অবশ্য বাসাটি ভাড়া নেওয়ার আগেই বলেছিল যে, বেচলর হলে কেউ বাসা ভাড়া দিবে না। তাই আমি বিবাহিতই বলবো। তবে বউ হিসেবে তোমাকেই কথা বলতে হবে।
ও ঐ বাসায় ওঠার দু’দিন পরে বাবুকে নিয়ে ওর সাথে ঘুরতে বের হলাম। লেকের পাড়ে ও আর বাবু অনেক সময় খেলা করল। বাবু ওর গুটি গুটি পায়ে পানির দিকে ছুটে যায়, আর ও বাবুকে ধরে নিয়ে আসে। দু’জনে পানিতে ঢিল ছুড়ে খেলা করে। ও একটু সরে গেলে বাবু ‘বাব্বা’ বলে ওকে জড়িয়ে ধরে। এ দেখে আমার ভিতরটা খুশিতে ভরে ওঠে। এমন সময় আকাশে মেঘ দেখা দেয়, হঠাৎ ও এসে বলে – সূর্য আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধর।
আমি বলি- কেন, হঠাৎ কি হল?
ও আকাশে মেঘ দেখাল। ততণে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। আমি ওর কথার গুরুত্ব না দিয়ে ওর হাত ছেড়ে বাবুকে কোলে তুলে নিলাম। এখন আমাদের যেতে হবে। বাসায় সবাই চিন্তা করবে। আমি বাবুকে নিয়ে রিক্সায় চেপে বসলাম। পিছনে ও আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে অদ্ভুত এক বেদনার চোখে। বাসায় পৌঁছতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হল। আমি ফোনে ওর অবস্থান জানতে চাইলাম। ও তখন বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করেছে। বলল – জান এই বৃষ্টি মানেই তোমার ছোঁয়া।
আমি ওকে ভিজতে বারণ করলাম। বললাম – তোমার এমনিতেই ঠাণ্ডার সমস্যা আছে। দেখ জ্বর হবে কিন্তু।
ও বলল – ভালোই হবে। তাহলে অন্তত ডাক্তার দেখাতে হবে, মানে তোমার সেবা পাওয়া যাবে।
আমি বললাম – তুমি মরে গেলেও সে সুযোগ আমার হবে না।
ও হেসে বলল – মরে গেলে দরকারও হবে না। বলেই লাইন কেটে দিল।
তারপরই ফোন বন্ধ। অসংখ্যবার ফোন করলাম ওকে। না সারারাত আর ফোন খুলল না। কি এমন অন্যায় করলাম বুঝতে পারলাম না। ওর ফোন বন্ধ পেয়ে আমি প্রায় পাগল হয়ে উঠলাম। সারারাত বৃষ্টি হল। সারারাত আমি কাঁদলাম আর আল্লাহর কাছে ওর ফোন খোলার জন্য মিনতি জানালাম। কেউ আমার মিনতি শুনল না, না আল্লাহ, না ও।
সকালবেলাও বৃষ্টি থামেনি। আকাশের মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে আমার মনের মেঘ বাড়ছে। ইচ্ছে করেই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে অফিসে যাচ্ছি আর স্মরণ করার চেষ্টা করছি – ওর বাসাটা কোন এলাকায় বলেছে, কত নম্বর যেন বলেছে? তারপর এই বৃষ্টির ভিতরই অনেকটা আধাআধি ঠিকানা দিয়ে পরিচিত এক লোককে পাঠালাম। প্রায় ঘন্টা দুয়েক খোঁজাখুজি করে ভদ্রলোক ওর বাসা পেলেন। তার ফোন দিয়েই আমি ওর সাথে কথা বললাম। আবার মরে যাওয়ার হুমকি দিতেই ও ছুটে এল আমার অফিসে। অফিস শেষে দু’জন গিয়ে বসলাম একটা কফি হাউসে। জানতে চাইলাম – আমার কি দোষ হয়েছিল যে তুমি আমাকে এত বড় শাস্তি দিলে।
উত্তরে ও বলল – তোমাকে না শাস্তি দিয়েছি আমি আমাকে। কারণ আমি মরে গেলেও যদি তুমি আমার কাছে যেতে না পার তাহলে এই সম্পর্ক কেন রাখবো, বলতে পার সূর্যমুখী? কী লাভ এ সম্পর্কে?
ওর উত্তর শুনে আমি থমকে গেলাম। কান্নায় আমার কণ্ঠ জড়িয়ে এল। ওর শরীর ছুঁয়ে বললাম – কিছু না পারি তোমার জন্য মরতে পারবো। এই তোমাকে ছুঁয়ে বলছি, তোমার বুকে মাথা রেখেই মরবো আমি।
আমি জানিনা ও আমার কথা কতটুকু বিশ্বাস করেছে। তবে সেদিন আমার মুখে হাসি ফুটাতে অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসল ও। বাহিরে তখনও বৃষ্টি হচ্ছে। হঠাৎ আমার হাত ধরে বৃষ্টির মধ্যেই বাহিরে বের হয়ে এল। বলল – কাল তোমাকে এত করে বললাম, আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধর, শুনলে না। দেখেছো বিনিময়ে দু’জনেই কী কষ্টটাই না পেলাম। আসো এখন প্রকৃতিকে খুশি করি। কথাটি বলেই ও আকাশের দিকে তাকিয়ে আবৃত্তি শুরু করল –
অবশেষে অন্ধকারে আবার আলো জ্বলেছিল,
আর দিনান্তের অস্তগামী সূর্যটা
আবার ফিরে এসেছিল ধরার বুকে।
আমি তারই প্রতিায় ছিলাম অনাদিকাল।।
যুগান্তরের দিনলিপি লিখেছেন বিধি,
কষ্টের সমুদ্রে কাটতেই হবে সাঁতার,
আমি মানুষ!
সাধ্য কি তাঁর? বিধির বিধান ভাঙার।।
ভিজতে ভিজতেই রিক্সা নিলাম আমরা। রিক্সায় পর্দা দিয়ে এই প্রথম দু’জন দু’জনকে নিবিড় ভাবে স্পর্শ করলাম। ইচ্ছে মত আদর করলাম। ওর মুখে আমার জিহ্বা আবার আমার মুখে ওর জিহ্বার স্বাদ পেলাম। ও আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল – এবার হয়েছেতো বাপু। তোমার কান্না থামাও।
আমি হেসে ফেললাম। আর সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিও যেন হেসে উঠল। অবাক চোখে দেখলাম রোদ্রঝরা বৃষ্টির মাঝেই পশ্চিমাকাশে সূর্যটা অনেক হেলে গেছে। হাত ঘড়িতে দৃষ্টি দিয়ে চমকে উঠলাম। সাড়ে তিনটা বাজে। ওকে অনেকটা ধাক্কা দিয়ে রিক্সা থেকে নামিয়ে দিয়ে আমি ঐ রিক্সা নিয়েই দ্রুত বাসায় চললাম। ফোনে ওকে জানালাম – রাগ করনা লক্ষ্মীটি, আর কখনো এমন কাজ করনা। তুমি বললে আমি না করতে পারি না। অথচ আজ ঘরে আগুন জ্বলবে।
নয়
অনেকদিন পর অনেকটা ফুরফুরা মন নিয়ে ঘরে ফিরলাম। ‘সূর্যমুখী শুধু আমার’ এই বোধটা আজ খুব বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আমার একান্ত আদর পেয়ে ও অবশেষে কথা দিয়েছে আমরা একদিন বিয়ে করবোই। আল্লাহ নিজেই আমাদের সে সুযোগ তৈরি করে দেবেন। তিনিই সবদিক বজায় রেখে সূর্যকে পৃথীবীর আপন করে দেবেন। আজই ও আমাকে পৃথিবী নামে উপাধি দিয়েছে। ওর পৃথিবী আমি। একান্ত ওর। কিন্তু সন্ধ্যা পার হয়ে গেল ওর কোন ফোন আসেনি। এমনটাতো হয় না। গত তিন মাসে এমন ঘটেনি কখনো। দুশ্চিন্তায় ক্রমশ অস্থির হচ্ছিলাম। রাত আটটা বেজে গেল। কি করবো, আমি ফোন করতে পারছি না, পাছে ওর ঘরের লোকেরা ধরে এই ভয়ে। এমন সময় ওর ফোন এল। ঘরে থাকলে বাথরুমে গিয়ে ও আমায় ফোন করে। পানি ঝরার শব্দে বুঝতে পারলাম এখন ও ঘরে।
আমি কিছু বলার আগেই ও বলে উঠল – আমি আমার কাপড়-চোপড় নিয়ে তোমার কাছে চলে আসছি। তুমি শাহবাগে এসে দাঁড়াও।
আমি ওকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম – দূর পাগলী! আগে বল কি হয়েছে। মা বকেছে?
ওর উত্তর – শুধু বকেনি। নোংরা কথা বলতে শুরু করেছে। যাচ্ছে তাই বলে গালি দিচ্ছে। তোমাকেও দিচ্ছে। তবে জানে না তুমি টা কে?
আমি বললাম – এতেই এত ভয় পেয়েছ? সত্যতো একদিন সবাই জানবেই। লক্ষ্মী মেয়ে, মাথা ঠাণ্ডা রাখ। মা বকলে কিছু হয় না। অফিস থেকে যেখানে দশ মিনিটে ফিরে যাও, সেখানে ২ ঘন্টা দেরী করলে মায়ের মনে সন্দেহ তো হবেই। আমরা আর কখনো এটা করবো না। ৫ মিনিটের বেশি আমি আর তোমার সাথে দেখা করবো না।
এ কথাাটি আমি রেখেছিলাম। পরবর্তী একটা বছর কখনো পাঁচ মিনিটের বেশি ওকে আটকাইনি। ও যেতে চায়নি। আমি জোর করে ওকে পাঠিয়ে দিয়েছি। নিজে একা একা কষ্ট পেয়েছি। সবচেয়ে বেশি কষ্টের দিন ছিল শুক্রবারটা। এ দিন ওর স্বামী ঘরে থাকে। ওকে আর ছেলেকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। এ সময় আমার খুব কষ্ট হয়। আমার কষ্ট কমাতে ও আগেই এদিন ফোনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে রাখে। অথচ ঘন্টায় ঘন্টায় নিজেই ফোন দিয়ে আমার সাথে কথা বলে, আমাকে সঙ্গ দেয়। ও আমার জন্য কম ছাড় দেয় নি। অফিস থেকে পাওনা ছুটিগুলো বাতিল করে দিয়েছে। কারণ ছুটি নিলেই তো ঘরে আটকে থাকা অথবা স্বামীকে নিয়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যেতে হবে। আমার সাথে দেখা হবে না। আমি বুঝি ও আগে যা ভেবেই আমার সাথে সম্পর্ক করুক, এখন ও আমাকে ছাড়া বাঁচবে না। আর আমি? ওকে ছাড়া আমি যে আর কিছু চিন্তাই করতে পারি না। তাহলে উপায় কী হবে? আমাদের পরিণতি কী হবে হে আল্লাহ’ তুমি বলে দাও। আমি যে অবৈধ কোন সম্পর্ক ধরে রাখতে রাজী না।
এরমাঝে হঠাৎ একদিন আলাওলকে নিয়ে আমি খেলা করছি, এমন সময় ও হাসতে হাসতে বলল – এই তোমার বাসাটা আমাদের বাসার কাছে নিয়ে আসতো! আমি যেন মাঝে মধ্যে যেতে পারি।
আমি অবাক হয়ে ওকে দেখলাম। বললাম – মাঝে মধ্যে কেন বলছ? একবারে কেন নয়।
ও বলল – তা কি করে সম্ভব? বল? তুমি কি চাও আমার ছেলেটা বাবার স্নেহ বঞ্চিত হোক। তুমি যদি শুধু আমাকে চলে আসতে বল, তাহলে আমি যে কোন সময় আসতে রাজী।
আমি বললাম – বলতে পারি, কিন্তু বাবাকে ছাড়া তুমি থাকতে পারবে?
ও কোন উত্তর দিল না।
আমি বললাম, আবার আমাকে ভাবনায় ফেললে সূর্য।
ও মুখ খুলল – না না অত ভেব না। ‘ইউসুফ-জুলেখা’র সমস্যার সমাধান যখন আল্লাহ করেছেন, আমাদেরটাও আল্লাহ’কেই সমাধান করতে দাও। তিনি নিশ্চয়ই ভাল কিছু ঘটাবেন।
দুদিন পর আমি ওর এলাকায় বাসা খুঁজতে বের হয়েছি। একটা বাসা দেখি আর ওকে ফোনে বর্ণনা দেই। ও বর্ণনা শুনে বাতিল করে দেয়, কোনটা আবার দর করতে বলে। একটা বাসা বেশ পছন্দ হয়। আমি বলি এটা তুমি এসে দেখে যাও।
ও সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে পাগল হয়েছো? আমি কি করে এসে দেখবো। এটা আমার এলাকা। সবাই এখানে আমায় চেনে। আমি যাদের চিনি না তারাও আমাকে চেনে। কেন বুঝ না সোনা, তোমার সূর্যমুখী মোটামুটি পরিচিত একজন ডাক্তার।
আমি বললাম – তাহলে এখানে বাসা নিতে বলছো কেন? তুমি যদি নাই আসতে পার এখানে বাসা নিয়ে আমার কি লাভ?
ও রেগে উত্তর দেয় – দেখ তুমি এই অসম্ভব স্বপ্ন কখনো দেখ না। আমি কখনোই তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না, তোমার ঘরেও আসতে পারবো না। তাতে তুমি থাক আর না থাক।
ওর কথা শুনে আমার আপাদমস্তক জ্বলে ওঠে, আমি কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে পড়ি। খুব রেগে গিয়েছিলাম। ওকে খানকী, বেশ্যা ইত্যাদি যা-তা বলে গালাগাল করেছিলাম। তারপর প্রায় দু’ঘন্টা ফোন অফ করে রাখি। ফোন খুলে দেখি ও লিখেছে – নেভার ডিস্ট্রাব মি। তুমি কতটা নোংরা, আমি বুঝলাম।
কোথা থেকে জানিনা হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল। আমি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কাঁদছি আর আল্লাহ’র সাথে মুখ খিস্তি শুরু করেছি। আমি এতোটা আল্লাহ নির্ভর ছিলাম না। ও আমাকে ক্রমশ ধার্মিক বানিয়ে তুলেছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, রোজা রাখা- এ সব করতে বাধ্য করেছে। ওর ও আলাওলের অমঙ্গল হবার ভয়ে জীবনে প্রথম আমি ত্রিশটি রোজা রেখেছি। কখনো ওর সাথে ঝগড়া হলেই আমি ছুটে গিয়েছি মসজিদে। আল্লাহর কাছে গিয়ে কান্না করেছি। প্রকৃতি আমাকে সঙ্গ দিয়েছে। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, আমাদের এ সম্পর্কটা আল্লাহ-ই তৈরি করে দিয়েছেন। তিনিই এটার নিয়ন্ত্রক। মেঘ আর বৃষ্টি আমাদের পথপ্রদর্শক। ওরা আমাকে বলে দেয় আমার সূর্য কখন মন খারাপ করছে, কখন কাদঁছে, আবার কখন হাঁসছে। ভিজতে ভিজতেই আমি আমার ভাড়া করা ঘরে ফিরে এসে ফোন বন্ধ করে দিলাম। ইচ্ছে মত ফোনটাকে আছাড় দিয়ে ভাঙার চেষ্টা করলাম আর হু হু করে মেয়ে মানুষের মত কাঁদলাম। জায়নামাজে বসে আল্লাহ’র কাছে বারবার আবেদন জানালাম –
হে স্রষ্টা, তুমি পথ ভ্রষ্টা আমাদের মা কর।
জ্বালো সত্য পিদীম জ্বালো,
জ্বালো মঙ্গল শিখা জ্বালো।
পরদিন সকালে পাশের বাসার ভাবীর ডাকে আমার ঘুম ভাঙলো। দরজা খুলতেই তিনি তার ফোনটা বাড়িয়ে ধরলেন – নেন ভাবী ফোন করেছে।
ফোনটা নিয়ে কানে ধরতেই ও পাশে সূর্যমুখীর কান্নার শব্দ শুনে বিচলিত হয়ে উঠলাম। মনে পড়ল সেবার যখন বাসায় লোক পাঠিয়েছিল তখনই ওকে এই ভাবীর ফোন নম্বর দিয়েছিলাম। ও প্রান্তে ওর তখন ফুফিয়ে কান্না চলছে আর বলছে – আর কি কি নোংরা গালি তুমি জান আজ সব আমাকে দাও আবার বল কী যেন বলেছিলে কাল। আমি খান…….।
ধমকে থামিয়ে দিলাম। অনেক করে বুঝালাম, রাগের মাথায় বলেছি ও সব। আমায় মা করে দাও প্লিজ। ও মা করে দিল কিনা জানি না। তবে সন্ধ্যায় আমাদের দেখা করার জায়গাটায় ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করে দিলাম। ওর কপালে চুমু খেতে আমার সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে। তাই বার বার কপালে চুমু খেলাম। আর বললাম – সূর্যমুখী কেন ভুলে যাও, তোমার দেহের প্রতিতো আমার কোন আকর্ষণ নেই। সে জাতীয় কোন আচরণ কি কখনো পেয়েছো বল? আমি তোমাকে চাই দেহ-মন-প্রাণ এ সব নিয়েই তুমি। তাই তোমাকে চাই। তুমি যদি চাও কোনদিন আমাদের মধ্যে সেক্স হবে না। তারপরও আমি তোমাকে চাই, আমার বউ হিসেবে চাই।
মুখে ওকে এ সব বলছি আর মনে মনে ভাবছি, আজই শেষ আর আমাদের দেখা হবে না সূর্য। এ নোংরা সম্পর্কটা আর টিকিয়ে রাখবো না। স্রষ্টা তোমাকে আর বাবাকে ভালো রাখবেন। আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও তোমাদের তিনি ভালো রাখবেন।
ওর থেকে বিদায় নিয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে একা একা অনেক ভালো মন্দ ভাবনা এল। সব ছাপিয়ে একটাই ভাবনা স্থান পেল মনে। আমি ওকে একটা এসএমএস পাঠালাম – সূর্যমুখী, আমি জানি তুমি প্রচণ্ড দোটানার মধ্যে আছ। একদিকে স্বামী-সন্তান, বাবা-মা, ভাই ও ভাবীরা। অন্যদিকে আমি। ওজনে আমার পাল্লা অনেক হাল্কা। আমার প্রতি তোমার ভালবাসাটাও তাই খুব হাল্কাই হবে। আমাদের সম্পর্ক বেশি দূর এগোবে না এটাও আমি ভালো জানি। তারপরও তোমাকে ভালবাসি, সত্যিই ভালোবাসি। আর ভালবাসি বলেই তোমাকে আমি কষ্ট দিতে পারি না। তিল তিল কষ্টের চেয়ে একেবারে কষ্ট পেয়ে মরা অনেক ভালো।
এসএমএসটা পাঠিয়ে নিজেই যেন চরম অশান্তিতে ডুবে গেলাম। পরদিন সকালে দূর পাল্লার বাসে চেপে বসলাম। আবার হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম দূরে বহুদূরে।
দশ
সকাল বেলা ফোন খুলে সাধনকে এসএমএস পাঠাতে গিয়ে দেখলাম ওর এসএমএস। মেসেজটি পরেই আৎকে উঠলাম। ফোন দিয়ে দেখি ওর ফোন বন্ধ। কান্নায় ভেঙে পড়লাম। সে সাথে একটা রাগ, একটা ঘৃণা এসে জায়গা নিল মনে। ঘৃণা নিজের প্রতি। যে বার বার আমার থেকে পালাতে চায় তার জন্য কেন এত কাঁদছি। তারপরও ‘তোমার সূর্য যে ডুবে যাচ্ছে’ বলে একটি এসএমএস পাঠিয়ে দিলাম। এসএমএসটি ডেলিভার হল না। আমিও ফোন বন্ধ করে রাখলাম। আমার দুটো ফোন, দুটোই বন্ধ করে দিলাম। সারাদিন আর ফোন খুললাম না। জানিনা কেন সেদিন সন্ধ্যায় কোন পূর্ব সংবাদ ছাড়াই তুমুল ঝড়বৃষ্টি শুরু হল। সাথে সাথে আমার মনের ভিতরও শুরু হল তুমুল ঝড়। এই ঝড়ই বলে দিল – আমার সাধন ভালো নেই।
পরদিন সকাল বেলা কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। আমার স্বামী নিজেই দরজা খুললেন। আমি উঁকি দিয়ে দেখি সাধন দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। আমার স্বামীর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করছে। এই সাত সকালে ওকে দেখে আমার মনটা খুশিতে উৎফুল্ল হলেও একটা আতঙ্ক নিয়ে কুশল বিনিময় করলাম। ও নিজেই ভিতরে এসে বসল। ওকে দেখেই আলাওল ছুটে এসে ওর কোলে চেপে বসল। ও আলাওলকে নিয়ে মগ্ন হল। আর আমার ভিতর তখন আতঙ্ক চলছে। মিনিট বিশেক ও ছিল। শুধু চা খেয়ে চলে গেল। এই মিনিট বিশেক আমি ছিলাম মহা আতঙ্কে। একদিকে ওর সাথে কথা বলার প্রবল আকাঙ্খা, অন্যদিকে আমার স্বামী যদি কিছু সন্দেহ করে, যদি ধরা পড়ে যাই! এই ভয়। বুঝলাম এ পাগল সব পারে। সব। ওর উপর রাগ করে আর যাই হোক ফোন বন্ধ রাখা যাবে না।
আমি অফিসে যাবার উদ্দেশ্যে বের হয়ে ওকে ফোন দিলাম। দুটো ফোন অফ রাখার জন্য ও আমায় ধমকালো। আমি ওকে বললাম – তুমি যে অফ রাখবে না কথা দিয়েও ফোন অফ রাখ তার কি হবে। আমি ওকে আমার দিব্যি দিলাম। বললাম, এরপর আমাকে না বলে ফোন অফ রাখলে আমার মরা মুখ দেখবে।
সেদিনটা ভালোই গেল। দিনের মধ্যে অন্তত চল্লিশবার ওকে ফোন করেছি। দিন দুই পরের কথা। চেম্বার থেকে রাতে ঘরে ফিরে দেখলাম আমার ছেলেটার চোখ ওঠা রোগ হয়েছে। ওকে ফোন করে সে কথা বলতেই ও বলল, ভয় পেও না। কাল আমার কাছে নিয়ে এস ভালো হয়ে যাবে। সকাল বেলা আমার নিজেরই চোখ ওঠা রোগ হল। দুপুর যেতে না যেতে সেটা বেড়ে গেল। ওই অবস্থায় আমি কফি হাউসে ওর কাছে এলাম। ওর সাথে দেখা করে তবে ঘরে গেলাম। যদিও ও আমাকে ৫ মিনিটের বেশি থাকতে দেয়নি। বাসায় গিয়ে দেখি বাবুর চোখ আরও ফুলে উঠেছে। বাথরুমে গোসল করতে গিয়ে ফোনে ওকে জানালাম – তোমার ছেলের চোখ আরও ফুলেছে।
ও বলল – বিকালে যেভাবে হোক ওকে নিয়ে পার্কে আস। আমি দেখব আমার ছেলের চোখে এ রোগ কি করে থাকে।
ও একটা দাবী করলে সেটা না মানা আমার প্রায় অসাধ্য হয়ে উঠেছে। তাই বিকালে ২০ মিনিটের জন্য বাবুকে নিয়ে বের হলাম। পার্কের গেটে ও দাঁড়িয়েছিল। রিক্সা থেকে বাবুকে ও নিজেই কোলে তুলে নিল। আমি দেখলাম কি নিঃসঙ্কোচে ও আমার ছেলের দু’চোখে চুমু খেল। তারপর বাবুকে নিয়ে খেলা করতে ব্যস্ত হল। যে বাবু গত দু’দিন একটু হাসেনি। গায়ে জ্বর, শরীরে ব্যাথা নিয়ে সেই বাবু ওর গলা জড়িয়ে ধরে হাসছে। বাবুর সাথে খেলার ছলে হঠাৎ ঝুকে আমার চোখেও চুমু খেয়ে নিল দুষ্টটা।
পরদিন সকালে অবাক বিস্ময়ে দেখলাম আমার বাবুর চোখ সম্পূর্ণ ভালো হয়ে গেছে। তবে আমারটা বেড়েছে। নতুন করে শুরু হয়েছে বাবুর বাপের। আমার মধ্যে একটা ভয় ছিল – চোখ ওঠা রোগী নিয়ে সাধন যেভাবে খেলা করেছে, চোখে চুমু খেয়েছে, তাতে ওর ও না এ রোগ হয়ে যায়। কিন্তু অদ্ভুত হলেও সত্যি যে ওর কিছুই হয়নি। একবার শুধু ফোন করে বলেছিল আমার চোখ ব্যাথা করছিল, একটু জাম্বুরার খোসা থেকে রস ছিটিয়ে দিয়েছি। ব্যস ব্যাথা ছেড়ে গেছে।
এগার
সূর্যমুখীর ঘরে সাধনের যাতায়াত সুত্র ছিল সাংবাদিকতার প্রয়োজনে। সূর্যমুখীর বাবার যে গবেষণার কাজ সাধন করছিল, সেখানে তাদের ঘরের সকলের বক্তব্যও প্রয়োজন ছিল। এই সাাৎকার নিতে এসেই সূর্যমুখী, তার সন্তান ও তার স্বামীর সঙ্গে সাধনের প্রথম পরিচয় হয়েছিল। এটা তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হবারও পাঁচ মাস আগের কথা। বছর দেড়েক পর সূর্যমুখী ও সাধনের মধ্যে যখন নিবিড় ভালবাসার দেয়া নেয়া চলছে ঠিক তখন সাংবাদিক সাধন তালুকদারের মনে প্রচণ্ড পাপবোধ দানা বেঁধে ওঠে। সে ভেবে দেখে সূর্যমুখী আসলে কৌশলে সাধনকে তার সেই বন্ধু যুক্তিতেই বেঁধে রেখেছে। যে কারণে সাধন আর এ সম্পর্ক ধরে রাখতে আগ্রহী না। কষ্টে মরে যাবে, তবু সে আর সূর্যমুখীর সাথে সম্পর্ক রাখবে না স্থির করল। কিন্তু ছেলে আলাওলকে যে সে ইতিমধ্যেই নিজের ছেলে ভাবতে শুরু করেছে। তাছাড়া সূর্যমুখী নিজেও ছেলে সম্পর্কে ওকে কোন কথা বললে সেটা ‘তোমার ছেলে ওমুক করেছে। তোমার ছেলে আজ তমুক করেছে’। এভাবে পরিচয় দিয়েছে। কখনো ফোনটা ছেলের হাতে দিয়েছে সাধনের সাথে কথা বলতে। আলাওল ঐ দু চারটে শব্দ উচ্চারণ করতে পারে। গাড়ি, বাব্বা, পাম ও মা।
এ মূহুর্তে চিরবিদায় নেয়ার ইচ্ছা হতেই প্রচণ্ডভাবে ছেলেকে একবার শেষ দেখতে ইচ্ছা হল ওর। সূর্যমুখীর কাছে ও শুনেছে ছেলে তার গত দুদিন ধরে কিছু খাচ্ছে না। রাতে সূর্যমুখীর এ সংক্রান্ত একটা এসএমএস ওকে খুব কাঁদিয়েছে। সূর্যমুখী লিখেছে – তুমি ভালো আছো তো? তোমার ছেলের যেন কি হয়েছে, সারারাত ঘুমায়নি কেঁদেছে আর কিছু খায় নি।
এসএমএসটা পড়েই খুব অস্থির হয়ে ওঠে সাধন। আলাওলকে বুকে জড়িয়ে আদর করার জন্য ফন্দি খুঁজে বের করে ও। সূর্যমুখীর মায়ের একটা সাাৎকার এখনো গোছানো হয়নি। এই বলে সে ফোনে সূর্যমুখীর বাবার কাছে অনুমতি চায় তাদের বাসায় যাবার। সঙ্গে সঙ্গে অনুমতিও পেয়ে যায় সে। ব্যস সূর্যমুখী যখন অফিসের কাজে ব্যস্ত এই ফাঁকে বাসায় তার মায়ের কাছে গিয়ে হাজির হয় সাধন। ওর গলার শব্দেই আলাওল ছুটে আসে। আলাওলকে ওর কোলে চড়তে দেখে ঘরের সবাইতো খুব অবাক। বেশ অনেকণ আলাওলকে বুকে জড়িয়ে বাড়ির চারপাশে পাগলের মত ঘুরে বেড়ায় সাধন। কাজের লোকেরা বা সূর্যমুখীর মা সবাই হয়ত ওকে তখন ছেলে ধরা বা পাগল এ সবই ভাবছে। কেউ একবার বুঝতে চেষ্টা করছে না ছোট্ট বাচ্চাটির কষ্ট।
সাধন বারবার তাদের অনুরোধ করে – একবার দরজার তালাটা খুলে দিন, আমি ওকে নিয়ে একটু রাস্তায় হেঁটে আসি, দেখবেন এরপর ওকে আপনারা যা খেতে দেবেন ও তাই খাবে।
কেউ ওর কথায় কান দেয় না। শুধু নিষ্পাপ আলাওল ওর গলা জড়িয়ে থাকে। আলাওলের গালে, ঠোঁটে, গলায়, হাতে একের পর এক পাগলের মত চুমু খেয়ে চোখ বন্ধ করে ধ্যানী পুরুষের মতই আল্লাহ’র কাছে প্রার্থনা জানায় সাধন – ‘হে আল্লাহ, ওর আর আমার নামের অর্থ কাকতালিয় ভাবেই তুমি এক বানিয়ে দিয়েছো, আজ তাই আমার এ প্রার্থনা তুমি কবুল কর। ওর সব রোগ-ব্যাধি তুমি আমায় দান কর। প্রয়োজনে আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও ওকে সারাজীবন সুস্থ রেখ প্রভু’।
এ প্রার্থনা জানিয়ে আর দেরী করে না সাধন। কাজের লোকের কোলে আলাওলকে তুলে দিয়ে ঐ বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় দ্রুত। পিছনে আলাওলের চিৎকারের সাথে তাল মিলিয়ে ওর চোখের জল ঝরতে থাকে। যা কারোই চোখে পড়ে না।
ঘরে ফিরে সূর্যমুখী শোনে এক পাগলের গল্প। কাজের লোকেরা ওকে বলে সাংবাদিকটার নিশ্চয়ই কোন বদ মতলব ছিল। আর একজন বলে, ও ব্যাটা নেশা করে। দেখেন না কেমন হাত-পা কাঁপে। ধমকে ওদের থামায় সূর্যমুখী। কড়া কিছু বলতে পারে না, পাশে ওদের সম্পর্ক কেউ টের পেয়ে যায় এ ভয়ে। ফোন করে সাধনকে বলে – তুমি আর কোনদিন এ বাড়িতে এস না। এরা সবাই তোমাকে খুব অপমানকর কথা বলেছে।
পাগলের মতই হ্যাঃ হ্যাঃ করে হাসে সাধন। ওর হাসিতে আরও ভড়কে যায় সরল মনের মেয়েটি। নিজের জালে যে সে নিজেই ফেঁসে গেছে। বুঝতে পারে না কি করবে। সাধনের সাথে পরিচয়ের পর ঠিকমত একটা দিন পড়তে পারে না। শ্রেণীকে সবসময় প্রথম স্থান অধিকার করা মেয়েটি এখন কেমন গুবেট বনে গেছে। ডিসিএইচ কোর্সটা করা হল না। এমআরসিপি পরীাটাও কি আর দেয়া হবে না? কি করবে ও? সাধন অবশ্য প্রথম থেকেই ওকে পড়ার ব্যাপারে খুব উৎসাহিত করছে। বিভিন্ন শর্ত দিয়ে ওকে পড়তে বসতে বাধ্য করছে। কিন্তু পড়া যে হয় না। পড়তে বসলেই সাধনের মুখটা ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। আপন মনে নিজের সাথে কথা বলে সে। সাধনের সাথে স্বামীর সাথে সে কি তাহলে প্রতারণা করছে না? দু’ নৌকায় পা দিয়ে কতণ চলতে পারবে? কি করবে সে? আল্লাহ’র কাছে প্রার্থনা করেও কোন ফল হয় না। হঠাৎ ওর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। হ্যাঃ এটাই উত্তম পথ। সাধনকে ওর আগের জীবনে, মানে ওর ঘরে ফিরিয়ে দিতে হবে। ওর স্ত্রীর কাছে ওকে ফেরত পাঠাতে পারলে একটু হলেও শান্তি পাবে ও। হায়রে মেয়ে, সাধন কোন জাতের তা যদি বুঝতে তাহলে এ চিন্তা ভুলেও করতে না।
বার
আজ আমার জন্মদিন। ভোরবেলা ফোন খুলতেই দেখি সাধনের এসএমএস। জম্মদিনের অভিনন্দন জানিয়ে কবিতা পাঠিয়েছে।
আজকে তোমার জন্মদিন
আমি ছিলাম নিদ্রাহীন, জাগনা সারারাত।
আজকে আমি আঁকবো ছবি
নদীর ঘোলা জলে দেখা লুকিয়ে থাকা চাঁদ।
সন্ধ্যায় আমার সামনে হাজির হল মিষ্টি আর বেশকিছু খুচরো টাকার ভান্ডিল নিয়ে। জানতে চাইলাম এটা কি। বলল – গত একবছর ধরে খুচরো নতুন যে টাকা জমিয়েছি তা তোমার জন্য নিয়ে এলাম।
খুলে দেখি সত্যি কড়কড়ে তাজা সব দু টাকা ও পাঁচ টাকার নোট। সঙ্গে আমার একটা ছবিও বাঁধাই করে এনেছে। খুব আনন্দ পেলেও ওকে ধমকালাম। টাকাগুলো নিয়ে যেতে বললাম। মনে মনে লজ্জাও পেলাম এই ভেবে যে, আমার জন্য বেচারার ঘড়িটা চুরি গেল, হাতে ঘড়ি নেই। আমি ওকে ঘড়িটা কিনে দিতে পারছি না, আর ও কতগুলো টাকা খরচ করে আমার মন জয় করতে এসেছে। এইতো ভালবাসা। সত্যিকারের ভালবাসার স্বাদই ভিন্ন।
বড় ঈদের উৎসব সামনে। মনে মনে ভাবলাম, ঈদের আগেই ওকে ঘড়িটা কিনে দেব। তাছাড়া ঈদের দিন পরার জন্য কিছু পোষাকও উপহার দেব ওকে। এ ভাবনা নিয়েই পরদিন ওকে আসতে বললাম। কিন্তু কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় আর মার্কেটে যাওয়া হল না। কফি হাউসে ঘড়ি ধরা ৫ মিনিট মুখোমুখি বসে দু’জন দু’জনকে দেখি। আমাদের চোখ খেলা করে চোখের গভীরে। ওর চোখে তাকিয়ে থাকাতেই যেন আমার সব সুখ। ওকে আমি কি করে বোঝাবো যে এই চোখে তাকিয়ে আমার আর ঘরের কথা মনে থাকে না। কিন্তু ও ঠিকই ৫ মিনিটের বেশি আর বসতে দেয় না। যাবার পথে আমি অবশ্য কয়েকটা দোকান ঘুরে ওকে একটা ঘড়ি পছন্দ করতে বলি। কোন ঘড়িই ওর পছন্দ হয় না। অবশেষে জেন্ট ও লেডিস ঘড়ির যৌথ একটি সেট ওর পছন্দ হয়। বুঝতে পারি ঘড়ি নয় জোড়াটা ওর পছন্দ হয়েছে। ওর হাত থেকে আমরটা নিয়ে আমি রিক্সায় চেপে বসি। মিনিট দশেক পরেই ও ফোন করে জানায় – সূর্য! এতদিন তুমি ঘড়ি কিনতে পারনি কেন জান? আমি বলি – না কেন?
ও উত্তর দেয় – এই জোড়া ঘড়িটা কিনবো বলে। আর এ জোড়াটা কেন পাওয়া গেল বলতে পার?
আমি জানতে চাই – কেন?
ও বলে – কারণ, এই ঘড়ি আজ থেকে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে। যতদিন আমাদের ভালবাসা গভীর থাকবে, ততদিন এই ঘড়ি কখনো বন্ধ হবে না।
আমি বলি – যাও, তা কি হয়? এটা ইলেকট্রনিক্স জিনিস। ব্যাটারী শেষ হলেই বন্ধ হবে।
ও বলল – ব্যাটারী বদলে নেয়ার পরও যখন ঘড়ি চলবে না, তখন বুঝতে হবে আমাদের ভালবাসায় কোথাও সমস্যা হচ্ছে।
ওর এ কথা শুনে আমি আর উত্তর খুঁজে পাই না। কারণ আমার মনের ভিতর ওকে নিয়ে অনেক ভয়। আমাদের মধ্যে যতটা না মিল তার চেয়ে বেশী ভুল বোঝাবুঝি কাজ করে। ও ওর মনে আসা একান্ত গোপন কথাটিও আমাকে বলে দেয় বলেই আমি জানি, আমাকে নিয়ে ওর মধ্যে অনেক ভয়। তবে সেটা আমাকে হারাবার ভয় না। আমার আচরণে, কথাবার্তায় নাকি স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে, এটাই ওর একমাত্র ভয়। ওর ধারণা – আমি যখন বুঝতে পারবো সাধন নামের ছেলেটি আমাকে প্রচণ্ড ভালবাসে। আমাকে ছেড়ে সে আর কোথাও যেতে পারবে না। ঠিক তখনই নাকি আমি ওকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়বো। তখনই আমি আমার বন্ধুত্ব দাবীটাকে ফুটিয়ে তুলতে চাইবো।
যদিও ওর ধারণা পরবর্তীতে মিথ্যে হয় নি। আসলেই আমি তাই চেয়েছিলাম। আমি ওর সাথে সারা জীবনের বন্ধুত্বই চেয়েছিলাম। তবে কখনো ওকে অখুশি করে নয়।
আমি মাঝে মধ্যেই ওর কাছে ওর ঘরের খবর জানতে চাইতাম। ও কখনো কিছু লুকোয় না। সরাসরি সবই বলে দেয়। আমার খুব কষ্ট লাগে যখন শুনি ঘর থেকে কেউ একবার ওর খোঁজ নেয় না। কিন্তু সেদিন হঠাৎ ও ফোন করে জানাল যে, ওর ছোটভাই গিয়ে নাকি ওর স্ত্রীকে বাসায় নিয়ে এসেছে। ওর কোন এক খালা ওকে ফোন করে ঘটনাটা জানিয়েছে। শুনেই আমার মধ্যে একটা পরিবর্তন টের পেলাম। আমি ভাবলাম এই সুযোগ ওকে ঘরে পাঠাবার। বললাম, তারা যেহেতু তোমার স্ত্রীকে ঘরে ফিরিয়ে এনেছে, তারমানে তারা তাকে খুব পছন্দ করে। অর্থাৎ তাদের চোখে তুমিই অপরাধী। সে যাইহোক ঈদের দিন কেউ ডাকুক আর না ডাকুক তুমি মায়ের সাথে দেখা করতে যাবে।
আমার ভাবনায় তখন অন্য চিন্তা চলছে। আমি কৌশলে ওর কাছ থেকে ওর স্ত্রী কোথায় চাকুরি করে তা জেনে নিয়েছি। পরদিনই ফোন গাইড থেকে ওই অফিসের নম্বর খুঁজে পেতে দেরী হল না। আমার পরিচয় না দিয়ে আমি ওর স্ত্রীর সাথে কথা বললাম। আমি ওর অবস্থা সব বললাম, সে সাথে একটু মন্দও বললাম, এতদিন স্বামীর খোঁজ না নেওয়ার জন্য। সব মিলিয়ে বুঝালাম ও অনেক কষ্টে আছে এবং এখনো তাকেই খুব ভালোবাসে। আমি যে তাকে ফোন করে এ সব বলেছি তা যেন সে সাধনকে না বলে বা বুঝতে না দেয়। সে অবশ্য আমার পরিচয় জানার খুব চেষ্টা করেছিল।
রাতেই সাধন ফোন করে জানাল যে, ওর স্ত্রী আজ ওকে ফোন করেছে এবং ও ওর স্ত্রীকে সব সত্য কথা বলে দিয়েছে। আমি জানতে চাইলাম কি সত্য কথা বলে দিয়েছো?
ও প্রচণ্ড একটা আত্মতৃপ্তি নিয়ে বলল – তোমার সাথে আমার সম্পর্কের কথা।
ওর কথা শুনেই রাগে, ঘৃণায় আমার শরীর জ্বলে উঠল। আমি জানতে চাইলাম – কি বলেছো? কেন বলেছো?
উত্তরে ও বলল – সে ফোন করে আগের মতই সন্দেহের সুরে কথা বলছিল। বলছিল যে, অসংখ্য মেয়ে বান্ধবীদের মাঝে আমি সুখে আছি, তাই সে আমাকে কোন ফোন করে ডিস্টার্ব করতে চায়নি। তাই তার সন্দেহ দূর করতেই আমি তাকে বললাম যে, আগে তুমি মিথ্যে সন্দেহ করে আমাকে ছেড়ে গেছ। এখন আর তোমার সন্দেহ মিথ্যে নয়। এই এক বছরে আমি সত্যি নতুন করে একজনের প্রেমে পড়েছি এবং আমি এখন তাকে প্রচণ্ড ভালবাসি। এই বলে আমি তোমার পরিচয় তাকে দিয়ে দিয়েছি। তবে নাম বলিনি।
এমন বোকার হর্দ আমি জীবনে দেখিনি। ওকে খুব গালাগাল করলাম। ও রেগে ফোন কেটে দিল। আর আমি বোকার মত কাদঁতে শুরু করলাম। রাতের আকাশে তারার খেলা ছিল মিনিট পাচেঁক আগেও। হঠাৎ সেখানে কালো মেঘ দেখে ভড়কে গেলাম। মিনিট দশেকের মধ্যেই ঝড় শুরু হল। আমার মনের ভিতরও ঝড় চলছে। বুঝতে পারলাম, ওকে রাগিয়ে ভাল করিনি। প্রকৃতিও হয়ত বিষয়টা পছন্দ করেনি।
পরদিন সকালে আমিই আবার ফোন করলাম। ওর ফোন বন্ধ দেখে পাশের ভাবীকে ফোন করে ওকে চাইলাম। ওর কণ্ঠ শুনে কিছুটা ধাতস্থ হলাম। ও ফোন খুললে আবার ওকে ফোন করলাম। বুঝালাম যে তুমি কথা ঘুরিয়ে নেবে, বলবে তুমি আসলে তোমার স্ত্রীকে খেপাতে এ সব কথা বলেছো, তোমার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
ও বোকার মত হাসল আর বলল ঠিক আছে। আজ সন্ধ্যায় আমাদের দেখা হবে। তুমি গাছটার কাছে থেক। তারপর তুমি আমাকে সব শিখিয়ে দিও। আমি তোমার কাছে শিখে ঘরে গিয়ে তাই অবিকল বলবো। আমরা পার্কে লেকের পাড়ের একটা গাছকে বেছে নিয়েছি আমাদের ভালবাসার সাী হিসেবে। ঠিক টিনেজ ছেলে-মেয়েরা যা করে। এই গাছটির গায়ে হেলান দিয়েই ও আমাকে প্রথম ওর বুকে জড়িয়ে নিয়েছিল। আমার আসতে দেরী দেখে ও ঐ ‘গাঁও গ্রামের মূর্খ ছেলে’ কবিতাটি পাঠিয়েছিল। আজও সন্ধ্যার একটু পরেই আমরা দু’জন গাছটার কাছে এসে দাঁড়ালাম। ও আমার কপালে, ঠোঁটে, ঘাড়ে পাগলের মত চুমু খেল। তারপর বলল, তুমি এতো ভালো কেন সূর্য? আমি তোমাকে ছাড়া কেমন করে বাঁচবো বলতে পার?
উত্তরে আমি বললাম – তোমাকে কোনদিনই আমাকে ছাড়া বাঁচতে হবে না। আমরা যেমন আছি চিরদিন এমনই থাকবো।
এ কথা শুনে ওর মুখ কালো হয়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে বললাম, না না বন্ধু থাকবো না, আমরা অবশ্যই বিয়ে করবো। সে সাথে আমি ওর থেকে কথা আদায় করে নিলাম যে ও ওর স্ত্রীর কাছে ফিরে যাবে। ওর স্ত্রী’র সাথে ভালো থাকার চেষ্টা করবে। আমার যে কষ্ট হবে তাও স্বীকার করলাম। ও হয়তো আরও কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু হঠাৎ একজন সিরিয়াস রোগীর ফোন আসায় আমি দ্রুত সেদিন ওর থেকে বিদায় নিয়ে রোগী দেখতে চলে গেলাম।
ঈদ পার হয়ে যাওয়ার চারদিন পর এক সকালে টানা বৃষ্টি চলছে। আকাশের মেঘ কাটছে না কিছুতেই। আর মেঘ দেখে আমার মধ্যে ভয় শুরু হয়েছে। আমি বৃষ্টিতে নিজেদের গাড়ি নিয়ে অফিসে গিয়েছি। খুব সম্ভব সাধন আমার আসার অপোয় ছিল। প্রবেশ পথেই আমাকে আটকাল, ঠিক প্রথম পরিচয়ের দিন যেভাবে ডেকেছিল সেই একই সুরে বলল – ‘এই যে, শুনুন’।
তের
সাধন সূর্যমুখীকে দেয়া প্রতিটি কথা অরে অরে পালন করেছিল। ঈদের দিন সকালেই সূর্যমুখীর শুভেচ্ছা ও আদর সাথে নিয়ে সে তাঁর মা ও স্ত্রী’র কাছে ফিরে গিয়েছিল। দু’দিন স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। তারপর ওর স্ত্রীকে বুঝিয়েছে যে, ওর মনে এখন আর কোথাও ওর স্ত্রীর জন্য এতটুকু ভালবাসা নেই। আছে শুধু পাঁচবছর একসাথে থাকার কারণে তৈরি হওয়া একধরণের মায়া এবং একটা দায়িত্ববোধ। সে তার স্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছে – এটা জেনেও কি সে ওর সাথে থাকতে পারবে? যদি পারে তাহলে সেও চেষ্টা করবে নতুন করে আবার সব সাজাতে। শুধু সে যেন কখনো সূর্যমুখীকে নিয়ে কোন কথা না বলেন।
ওর স্ত্রী জানকী বেগম নিজেও খুব ভাল ও সৎ একজন মেয়ে। সে বিশ্বাস করে যেখানে ভালবাসা থাকেনা সেখানে আর কিছুই থাকেনা। তাই সে স্পষ্ট বলে ওঠেথ – সেটা কখনো সম্ভব নয়। তোমার জন্য এতোদিন আমি সবখানে পিছিয়ে ছিলাম, আর পিছনে থাকতে চাইনা। এবার আমি সামনে এগোতে চাই। কথাটি বলে সে জানতে চায় মেয়েটি কে?
সাধন তখন তাকে সবই খুলে বলে। সাধন স্ত্রী’র সাথে শুনে সূর্যমুখী খুব খুশি হয়। রাতে ওকে বেশ পরামর্শ দেয়। পরামর্শ দিতে গিয়েই আবার মনমালিন্য দেখা দেয় ওদের মধ্যে। আবার শুরু হয় ঝড়-বৃষ্টি। আবার মরার হুমকী দিয়ে সূর্যমুখী সেই যে তাঁর ফোন বন্ধ করে, আর খোলেনা। ঈদের পরদিন দুপুর পর্যন্ত সাধন অপো করে সূর্যমুখীর ফোন খোলার জন্য। ওর অস্থিরতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। তারপর হঠাৎ করেই ইলশে গুড়ি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে স্ত্রীকে নিয়ে হাজির হয় সূর্যমুখীর ঘরে। প্রথম চমকে গেলেও সাধনের স্ত্রীকে খুব সম্মান দেখায় সূর্যমুখী। আলাওল ঘুমে থাকায় সাধন তাকে দেখতে পায় না। তবে সূর্যমুখীর স্বামীর সঙ্গে এই প্রথম খুব আন্তরিকতার সাথে কথা বলে সাধন। নিজের স্ত্রীকে পরিচয় করিয়ে দেয়। দুপুরের খাবার খায় তারা একসাথে।
রাতে সূর্যমুখী ফোন করে সাধনকে। জানতে চায় ও কেন এভাবে ওর স্ত্রীকে নিয়ে তাদের বাসায় এসেছে। এটা কেন করেছে? ওর স্ত্রী কি তাহলে সব জেনে শুনেই ওর বাসায় গিয়েছে।
সাধন উত্তর দেয় – হ্যাঃ। সে সব জানে। তুমিও তোমার স্বামীকে সব জানিয়ে দাও প্লিজ।
ও প্রান্তে কান্নায় ভেঙে পড়ে সূর্যমুখী। সাধন ফোন কেটে দেয়। রাগে ােভে সে আবার ফোন করে সাধনকে। সাধনের স্ত্রীর সাথে কথা বলতে চায়। নিঃসঙ্কোচে সাধন ফোনটা বাড়িয়ে ধরে ওর স্ত্রীর দিকে। প্রায় দেড়ঘন্টা ধরে সূর্যমুখী আর সাধনের স্ত্রী জানকী বেগম কথা বলেন। কি বলেন তা তারাই জানেন। পরদিন সূর্যমুখীর ফোন বন্ধ। সারাদিন সে আর ফোন খোলেনা দেখে সাধন কান্নায় ভেঙে পড়ে। সাধনের কান্না দেখে ওর স্ত্রী নিজেও কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি জানতে চান এখন সাধন কি করবে?
সাধন তাকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে – দেখ, আমি যাকে এখন ভালবাসি, সে কোনদিন আমার বউ হতে পারবে না, তার সাথে হয়ত আমার আর কোন সম্পর্কও থাকবে না কোনদিন, হয়ত আর দেখাও হবে না। কিন্তু মনের মধ্যে থেকে আমি তাকে তাড়াতে পারবো না। তার সাথে আমার কোন শারীরিক সম্পর্কও তৈরি হয়নি কখনো। কোনদিন হবেও না। তারপরও তাকে আমি ভালবাসি, ভীষণ ভালবাসি। তার জন্যে আমি কষ্ট পাব, আর আমার কাছে থাকলে আমার কষ্ট দেখে তুমিও কষ্ট পাবে, এটা ভাল হবে না। তার চেয়ে এই ভাল আছি আমরা। আমাদের মধ্যে যখন কোন বাঁধন নেই। তখন তুমি নতুন জীবন বেছে নাও। আমি চললাম আমার মতন।
সাধনের স্ত্রীর সাথে এই ছিল সাধনের শেষ কথা। আধুনিক মেয়ে জানকী বেগম বুঝতে পারেন, সে আগে আসলেই সাধনকে ভুল বুঝেছিল। এই প্রথম সে সাধনকে ভালোভাবে বুঝতে পারেন। বুঝতে পারেন, সাধন আগেও কখনোই তার সাথে মিথ্যে বলেনি। ইচ্ছে হয় চিৎকার করে বলেন যে – সাধন তুমি আমার কাছেই থাক। কোথাও যেওনা। আমি তোমার ব্যাথার ভাগীদার হয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। কিন্তু পরণে ভাবেন – সূর্যমুখী নামের ডাক্তার মেয়েটির কথা। ফোনে কথা বলতে গিয়ে সে ঐ মেয়েটির কাছ থেকে কথা আদায় করে নিয়েছে যে, সে আর কোনদিনই সাধনকে ফোন বা এসএমএস করবে না। মেয়েটি শপথ করে বলেছে, সে যেভাবে পারে সাধনকে তার পথ থেকে সরিয়ে দেবে। কেন জানি মনে হয়, সে কথা রাখবে। হে আল্লাহ এ আমি কি করলাম। ভুলবুঝে দুটো জীবনকেই হয়ত বিপথে ফেলে দিলাম। ঐ ডাক্তার মেয়েটির কষ্টের ভাগীদার এখন কে হবে? আল্লাহ! তুমি নিজে যা মেলাতে পার না পৃথিবীতে তা কেন ঘটতে দাও। নিরবে চোখের জল ফেলে জানকী বেগম চলে যায় তার বোনের বাড়িতে। বোন ছাড়া তার এ দুনিয়ায় আর কেউ নেই। আর সম্বল সাধনেরই দেয়া চাকুরিটা। এ চাকুরিতে সে এতোদিনে অনেক উন্নতি করতে পারতো। শুধু সাধনের জন্যই পারেনি। এবার নিশ্চিন্তে মন-প্রাণ উজার করে দেবে তার কর্মেেত্র, এটাই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে সে।
সাধন ফিরে যায় তার ভাড়া করা বাসায়। ইচ্ছে মত বিছানায় পড়ে কাঁদে। ওর কান্নার সাথে প্রকৃতি আজ আর পাল্লা দেয় না। শুধু কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়েই ঝকমকে রোদ ওকে ব্যঙ্গ করে। প্রকৃতির এ রূপ দেখে ওর কান্না আরও বেড়ে যায়। আপন মনে চিৎকার করে ওঠে – হে আল্লাহ! আমার মনে তো কোন পাপ ছিল না। আমিতো সূর্যমুখী বা জানকী কারো সাথেই কোন প্রতারণা করিনি, তবে আমি কেন এত শাস্তি পাব। সূর্যমুখীর সাথে আমার কোন অবৈধ সম্পর্ক হোক, এটা আমি চাইনি। এটা না চাওয়া কি আমার অপরাধ? তাহলে কেন এই ভালবাসা তৈরি হতে দিয়েছিলে তুমি। কেন পবিত্র শবেবরাতের সকালে ওকে আমার কাছে আসার সুযোগ দিলে তুমি? তাহলে কি ও আমাকে সত্যিকার ভাবে ভালবাসেনি? সাধনের আর্তনাদ আল্লাহ শোনেন কিনা বোঝা যায় না। তবে এ সময় মাগরিবের আজান পড়ায়, কান্না থামিয়ে উঠে প্রার্থনায় বসে ও। এই একটা জায়গায় ও সূর্যমুখীর কাছে আজীবন ঋণি থাকবে। সূর্যমুখী ওকে সারা জীবনের জন্য নামাজ ধরিয়ে দিয়েছেন। তাই নামাজে দাঁড়িয়েই প্রথমে সূর্যমুখী ও তাঁর সন্তানের সুস্থতার জন্য নফল আদায় করে ও।
পরদিন অনেকটা ঝরঝরা মনে অফিসে আসে। সূর্যমুখীর বাবার চাকুরিতে ইস্তফা দেয়। তারপর গিয়ে দাঁড়ায় সূর্যমুখীর সামনে। সূর্যমুখীর থেকে বিদায় নিয়ে সোজা ফিরে যায় ভাড়া বাসায়। আগেই সব গোছানো ছিল। সাবলেট বাসাটির ভাড়া পরিশোধ করে দেয়। প্রতিবেশী ভাবীটি অবশ্য জানতে চায় কি হয়েছে? অনেকদিন ভাবী ফোন করে না কেন? তার সাথে ভাল-মন্দ কোন কথাই বলে না সাধন। সামান্য হেসে তাদের থেকে বিদায় নিয়ে সামান্য মালামাল যা ছিল তা নিয়ে চেপে বসে দীণমুখী যাত্রীবাহী লঞ্চের ছাদে। পশ্চিমাকাশে সূর্যটা তখন ডুবু ডুবু। বুড়িগঙ্গার বুক চিড়ে লঞ্চটি ছুটে চলে, শীতের বাতাস শূল বিধায় ওর চোখে মুখে। কোন ভ্রুপে নেই ওর। চোখের কোনে জমাট পানি গাল বেয়ে নেমে যায়। হঠাৎ গলা ছেড়ে গান ধরে সাধন –
সূর্যমুখী, সূর্যমুখী শোন
এই সূর্য ডোবা ভোরে
ডাকছি তোমায় যখন
আমি তখন
যাচ্ছি হারিয়ে
আলোহীন ঘরে
ডাকছি শুধু তোমায়
বিশুদ্ধ চিৎকারে
ও সূর্য! আলো দাও আমারে।
ও সূর্য! বাচাঁও আমারে।।
বাঁচানোর মালিকতো আল্লাহ। সূর্যমুখী বা অন্যকারো সে মতা নেই। সে কথা কি সাধন ভুলে গেল? সাধনের শেষ কান্না আল্লাহ না শুনলেও ত্রিশ রোজা রাখতে গিয়ে প্রতিদিন সাধন যে প্রার্থনা জানিয়েছিল – ‘হে আল্লাহ, আমার বিশ্বাস সূর্যমুখী ও আমার সম্পর্কটা তুমিই তৈরি করেছো। তাই তোমার কাছে আবেদন, ওকে তুমি আমার সারা জীবনের সঙ্গী করে আমার স্বপ্নের কিনিকটি গড়তে দিও। আর তা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে ওর আমার মৃত্যুকে তুমি কবুল কর হে রাব্বুল আলামীন। ওকে ছাড়া আমি বাঁচতে চাইনা, আমি আর পাপী হতে চাইনা, কারো কষ্টের কারণ হতে চাইনা।’ আল্লাহ হয়ত ওর এই প্রার্থনা ঠিকই কবুল করে নিয়েছিলেন।
কারণ, এরপরের ঘটনাগুলো আর সাধনের ভাবনার সাথে মেলেনি। দণিাঞ্চলের সমুদ্রের পাড় ঘেঁষা জেরা শহরটিতে গিয়ে নিজের পরিচয় গোপন করে সাধন কাজ খুজে নেয় একটি বইয়ের দোকানে। কোন প্রকার ভার বহনের কাজ ওর জন্য নিষিদ্ধ। তা স্বত্বেও বইয়ের দোকানের ভারী কাজগুলো বেছে নেয় ও। সাইকেল চালিয়ে পাড়া গায়ের বিভিন্ন স্কুল ও লাইব্রেরীতে বই দিয়ে আসে। নিজেকে ব্যস্ত রেখে ভুলে থাকতে চায় সব কষ্ট। কিন্তু কষ্ট ভোলা কি এত সহজ? রাতে বিছানায় মাথা ঠেকাতেই সূর্যমুখী ও আলাওল চলে আসে ওর ভাবনায়। আলাওলকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখে গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে কেঁদে ওঠে সাধন। স্বপ্ন দেখে আলাওল ‘বাব্বা বাব্বা’ বলে ওকে লেকের পাড়ে ওকে খুজে বেড়াচ্ছে। সূর্যমুখীর কোল থেকে নেমে ছুটে যাচ্ছে লেকের দিকে। পিছন থেকে সূর্যমুখী ওকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। ঝপাৎ করে আলাওল পরে যায় পানিতে। চিৎকার করে ঘুম ভেঙ্গে যায় সাধনের। এভাবে দু সপ্তাহ পার হতেই সাধন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। আলাওলের জন্য অস্থির হয়ে এক মাঝরাতে ওর বন্ধ থাকা সেলফোনটি খুলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে তিনদিন আগে পাঠানো সূর্যমুখীর একটি এসএমএস এসে প্রবেশ করে। ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে এসএমএসটি পড়ে সাধন। সূর্যমুখী লিখেছে – সব সময় তুমিই জিতে যাও। আল্লাহর কসম, জীবনে একবার অন্তত আমাকে জিততে দাও। আমি কি সব সময় হেরেই যাব। ফোন বন্ধ করার আগে আমার সাথে একটু কথা বলতে। মেসেজটি পড়ে গুমরে কেঁদে ওঠে সাধন। মনে মনে বলে – একবার নয় সূর্য! আমি তোমাকে সারা জীবনের জন্য জিতিয়ে দেয়ার প্রার্থনা করেছি। আল্লাহ তোমাকে সব সময় জয়ী করবেন।
পরদিনই কর্মস্থান ত্যাগ করে ও। বাসে চড়ে সন্ধ্যা নামার আগেই আবার ফিরে আসে ঢাকায়। লেকের পাড়ে সেই গাছটির কাছে গিয়ে বসে পড়ে। মনে মনে ভাবে ভালবাসা সত্যি হলে সূর্যমুখী এখানে আসবে। ওর টানে, মনের টানে ওকে আসতেই হবে। একে একে ঘন্টা পেরিয়ে যায়। গাছের গোড়ায় স্থির বসে মনে মনে স্রষ্টাকে ডাকতে থাকে সাধন। বিশ্বাস আর ভালবাসা যখন এক হয়ে যায় তখন অনেক কিছুই টের পায় মন। এ সত্য উপো করার সাধ্য কার আছে। সূর্যমুখীও পারেনি এ সত্যকে এড়িয়ে যেতে। নিজের অজান্তেই রাত আটটার দিকে সে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। রাতে তাঁর এ বের হওয়া সকলের চোখেই অস্বাভাবিক মনে হয়। তারপরও গত ক’দিন ধরে ওর মনের অবস্থা ভালো না থাকায় কেউ এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে না। সূর্যমুখী যখন গাছটার কাছে পৌছেছে তখন রাত পৌনে ন’টা। দেখে গাছের গোড়ায় বসে কাঁদছে সাধন। ছুটে গিয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু একটা সঙ্কোচ ও লোক-লজ্জার ভয়ে তা পারে না। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুজন দুজনকে দেখে। সূর্যমুখীর চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে যায় অশান্ত জলের ধারা। মুখে বলে – কি পারলে না আমাকে ছেড়ে থাকতে? আমিও পারবো দেখো। এবার আর সঙ্কোচ মানে না সাধন। সূর্যকে বুকে জড়িয়ে হাউ-মাউ করে কেঁদে ওঠে। ওর চোখে মুখে চুমু খেয়ে বলে – আমি কি করবো সূর্য? তুমি বলে দাও।
সূর্যমুখী আবারও বলে একই কথা – আমরা কেন সারা জীবন এভাবে একে অপরের বন্ধু হয়ে তাকতে পারবো না। আমরা তো কোন পাপ করছি না। কেন তুমি বার বার এভাবে কষ্ট দিচ্ছ?
সাধন চুপ হয়ে যায় এ কথা শুনে। তারপর বলে – তা সম্ভব নয় সূর্য।
এসময় সূর্যমুখীর ফোন বেজে ওঠে। ও প্রান্তে বাবা ওকে খুজছে। কাল কথা হবে, কাল আমাদের দেখা হবে, দুপুরে অফিস ছুটির পরে। বলেই আবার অপেমান রিক্সায় চেপে বসে সূর্য।
চৌদ্দ
পরদিন দুপুরে হঠাৎই সাধনের এসএমএস আসে। ও লিখেছে – সূর্য, কেন জানি মন বলছে – অফিস ছুটির পর তোমার সাথে দেখা করা ঠিক হবে না। তাই দুপুরে নয়, বিকালে আমি তোমার জন্য লেকের পাড়ে অপো করবো। যদি সমস্যা না থাকে আমাদের ছেলেকে নিয়ে ওখানে এস প্লিজ।
ও একটা অনুরোধ করলে সেটা রাখতে না পারার কষ্ট যে কি তা আমি জানি। যত সমস্যাই হোক আমি যে যাব তা ও ভালোই জানে। অথচ ওর এ সব আবদার রাখতে গিয়েই ঘরের মানুষ, মা-ভাবী ও আমার স্বামীর কাছে ক্রমশ সন্দেহভাজন হয়ে উঠছি আমি। এটা ও একবার বুঝতে চায় না। এসএমএসটা পড়ে প্রথম রাগ হলেও পরে নিজেকে বোঝালাম যে, ওর ভয়টা হয়ত মিথ্যে নয়। অফিসের শেষে ঘরে যেতে দেরি হলেই মা খোজাখুজি শুরু করেন। আর আজ এমনিতেই দেরি হবেই। তাই বাধ্য হয়েই ঘরে ফিরে গেলাম। বিকাল হবে পাঁচটায়। সময় যেন আর কাটে না। ওর কাছে যাবার জন্য ছেলেকে বার বার সাজাচ্ছি। ছেলেটাও যেন বুঝেঞ গেছে- আজ ওকে নিয়ে লেকের পাড়ে যাব। লেকের পাড় মানেই ওর কাছে পাম আর বাব্বা। তাই বার বার ও পাম আর বাব্বা বলে বাড়ি মাতিয়ে তুলছে। এ ঘর ও ঘর ছুটে বেড়াচ্ছে আর বলছে – পাম, বাব্বা-পাম। ওর নাচানাচি দেখে মা এসে বলছেন – বাহিরে যাবে? কাজের মেয়ে দুটোকে নিয়ে যেও।
মায়ের চোখে সন্দেহের দৃষ্টি আমাকে আরও বিব্রত করে তুলল। এখন কি করি। কাজের মেয়েরা ওকে চেনে। ওর কাছে ওদের নেয়া যাবে না। তাহলে উপায়। এ সব ভাবনার মাঝেই আবার ফোন দেখছি। ওর কোন মেসেজ আসে কি না। না নেই। সেই যে দুপুরে একটা এসএমএস করে ওর ফোন বন্ধ করেছে আর খোলেনি। আমি যে কিছু বলবো সে সুযোগও নেই। সাড়ে চারটা বাজতেই অস্থির হয়ে উঠলাম। কাউকে কিছু না বলে ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বের হয়ে এলাম ঘর থেকে। পিছনে মা ডাকলেন। কানে তুললাম না। রিক্সায় চেপে সোজা চলে এলাম পার্কের গেটে। আমার সেলফোনও বন্ধ করে দিলাম। যাতে ঘরের কেউ আমাকে ফোন করে বিরক্ত করতে না পারে। আমি ছেলেকে নিয়ে ওর সাথে আজ কিছুটা সময় একান্তভাবে কাটাতে চাই। কেউ বিরক্ত করুক তা চাইনা।
ও পার্কের গেটেই আমাদের জন্য অপো করছিল। দেখেই এগিয়ে এসে ছেলেকে কোলে তুলে নিল। আমি রিক্সা ভাড়া মেটাতে মেটাতে আড়চোখে দেখলাম, ও পাগলের মত ছেলেকে চুমু খাচ্ছে আর বুকে জড়িয়ে ধরছে। ছেলেটাও ওকে পেয়ে যেন সাত রাজার ধন পেয়েছে। ওর খিল খিল হাসির শব্দ আমাকে ণিকের জন্য সব টেনশন মুক্ত করে দিল। আমরা তিনজন পার্কের ভিতরে, লেকের পাড়ে প্রায় ঘন্টা দেড়েক খেলা করে বেড়ালাম। আজ ও অদ্ভুত এক কাজ করে বসল। ছেলেকে নিয়ে খেলা করতে করতে হঠাৎ ঝুকে আমার স্তনের বোটায় আলতো কামড়ে দিল। আমি কপট ধমক দিলাম। ও হেসে উঠল, বলল – আর তো সুযোগ হবে না। তাই একটু ছুয়ে দিয়ে তোমার ইচ্ছাটা পুরোন করলাম।
মূহূর্তে বুকের ভিতরটা ছাৎ করে উঠল। তার মানে এই আমাদের শেষ দেখা? প্রশ্নটা না করে পারলাম না।
অনেক কান্নারত কণ্ঠেই ও উত্তর দিল – হ্যা সূর্য, এই শেষ দেখা।
আমাদের আর কথা হবে না ?
ওর গম্ভীর উত্তর – জানি না।
তাহলে কেন ফিরে এলে?
বলল – বাবার জন্য। ওর থেকে বিদায় নেয়া হয়নি তো তাই। আজ আমি ওর ঠোঁটে চুমু খেয়ে গেলাম। আল্লাহর রহমতে ওর আর কোনদিন বড় রকমের কোন অসুখ বিসুখ হবেনা ইনশাহ্ আল্লাহ।
বলেই আমার ঠোঁটে ওর ঠোঁট ছুইয়ে দিল। তারপর বলল – তুমিও রোগ-শোক মুক্ত থাকবে ইনশাহ্ আল্লাহ। ভালো থেকো সূর্য। এই বলে একটা রিক্সা ডেকে আমাদের তুলে দিল।
আমার কান্না তখন আর বেগ মানছে না। বললাম – এই কষ্টটা দিতেই কি এসেছিলে? এভাবে বার বার না মেরে কেন একেবারে মুখে বিষ তুলে দিচ্ছ না।
ও কোন উত্তর দিল না। আমি ঘরে ফিরলাম সন্ধ্যার একটু পরে। মা রেগে আগুন। কারো সাথে কোন কথা না বলে আলাওলকে কাজের লোকদের কাছে তুলে দিয়ে সোজা নিজের রুমে গিয়ে ঢুকলাম। বিছানায় পরে অনেকণ কাঁদলাম। চেম্বারে যাবার সময় পার হয়ে গেছে। রোগীরা ভিড় করেছে জানিয়ে বার বার চেম্বার থেকে ফোন আসছে বলে মা শাসিয়ে গেলেন। প্রায় একঘন্টা বিছানায় পরে কেঁদে শান্ত হলাম। চোখমুখ ফুলে গেছে। এই অবস্থায়ই চেম্বারে গেলাম। বার বার ফোন দেখছি। দেখি ওর ফোন আসে কি না? নাহ, নেই। কোন ফোন, কোন এসএমএস নেই। কষ্টে বুকটা ভেঙ্গে যেতে চাইছে। অথচ কোন কিছু করার উপায় নেই। পরদিন সারাদিন গেল। সন্ধ্যার পর ঢাকার বাহিরে ওর বন্ধু গালিবের কাছে ফোন করলাম। জানতে চাইলাম – ও আছে কি না। আমার মন বলছিল, ও ভালো নেই, যেখানেই থাকুক খুব কষ্টে আছে।
গালিব জানালেন – ও আছে এবং বিকালে ওর এখানে পৌছেছে। খুব কান্নাকাটি করছে।
আমি ওকে ফোন দিতে বললাম।
ওপ্রান্তে ও বসে যাওয়া কণ্ঠে ফোন ধরেই জানতে চাইলো কেন ফোন করেছো? আর কখনো করো না প্লিজ। বলেই ফোনটার লাইন কেটে দিল। আমি আবার করলাম। আবার। কিছুণ পর ওর ফোন থেকে একটা এসএমএস এল। সেই একই কথা – তোমার স্বামীকে সত্যটা বলে দাও প্লিজ। আমি আমার স্ত্রীকে সত্য বলেছি। তাকে ছেড়ে চলে এসেছি। তুমি যদি তা না পার, আর কখনো আমাকে ফোন কর না। কোনদিন না।
পনের
সূর্যমুখীকে এই এসএমএস পাঠিয়ে আমি পাগলের মত কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। বন্ধুরা আমাকে অনেক বুঝাতে চেষ্টা করল। ওরা বলল – দেখ, এটা আধুনিক যুগ। এ যুগে লাইলী-মজনু, শেরী-ফরহাদ, এদের কোন অস্তিত্ব নেই। তুই ভুল করছিস। ডাঃ আসলে তোর সাথে একটা শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করে কিছুদিন আনন্দে কাটাতে চায়। এটা কোন ভালোবাসা না। আর যদি তোকে সত্যিই ভালোও বাসে তবু সে তাঁর স্বাবলম্বি স্বামী, অবস্থাপন্ন বাবা-মাকে ছেড়ে তোর কাছে আসবে না। তোর চাওয়াটা বড় অযৌক্তিক।
এ সবই আমি বুঝি। সবচেয়ে বড় কথা আমি নিজেতো জানি, সূর্য তাঁর সন্তানকে কতটা ভালোবাসে। সন্তানের মঙ্গলের জন্যই সে কোনদিন আমার কাছে আসতে পারবে না। আমি নিজেও তা চাই না। তারপরও কেন যে মন মানে না। বন্ধু গালিব ও এখানের অন্যদের কথাবার্তা ভালো লাগে না আর। ওরা প্রায়ই এটাকে একটা বাঝে, কুৎসিত সম্পর্ক বলে বুঝাতে চায়। বাধ্য হয়েই ওদের কাছ থেকে কেটে পড়লাম। চলে গেলাম সিলেটের চা বাগান এলাকায়। ভাবলাম প্রকৃতির বিশালত্বের মাঝে কিছুটা হলেও শান্তি পাব। কিন্তু না। কোথায় শান্তি। সূর্যমুখী আর আলাওল এখানের প্রকৃতিকেও ঢেকে দিল। চোখ বন্ধ করলেই আলাওলের হাসির শব্দ। বাব্বা, বাব্বা বলে মধুর ডাক। হাতের ঘড়িটাকে দেখি, মনে হয় সূর্যমুখী করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। কিছু বলতে চায়। পাগলের মত ঘড়িটাকে চুমু খাই।
ষোল
সাধনের ভাবনায় সূর্যমুখী প্রচণ্ড সৎ ও ধার্মিক একজন মেয়ে। যে একদিন না একদিন তাঁর সততা প্রতিষ্ঠিত করতেই সত্য স্বীকার করবে। তাই সাধন ভেবেছে যে এ ঘটনায় সূর্যমুখী কিছুদিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পরে থাকলেও সুস্থ হয়েই সে সাধনকে খুঁজতে বের হবে। সাধন স্বপ্ন দেখে – সূর্যমুখী প্রথমে ছুটে যায় সাধনের ভাড়া বাসায়। সেখানে ওকে না পেয়ে ফোন করে ওর বন্ধুদের কয়েকজনকে। তারপর ছুটে যায় সাধনের মায়ের কাছে। কেউ ওর সন্ধান দিতে পারে না। পাগল প্রায় সূর্যমুখী পথে ঘাটে সাধনকে খুঁজে বেড়ায়। জানকী বেগমকে ফোন করে তাঁর সাথে কথা বলে। সত্য স্বীকার করে মা চায়। জানকী বেগমও হাসি মুখে মা করে দেয় সূর্যমুখীকে। বলেন – মাতো আমার চাওয়া উচিত আপনাদের কাছে বোন। আমরা দুজনেই আসলে ভুল বুঝেছি ওকে। জানকী বেগমের কাছে সাধন ও তাঁর সর্বশেষ কথা শুনে সে বুঝতে পেরেছে কত বড় ভুল সিদ্ধান্ত সে নিয়েছিল সেদিন। সাধনের সুন্দর জীবন ফিরিয়ে দিতে গিয়ে সে আসলে ওর সততাকে অপমান করেছিল।
সাধন ওকে বারবার বলেছিল – সূর্যমুখী, দেখ! প্রকৃতির সাথে আবার যুদ্ধ করতে যেও না। স্বাভাবিক নিয়মে যা ঘটবে তা ঘটতে দিও। তুমি বুদ্ধি খাটিয়ে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ কর না। তাহলে ফল ভাল হবে না। আর একটা কথা মনে রেখ, আমার ভিতর তুমি ছাড়া এখন আর কারো কোন অস্বিত্ব নেই। আমি জানকীর সাথে প্রতারণা করতে পারবো না। তাই ওকে সব সত্য বলে দিয়েছি। তুমি যদি সত্যিই আমায় ভালবাস, তাহলে যাও! ঘরে গিয়ে সব সত্য স্বীকার করে, তোমার স্বামীর কাছে মা চাও। যদি সে তোমায় মা করেন এবং তোমায় নিয়েই সংসার করতে চান, তাহলে আমি সরে যাবো। আর যদি সে তোমার উপর থেকে তাঁর দাবী তুলে নেন, তাহলেই আমরা বিয়ে করবো।
সাধনের বলা এ কথা মনে আসতেই সূর্যমুখী ছুটে যায় তাঁর স্বামীর কাছে। সব সত্য খুলে বলে তাকে। মহৎ মনের মানুষ সূর্যমুখীর স্বামী নবকুমার। তিনিও জানকী বেগমের মতই জানতে চাইলেন একই প্রশ্ন – এখন তুমি কী চাও? তারপর বললেন – তুমি আজ সত্যটা বলতে পারছো দেখে আমার ভালো লাগছে সূর্য। সাধন সাহেব যেদিন খুব ভোরে এ বাসায় ছুটে এসেছিলেন। সেদিন থেকেই আমি তোমাদের সব এসএমএস পড়েছি। তখন থেকেই আমি সব জানতাম। তাঁর সততা, তাঁর সাহস দেখে তুমি শিখবে এটাই আমি আশা করেছিলাম। এখন বল কী চাও?
সূর্যমুখী এই প্রথম স্পষ্ট উত্তর দিল তার স্বামীকে। প্লিজ নব তুমি আমায় ডিভোর্স দাও।
হেসে ফেললেন নবকুমার – প্রায় ৫ বছর পর তুমি আমাকে নব বললে সূর্যমুখী।
মৃদু হাসি নিয়ে সূর্যমুখী বলল – তুমিও তো একই কাজ করেছো। ৭ বছর পর আমাকে সূর্য বলেছো।
তাহলে আলাওল ওর কী হবে? প্রশ্নটা সূর্যই করল।
উত্তরে নবকুমার বললেন – ওতো যতোটা না আমার ছেলে, তারচেয়ে অনেক বেশি সাধন সাহেবের ছেলে হয়ে গেছে। বাবা ডাক শেখেনি কিন্তু বাব্বাটা উচ্চারণ করে নির্ভূল ভাবে। আমিতো বিদেশে চলে যাচ্ছি। কাগজপত্র সব তৈরি। ও তোমার কাছেই থাকুক। আর তোমার ডিভোর্স পেপারটাও আমি আগেই তৈরি করে সই করে দিয়েছি। শুধু তোমার সইটা বাকী। দিয়ে নিও।
আর একটা সত্য কথা শোন – যদিও এ সত্য বলার সাহস আমাকে সাধন সাহেবই শিখিয়েছেন। আমিও তোমাদের মতই গোপনে আরেকজনকে ভালো বেসেছিলাম। তবে আমি গোপনেই তাকে বিয়ে করে ফেলেছি। সেখানে আমার এক সন্তানও আছে। আমি বিদেশে তাদের কাছেই ফিরে যাচ্ছি।
সাধনের এ স্বপ্ন ঘোর কেটে যায় একমাস যেতে না যেতেই। কারণ বাস্তব বড় কঠিন। সেখানে প্রেম-ভালবাসার আদৌ কোন মূল্য নেই। একমাস পরে সাধন তখন ফিরে গেছে দণিাঞ্চলের সমুদ্র পাড়ের সেই ছোট্ট শহরটিতে। ও যাবার পরদিনই প্রলয়ংকারী ঝড় সিডর আঘাত হানে উপকূল অঞ্চলে। অল্পের জন্য প্রাণে বেচে যায় সাধন। কিন্তু লাখ লাখ মানুষ, ঘর-বাড়ি, শিশুদের প্রাণ তছনছ করে দিয়ে যায় সিডর। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে মানুষের জন্য কিছু করতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে ওর মন। ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের হাত-ভাঙ্গা, কারো পা ভাঙ্গা দৃশ্য দেখে ওর মন কেঁদে ওঠে। ডায়রিয়া তখন সরিয়ে পড়েছে দণিাঞ্চলের গ্রামগুলোতে। ইচ্চে হয় – এই সময় সূর্যমুখীকে ডেকে এনে এই অসহায় মানুষের পাশে দাঁড় করায়। ভাবনাটা মাথায় আসতেই ফোন খোলে ও। কিন্তু নিজের শপথ মনে পড়ে যাওয়ায় ফোন করতে পারে না। বন্ধুত্ব চেয়ে একটা এসএমএস পাঠায়। ভাবে এটা পেয়েই হয়ত সূর্যমুখী ফোন করবে। ফোন করলেই ওর স্বামীকে নিয়ে এখানে চলে আসতে বলবে। ওরা এসে এখানে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে। সাধন দু’ চোখ ভরে দেখবে ওদের। এ ভাবনার মাঝেই কয়েকদিন কেটে যায়, ফোন আর আসে না। মনে মনে ভাবে দু’দিন পরতো আমার জম্মদিন – আমার জম্মদিনে আমাকে উইশ করবে তো সূর্য?
দেখতে দেখতে ওর জম্মদিনটা এসে চলে যায়। অনেক আশা নিয়ে সেলফোনটা খুলে বসে থাকে সাধন। কেউ ওকে উইশ করে না। আশায় আশায় দিন কাটে সাধনের। যখন খুব কষ্ট হয় তখন সমুদ্রের কাছে গিয়ে পাগলের মত কান্না করে। এভাবেই একদিন সন্ধ্যায় ওর লাশ খুঁজে পায় কুয়াকাটা পুলিশ। ময়না তদন্তে দেখা যায় স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে সাধনের। স্রষ্টা এতোদিনে ওর প্রার্থনা কবুল করেছেন।
নাহ সূর্যমুখীর তেমন দোষ দেয়া যায় না। সাধনের ভাবনার সাথে তাঁর আচরণ প্রায় সবটাই মিলেছিল। স্বামীকে সে সত্য স্বীকার করেছিল। তবে নিজের সন্তানের মঙ্গলের কথা চিন্তা করেই সত্যটাকে একটু ঘুরিয়ে বলেছে মাত্র। যে কারণে সব শুনে সূর্যমুখীর স্বামী নবকুমার সাহেবও তাকে মা করে দেন। তিনিও নিজের ভুলগুলো বুঝতে পেরেছিলেন। স্ত্রীকে সময় না দেয়া, স্ত্রীর সাথে রোবটের মত আচরণ করা এগুলো যে ঠিক নয় তা বুঝতে পেরে মনে মনে সাধনকে ধন্যবাদ জানান তিনি। প্রায় পাঁচবছর পর তারা দু’জনে আবার আগের মতই স্বাভাবিক জীবন-যাপনে অভ্যস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন সুখেই ছিলেন তারা। নবকুমার সাহেবের মৃত্যুর পর হঠাৎ একরাতে কলেজ পড়ুয়া আলাওল বাব্বা, বাব্বা বলে কেঁদে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে সাধনের জন্য কেঁদে ওঠে সূর্যমুখীর মন।
সমাপ্ত